‘বৃটিশ সরকারের রোপিত বৃক্ষ’ বিষয়ক প্রচারণার উত্তর


অপবাদকারীরা বলেন যে, মির্যা সাহেব লিখেছেন যে, “আহমদীয়া জামাত ইংরেজদের রোপিত বৃক্ষ।” বিরোধীদের বিভিন্ন পুস্তক-পুস্তিকায় এই উদ্ধৃতি উপস্থাপন করে অপবাদ দেয়া হয়েছে যে, “আহমদীয়ত বস্তুতঃ ইংরেজদেরই তৈরীকৃত ধর্ম বা ফির্‌কা।”

উত্তর

হযরত মির্যা সাহেবের, নিজেকে ইংরেজদের রোপিত বৃক্ষ বলে স্বীকার করে নেয়ার অপবাদ একটা নির্জলা মিথ্যা। খোদার ভয়-ভীতি হতে যারা নিজেকে মুক্ত মনে করে, এ অপবাদ তাদেরই প্রতারণা মাত্র। নিম্নে হযরত মির্যা সাহেবের কয়েকটি উদ্ধৃতি দ্বারা অপবাদটির খণ্ডন করছি। হযরত মির্যা সাহেব (আঃ) বলেন-

“আমি অবিরত সংবাদ পাচ্ছি যে, কোন কোন বিদ্বেষ-পরায়ণ ব্যক্তি, যারা ধর্মীয় মতভেদের দরুন বা অন্য কোন কারণে আমার প্রতি হিংসা ও শত্রুতা পোষণ করে, তারা আমার ও আমার বন্ধুগণের সম্বন্ধে সত্যবিরোধী তথ্য সরকারের সম্মানিত প্রশাসকগণের নিকট পৌঁছাচ্ছে। এজন্য আশংকা করছি যে, এদের বিদ্বেষপ্রসূত কার্যকলাপের দরুন সরকারী কর্মকর্তাগণের হৃদয়ে মিথ্যা ধারণা সৃষ্টি হয়ে আমার খান্দানের ঐ সকল প্রাণান্তকর পরিশ্রম সেবা ব্যর্থ ও বরবাদ না হয়ে যায়।” (রূহানী খাযায়েন, কেতাবুল বারীয়া, ১৩ খন্ড, ৩৪৯ পৃঃ)

তিনি আরো লিখেনঃ

“একটানা পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞতায় যারা বিশ্বস্ত ও আত্মোৎসর্গীকৃত খান্দান বলে প্রতীয়মান হয়েছে, (এখানে আহ্মদীয়া জামাতের কোন উল্লেখ নেই। কেবল মাত্র তার খান্দানের কথা বলা হয়েছে) তাদের সম্বন্ধে সরকার বাহাদুরের সম্মানিত কর্মকর্তাগণ সর্বদা সর্বসম্মতভাবে নিজেদের চিঠিতে এই সাক্ষ্য প্রদান করেছেন যে, তারা আদি হতে ইংরেজ সরকারের একান্ত হিতাকাক্ষী এবং সেবাকারী। কাজেই এই স্বরোপিত বৃক্ষ (এখানে খান্দানকে বলা হয়েছে) সম্বন্ধে খুব সাবধানতা ও সতর্কতা অবলম্বনপূর্বক অনুসন্ধান করে, চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত।
(রূহানী খাযায়েন, কিতাবুল বারীয়া, ১৩ খন্ড, ৩৫০ পৃঃ)

সুধী পাঠকবৃন্দ। উপরোক্ত লেখায় হযরত মির্যা সাহেব তার খান্দানের কথা উল্লেখ করেছেন, আহমদীয়া জামাতের কথা নয়। তার খান্দানকে স্বরোপিত বৃক্ষ, সরকারের অনুগ্রহের কারণে বলেছেন। প্রকৃতপক্ষে জমিদাররাও বৃটিশ সরকারের প্রতিপালিত ছিলেন। এই সত্য স্বীকারের মধ্যে আপত্তির কী আছে? হযরত মির্যা সাহেব ইংরেজ সরকারের প্রশংসা করেছেন বটে, কিন্তু সাথে সাথে তার কারণও বর্ণনা করেছেন।
“অতএব, হে নির্বোধগণ। শুন! আমি এই সরকারের কোন খোশামোদি করি না। বরং আসল কথা এই যে, এইরূপ সরকার, যারা দীনে ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কোন হস্তক্ষেপ করে না এবং নিজেদের ধর্মের উন্নতির জন্যও আমাদের উপর তরবারী চালায় না, কুরআন শরীফের আলোকে তাদের বিরুদ্ধে ধর্ম যুদ্ধ করা হারাম। কেননা, তারাও কোন ধর্মীয় যুদ্ধ করে না।”

একটু চিন্তা করলেই আসল বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যেতে পারে। ভেবে দেখুন, এমন ব্যক্তি

(ক) যিনি খৃষ্টানদিগকে দাজ্জাল বলেছেন

(খ) তাদের খোদাকে (ঈসাকে) মৃত বলেছেন

(গ) যার কলম সর্বদা ত্রিত্ববাদের বিরুদ্ধে কর্তনকারী ছুবির মত চলেছে

(ঘ) যে ব্যক্তি এই দাবী করেছেন যে, তাদের কল্পিত খোদা বা খোদার পুত্র এই ধরা পৃষ্ঠে আর আসবে না সেই ব্যক্তি কীভাবে ইংরেজদের স্বরোপিত বৃক্ষ হতে পারেন, ভাবতেও অবাক লাগে! অপবাদকারীরা একেবারে উল্টোটা বুঝেন কেন ? যদি মির্যা সাহেব ও তাঁর জামাত ইংরেজদের স্বরোপিত বৃক্ষ হন, নিম্নে বর্ণিত ব্যক্তি ও ফিরকাদের সম্বন্ধে কী রায় দেয়া যেতে পারে, তা নির্ণয় করার দায়িত্ব পাঠকের উপর ছেড়ে দিলাম:

(১) মুজাহেদে মিল্লাহ আল্লামা ইকবাল সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুতে বলেন,

অর্থাৎ যে ভারতবর্ষ! তোমার মাথার উপর হতে খোদার ছায়া উঠে গেল! এখানে
রাণী ভিক্টোরিয়াকে ‘খোদার ছায়া’ বলা হয়েছে।

(২) শামসুল উলামা মাওলানা নযীর আহমদ,দেহলভী বলেন, “সমগ্র ভারতবর্ষের – কল্যাণ এর মধ্যেই নিহিত আছে যে, কোন বহিরাগত শাসক এই দেশ শাসন করুক।
তিনি না হিন্দু হবেন, না মুসলমান হবেন। তিনি ইউরোপের কোন বাদশাহ্ই হউন। কিন্তু খোদার অশেষ মেহেরানী যে, সময়ের প্রয়োজনে তিনি ইংরেজ বাদশা হয়েছেন। (বক্তৃতাগুচ্ছ, মাওলানা নযীর আহমদ দেহলভী, ৪-৫ পৃঃ)

(৩) আহ্‌লে হাদীস ফিরকার নেতা মাওলানা মুহাম্মদ হুসায়েন বাটালভী সাহেব লিখেনঃ

“রোমের সুলতান ইসলামী বাদশাহ্। কিন্তু সাধারণ শান্তি-শৃঙ্খলার পরিস্থিতি ও
সুশাসনের দিক হতে বৃটিশ সরকার আমাদের স্বজাতি মুসলমানদের জন্য কোন কম গৌরবের কারণ নয় এবং বিশেষভাবে আহ্‌লে হাদীস সম্প্রদায়ের জন্যতো এই সরকার শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্বাধীনতার দিক হতে বর্তমান সময়ে সমগ্র ইসলামী সুলতানদের চাইতেও অধিক গর্বের কারণ।” (ইশায়াতুস সুন্নাহ্‌ পত্রিকা, ১০ম সংখ্যা, ২৯২-২৯৩ পৃষ্ঠা)

(৪) আহরারীদের নেতা মাওলানা জাফর আলী খান বলেন, “আমি মহামান্য
সম্রাটের কপালের এক ফোঁটা ঘামের পরিবর্তে নিজের দেহের রক্ত প্রবাহিত করার জন্য প্রস্তুত আছি এবং ভারতবর্ষের সমগ্র মুসলমানদের এই একই অবস্থা”। (জমিদার পত্রিকা, লাহোর ২৩শে নভেম্বর, ১৮৯১ খৃষ্টাব্দে)

(৫) কারো কারো মতে ওহাবীরা ইংরেজদের স্বরোপিত বৃক্ষ। সাপ্তাহিক তুফান
লিখেছেঃ ইংরেজরা খুবই সতর্কতা ও চালাকীর সাথে নযদীয়ত আন্দোলনের বৃক্ষ। (অর্থাৎ আহলে হাদীস যাকে ওহাবী আন্দোলন বা ন্যদীয়ত আন্দোলনও বলা হয়) ভারববর্ষেও রোপণ করেছে। অতঃপর ইহাকে নিজেদের হাত দ্বারাই উচ্চ শিখরে আরোহণ করিয়াছে” (তুফান, ৭ই নভেম্বর ১৯৬২ ইং)

(৬) “নদওয়তুল উলামায়ে ইসলাম” এর নিজস্ব পত্রিকার উদ্ধৃতি দিলামঃ “যাহা হউক, বিখ্যাত ধর্মীয় শিক্ষকগণ ইংরেজের অনুগ্রহের ফলশ্রুতি।” (আন্‌ নদওয়া,ডিসেম্বর, ১৯০৮, খৃঃ ৪র্থ পৃঃ)

উল্লেখ থাকে যে, দারুল উলুম নদওয়াতুল ইসলামের ভিত্তি প্রস্তর রেখেছিল ।
“গভর্ণর বাহাদুর স্যার জন স্কট হাউস, কে, সি, এস, আই, ই”।
(আন নদওয়া ডিসেম্বর, ১৯০৮ খৃঃ ৪র্থ পৃঃ)

হযরত মির্যা সাহেবের একটি উদ্ধৃতি দ্বারা এই অধ্যায়কে শেষ করছি।

“পৃথিবী আমাকে জানে না। কিন্তু তিনি আমাকে জানেন, যিনি আমাকে প্রেরণ করেছেন। ইহা এই সকল লোকের ভ্রান্তি এবং দুর্ভাগ্য যে, তারা আমার ধ্বংস কামনা করে। আমি ঐ বৃক্ষ যাকে আল্লাহ স্বহস্তে রোপণ করেছেন। …………… হে মানবমণ্ডলী। তোমরা নিশ্চিতভাবে জেনে রাখো যে, আমার সাথে ঐ হাত আছে, যা মুহূর্ত পর্যন্ত আমার সাথে বিশ্বস্ততা রক্ষা করবে। যদি তোমাদের পুরুষেরা, তোমাদের স্ত্রীলোকেরা, তোমাদের যুবকেরা, তোমাদের বৃদ্ধেরা তোমাদের কনিষ্ঠেরা এবং তোমাদের বয়োজ্যেষ্ঠরা সকলে মিলে আমার ধ্বংসের জন্য দোয়া করো, এমন কি সিজদা করতে করতে যদি তোমাদের নাক গলে যায় এবং হাত অবশ হয়ে যায়, তবুও খোদা কখনো। তোমাদের দোয়া শুনবেন না এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি নিজের কাজকে পূর্ণ না করবেন, ততক্ষণ তিনি ক্ষান্ত হবেন না (তোহফায়ে গোলড়াবিয়া, ১২-১৩ পৃঃ)।

অন্যান্য উত্তর