মক্কা-মদীনার অবমাননা সম্পর্কিত আপত্তির উত্তর


আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বিরুদ্ধে প্রকাশিত প্রায় সব পুস্তক-পুস্তিকাতে হযরত মির্যা সাহেবের উপর এই অপবাদ দেয়া হয়েছে যে, হযরত মির্যা সাহেব কাদিয়ানকে মক্কার সমান বলেছেন এবং কাদিয়ানকে হেরেম বলেছেন। কাদিয়ানের মসজিদকে ‘মসজিদে আকসা’ বলেছেন, সাহেবযাদা আবৃদুল লতীফকে কাদিয়ানে এসে হজ্জ করতে বলেছেন ইত্যাদি।

উত্তর: উপরোক্ত অপবাদগুলো সত্যকে লুকানো এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য করা হয়েছে। হযরত মির্যা সাহেবের অদ্বিতীয় আশেক রসূল কীভাবে এরূপ কথা বলতে পারেন, তা কল্পনাও করা যেতে পারে না। এসব মিথ্যার পাহাড় যে, কীভাবে গড়া হয়েছে, তা-ও আবার আল্লাহ্ ও রসূল করীম (সঃ)-এর নামে তা ভাবতে অবাক লাগে। হযরত মির্যা সাহেব তার এক ফারসী কবিতায় লিখেছেনঃ

অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর সৌন্দর্যে আমার হৃদয় ও আত্মা কুরবান। হযরত
মুহাম্মদ (সঃ)-এর বংশধরদের গলিতে আমি ধূলো হয়ে বিলীন হয়ে যেতে চাই।

তিনি তার এক আরবী “কসীদাতে” লিখেনঃ

অর্থাৎ হেদায়াতের সূর্য আমাদের জন্য মক্কা হতে উদিত হয়েছে। দানশীলতার
ঝরণা আমাদের জন্য হেরা গুহা হতে উৎসারিত হয়েছে। পৃথিবীর সূর্য তারই কিছু নূরের সাথে সামঞ্জস্য রাখে। যখন তার সূর্যের আলোর কিরণকে দেখি অঝোরে কাদতে লাগি।”

হযরত মির্যা সাহেব তার কবিতার পংক্তিতে কাদিয়ানকে “হারম” বলেছেন। যারা
সাহিত্য চর্চা করেন তারা জানেন যে, তাদের ভাষার বহু শব্দ রূপকভাবে ব্যবহার করা
হয়। “হারম” শব্দ আরবী এবং উর্দু ভাষায় শ্রদ্ধেয় ও পূত-পবিত্র অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এমনকি স্ত্রীকেও হারম বলা হয়। সুতরাং হযরত মির্যা সাহেব তার কাব্যে কাদিয়ানকে হারম আখ্যা দিয়েছেন এতে আপত্তি কিসের?

লাহোরে (পাকিস্তান) হযরত দাতাগঞ্জ বখশ (রহঃ)-এর নামে নির্মিত মসজিদ এর
দরজায় আল্লামা ইকবালের কবিতার পংক্তি লেখা আছেঃ

অর্থাৎ মু’মিনগণ এ বছর হারম বানিয়েছেন তা দেখে আকাশ হতে জিবরীল (আঃ)
ঘোষণা দিচ্ছেন ‘মসজিদে আকসা’কে স্বচক্ষে দেখ যার সম্বন্ধে আমরা বলেছি যার
চতুর্দিককে কল্যাণমন্ডিত করা হয়েছে।

আল্লামা ইকবাল আরও লিখেনঃ

অর্থাৎ গৌতমের ভূমি জাপানের “হারম।”

তাযকেরাতুল আওলিয়াতে (উর্দু) ৩৩৮ পৃষ্ঠায় হযরত যুনায়েদ বাগদাদীর বয়ান আছে – “তোমার এই হৃদয় খোদার “হারম”।

প্রখ্যাত বুযর্গ হাজী ইমদাদুল্লাহ্ মুহাজের মক্কী লিখেন (ইনি দেওবন্দীদের সম্মানিত ব্যক্তি আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বিরুদ্ধবাদীদেরও অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি)

অর্থাৎ এই ফকীর যেখানে থাকবে, সেখানেই মক্কা, মদীনা ও রওযা [হুযুর
(সঃ)-এর কবর! (খায়রুল ইফদাত-মালফুযাতে মাওলানা আশরাফ আলী থানভী)।

আর একটি উদ্ধৃতি দেখুন মৌলানা রশীদ আহমদ সাহেব গঙ্গোহীর মৃত্যুতে শেখুল হিন্দ মৌলভী মাহমুদুল হাসান সাহেব যে মর্সিয়া লিখেন, তার কিছু পংক্তি নিম্নে দিলাম, “হিন্দু জাতির মুখে আজ আবার হবল”হবল বোধ হয় উচ্চারিত হচ্ছে। তাই মুসলিম জগতে আবার ইসলামের প্রতিষ্ঠাতার দ্বিতীয় আবির্ভাব হয়েছে।”

“যাদের খোদা-পরিচিতির উদ্যম ও কামনা ছিল, কা’বা শরীফের তওয়াফ করার
সময়ও তারা গঙ্গোহীর’ (মৌলানা আব্দুর রশীদ আহমদ গঙ্গোহীর দরবারে) রাস্তা
জিজ্ঞেস করে।”

সহৃদয় পাঠকবৃন্দ! খোদা-ভীতিকে মনে রেখে চিন্তা করুন, আজ যে সকল
ওলামারা আহমদীয়া মুসলিম জামাতের প্রতিষ্ঠাতার বিরুদ্ধে মক্কা ও মদীনার অবমাননার অপবাদ দেন, তাদের সম্মানিত বুযর্গানের (আমরাও তাদের সম্মান করি) উপরোক্ত অভিব্যক্তিও কি তাহলে প্রমাণ করে যে, তারা মক্কা মদীনার অবমাননা করেছেন ? যদি তা না হয়, তাহলে উপরোক্ত উদ্ধৃতিগুলোর যে অর্থ নেয়া হবে, হযরত মির্যা সাহেবের বেলাতেও তা নিতে হবে।

হযরত মির্যা সাহেবের উপর মক্কা মদীনার অবমাননা সম্বন্ধে আরও একটি উদ্ধৃতি
দেয়া হয় যে, তিনি লিখেছেন, “মক্কা ও মদীনার দুধ শুষ্ক হয়ে গিয়েছে” । আমার
আবেদন হযরত মির্যা সাহেব এই উক্তিটি কোথায় করেছেন? কোন পুস্তকে? কত পৃষ্ঠায়? যদি এই অপবাদটি সত্য বলে গণ্য করাও হয়, তাতেও আপত্তির তেমন কিছুই নেই। স্বয়ং হযরত নবী করীম (সঃ) এ কথা বলে গেছেন। (দুধ শুষ্ক হওয়া অর্থ আধ্যাত্মিক অবনতি হওয়া) মিশকাত কিতাবুল ইলমে রেওয়ায়াত আছে যেখানে হুযুর (সঃ) বলেছেন,

অর্থাৎ “ইমাম মাহদীর আগমনকালে তাদের মসজিদগুলি আড়ম্বরপূর্ণ হবে কিন্তু
হেদায়াতশন্য হবে।” এই হাদীস কি প্রমাণ করে না যে, দুনিয়ার সকল মসজিদ
হেদায়াতপূন্য হবে? হযরত রসূল করীম (সঃ) তো এ-ও বলেছেন, “ঈমান সুরাইয়া নক্ষত্রে চলে যাবে।” অতএব, প্রমাণ হলো মক্কা মদীনার দুধ শুষ্ক হবার অর্থ হবে যে, সেখানেও হেদায়াত দানকারী ব্যক্তি থাকবে না, যে আধ্যাত্মিক দুগ্ধ পান করাবে!

হযরত মির্যা সাহেবের উপর এই অপবাদ দেযা হয় যে, তিনি কাদিয়ানে হজ্জ করতে বলেছেন। অথবা বলা হয় যে, আহমদীদের হজ্জ হয় কাদিয়ানে। এই অপবাদটি অতি বড় মিথ্যা ও জাজ্বল্যমান জালিয়াতি! আহমদীয়া জামাতের ধর্ম-বিশ্বাস এই জামাতের প্রকাশিত প্রায় সকল পুস্তক-পুস্তিকায় লিপিবদ্ধ হয়েছে। সুধী পাঠকবৃন্দ তা অনায়াসে দেখতে পারেন। আহ্মদীয়া মুসলিম জামাতের প্রথম খলীফা ও দ্বিতীয় খলীফা এবং আরও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গও বায়তুল্লাহ্ (কা’বা) শরীফের হজ্জ করেছেন। সুতরাং সাহেবযাদা আবদুল লতীফ সাহেবকে কাদিয়ানে হজ্জের জন্য বলা, কথাটি সম্পূর্ণভাবে মনগড়া মিথ্যা।

তবে এটা জানা আবশ্যক যে, সূফীগণ বুযর্গদের দর্শনকেও হজ্জ বলে আখ্যায়িত
করেছেন। যেমন বড় পীর গাওসুল আযম আব্দুল কাদের জীলানী (রহঃ) তাঁর পুস্তক “আল্ ফাতহুর রব্বানী’র ৪৩তম মজলিসে বলেন,

অর্থাৎ মুর্খ প্রথমে আমার হজ্জ কর; তারপরে বায়তুল্লাহ্র হজ্জ কর। আমি কা’বার
দরজা। আমার নিকট আইস।

সুলতানুল মাশায়েখ হযরত আবুল হাসান খিরকানী (রহঃ) বলেন,

অর্থাৎ এক মু’মিন ব্যক্তির যিয়ারত (দর্শন)-এর সওয়াব একশ’ মকবুল হজ্জেও পাবেন না। (জহুরুল আসফিয়া, ৫০৪ পৃষ্ঠা)

‘তাযকেরাতুল আওলিয়াতে হযরত বায়েযীদ বুস্তামী (রহঃ), হযরত রাবেয়া বসরী
(রহঃ) এবং আরও অন্যান্য বুযর্গানের অনুরূপ বর্ণনা রয়েছে। হযরত রসূল করীম (সঃ) বলেছেনঃ

অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার মুসলমান ভাইয়ের কোন অভাবকে পুরণ করে দিবে, তার
জন্য হজ্জকারী ব্যক্তির মতই পুরস্কার রয়েছে (জামেউস সগীর লিস্ সৃউতী, দ্বিতীয় খণ্ড, ১৭৮ পৃঃ)

 

অন্যান্য উত্তর