মাসিক মদীনা: ওহী ইলহামের দরজা হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর ইন্তিকালের পর বন্ধ হয়ে গেছে?


মদীনা ভবন বাংলাবাজার ঢাকা থেকে প্রকাশিত মাসিক মদীনা পত্রিকার সেপ্টেম্বর-১৯৯৮ সংখ্যায় মোল্লা জামান নামে জনৈক ব্যক্তি আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বিরুদ্ধে “কাদিয়ানী মতবাদ একটি ফেতনা” নামে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন। এতে তিনি এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, ওহী ইলহামের দরজা হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর ইন্তিকালের পর বন্ধ হয়ে গেছে। আল্লাহতাআলা আর মানুষের সাথে কথা কইবেন না। যেহেতু ওহী ইলহামের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে, সেহেতু নবুওয়তের দরজাও বন্ধ হয়ে গেছে। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) শেষ নবী। তার পরে আর কোন প্রকার নবীর আগমন হবে না।

হযরত রসূল করীম (সঃ) মরে গিয়ে মদীনার মাটির নীচে শুয়ে আছেন অথচ গ্রীষ্টানদের নবী যীশু (ঈসা-আঃ)-এর মৃত্যু হয়নি। তিনি আজও বেঁচে আছেন। আল্লাহ্তাআলা তাকে নিজের নিকটে তুলে নিয়েছেন। আবার তিনি সেখান থেকে নেমে এসে মুসলমান জাতিকে দজ্জালের কবল থেকে উদ্ধার করবেন।

ভাই মোল্লা জামান সাহেব! আপনি যে ওহীর দরজায় তালা লাগাবার চেষ্টা-প্রচেষ্টায় রত হয়ে পর্বত পরিমাণ পরিশ্রম করেছেন, তাতে সাগরে সূচাগ্রও প্রবেশ লাভ করতে পারেনি। এত সময় ও পরিশ্রম ব্যয়, এত মাথার ঘাম পায়ে ফেলা সবই আপনার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে গেছে। কেননা, আপনাকে বেশী দূরে যেতে হবে না। আপনাদের মাসিক মদীনা পত্রিকা থেকেই প্রমাণ দিব যে, ওহী ইলহামের দরজা চির উন্মুক্ত। তবে মনে রাখতে হবে যে, মিথ্যাবাদীর স্মরণশক্তি থাকে না। একই বিষয়ে ইতঃপূর্বে কি-ই-বা বলে এসেছে, এবং পরবর্তীতে কিবা বলছে ইত্যাদি বিষয়ে হুশ-জ্ঞান থাকে না।

আপনি প্রবন্ধের শুরুতেই দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন যে, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন যাবৎ কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণার দাবী উত্থাপিত হচ্ছে। অথচ এ ব্যাপারে সরকার যেন বেখেয়াল। কেন ভাই!
আপনারাতো আহমদী জামাতকে কাফের, কাফের বলে ফতোয়া দিয়ে আসছেন আজ দীর্ঘ একশত বৎসরের অধিক কাল যাবৎ। তাতেও যখন আহমদ জামাত কাফের হলো না, এতেই কি প্রমাণিত হয় না যে, আপনাদের এইরূপ সস্তা ফতোয়াবজীর কানা কড়িও মূল্য নেই?

দিশেহারা হয়ে সরকারের কাছে ক্ষমতা ও শক্তি বলের করুণা ভিক্ষা প্রার্থনা করে আবদার জানাচ্ছেন আহমদী মুসলিম জামাতকে অমুসলিম ঘোষণা করার জন্য? সরকারীভাবে অমুসলিম ঘোষণা করলেই কি আহমদীয়া মুসলিম জামাত অমুসলিম হয়ে যাবে? ধর্মটা কি সরকারের মনোনীত, না কি আল্লাহতাআলার মনোনীতঃ পার্শ্ববর্তী ভারত রাষ্ট্রে তো বহু মুসলমান বসবাস করে। মনে করুন, ভারত সরকার যদি ঘোষণা করেন যে, ভারতে যত মুসলমান রয়েছে সবাই হিন্দু হয়ে গেল। তাহলে কি তারা হিন্দু হয়ে যাবে! প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে আপনারা কি তাদেরকে এই শিক্ষাই দিচ্ছেন না? এটাই কি ইসলাম প্রবর্তক হযরত রসূল করীম (সঃ)-এর আদর্শ শিক্ষাঃ ধর্ম মানুষের অন্তরের ব্যাপার। শক্তি ও ক্ষমতার বলে রাজ্য জয় করা যায় কিন্তু মানুষের অন্তরকে জয় করা যায় না। ধর্ম সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হলে উত্তরে হযরত রসূল করীম (সঃ) বলেছেন, “ধর্ম মানুষের জন্য সতর্ক বাণী”। ইহার অর্থ পবিত্র হওয়া। কথা, কাজ, আচার, আচরণে, আখলাক-চরিত্রে নিজে উৎকৃষ্ট নমুনাস্বরূপ হয়ে অন্যকে পবিত্র করা। ইসলাম বল প্রয়োগের ধর্ম নয়। ইসলাম প্রবর্তক হযরত রসূল করীম (সঃ) এরশাদ করেছেন, “যার হস্ত এবং জিহবা থেকে অন্যেরা নিরাপদ নয়, সে প্রকৃত মুমিন মুসলমান নয়। হযরত রসূল করীম (সঃ) কখনও শক্তি-বলের ভয় দেখিয়ে কাউকে মুসলমান বানান নি। প্রাথমিক যুগে অমুসলিমগণ ইসলামের আদর্শ শিক্ষায় মুগ্ধ হয়ে মুসলমান হতো, লাঠি ঠেংগার ভয়ে নয়।

এবার ওহী ইলহাম ও নবুওয়তের প্রসংগে যাচ্ছি। আপনি অবশ্যই মাসিক মদীনা পত্রিকাটি পড়ে থাকেন। যদি নিয়মিত পড়ে না থাকেন
তাহলে ভালভাবে একটু নজর দিয়ে পড়বেন। আমি সংক্ষিপ্তভাবে আপনার চোখের সম্মুখে তুলে ধরছি, “মাওলানা রুমী বলেছেন, ঐ ব্যক্তিকেই নায়েবে রসূল বলা যায়, যার অন্তরে কাশফ, ইলকা, ইলহাম, ফরাসাত, খাতেরে হক ইত্যাদির উসীলায় আল্লাহ্‌ তাআলার হুকুম ও আদেশ অবতীর্ণ হতে থাকে” (মাসিক মদীনা, জুন ১৯৯৮, ৫৪ পৃষ্ঠা)

গোস্বাভরে মাওলানা রুমীর বিরুদ্ধে ফতোয়া জারী করার দুঃসাহস হয়তো আপনার হবে না। কেননা, তিনি জগতবরেণ্য একজন বুযর্গ ব্যক্তি। প্রশ্ন আসে যে, আল্লাহতাআলার হুকুম ও আদেশ কিসের মাধ্যমে অবতীর্ণ হয়। ওহী ইলহামের মাধ্যমে নয় কি?

রূহুল মায়ানীর বর্ণনায় আছে, “আমার পরে ওই নাই, বর্ণিত হাদীসটি মিথ্যা এবং নবী করীম (সঃ)-এর মৃত্যুর পর জিব্রীল পৃথিবীর দিকে আর নাযিল হইবেন না বলিয়া যে কথা প্রচলিত আছে উহার কোন ভিত্তি নাই” (রূহুল মায়ানী, ৭ম খন্ড, ৬৫ পৃষ্ঠা)।

“খোদাতাআলা কখনও কখনও সাক্ষাতভাবে (বা মুখোমুখি) কথা বলেন এবং এই সকল লোক নবী হইয়া থাকেন, এবং কখনও তাহাদের কোন কোন পূর্ণ অনুসারীর সহিতও এইরূপে কথা বলেন এবং যখন কাহারও সহিত অধিক পরিমাণে এইরূপে কথা বলেন, তখন ঐ ব্যক্তিকে মুহাদ্দাস বলিয়া আখ্যা দেওয়া হইয়াছে”
(মকতুবাত ইমাম রব্বানী আলফে সানী মকতুব নং ৫২ খন্ড, ৯৯ পৃঃ)।

ভাই মোল্লা জামান সাহেব! আপনারা তো হযরত ঈসা (আঃ) কে জীবিত আল্লাহতাআলার নিকটে তুলে রেখেছেন। তার নামবার যখন সময় হবে, তখন কি আল্লাহতাআলা তাকে একথাও বলবেন না যে, হে ঈসা! তোমার এখন নামবার সময় হয়ে গেছে, তুমি নেমে যাও?

এবার আসুন পবিত্র কুরআনের পাতা উল্টিয়ে দেখি যে, এই কুরআনে স্বয়ং আল্লাহতাআলা কী বলেছেন। আল্লাহতাআলা বলেন, “এবং যখন আমার বান্দাগণ আমার সম্বন্ধে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, তখন (বল) আমি নিকটেই আছি। আমি প্রার্থনাকারীর প্রার্থনার উত্তর দিই যখন সে আমার নিকটে প্রার্থনা করে। সুতরাং তাহারাও যেন আমার ডাকে সাড়া দেয় এবং আমার উপর ঈমান আনে যাহাতে তাহারা সঠিক পথ প্রাপ্ত হয়” (সূরা বাকারা)।

আপনিই হয়তো বলবেন যে, সারা জীবনভর আল্লাহতাআলাকে ডাকলাম কিন্তু কই তার কাছ থেকে আমার ডাকের তো কোন উত্তর পেলাম না? তাহলে বুঝে নিবেন যে, আপনি সন্দেহের মধ্যে নিপতিত হয়ে যত্রতত্রভাবে তাকে ডাকছেন।
আল্লাহতাআলার কথা শুনার যে যন্ত্রটি স্বয়ং আল্লাহতাআলা আপনাকে দান করেছেন, দুনিয়াদারীর মোহ মায়ায় মত্ত হয়ে অন্যায় কাজে লিপ্ত হওয়ার কারণে তাতে মরিচা ধরে বিকল হয়ে গেছে। এরূপ অবস্থাকেআল্লাহতাআলা কুরআন মজীদে অন্ধ, বধির এবং বোবা হিসাবে বর্ণনা করতঃ মৃত বলে অভিহিত করেছেন। এইরূপ অবস্থায় অন্ধকে দৃষ্টিশক্তি দিয়ে, বোবার মুখে বাণী ফুটায়ে, বধিরকে শ্রবণশক্তি দানে, মৃত দেহে প্রাণ সঞ্চার করতঃ জীবন্ত করে তোলার জন্য করুণাময় আল্লাহতাআলা প্রতি যুগে যুগে দুনিয়ার বুকে এক একজন প্রেরিত মহাপুরুষকে আবির্ভূত করেন। ইহা দয়াময় আল্লাহতাআলার চিরন্তন বিধান। তাই পাক কালামে আল্লাহতাআলা বলেন, “হে ঈমানদারগণ!
তোমাদিগকে সঞ্জীবিত করিবার জন্য যখন আল্লাহ ও তার রসূল তোমাদিগকে আহ্‌বান করিবেন, তোমরা তাহাদের আহ্‌বানে সাড়া দাও” (সূরা আনফাল)।

আল্লাহতাআলা চিরঞ্জীবী। তিনি পূর্বে যেমন শুনতেন এখনও তেমনি শুনেন এবং বান্দার ডাকের উত্তর দিয়ে থাকেন। অতএব তিনি যখন কোন প্রেরিত নবীর মাধ্যমে বান্দাগণকে আহবান করেন তখন তার আহবানে সাড়া দেয়া কর্তব্য। পবিত্র কুরআন করীমে এইরূপ বহু আয়াতে হযরত রসূল করীম (সঃ)-এর পর নবীর আগমনের পথ খোলা আছে, তবে অবশ্যই উম্মতী নবী।
কেননা, নবী করীম (সঃ) পূর্ণ শরীয়তবাহী শেষ নবী। এমন কোন নবী আসতে পারেন না। যিনি খাতামুন্নাবীঈনের মর্যাদার পরিপন্থী ও এতে ব্যাত্যয় ঘটান।

আল্লাহতালা বলেন, “হে আদম সন্তানগণ! যখন তোমাদের মধ্যে থেকে তোমাদের জন্য কোন নবী আসেন এবং তোমাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ পাঠ করেন, তখন তোমারা তাঁর অনুসরণ করো । যারা পরহেযগারী অবলম্বন করবে এবং নিজেকে সংশোধন করে নেবে তাদের জন্য চিন্তা ও ভয়ের কোন কারণ নেই”
(সূরা আ’রাফ)।

ভাই মোল্লা জামান সাহেব! আপনি হযরত রসূল করীম (সঃ)-এর পরে আর কোন নবীর আগমন হবে না প্রমাণ করতে কয়েকটি হাদীস তুলে ধরছেন, যেগুলির মর্মার্থ একই প্রকার। যেমন, “নবী করীম (সঃ) বলেছেন, বনী ইসরাঈলের নেতৃত্ব করতেন নবীগণ। একজন নবী মরে গেলে অপর একজন নবী তার স্থলাভিষিক্ত হতেন। কিন্তু আমার পর কোন নবী হবে না, হবে খলীফা (বুখারী)।

উপরোক্ত হাদীসটি তো অতি পরিষ্কার । একজন অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষের পক্ষেও বুঝে নিতে কষ্ট হবে না যে, বনী ইসরাঈল জাতির নেতৃত্ব দিতেন নবীগণ। একজন নবী মারা গেলে পরে পরেই অপর একজন নবী তার স্থলাভিষিক্ত হতেন। কিন্তু হযরত রসূল করীম (সঃ)-এর ইন্তিকালের পর পরই কোন নবী হবেন না, হবেন খলীফা। তাইতো আমরা দেখতে পাই যে, হযরত রসূল করীম (সঃ) এর ইন্তিকালের পর তার পবিত্র মরদেহ সমাধিস্থ করা হয়নি যতক্ষণ পর্যন্ত না হযরত আবুবকর (রাঃ) খিলাফতের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এখানে আমি হযরত রসূল করীম (সঃ)-এর একটি হাদীস পেশ করছি যে হাদীসটি আপনাদের মাসিক মদীনাতেও প্রকাশিত হয়েছে।

“হযরত রসূল করীম (সঃ) নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, আমি তোমাদেরকে সতর্ক করছি আল্লাহকে ভয় করতে, আমার উত্তরাধিকারীর অনুগত হতে তিনি কৃষ্ণকায় কৃতদাস হলেও। কারণ আমার পর তোমাদের মধ্যে যারা জীবিত থাকবে তারা (মুসলমানের মধ্যে) মহা বিভেদ দেখবে। অতএব দৃঢ়ভাবে অবলম্বন কর ও আমার উত্তরাধিকারীর রীতিগুলো যারা নিজেরা সরল পথ লাভ করে পথ নির্দেশক হতে পারে। আর আমার বিধানগুলি দৃঢ়ভাবে ধরে উহাতে মজবুত থাক।”

প্রশ্ন এই যে, বর্তমানে মুসলমান জাতির খলীফা কে এবং তিনি কোথায়, তার কোন খোজ-রাখেন কি? আপনারা তো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বেহেশতে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর। আহমদীয়া জামাত কর্তৃক যখনই সত্যের ডাক আপনাদের কর্ণে পৌঁছে, ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে বলে তখনই আপনারা আহমদী জামাতের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠেন। খিলাফত আল্লাহ ও মানুষের সংযোগস্থল, মুসলমান জাতির প্রাণশিরা। দুনিয়াদারীর লোভ-লালসায় মসনদের মোহে মত্ত হয়ে একই আল্লাহ্ একই রসূলের অনুসারী, মুসলমান জাতি সেই প্রাণ শিরাকে কর্তন করতঃ শতধা বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণেই এই জাতির ললাটে নেমে এসেছে অন্ধকারের ঘনঘটা। ইহা এখন নেতা বিহীন হয়ে একতা ও ভ্রাতৃত্বকে বিদায় দিয়ে শক্তি-বল-হীন মৃত দেহের তুল্য। সকল জাতির কাছে অবহেলিত, অপমানিত, লাঞ্ছিত।
এমতাবস্থায় আল্লাহতালা তার প্রতিশ্রুত পুরুষকে উদ্ভব করতঃ নবুওয়তের পদ্ধতিতে পুনরায় পৃথিবীতে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত করবেন। এ প্রসংগে হযরত রসূল করীম (সঃ) বলেছেন,

“তোমাদের মধ্যে নবুওয়ত ততক্ষণ পর্যন্ত বর্তমান থাকিবে যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহতাআলা চাহিবেন, অতঃপর আল্লাহতাআলা উহা উঠাইয়া লইবেন। ইহার পর নবুওতের পদ্ধতিতে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হইবে এবং উহা ততক্ষণ পর্যন্ত বর্তমান থাকিবে যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ চাহিবেন, অতঃপর আল্লাহতাআলা উহা উঠাইয়া লইবেন। তখন যুলুম, অত্যাচার ও উৎপীড়নের রাজত্ব কায়েম হইবে। উহা ততক্ষণ পর্যন্ত বর্তমান থাকিবে যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ চাহিবেন, অতঃপর, আল্লাহতাআলা উহা উঠাইয়া লইবেন। তখন উহা অহংকার ও জবরদস্তিমূলক সাম্রাজ্যে পরিণত হইবে এবং উহা ততক্ষণ পর্যন্ত বর্তমান থাকিবে যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ চাহিবেন, অতঃপর আল্লাহতালা উহা উঠাইয়া লইবেন । তখন নবুওয়তের পদ্ধতিতে পুনরায় খিলাফত প্রতিষ্ঠিত
হইবে। অতঃপর হযরত আকদস (সঃ) নীরব হইয়া গেলেন (আহমদ, বায়হাকী)।

আল্লাহতাআলা তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আঃ)-কে হযরত ইমাম মাহদী ও মসীহ মাওউদরূপে আবির্ভূত করেছেন। আল্লাহতাআলা তার মাধ্যমে খিলাফতবিহীন নেতাহীন মুসলমান জাতির মধ্যে আহমদীয়া জামাত নামে নবুওয়তের পদ্ধতিতে পুনরায় খিলাফত প্রতিষ্ঠিত করেছেন দলে দলে বিভক্ত মুসলমান জাতিকে ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। ভাই মোল্লা
জামান! আপনাদের বিশ্বাসে হযরত ঈসা (আঃ) আল্লাহর নিকট থেকে নেমে এসেই দুনিয়ার সকল মানুষকে মুসলমান বানিয়ে ফেলবেন।

এটা কিন্তু আপনাদের কল্পিত ধারণা। নবীগণ প্রতিষ্ঠাতা। নবীর  অবর্তমানে উম্মতগণের দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রচারের মাধ্যমে ইহাকে প্রসারিত করা। জিজ্ঞাসা করি যে, আপনি তো হযরত রসূল করীম (সঃ)-এর উম্মত দাবি করেন। আপনার উপর কি কোন দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল না, বিশ্বের জনসংখ্যা অনুপাতে মুসলমানের সংখ্যা এক চতুর্থাংশেরও কম। বাকি সবাই অমুসলমান। তাদেরকে মুসলমান বানায় কারা? একমাত্র হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আঃ)-এর প্রতিষ্ঠিত আহমদীয়া জামাত । আপনি হযরত মির্যা গোলাম আহমদ
(আঃ)-এর একটি এবারত টেনে তাতে নাখোশ হয়ে মন্তব্য করেছেন।

তিনি বলেছেন, “সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি তোমাকে মরিয়মের পুত্র ঈসা মসীহরুপে সৃষ্টি করিয়াছেন। তিনি কেন এরূপ করিলেন কাহারো প্রশ্ন করিবার অধিকার নাই। কিন্তু মানুষকে প্রশ্ন করা হইবে কেন তাহার আজ্ঞা পালন করিল না”? এতে রাগ করার কি আছে ভাইঃ উপরোক্ত কথাগুলি তো হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আঃ) এর নিজস্ব কথা নয়। “তিনি কেন এরূপ করিলেন কাহারো প্রশ্ন করিবার অধিকার নাই। কিন্তু মানুষকে প্রশ্ন করা হইবে কেন তাহার আজ্ঞা পালন করিল না”?-একথাগুলো তো স্বয়ং আল্লাহতাআলার।

তাতে রাগ করার কি কারণ থাকতে পারে? সম্ভবতঃ এই জন্য যে, আপনাদের মত আখেরী যামানার মোল্লা-মৌলভীদের সাথে পরামর্শ না করে কেন আল্লাহতাআলা হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আঃ)-কে ইমাম মাহদী ও মসীহ মাওউদরুপে আবির্ভূত করলেন, তাই নয় কি?

আপনি বলেছেন, হযরত ঈসা (আঃ) মৃত্যুবরণ করেছেন আকিদাটি মুসলিম উম্মার সর্বজনগ্রাহ্য আকিদার পরিপন্থী। আল্লাহ্তাআলা তাকে নিজের নিকটে তুলে নিয়েছেন। সর্বজন বলতে আপনাদের মত মোল্লা মৌলভী ছাড়া বর্তমানকালে অধিকাংশ জ্ঞানবান, চিন্তাশীল, গবেষক হযরত ঈসা (আঃ) আজো জীবিত আছেন, ধারণা করাকে একটা উদ্ভট কল্পনা মনে করেন। কেননা, যার খাতিরে মহান আল্লাহতাআলা এই বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, সেই রহমাতুল্লিল আলামীন হযরত মুহাম্মদ (সঃ) যখন মরে গিয়ে মদীনার মাটির নিচে শুয়ে আছেন, তখন আকাশে বা পাতালে আর কেউ-ই বেচে থাকতে পারে না এবং কেউই বেঁচে নেই, যদি কারো পক্ষে বেচে থাকা প্রয়োজন হতো, তা হলে স্বয়ং হযরত রসূল করীম (সঃ)-ই বেঁচে থাকতেন। মানবকুল শ্রেষ্ঠ হযরত রসূল করীম (সঃ)-এর উম্মতকে উদ্ধার করার নিমিত্তে খ্রীষ্টানদের নবী যীশু (ঈসা-আঃ)কে জীবিত ধারণা করা এবং তিনি আবার পৃথিবীতে নেমে আসার কল্পিত বিশ্বাস পোষণ করতঃ আসমানের দিকে তাকিয়ে থাকা হযরত রসূল করীম (সঃ)-এর মান মর্যাদাকে হেয় প্রতিপন্ন করার শামিল। আপনাদের বিশ্বাসে হযরত ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহ তার নিজের নিকটে তুলে নিয়েছেন। প্রশ্ন এই  যে, নিজের নিকট বলতে আল্লাহতাআলার নির্দিষ্ট একটি স্থান বোঝায় নাকি, যেখানে আল্লাহতাআলা থাকেন? তিনি কোথায় থাকেন, আকাশে, পাতালে, উত্তরে, দক্ষিণে কিংবা সর্বত্র সর্বক্ষণ তিনি বিরাজমান। এমন কোন স্থান নেই যেখানে তিনি নেই। মৃত্যুর দুয়ার ব্যতীত তার নিকটে কেউ-ই যেতে পারে না। হযরত ঈসা (আঃ) মৃত্যুর দুয়ার পাড়ি দিয়েই আল্লাহর নিকটে গিয়েছেন। জড়দেহে নয়।

আল্লাহতাআলা হযরত ঈসা (আঃ)-কে জড় দেহে তার নিকটে তুলে নিয়েছেন বিশ্বাস করা ত্রিত্ববাদী খ্রীষ্টানদের হাতে হাত মিলানো বৈ কিছু নয়। ত্রিত্ববাদী খ্রীষ্টানদের বিশ্বাসে খোদার একমাত্র জাত পুত্র যীশু (ঈসা-আঃ) ক্রুশে রক্ত দিয়ে আদি পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতঃ সেখান থেকে পৃথিবীতে নেমে আসবেন। হযরত রসূল করীম (সঃ) এ কারণেই বলেছেন যে, “আমার উম্মতগণ হুবহু ইহুদী খ্রীষ্টানদের পথ অনুসরণ করবে।” হযরত রসূল করীম (সঃ)-এর বাণী যে আজ অক্ষরে অক্ষরে পূর্ণ হয়ে গেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এইরূপে ইহুদী খ্রীষ্টান সৃদশ জাতির ভুল বিশ্বাসকে ভেঙ্গে সত্য ও সঠিক পথ দেখাবেন বলেই হযরত ইমাম মাহদী (আঃ)-কে রূপকভাবে ঈসা (আঃ)-বলা হয়েছে। মোল্লা জামান সাহেব! আপনার প্রবন্ধের এক স্থানে বলেছেন, ঈসা (আঃ)-এর শ্বাস-বায়ু যে কাফেরকে স্পর্শ করবে বা তার দৃষ্টি-সীমা যে পর্যন্ত পৌঁছাবে সে পর্যন্ত আর কাফের বাচবে না। আর এক স্থানে বলেছেন, যখনই তাদের চোখ ঈসার উপর পড়বে, দজ্জাল এমনভাবে দ্রবীভূত হতে থাকবে, যেমন লবণ পানিতে গলে যায়। আবার আরেক স্থানে বলেছেন, যুদ্ধের মাধ্যমে দজ্জালকে পরাস্ত করে হত্যা করবে। প্রশ্ন এই যে, যার শ্বাস-বায়ুতে কাফেরগণ মরে যাবে এবং চাহনিতে দজ্জাল লবণের মত দ্রবীভূত হয়ে গলে যাবে, এমতাবস্থায় তার সাথে ঢাল তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার প্রয়োজনটা কি? তারা তো আপসেই মরে যাবে। বর্তমান এই আণবিক যুগে ঈসা (আঃ) কি আণবিক শক্তিসম্পন্ন যুদ্ধের সরঞ্জামাদি নিয়ে আসমান থেকে নামবেন? কাফেরদের আণবিক বোমা এবং অন্যান্য শক্তিসম্পন্ন যুদ্ধাস্ত্র বিদ্যমান থাকতে ঈসা (আঃ)-এর মোকাবিলায় কাফেরেরা দাঁড়িয়ে দাড়িয়েই প্রাণ দিবে? তিনি শূকর বধ করবেন, ক্রুশ ধ্বংস করবেন ইত্যাদি। একজন মহাপুরুষ নেমে এসে গ্রামে-গঞ্জে, ময়দানে, বনে-জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে শূকর বধ করবেন কথাটা বর্তমান মোল্লা-মৌলভীদের ব্যতীত কোন চিন্তাশীল জ্ঞানবান ব্যক্তির পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয় । আপনি হয়ত বলবেন যে, কেউ মানুক আর নাই মানুক তাতে কিছু যায় আসে না। ইহ হাদীসের কথা। এই কাজটা যখন এতই পুণ্যের, তখন তাঁর ভক্তবৃন্দ, যারা তার নাম্বার অপেক্ষা আসমানের দিকে তাকিয়ে আছেন তাদের পক্ষে উচিত নয় কি যে, নিজেরা এইরূপ একটি মহৎ কাজকে শুরু করে দিয়ে ঈসার কাজটিকে এগিয়ে রাখেন। এ কারণেই পাক কালামে আল্লাহতাআলা বলেছেন, “যারা ইহজগতে অন্ধ থাকবে পরজগতেও তারা অন্ধ থাকবেই” (সূরা বনী ইসরাঈল)। অর্থাৎ ইহজগতে যারা আধ্যাত্মিক জ্ঞানে অন্ধ থাকবে পরজগতেও তারা অন্ধ থাকবে । মনে
পড়ে গেলো হযরত যিয়াদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হযরত রসূল করীম (সঃ)-এর একটি পবিত্র বাণী: “হযরত রসূল করীম (সঃ) বলিয়াছেন,
ইহা (এলেম) উঠিয়া যাইবে। আমি বলিলাম, হে আল্লাহর রসূল! এলেম কীরূপে উঠিয়া যাইবে। যেহেতু আমরা কুরআন পড়িতেছি, তাহা আমাদিগের সন্তানদিগকে পড়াইতেছি এবং আমাদের সন্তানগণ তাহাদের সন্তানগণকে কিয়ামত পর্যন্ত পড়াইতে থাকিবে?

উত্তরে হুযূর (সঃ) বলিলেন : হে যিয়াদ! তোমাকে তো আমি এই শহরের একজন জ্ঞানী লোক মনে করিতাম। ইহুদি খ্রীষ্টানগণ কি তাওরাত ও ইনজিল কিতাব পড়ে না? অথচ তাহারা ইহার ভিতর কি আছে তাহা জানে না অর্থাৎ হৃদয়ঙ্গম করে না।”

আসল কথা হযরত ঈসা (আঃ) ত্রুশে প্রাণ ত্যাগ করেন নি। সংজ্ঞাহারা অবস্থায় তাঁকে ক্রুশ থেকে নামানো হয়। সেবা-শুশ্রুষায় সুস্থ হয়ে নবীদের সুন্নত অনুযায়ী গোপনে মালির বেশে স্বদেশভূমি থেকে হিজরত করতঃ কাশ্মীরে গমন করেন এবং একশত কুড়ি বৎসর বয়সে কাশ্মীরেই স্বাভাবিক মৃতু্যবরণ করেন। অবিভক্ত বাংলার বিখ্যাত আলেম মাওলানা আকরাম খাঁ কুরআন করীমের সূরা আলে ইমরানের তফসীরে হযরত ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যু স্বীকার করেন।

আমি প্রবন্ধকে আর দীর্ঘায়িত করবো না। কেননা, এগুলি গুরুদের চর্বিত চর্বণ। যেগুলির বহুবার উত্তর দেওয়া হয়েছে। আমি হযরত ইমাম মাহদী ও মসীহে মাওউদ হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আঃ)-এর একটি এবারত দিয়ে প্রবন্ধ শেষ করছি।

“স্মরণ রাখিও, কেহ আকাশ হইতে অবতীর্ণ হইবে না। আমাদের সকল বিরুদ্ধবাদী, যারা আজ জীবিত আছে, তাহারা সকলে মরিবে, কিন্তু তাহাদের মধ্য হইতে কেহই মরিয়মের পুত্র ঈসা (আঃ)-কে আকাশ হইতে অবতীর্ণ হইতে দেখিবে না। অতঃপর তাহাদের সন্তানেরাও মরিবে কিন্তু তাহাদের সন্তানদের সন্তানেরাও মরিবে কিন্তু তাহারাও মরিয়মের পুত্রকে আকাশ হইতে অবতীর্ণ হইতে দেখিবে না, তখন বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা এই বিশ্বাসের প্রতি বিতৃষ্ণ হইয়া পড়িবে এবং আজ হইতে তৃতীয় শতাব্দী পূর্ণ হইবে না যখন ঈসা (আঃ)-এর অপেক্ষাকারীরা কি মুসলমান, কি খ্রীষ্টান সকলে অত্যন্ত হতাশ ও বিরক্ত হইয়া ঐ মিথ্যা বিশ্বাসকে পরিত্যাগ করিবে। তখন পৃথিবীতে একটিই ধর্ম হইবে এবং একই নেতা। আমি তো এক বীজ বপন করিতে আসিয়াছি। সুতরাং আমা দ্বারা ঐ বীজ বপন করা হইয়াছে।
এখন ইহা বৃদ্ধি লাভ করিবে এবং বিকশিত হইবে। কেহ ইহাকে  রুখিতে পারিবে না” (তাযকেরাতুশ্ শাহাদাতাইন)।

সরফরাজ এম, এ, সাত্তার রঙ্গু চৌধুরী
পৃষ্ঠা ৫৩-৫৫, পাক্ষিক আহ্‌মদী – নব পর্যায় ৬১বর্ষ | ১৪তম ও ১৫তম সংখ্যা | ১৫ই ফেব্রুয়ারী ১৯৯৯ইং 

অন্যান্য উত্তর