মাসিক মদীনা পত্রিকায় “কাদিয়ানী মতবাদ একটি ফেৎনা” শীর্ষক প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ত উত্তর
মাসিক মদীনা পত্রিকার সেপ্টেম্বর ‘৯৮ সংখ্যায় জনাব মোল্লা জামান সাহেবের উপরোল্লিখিত শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এ প্রবন্ধে মোল্লা সাহেব আহমদীয়া জামাতের বিরুদ্ধে
ঐ সকল অভিযোগই উত্থাপন করেছেন যা বিগত ১০৮ বৎসর যাবত আহমদী-বিদ্বেষী বিভিন্ন আলেম-ওলামা উত্থাপন করে আসছেন। বিগত ১০৮ বৎসর যাবতই আমরা অর্থাৎ আহমদীরা এ সকল অভিযোগ ও আপত্তির জবাব দিয়ে আসছি। অতএব মোল্লা সাহেবের অভিযোগসমূহের জবাব দেওয়া সমীচীন মনে করি।
মোল্লা সাহেবের অভিযোগসমূহ সংক্ষেপে নিম্নরূপ:
১। আহমদীরা বিশ্বাস করে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সর্বশেষ নবী নন।
২। আহমদীরা বিশ্বাস করে ওহীর দরজা খোলা আছে।
৩। আহমদীরা বিশ্বাস করে ঈসা ইবনে মরিয়ম মৃত্যুবরণ করেছেন। জনাব মোল্লা সাহেবের মতে আহমদীদের উপরোক্ত বিশ্বাসসমূহ কুরআন ও হাদীসবিরোধী। অতএব তিনি বাংলাদেশ সরকারের নিকট আবেদন জানাচ্ছেন সরকার যেন আহমদীদেরকে অ-মুসলমান ঘোষণা করেন।
এখন আমরা জনাব মোল্লা সাহেবের অভিযোগসমূহের সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়ার চেষ্টা করছি।
সূরা আল আহযাবের ৪০ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “মুহাম্মদ তোমাদের পুরুষদের মধ্যে কাহারও পিতা নহে, বরং তিনি আল্লাহর রসূল ও খাতামান্নাবীঈন।”
মোল্লা সাহেবগণ এ আয়াতে বর্ণিত “খাতামান্নাবীঈন” শব্দটির অর্থ করেন সর্বশেষ নবী।কিন্তু আমরা বহুবার উল্লেখ করেছি যে, খোদ সৌদী আরব থেকে প্রকাশিত পবিত্র কুরআনের ইংরেজি অনুবাদে ‘খাতামান্নাবীঈন’ শব্দের অর্থ করা হয়েছে Seal of the Prophets বা নবীগণের মোহর।’ এমনকি ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ শফী সাহেব কর্তৃক রচিত ‘খতমে নবুয়াত’ নামক অনূদিত গ্রন্থের ৬৮ পৃষ্ঠায় ‘খাতাম’ শব্দটির অর্থ করা হয়েছে নাগীনা মোহর, আংটি, ঘোড়ার পায়ের সামান্য সাদা চিহ্ন, গদির নিচের গর্ত এবং মোহর বা সীলের যে চিত্র কাগজের উপর অংকিত হয়।
এমতাবস্থায় মোল্লা সাহেবগণ খাতামান্নাবীঈন’-এর অর্থ কীভাবে ও কি কারণে সর্বশেষ নবী করেন তা আমাদের বোধগম্য নয়। কোন কিছুর উপর মোহর লাগানোর অর্থ কি ঐ বস্তুটির শেষ করে দেয়া?
ডাক বিভাগ চিঠির উপর মোহর লাগিয়ে থাকে। এর অর্থ কি চিঠিকে শেষ করে দেয়া? বস্তুতঃ মোহরের সাহায্যে কোনকিছুকে সত্যায়ন করা হয়। হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (সঃ) নবীগণের মোহর। এ অর্থ অতীতের সব নবী যেমন হযরত ইব্রাহীম (আঃ), মূসা (আঃ), দাউদ (আঃ), ঈসা (আঃ) সকল নবীই হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (সঃ)-এর মোহর দ্বারা সত্যায়িত বলেই আমরা এদের সকলকে নবী বলে বিশ্বাস করি। তদ্রুপে হযরত মির্যা গোলাম (আঃ)-এর মাহদী ও মসীহের দাবীও হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (সঃ)-এর মোহর দ্বারা সত্যায়িত। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনায় যেতে চাই না। এ বিষয়ের উপর আমাদের জামাতের ভুরি ভুরি লিটারেচার আছে। উৎসাহী পাঠকগণ আমাদের ঢাকাস্থ কেন্দ্র ৪ নং বকশী বাজারে এসে তা দেখতে পারেন।
মোল্লা সাহেবের দ্বিতীয় অভিযোগের উত্তরে বলছি, আল্লাহ শুনেন, দেখেন ও কথা বলেন। আল্লাহর কথা বলার নামই ওহী ও ইলহাম। অতীতে আল্লাহ দেখতেন, শুনতেন ও এক লক্ষ চব্বিশ হাজার বা দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার নবী ও বহু বুযর্গের সঙ্গে কথা বলেছেন।বর্তমানেও আল্লাহ দেখেন, শুনেন ও কথা বলেন। ভবিষ্যতেও তিনি তাই করবেন। কেননা, তার দেখা, শুনা ও কথা বলার গুণাবলী লোপ পায়নি বা তিনি রাগ করে আর আমাদেরকে দেখবেন না, আমাদের কথা শুনবেন না বা বুযর্গগণের সাথে কথা বলবেন না-এমন তো হতে পারে না।
মোল্লা সাহেবরা বলেন, যেহেতু পবিত্র কুরআন পরিপূর্ণ ও সর্বশেষ ধর্মগ্রন্থ, তাই আল্লাহর ওহীর অর্থাৎ কথা বলার আর প্রয়োজন নেই।
আমরাও বিশ্বাস করি কুরআন পরিপূর্ণ ও সর্বশেষ ধর্মগ্রন্থ। কিন্তু কুরআনের অর্থ ও ব্যাখ্যা নিয়ে মতভেদ করে বর্তমান মুসলমানগণ বহু দলে ও উপদলে বিভক্ত। এমনকি এক ফেরকার লোক অন্য ফেরকাকে কাফের বলে। পাকিস্তানের শিয়া-সুন্নীর মারামারি লেগেই আছে। আফগানিস্তানে তালেবান ও মুজাহিদদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চলছে। এ বিরোধ ঝগড়ার ফিরিস্তি আর লম্বা করতে চাই না।
মুসলমানগণের এক আল্লাহ, এক রসূল ও একই ধর্ম ইসলাম হওয়া সত্ত্বেও এই ঝগড়া ও বিরোধের কারণ কি? এ ঝগড়া-বিরোধের ফয়সালা কে করবে? সকল মুসলমান এক বাক্যে স্বীকার করে যে, হযরত ইমাম মাহদী (আঃ) ঝগড়া ও বিরোধের মীমাংসা করবেন। তাই তো হাদীসে তাকে বলা হয়েছে হাকাম ও আদাল’ অর্থাৎ তিনি মুসলমানদের পারস্পরিক ধর্মীয় ঝগড়া ও বিরোধের মীমাংসাকারী হবেন। আল্লাহর নিকট থেকে ওহী ইলহাম না পেয়ে তিনি কীভাবে সঠিক মীমাংসা করবেন? তিনি কি জাগতিক ধর্মীয় নেতাগণের ন্যায় মনগড়া ফয়সালা দিবেন? যদি তাই হয় লোকেরা তার ফয়সালা মানবে কেন? আর সেটা সঠিক ফয়সালাই বা কীভাবে হবে? কাজেই ওহীর দরজা খোলা আছে, খোলা ছিল ও খোলা থাকবে। কেননা, আল্লাহর সুন্নতের কোন পরিবর্তন হয় না। ওহী ইলহাম বন্ধ থাকলে,
যিনি ইমাম মাহদী হবেন তিনি কীভাবে জানতে পারবেন যে, তিনি ইমাম মাহদী। বলা বাহুল্য, ইমাম মাহদী তো মানুষের মনোনয়ন ও নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন না।
তৃতীয় প্রশ্নের উত্তরে লিখছি যে, মানুষ মরণশীল। হযরত ঈসা (আঃ) একজন মানুষ ছিলেন। অতএব তিনিও মারা গেছেন। দুই হাজার বৎসর থেকে না-খেয়ে দেয়ে তিনি আকাশে জীবিত থাকতে পারেন না। কারণ ব্যাধি, জরা ও মৃত্যুও আল্লাহর অমোঘ সুন্নতের অধীন। ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যুর প্রমাণে কুরআন শরীফে অনেক আয়াত রয়েছে। এ ক্ষুদ্র প্রবন্ধে এসকল ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ নেই। কেবলমাত্র কুরআন মজীদের একটি মাত্র আয়াতই পেশ করবো। যখন আমাদের খাতামান্নবীঈন হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (সঃ) ইন্তেকাল করেন তখন হযরত উমর (রাঃ) গভীর শোক ও আবেগে আত্মহারা হয়ে উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে দাড়িয়ে পড়লেন এবং বললেন, “যে বলে মুহাম্মদ (সঃ) মারা গেছেন এ তলোয়ার দিয়ে আমি তার মুণ্ডুপাত করবো।” হযরত আবু বকর ছিলেন বয়োঃবৃদ্ধ ও জ্ঞানী। তিনি মসজিদের মেম্বরে গিয়ে দাড়ালেন এবং কুরআন হতে ঐ পারেন । আয়াত তেলাওয়াত করলেন যার অর্থ হলো “মুহাম্মদ (সঃ) রসূলে ব্যতীত কিছু নন তার (সঃ) পূর্বে সকল রসূল গত হয়ে গেছেন। অতএব তিনিও যদি মারা যান বা নিহত হন তোমরা কি তাহলে ইসলাম হতে ফিরে যাবে?” এ আয়াত শুনার পর হযরত ওমরের হাত হতে তলোয়ার খসে পড়লো। তিনি বসে পড়লেন। তিনি বুঝতে পারলেন প্রিয় নবী (সঃ) আর ইহ জগতে নেই। যদি হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (সঃ)-এর পূর্ববর্তী নবী হযরত ঈসা (সঃ) সশরীরে আকাশেই জীবিত থাকতেন (যেমনটি এ যুগের মোল্লা সাহেবগণ বিশ্বাস করেন) তবে ঐদিন হযরত উমর (রাঃ) এ আয়াতের প্রতিবাদ করতেন এবং হয়তো নাউযুবিল্লাহ বলতেন, এ আয়াতটি ভুলক্রমে কুরআন শরীফে ঢুকে পড়েছে। সুধী পাঠকবৃন্দের নিকট আমাদের বিনীত অনুরোধ তারা যেন মোল্লা সাহেবগণের বিভ্রান্তিকর প্রচারণার শিকার না হয়ে আহমদী জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মির্যা গোলাম (আঃ)-এর পুস্তকাদি নিরপেক্ষ মন নিয়ে পড়েন ও সত্য জানার জন্য আল্লাহ্তাআলার দরবারে আকুলভাবে দোয়া করেন তবেই তারা প্রকৃত সত্য জানতে পারবেন।
সর্বশেষে বলতে চাই আহমদীদেরকে অমুসলমান ঘোষণার দাবীটি অমূলক। কেননা, অন্যের ঘোষণার দ্বারা কেউ হিন্দুও হয় না, মুসলমানও হয় না, খৃষ্টানও হয় না। ধর্মের সম্পর্ক আল্লাহর সাথে ও মনের সাথে। আল্লাহতাআলাই উত্তম জানেন, কে মুসলমান আর কে নয়। সরকারের ঘোষণা দ্বারা কারো হৃদয়ের বিশ্বাস কেড়ে নেয়া যায় না বা সরকারের ঘোষণার দরুন আল্লাহ কারো ধর্মমত ও বিশ্বাস পাল্টিয়ে দেন না।
— নাজির আহমদ ভূইয়া
সূত্র: পাক্ষিক আহ্মদী – নব পর্যায় ৬১বর্ষ | ৮ম সংখ্যা | ৩১শে অক্টোবর ১৯৯৮ইং | The Fortnightly Ahmadi – New Vol: 61 Issue: 08 Date: 31st October 1998
অন্যান্য উত্তর
- মাসিক মদীনা পত্রিকার প্রশ্নোত্তরের কলামের উত্তর – ইমাম মাহদীর আগমন ও নিদর্শন স্বরূপ চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ
- মাসিক মদীনার মিথ্যাচারের উত্তর – পবিত্র কুরআনের কিছু অংশ ছেটে ফেলা এবং ঈসা (আঃ)-কে শূলীবিদ্ধ করে মেরে ফেলা হয়েছে
- ইসলামী প্রতীকসমূহের ব্যবহার আহ্মাদী ফিরকার জন্য আইনতঃ নিষিদ্ধ হওয়া উচিত কি?
- মাসিক মদীনায় প্রকাশিত “আহমদী সম্প্রদায় : আমার বক্তব্য” – আপত্তির উত্তর
- ঈসা (আ.) কি আসবেন? – মাসিক মদিনায় প্রকাশিত প্রশ্নের উত্তর
- মাসিক মদীনা পত্রিকায় “কাদিয়ানী মতবাদ একটি ফেৎনা” শীর্ষক প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ত উত্তর
- হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.)-এর মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল?
- হযরত মির্যা সাহেবের মৃত্যুতে বিখ্যাত মনীষীরা কি বলেছিলেন?
- মৌলবী সানাউল্লাহ অমৃতসরীর পরিণাম কি হয়েছিল?
- মির্যা সাহেবের মৃত্যু সম্পর্কিত অপবাদ খণ্ডন