অভিযোগ: প্রসঙ্গ মসজিদে জেরার
মুফতী নূরানী তার পুস্তিকার ৩৭/৩৮ নম্বর পৃষ্ঠায় মসজিদে জেরার এর প্রসঙ্গ টেনে নিজের পক্ষ থেকে এক অভিনব ফতোয়া প্রদান করেছেন। তার বক্তব্য হলো, যেহেতু ১৪০০ বছর আগে আল্লাহর আদেশ পেয়ে মহানবী (সা:) মুনাফেকদের তৈরী একটি কেন্দ্রকে (যার নাম কুরআন শরীফে মসজিদে জেরার’ বর্ণিত হয়েছে) ধ্বংস করেছিলেন তাই এবার মুসলমানদের এক হয়ে আহমদীয়া (কাদিয়ানী) মসজিদগুলোকে ধ্বংস
করতে হবে।
ভাবতেও অবাক লাগে, ধর্মীয় ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের তারতম্যের কারণে একজন মানুষ অন্যদেরকে কীভাবে এত জঘন্য অপরাধে লেলিয়ে দিতে পারে! আহমদীয়া জামাত ছাড়াও ইসলাম ধর্মে আরও ৭২টি ফের্কা রয়েছে।
এক ফের্কা আরেক ফের্কাকে কাফের পর্যন্ত ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। কিন্তু এ সত্ত্বেও এরা অন্যের মসজিদ ধ্বংস করার নিয়তে কখনও প্রতিপক্ষের মসজিদকে মসজিদে জেরার’ আখ্যা দেয় নি । কেননা এসব আলেম ভালভাবে জানতেন আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করার উদ্দেশ্যে নির্মিত এসব মসজিদকে ধ্বংস করার কাজ একমাত্র যালেমরাই করতে পারে । এদেশের আহমদীয়া মসজিদগুলোতে গত ৯৪ বছর ধরে আল্লাহ্র ইবাদত-বন্দেগী
হয় নাকি ফিতনা-ফাসাদের কাজ হয় তা স্থানীয় জনগণ ও এলাকাবাসী খুব ভাল জানেন। এ বিষয়ে কোন মুফতী সাহেবের ফতোয়া দেয়ার প্রয়োজন নেই।
এ পর্যায়ে ধার্মিক মুসলিমদের উদ্দেশ্যে একটি কথা নিবেদন করতে চাই।
পবিত্র কুরআনের সূরা আল বাকারার ১১৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ তা’লা মসজিদ আক্রমণকারীদের জন্য সতর্কবাণী নাযিল করে বলেছেন,
“ওয়া মান্ আযলামু মিম্মাম্মানা’আ মাসাজিদাল্লাহে আঁই ইউযকারা ফিহাসমুহু ওয়া সা’আ ফী খারাবিহা উলাইকা মা কানা লাহুম আঁই ইয়াদ’খুলুহা ইল্লা খায়েফীন লাহুম ফিদ দুনিয়া খিযইউন ওয়ালাহুম ফিল আখিরাতে আযাবুন আযীম।”
অর্থাৎ “যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত মসজিদে তার নাম স্মরণে বাধা দেয় আর এগুলোর ধ্বংস সাধনে প্রয়াসী হয় এমন ব্যক্তির চেয়ে বড় যালেম আর কে? অথচ এদের জন্য সেগুলোতে (আল্লাহর ভয়ে) ভীত না হয়ে প্রবেশ করা মোটেই সমীচীন ছিল না। এদের জন্য ইহকালেও লাঞ্ছনা নির্ধারিত আর পরকালেও রয়েছে মহাশাস্তি।” অতএব ধার্মিক মুসলমানরা কখনই অন্য ফের্কার বা সম্প্রদায়ের কোন মসজিদে আক্রমণ করতে পারে না।
আহমদীয়া মসজিদকে মুখের কথায় মসজিদে জেরার সাব্যস্ত করা এত সহজ নয়। কেননা চৌদ্দ শ বছর আগে স্বয়ং আরশের মালিক অন্তর্যামী খোদা ওহী করে তার প্রিয় রসূলকে জানিয়েছিলেন কোনটি মসজিদে জেরার’। এ যুগে কি কোন মুফতী’র কাছে এ বিষয়ে ওহী হয়েছে?
আহমদীরা সবাইকে কুরআন ও সুন্নতের পথে চলার ও এ পথে আসার আহ্বান জানায়।
সব দলাদলি বাদ দিয়ে এক ঐশী খেলাফতের অধীনে জীবন কাটানোর শিক্ষা দেয়—এসব কি ইসলাম বিরোধী কাজ? একদিকে ওহী’র দ্বার রুদ্ধ বলে মুফতী সাহেবরা ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, অন্যদিকে আহমদীরা ইসলামের খাটি শিক্ষা জগতময় প্রচারের কাজে রত। “মসজিদে জেরার’ ফতোয়া কিভাবে দিবেন বলুনঃ ধর্মের মত পবিত্র একটি বিষয়কে ছেলেখেলা না বানালেই কি নয়?
‘মুফতী’ নূরানীর বক্তব্য অনুযায়ী আহমদীয়া মসজিদগুলোকে আমরা তর্কছলে যদি মসজিদে জেরার বলে মেনেও নেই সেক্ষেত্রেও কিন্তু ‘মসজিদ’ শব্দটি বিদ্যমান থাকবে। মুফতী নূরানী নিজেও কিন্তু তার পুস্তিকায় মসজিদে জেরার’ শব্দই ব্যবহার করেছেন। তিনি মসজিদ নামটিকে বাদ দিতে পারেন নি কেননা সূরা তওবায় স্বয়ং আল্লাহ্ তা’লা
মুনাফেকদের কেন্দ্রকে মসজিদে জেরার বলেছেন (আয়াত: ১০৭)।
অতএব মুফতী নুরানীর বক্তব্য সত্য হলেও আহমদীয়া জামাতের মসজিদগুলো মসজিদ হিসেবেই চিহ্নিত থাকবে।
সত্যবাদীরা পরীক্ষার সময়ও অবিচল থাকেন আর তারা নিশ্চিতভাবে জানেন, আল্লাহ্ তা’লা শেষ পর্যন্ত আমাদেরই সমর্থন করবেন। এ অধম যদিও এমন সব নিষ্ঠাবান বন্ধু লাভ করে আল্লাহ্ তা’লার কাছে কৃতজ্ঞ,
এ সত্ত্বেও আমার দৃঢ় বিশ্বাস, একজনও যদি সঙ্গে না থাকে আর সবাই আমাকে পরিত্যাগ করে নিজ নিজ পথ বেছে নেয় তবুও আমার কোন ভয় নেই। আমি জানি, মহান আল্লাহ্ আমার সঙ্গে আছেন। আমাকে যদি পিষে ফেলা হয় বা দলিত-মথিত করা হয় কিংবা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর এবং তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর ক্রএ দেয়া হয়, আর আমি চারিদিকে যদি কষ্ট, গালিগালাজ আর অভিশাপও প্রত্যক্ষ করি তবুও পরিনামে আমিই জয়যুক্ত হব। যিনি সদা আমার সঙ্গে আছেন তিনি ছাড়া কেউ আমায় চেনে না। আমি কখনো বিনষ্ট হতে পারি না। শত্রুদের সমস্ত চেষ্টা বৃথা আর হিংসুকদের সমস্ত
ষড়যন্ত্র বিফল হতে বাধ্য।
হে নির্বোধ ও অন্ধের দল! আমার পূর্বে কোনো সত্যবাদী কি ব্যর্থ হয়েছে যে আমি ব্যর্থ হয়ে যাবো? খোদা তা’লা কখনো কি কোনো সত্য ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তিকে লাঞ্ছনাসহ ধ্বংস করেছেন যে আমায় ধ্বংস করবেন?
স্মরণ রেখো এবং মন দিয়ে শোন! আমার আত্মা ধ্বংস হবার আত্মা নয়, আর আমার স্বভাবচিত্তে ব্যর্থতা বলে কিছু নেই! আমাকে এমন সাহস ও দৃঢ়তা দেয়া হয়েছে যার তুলনায় পাহাড়ও তুচ্ছ। আমি কারো তোয়াক্কা করি না।
আমি একা ছিলাম এবং একা থাকায় আমার কোন আপত্তি নেই। খোদা তা’লা কি আমায় পরিত্যাগ করবেন? কখনো পরিত্যাগ করবেন না । তিনি কি আমায় বিনষ্ট করবেন? কখনো বিনষ্ট করবেন না । বরং শক্ররা অপমানিত হবে আর হিংসুকরা হবে লজ্জিত। খোদা তা’লা তার এই বান্দাকে প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজয় দান করবেন | আমি তার সঙ্গে আছি আর তিনি আছেন আমার সঙ্গে। কোন কিছুই আমাদের সম্পর্ক ছিন্ন করতে
পারবে না। আর আমি তার প্রতাপ ও সম্মানের কসম খেয়ে বলছি, তাঁর ধর্মের মাহাত্ম্য প্রকাশিত হোক, তাঁর প্রতাপের বিকাশ ঘটুক, তাঁর জয়জয়কার হোক- ইহকাল ও পরকালে আমার কাছে এর চেয়ে প্রিয় আর কিছুই নেই। তার অনুগ্রহ থাকলে যে কোন পরীক্ষাতে আমার মোটেও ভয় নেই। একটি পরীক্ষা কেন, কোটি পরীক্ষা হলেও না পরীক্ষার মরু-প্রান্তরে আর কষ্টের গহীন জঙ্গলে আমাকে বিশেষ শক্তি প্রদান করা হয়েছে।
আমি সে মানুষ নই, যুদ্ধের দিন তোমরা যাকে পালাতে দেখবে, আমি সেই পুরুষ, যুদ্ধের দিন তুমি যার মস্তককে রক্ত ও ধূলীমাখা অবস্থায় দেখতে পাবে।” (আনওয়ারুল ইসলাম, পৃষ্ঠা-২৩)
একটি বিনীত অনুরোধ:
ধার্মিক মুসলমানদের কাছে আমরা বিনীতভাবে একটি অনুরোধ জানাচ্ছি। দয়া করে ন্যায় বিচার করুন । কোন বিচারক কেবল এক পক্ষের কথা শুনে রায় দিতে পারে না। চিলে কান নিল, কান নিল চীৎকার শুনেই কোন বুদ্ধিমান মানুষ চিলের পেছনে ছুটতে পারে না। কানে হাত দিয়ে দেখলেই কিন্তু বিষয়টির মীমাংসা হয়ে যায়। কোন জাতির শত্রুতাও যেন মুসলমানদেরকে অন্যায়-অবিচারে প্ররোচিত না করে এ বিষয়ে কুরআন
শরীফে স্পষ্ট সতর্কবাণী দেয়া আছে (সূরা মায়েদা)। অতএব আপনারা দয়া করে বিরুদ্ধবাদীদের একপক্ষের কথা শুনে উত্তেজিত হবেন না। আমাদের ধর্মবিশ্বাস সম্বন্ধে আমাদের কাছে জিজ্ঞেস করুন, আমাদের কাছ থেকে জেনে নিন। এরপর আপনারা এ বিষয়ে নির্বিঘ্নে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
অতএব, সরলমনা জনগণের বিভ্রান্ত হবার কোন কারণ নেই। মনে রাখতে হবে, সর্বশক্তিমান ও অন্তর্যামী আল্লাহ্ সব দেখছেন ও সব শুনছেন। মসজিদ আক্রমণের বিষয়ে তার সতর্কবাণী জানার পরও হঠকারিতা প্রদর্শন করা কোন ঈমানদারের কাজ হতে পারে না। আমাদের সবাইকে স্মরণ রাখতে হবে ‘আল ফিতনাতু আশাদু মিনাল কৃতল’। অর্থাৎ, নৈরাজ্য সৃষ্টি হত্যার চেয়েও জঘন্য অপরাধ’। মহান আল্লাহ সবাইকে সুমতি দান করুন। আমীন!
অন্যান্য উত্তর
- মাসিক মদীনা পত্রিকার প্রশ্নোত্তরের কলামের উত্তর – ইমাম মাহদীর আগমন ও নিদর্শন স্বরূপ চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ
- মাসিক মদীনার মিথ্যাচারের উত্তর – পবিত্র কুরআনের কিছু অংশ ছেটে ফেলা এবং ঈসা (আঃ)-কে শূলীবিদ্ধ করে মেরে ফেলা হয়েছে
- ইসলামী প্রতীকসমূহের ব্যবহার আহ্মাদী ফিরকার জন্য আইনতঃ নিষিদ্ধ হওয়া উচিত কি?
- মাসিক মদীনায় প্রকাশিত “আহমদী সম্প্রদায় : আমার বক্তব্য” – আপত্তির উত্তর
- ঈসা (আ.) কি আসবেন? – মাসিক মদিনায় প্রকাশিত প্রশ্নের উত্তর
- মাসিক মদীনা পত্রিকায় “কাদিয়ানী মতবাদ একটি ফেৎনা” শীর্ষক প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ত উত্তর
- হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.)-এর মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল?
- হযরত মির্যা সাহেবের মৃত্যুতে বিখ্যাত মনীষীরা কি বলেছিলেন?
- মৌলবী সানাউল্লাহ অমৃতসরীর পরিণাম কি হয়েছিল?
- মির্যা সাহেবের মৃত্যু সম্পর্কিত অপবাদ খণ্ডন