মৌলবী সানাউল্লাহ অমৃতসরীর পরিণাম কি হয়েছিল?
মৌলবী সানাউল্লাহ অমৃতসরীর পরিণাম
[ হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আঃ)-এর সত্যতার জ্বলন্ত নিদর্শন ]
হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আঃ) তার সত্যতা সম্পর্কে দলীল প্রমাণাদি পূর্ণরূপে পেশ করার পরে তার তদানীন্তন বিরোধী ওলামা, পীর ও সাজ্জাদানশীনদেরকে সম্বোধন করে তার সঙ্গে মোবাহালা করার জন্য চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন। তার রচিত পুস্তক আঞ্জামে আথমে উল্লেখিত ঐ সমুদয় আলেমদের মধ্যে মৌলবী সানাউল্লাহ অমৃতসরী সাহেবের নাম ১১ নম্বরে (১৮৯৭ সনে) অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাদের মধ্যে যে সমস্ত আলেম
হযরত আহমদ (আঃ)-এর সঙ্গে মোবাহালায় অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের সকলেই এক বৎসরের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তবে আহলে হাদীস সম্প্রদায়ের প্রখ্যাত নেতা মৌলবী সানাউল্লাহ্ অমৃতসরী সাহেব মোবাহালা করার জন্য মির্যা সাহেবের চ্যালেঞ্জ ঘোষণার পর দীর্ঘ ১০ বৎসর পর্যন্ত হযরত মির্যা সাহেবের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার সাহস পেলেন না। অতঃপর বিভিন্ন মহল হতে বিশেষ চাপ সৃষ্টি হওয়ার ফলে মৌলবী সানাউল্লাহ সাহেব নিজে মুখ খুললেন এবং ২৯শে মার্চ, ১৯০৭ সনে তার আহলে হাদীস পত্রিকায় মির্যা সাহেবকে সম্বোধন করে লিখেছিলেন ‘হে মির্যাইগণ, তোমরা যদি সত্যবাদী হয়ে থাক তবে তোমাদের গুরুজীকে আমার সামনে নিয়ে আস যিনি ‘আঞ্জামে
আথম পুস্তকে (১৮৯৭) তার সঙ্গে আমাকে মোবাহালা করার চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন।’
– (আহলে হাদীস’ পত্রিকা-২৯শে মার্চ, ১৯০৭)
হযরত আকদস (আঃ) প্রথম যখন মোবাহালার চ্যালেঞ্জ দেন তখন তার বয়স ছিল ৬২ বৎসর এবং মৌলবী সানাউল্লাহ সাহেব তখন মাত্র ২৯ বৎসরের যুবক ছিলেন। দীর্ঘ দশটি বৎসর তিনি কেন নীরবতা অবলম্বন করলেন ? তার কারণ পাঠক মহোদয় নিরপেক্ষভাবে একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন। মৌলবী সানাউল্লাহ সাহেবের উক্ত চ্যালেঞ্জের উত্তরে ১৫ই এপ্রিল, ১৯০৭ সনে হযরত মির্যা সাহেব আরো একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেন যার শিরোনাম ছিল “মৌলবী সানাউল্লাহ সাহেব অমৃতসরী কে সাথ আখেরী ফায়সালা” অর্থাৎ মৌলবী সানাউল্লাহর সহিত শেষ মীমাংসা। উহাতে তিনি মৌলবী সানাউল্লাহ সাহেবকে পুনরায় মোবাহালার আমন্ত্রণ জানালেন এবং বললেনঃ
(১) তার এই চ্যালেঞ্জ যেন মৌলবী সানাউল্লাহ সাহেব নিজের পত্রিকায় প্রকাশ
করে দেন। এবং
(২) সঙ্গে সঙ্গে আমার এই মোবাহালার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার নিজ সম্মতিও তিনি যেন তার পত্রিকায় প্রকাশ করে দেন। চূড়ান্ত ফয়সালা আল্লাহর হাতে।
ইহার উত্তরে মৌলবী সানাউল্লাহ সাহেব তার পত্রিকায় পুনরায় ঘোষণা করলেন যে-
(ক) “তোমহারী ইয়ে তাহ্রীর মুঝে মঞ্জুর নেহি আওর না কোই দানা ইছে মঞ্জুর
কার সাক্তা হ্যায়” (আপনার এই চ্যালেঞ্জ আমার জন্য গ্রহণযোগ্য নয়, এবং কোন বিচক্ষণ ব্যক্তি উহা গ্রহণ করতে পারে না)। – (মৌলানা সানাউল্লাহ সাহেবের নিজস্ব সাপ্তাহিক আহলে হাদীস’ ২৬শে এপ্রিল সংখ্যা, ১৯০৭ ইং)
(খ) অতঃপর উক্ত পত্রিকারই সহকারী সম্পাদক সাহেব পবিত্র কুরআন ও হাদীস থেকে কিছু উক্তি পেশ করে এরূপ যুক্তিও ব্যক্ত করেন যে, মির্যা সাহেবের সাথে মোবাহালায় অবতীর্ণ হয়ে মৌলানা সানাউল্লাহ সাহেব যদি মির্যা সাহেবের পূর্বে মৃত্যু বরণ করেন তাহলে মির্যা সাহেবের কিইবা ফায়দা হবে। কেননা, আঁ হযরত (সাঃ) সত্য নবী হওয়া সত্ত্বেও মোসায়লামা কাযযাবের পূর্বেই মৃতু্যবরণ করেছিলেন এবং মিথ্যাবাদী হওয়া সত্ত্বেও মোসায়লামা কাযযাব আমাদের সত্য নবী রসূল করীম (সাঃ) এর পরে মৃত্যুবরণ করেছিলেন ইত্যাদি। -(‘মোরাক্কায় কাদিয়ানী আগষ্ট, ১৯০৭ ও
আহলে হাদীস ২৬শে এপ্রিল, ১৯০৭)
আহলে হাদীস পত্রিকার সহ-সম্পাদক সাহেবের উক্ত ভাষ্যটি স্বয়ং মৌলবী
সানাউল্লাহ সাহেব এই বলে তা নিজেই সমর্থন করেছিলেন যে “ম্যায় উছকো সহি জানতাহু।” অর্থাৎ আমি সহ-সম্পাদকের উক্তির সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত।
– (আহলে হাদীস ৩১শে জুলাই সংখ্যা ১৯০৮ সন)
(গ) মৌলবী সানাউল্লাহ অমৃতসরী বিদ্রুপাত্মক ভাষায় এ কথাও ব্যক্ত করলেন যে, “আমি স্বয়ং আপনার মত নবী, রসূল বা ইবনুল্লাহ (আল্লাহর পুত্র) হওয়ার দাবী রাখি না এবং কোন ইলহাম পাওয়ারও দাবীদার নই। সুতরাং আমি আপনার আহ্বানকৃত মোবাহালায় (দোয়া প্রার্থনা প্রতিযোগিতায়) নামতে সাহস করি না। সে জন্য আমি দুঃখিত।” – (ইলহামাতে মির্যা -৭৫ পৃষ্ঠা, দ্বিতীয় সংস্করণ)
এথেকে সুস্পষ্টভাবে এটাই প্রমাণিত হল যে, মৌলবী সানাউল্লাহ সাহেবের স্ববর্ণিত যুক্তি ও দলীলের মাধ্যমেই হযরত আহমদ (আঃ)-এর সঙ্গে মোবাহালা করা অগ্রাহ্য করে তিনি হযরত মির্যা সাহেবের মৃত্যুর পর বেঁচে রইলেন যমন মুসায়লামা কায্যাব রসূলে করীম (সাঃ)-এর পরেও জীবিত ছিল।
সম্মানীত পাঠকবৃন্দ! আল্লাহতা’লার শান লক্ষ্য করুন যে, মৌলানা সানাউল্লাহ্
সাহেব মির্যা সাহেবের পরেও জীবিত থেকে আল্লাহতা’লার কীরূপ ভয়াবহ প্রকোপে নিপতিত হয়েছিলেন তার কিছু সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে দেয়া হলো।
মৌলবী সানাউল্লাহ অমৃতসরীর আস্ফালন
মৌলবী সানাউল্লাহ সাহেব মির্যা সাহেবের প্রতিষ্ঠিত জামাতের বিরুদ্ধে
বিষোদগারণ করতে যেয়ে অমৃতসর হতে প্রকাশিত উকিল পত্রিকার মাধ্যমে ঘোষণা করেছিলেন
“আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে তবে মুসলমানদেরকে আমি এ কথাই বলবো যে,
মির্যা সাহেব প্রণীত তার সমুদয় গ্রন্থাবলী সমুদ্রে নিক্ষেপ কর অথবা জ্বলন্ত তন্দুরে নিক্ষেপ করে ছাই করে ফেল। এটাই যথেষ্ট নয় বরং ভবিষ্যতে কোন মুসলিম বা অমুসলিম ঐতিহাসিকদের মধ্যে কেউ যেন ভারতের অথবা ইসলামের ইতিহাসে তার নামের কোন উল্লেখও না করে।”-(উকিল পত্রিকা অমৃতসর ১৯০৮ সনের ১৩ সংখ্যা)
স্মরণ থাকে যে, হযরত আহমদ (আঃ) বিগত ১৯০৮ সনের ২৬শে মে ইন্তেকাল করার সময় তার শিষ্যদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৪ (চার) লক্ষাধিক। অতঃপর ১৯৪৭ সনে মৌলবী সানাউল্লাহ সাহেবের জীবদ্দশায় শুধু পাঞ্জাব প্রদেশেই সরকারী আদম শুমারী অনুসারে আহমদীদের সংখ্যা দাড়িয়েছিল প্রায় ৩০ (ত্রিশ) লক্ষ (বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রায় পৌনে দুই কোটি)।
তদুপরি ১৯৪৭ সনে ভারতবর্ষ বিভক্ত হলে সমগ্র পূর্ব পাঞ্জাব হতে প্রায় দুই
লক্ষাধিক অসহায় শরণার্থী মুসলমান নর-নারী উগ্রপন্থী শিখ ও হিন্দুদের দ্বারা
অমানবিক অত্যাচার ও নিপীড়নে জর্জরিত ও নিষ্পেষিত হয়ে একেবারে সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় প্রাণ রক্ষার জন্য আহমদীয়া জামাতের কেন্দ্রস্থল কাদিয়ানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। সে সময় আহমদীয়া জামাতের দ্বিতীয় খলীফা হযরত মির্যা বশীর উদ্দিন মাহমুদ আহমদ (রাঃ) সমস্ত মুসলমান বাস্তুত্যাগীদেরকে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে খাদ্য, বস্ত্র ও আশ্রয় দান করেছিলেন এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এসব আশ্রয় প্রার্থীদেরকে ক্রমান্বয়ে পাকিস্তান পাঠাতে সমর্থ হয়েছিলেন।
সেই ঘোরতর সংকটের সময় মহান খলীফার নেতৃত্বের কল্যাণে সেদিন জামাতে আহমদীয়া মানবতার বিশেষতঃ মুসলিম সম্প্রদায়ের যে অসামান্য সেবা ও খেদমত করেছিল ইতিহাসের পাতায় তা চির অম্লান হয়ে থাকবে। ডাব্লিউ, সি, স্মিথ নামক একজন সমাজবিজ্ঞানী লিখেছেনঃ
(১) In Quadian they (the Sikh gangs) had to deal with a well organised (rained and disciplined community with the result that every time they attacked this town and they suffered heavy casualities, Quadian served as a sanctuary to muslim refugees from
the villages in the neighbourhood who flocked there in thousands.
It was only when the state forces of India appeared on the scene
that Quadian surrendered.” – (Modern Islam in India, Page 396-97
By W. C. Smith.)
(২) সেই ঐতিহাসিক সংকটকালেও কাদিয়ানের আহমদী মুসলমানরা পাঁচ ওয়াক্ত আযানের মাধ্যমে মসজিদে তাদের নামায জারি রেখেছিলেন। ভারতের বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকা “The statesman”-এ ১৯৪৮ সনের ১৭-১৮ নভেম্বর তারিখে “Ahmadia sects wins Hindu respect in Quadian” নামক প্রকাশিত প্রবন্ধের অল্প কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হলোঃ
“From a tall white minaret in Quadian, a short, bearded, keen
eyed oldman still calls the faithful to prayer Three hundred and thirteen men responded six times a day (Including Tahajud prayer)
This must be the only city in East Punjab, ——- where Muslims congregate in number I saw them yesterday walking in their deserted streets converging maditatively towards the Mosque.
After prayers they stayed to study Quran ——- They still live an organised life.” – (The Statesman, Nov.1-171948. Calcutta)
পূর্ব পাঞ্জাবে যখন মুসলিম হত্যাযজ্ঞ চলছিল, মৌলবী অমৃতসরী সাহেব তখন অমৃতসরের স্বীয় বাসভবনে বসে স্বচক্ষে এসব হৃদয়বিদারক ঘটনাবলী অসহায় অবস্থায় অবলোকন করছিলেন, এই সত্য ঘটনা সর্বজনবিদিত।
১৯৪৮ সনে পূর্ব পাঞ্জাব (ভারত) হতে হিজরত করে পাকিস্তানে আশ্রয় গ্রহণ
করার পর মৌলবী সানাউল্লাহ সাহেবেরই ভক্ত একজন ঐতিহাসিক মৌলানা আবদুল হামিদ সহদ্রী সাহেব মৌলবী অমৃতসরীর জীবনী লিখতে গিয়ে তাঁর পুস্তকে লিখেছেনঃ
“১৯৪৭ সনে পাক-ভারত বিভক্ত হওয়ার সময় সংখ্যালঘু মুসলমানরা হিজরত করে পূর্ব পাঞ্জাব হতে পাকিস্তানে যাচ্ছিল তখনই বদমায়েশ ও লুটেরাগণ মুসলমানদের বাড়ী-ঘর
লুট-তরাজ, অগ্নিসংগযোগ এবং নারী-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকলের উপর অত্যাচার-উৎপীড়ন শুরু করল। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ১৯৪৭ সনের আগষ্ট মাস
হতে শুরু করে ১৯৪৮ সন পর্যন্ত ৩০ লক্ষ মুসলমান এসব দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হয়েছিল। দেশ বিভাগের সময় কোন এক কাল রাত্রে অমৃতসর শহরের মুসলিম মহল্লাগুলোর উপর যখন অমানুষিক অত্যাচার চলছিল তখন মৌলবী সানাউল্লাহ
সাহেবকেও যাবতীয় সম্পদ ফেলে রেখে রিক্ত হস্তে নিজ বাড়ী পরিত্যাগ করতে হলো।
লুটেরাগণ নিমিষে মৌলানা সাহেবের বাড়ীর টাকা-পয়সা, পারিবারিক দ্রব্য-সামগ্রী, ধন-সম্পদ ও স্বর্ণালঙ্কারসহ সর্বস্ব লুণ্ঠন করে নিয়ে গেল। এখানেই শেষ নয়, তার বাড়ীটি অগ্নিদগ্ধ করে ভস্মীভূত করা হল এবং লুটেরাগণ মৌলানা সাহেবের সারাজীবনের পরিশ্রমলব্ধ অতীব প্রিয় লাইব্রেরীটিকেও পুড়িয়ে ছাই করে দিল যাতে শত-সহস্র দুর্লভ ও দামী পুস্তকাদি সংরক্ষিত ছিল। সেই গোলযোগের সময় মৌলানা সাহেবের একমাত্র পুত্র জনাব আতাউল্লাহ সাহেব নিহত হন যার লাশটিকে কাফন-দাফন করার সুযোগও ঘটেনি।”
অতঃপর সেই ঐতিহাসিক লিখেছেন, “তার বড় সাধের লাইব্রেরীটি বিধ্বংস
হওয়ার ব্যথা মৌলানা সাহেবের হৃদয়ে তার একমাত্র সুশিক্ষিত পুত্রের শাহাদত বরণ থেকেও কম ছিল না। লাইব্রেরীটির মধ্যে সংরক্ষিত দুর্লভ পুস্তকাবলী মৌলানা সানাউল্লাহ সাহেবের সারা জীবনের একমাত্র সঞ্চয় ছিল। ঐসব পুস্তকের মধ্যে কিছু পুস্তক এতই দুষ্প্রাপ্য ছিল যে, বহু টাকা ব্যয় করলেও ঐগুলো সংগ্রহ করা সম্ভবপর ছিল না। এই নিদারুণ দুর্বিসহ মনোব্যথা মৃত্যু পর্যন্ত তার সঙ্গী ছিল।
প্রকৃতপক্ষে মৌলানা সাহেবের আকস্মিক মৃত্যুরও একমাত্র এই দুটি কারণই ছিল। প্রথমতঃ তার একমাত্র পুত্রের শাহাদত বরণ, অপরটি অতি কষ্টে সংগৃহীত তার মূল্যবান ও সাধের পুস্তকাবলী ভস্মীভূত হওয়া। সুতরাং এই দু’টি হৃদয় বিদারক ব্যথাই অবশেষে তার জীবন প্রদীপকে নির্বাপিত করে দিল।” – [ সীরাতে সানায়ী’ (উর্দু ভাষায় রচিত)
লেখক মৌলানা আবদুল হামীদ সহস্ত্রী – পৃষ্ঠা ৩৮-৩৯০ ) ]
মৌলবী সানাউল্লাহ অমৃতসরীর পরিণতির অপর দিক
হযরত আহমদ (আঃ)-এর সঙ্গে কোন মোবাহালায় (প্রার্থনা প্রতিযোগিতায়) লিপ্ত হওয়ার জন্য অস্বীকার করার পর মৌলবী সানাউল্লাহ স্বীয় আকাঙক্ষা ও উক্তি অনুযায়ী দীর্ঘ জীবন লাভ করার সুযোগ পেয়ে মৃত্যু পর্যন্ত পদে পদে লাঞ্ছনা ও অপমানজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে থাকেন। যথা –
(ক) মৌলবী সানাউল্লাহ সাহেব পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় হতে “মৌলবী ফাযেল” পরীক্ষায় স্বর্ণপদক লাভ করে কৃতিত্বের সহিত উত্তীর্ণ হতে সমর্থ হয়েছিলেন বলে তিনি তার বক্তৃতাদির মাধ্যমে নিজের অসাধারণ প্রতিভার কথা উল্লেখ করে সর্বদাই স্বীয় বিদ্যার অহংকারে স্ফীত থাকতেন। তিনি স্বীয় প্রতিভার কথা উল্লেখ করে কোন কোন সময় হযরত মির্যা সাহেব সম্পর্কে এরূপ কটুক্তিও করে বসতেন যে, মির্যা সাহেব আরবী পার্সি সম্পর্কে কিছুই জ্ঞান রাখেন না এমনকি তিনি সাধারণ মাদ্রাসা পাশও নহেন। এরূপ মুর্খ ব্যক্তির সঙ্গে আমি কিইবা বাহাস আর মোবাহালা করব ইত্যাদি।’
কিন্তু আল্লাহ্তা’লা মৌলবী সানাউল্লাহ সাহেবকে এরূপ স্পষ্ট নিদর্শন দেখালেন যে, হযরত আহমদ (আঃ)-এর রচিত ইসলামের স্বপক্ষে ৮৮ খানা মহামূল্যবান গ্রন্থ সুধীমহলে সমাদৃত হতে লাগল। শুধু তাই নয় হযরত আহমদ (আঃ)-এর শিষ্যদের মধ্যে
(১) মৌলানা মোহাম্মদ ইয়ার আরেফ,
(২) মৌলানা জালালুদ্দিন শামস
(৩) মৌলানা আবুল আতা জলন্ধরী প্রমুখ স্কলারগণ মৌলবী অমৃতসরী সাহেবের চোখের সামনে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্বর্ণপদক লাভ করে কৃতিত্বের সাথে মৌলবী ফাযেল পাশ করলেন। ইহা কি মৌলবী অমৃতসরী সাহেবের জন্য কুঠারাঘাত ছিল না?
হযরত আহমদ (আঃ)-এর বাসস্থান কাদিয়ানের প্রতি মহল্লায় মহল্লায় এবং নূতন মারকয (কেন্দ্র) রাবওয়ার প্রতি মহল্লায়ই বহু সংখ্যক জামেয়ার ছাত্র মৌলবী ফাযেল পাশ করেছেন এবং অদ্যবধি প্রতি বৎসরই আহমদীয়া জামাতের ছাত্রদের মধ্যে কৃতিত্বের সাথে ষ্টারমার্ক পেয়ে মৌলবী ফাযেল পাশ করার দৃষ্টান্তও বিরল নয়। কাদিয়ান এবং রাবওয়া শহরের বিভিন্ন মহল্লায় আল্লাহর ফযলে বহু মহিলা ‘মৌলবী ফাযেল’ এবং আরবীতে মাষ্টার ডিগ্রীধারীও রয়েছেন। এমনকি জন্মান্ধ জনাব হাফেয মুহাম্মদ রমযান সাহেবও পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় হতে আমার সঙ্গেই ১৯৩৬ সনে “মৌলবী ফাযেল” পাশ করেছিলেন।
(খ) আহলে হাদীস সম্প্রদায়ের ভিতর মৌলবী অমৃতসরী সাহেবের শৌর্য ও প্রভাব-প্রতিপত্তি ক্রমন্বয়েই হ্রাস পেতে থাকে। যার ফলে জনসমক্ষে তার অর্জিত সম্মানটুকুও ভাটা পড়তে লাগল। ইতঃপূর্বে ওয়ায নসিহত ও বক্তৃতা করার আমন্ত্রণে যখনই তিনি দিল্লী, সিমলা, লাহোর ইত্যাদি স্থানে সফর করতেন তখন অভ্যর্থনা করার জন্য তার হাজার হাজার ভক্তবৃন্দ রেলষ্টেশনে ভীড় জমাত। কোন সময় এমনও ঘটেছে যে, ষ্টেশন হতে যে টমটম গাড়ী চড়ে তিনি গন্তব্য স্থানের দিকে যাত্রা করতেন, সেই গাড়ীটির ঘোড়ার পরিবর্তে ভক্তির আতিশয্যে তার ভক্তরাই টেনে নিয়ে যেত। কিন্তু পরবর্তীতে নানা কারণে জনসাধারণের অসন্তুষ্টির ফলে তার জনপ্রিয়তা বিলুপ্ত হতে
লাগল এবং ক্রমান্বয়ে পরিস্থিতি একেবারে পাল্টে গেল। তিনি কোথাও সফরে গেলে মোটেই কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যেত না। দিল্লী, আগ্রা, সিমলা প্রভৃতি জনবহুল শহরে গমন করলে গুটিকয়েক অনুল্লেখযোগ্য ভক্ত ব্যতিরেকে তার অভ্যর্থনার জন্য জনসাধারণ হতে কোন লোক সমবেত হত না।
এমনকি, অবশেষে পাঞ্জাবের “আহলে হাদীস” সম্প্রদায়ের আমীর পদ হতেও
তাকে অপসারিত করা হল।
(গ) তার নিজ “আহলে হাদীস” সম্প্রদায়ের পক্ষ হতে তদানীন্তন কেন্দ্রীয়
নেতৃবৃন্দ কর্তৃক “আহলে হাদীস” সংস্থার জন্য সংগৃহীত জামাতী তহবিল তসরুফের মত মারাত্মক অভিযোগও তার বিরুদ্ধে আনয়ন করা হয়েছিল।
(ঘ) এ-ও সর্ব সুধীজনবিদিত যে, “আহলে হাদীস” সম্প্রদায়ের গণ্যমান্য
ব্যক্তিদের পক্ষ হতে মৌলবী অমৃতসরীর বিরুদ্ধে জামাতের অর্থ অপচয়ের মত
অপমানজনক অভিযোগ আনয়ন করে মক্কা শরীফ ও মদীনা শরীফের প্রখ্যাত আলেমগণ দ্বারা তার উপর কুফরী ফতওয়াও লাগান হয়েছিল।
“ফা’ তাবিরু ইয়া উলিল আবসার”
অর্থাৎ যাদের অন্তর্দৃষ্টি আছে তারা যেন শিক্ষা লাভ করেন।
সীরাতে সুলতানুল কলম (পৃ:৯৬ – ১০২ )
অন্যান্য উত্তর
- মাসিক মদীনা পত্রিকার প্রশ্নোত্তরের কলামের উত্তর – ইমাম মাহদীর আগমন ও নিদর্শন স্বরূপ চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ
- মাসিক মদীনার মিথ্যাচারের উত্তর – পবিত্র কুরআনের কিছু অংশ ছেটে ফেলা এবং ঈসা (আঃ)-কে শূলীবিদ্ধ করে মেরে ফেলা হয়েছে
- ইসলামী প্রতীকসমূহের ব্যবহার আহ্মাদী ফিরকার জন্য আইনতঃ নিষিদ্ধ হওয়া উচিত কি?
- মাসিক মদীনায় প্রকাশিত “আহমদী সম্প্রদায় : আমার বক্তব্য” – আপত্তির উত্তর
- ঈসা (আ.) কি আসবেন? – মাসিক মদিনায় প্রকাশিত প্রশ্নের উত্তর
- মাসিক মদীনা পত্রিকায় “কাদিয়ানী মতবাদ একটি ফেৎনা” শীর্ষক প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ত উত্তর
- হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.)-এর মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল?
- হযরত মির্যা সাহেবের মৃত্যুতে বিখ্যাত মনীষীরা কি বলেছিলেন?
- মৌলবী সানাউল্লাহ অমৃতসরীর পরিণাম কি হয়েছিল?
- মির্যা সাহেবের মৃত্যু সম্পর্কিত অপবাদ খণ্ডন