হযরত রসূল করীম (সাঃ)-এর অবমাননা সম্পর্কিত অপবাদ ও উহার খন্ডন
আল্লাহ্ তা’আলা পবিত্র কুরআনে এই আদেশ দিয়েছেন:
অর্থাৎঃ কোন জাতির শত্রুতা যেন তোমাদেরকে আদৌ এই অপরাধ করতে প্ররোচিত না করে যে, তোমরা ন্যায়-বিচার পরিহার কর, তোমরা সুবিচার কর, ইহা তাকওয়ার অধিকতর নিকটবর্তী। (সূরা মায়েদা: ৯ আয়াত)
আল্লাহতাআলার এই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে নূ্যনতম যে দায়িত্ব প্রতিটি মুসলমানের উপর বর্তায়, তাহলো কোন আন্দোলন অথবা ধর্মমতের বিরুদ্ধে কলম চালানোর পূর্বে ঐ মতবাদ সম্পর্কিত বই-পুস্তক গভীর দৃষ্টিতে পড়া আবশ্যক। আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বিরুদ্ধাচরণে কুরআনের এই নীতিকে মোটেই অনুসরণ করা হয় নি। শুধু অপবাদ ও বদনাম সৃষ্টির লক্ষ্যে হযরত মির্যা সাহেবের উপর দোষারোপ করা হয়েছে যে, (নাউযুবিল্লাহ) তিনি হযরত খাতামুল আম্বিয়া (সঃ)-এর অবমাননা করেছেন, আর এর প্রমাণস্বরূপ কাটছাঁট করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিছু উদ্ধৃতি বিকৃতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে কতিপয় উদ্ধৃতি আছে যা সম্পূর্ণভাবে মনগড়া ও কল্পনা-প্রসূত। বিরোধীদের প্রায় সব ক’টি পুস্তক-পুস্তিকায় হুযুরে আকরম (সঃ) সম্বন্ধে হযরত মির্যা সাহেবের উপর যে অপবাদসমূহ দেয়া হয়েছে তার মধ্যে নিম্নের তিনটি অন্যতম।
(১) হযরত রসূলে করীম (সঃ)-এর তিন হাজার মু’জেযা, আমার মু’জেযার অংশ দশ লক্ষ (বারাহীনে আহমদীয়া, ৫৭ পৃঃ)।
(২) দুনিয়াতে এমন কোন নবী হয় নি, যার নাম আমাকে দেয়া হয় নি। আমি হলাম আদম, আমি নূহ, আমি ইব্রাহীম …আমি হলাম মুহাম্মদ (সঃ) (তাতিম্মা হাকীকাতুল ওহী)।
(৩) হুযুর (সঃ) খৃষ্টানদের তৈরী পনির খেয়ে নিতেন অথচ এ কথা প্রসিদ্ধ যে, সেই পনির শূকরের চর্বি মিশ্রিত থাকে (পত্রিকা আল ফযল)।
অপবাদের খণ্ডন উপরোক্ত অপবাদগুলি শুধুমাত্র বিভ্রান্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে করা হয়েছে। মূল কথাগুলি যদি পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হত, তাহলে প্রকৃত তথ্য আপনাআপনি উন্মোচিত হয়ে যেত।
(১) হযরত রসূলে করীম (সঃ)-এর তিন হাজার মু’জেযা, আমার মু’জেযার অংশ দশ লক্ষ (বারাহীনে আহমদীয়া, ৫৭ পৃঃ)।
উত্তর: মু’জেযা এবং নিদর্শনের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। একটি মু’জেযা বহু নিদর্শনের সমষ্টি। কিন্তু একা একটি নিদর্শন মু’জেযা নয়। এখানে লক্ষ্যণীয়, হযরত মির্যা সাহেব নিজের জন্য নিদর্শন শব্দ এবং হযরত নবী করীম (সঃ)-এর জন্য মু’জেযা শব্দ ব্যবহার করেছেন। অপবাদটি উদ্ধৃত হয়েছে বারাহীনে আহ্মদীয়া হতে। পাঠকদের অবগতির জন্য বলা দরকার যে, বারাহীনে আহ্মদীয়া পাঁচ খণ্ডে লেখা একটি বিরাটাকারের গ্রন্থ। অপবাদের লক্ষ্যে উদ্ধৃত এই লেখাটি কোন খন্ড হতে নেয়া হয়েছে তারও উল্লেখ নেই। ১৮৮০ সনে প্রথম খণ্ড, ১৮৮২ সনে দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড, ১৮৮৪ সনে চতুর্থ খণ্ড এবং ১৯০৫ সনে পঞ্চম খণ্ড প্রকাশিত। হযরত মির্যা সাহেব এই পাঁচ খণ্ডের কেতাবটিতে কোথাও উল্লেখ করেন নি যে, আমার মজেযার সংখ্যা (১০) দশ লক্ষ। অপবাদটি সম্পূর্ণ মনগড়া । তিনি লিখেছেন, আমার সত্যতার নিদর্শনাবলীর সংখ্যা দশ লক্ষ । সুতরাং এক্ষেত্রে মু’জেযা আর নিদর্শনের মধ্যে পার্থক্য করা আবশ্যক । মু’জেযার ব্যাপারে তিনি কস্মিনকালেও কোথাও নিজেকে রসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর সাথে তুলনা করেন নি। বরং তিনি নিজেই রসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর অন্তর্গত অনুগত ছিলেন। হযরত মিযা সাহেবের নিম্নবর্ণিত উদ্ধৃতিগুলো জালিয়াতি ও ধোকাবাজী, তা সুষ্ঠভাবে প্রমাণ করে দিবে।
হযরত মির্যা সাহেব বলেন:
(ক) “আমাদের নবী (সঃ) কর্তৃক যে সকল মূজেযা প্রদর্শিত হয়েছে, তাঁর পুর্বের কোন নবী দ্বারা তা প্রকাশিত হয় নি। আমাদের নবী (সঃ)-এর মু’জেযা আজ পর্যন্ত প্রকাশিত হচ্ছে এবং কেয়ামত কাল অবধি তা প্রকাশিত থাকবে” (তাতিষ্মা হাকীকাতুল ওহী, ৩৫ পৃষ্ঠা)।
(খ) হযরত মির্যা সাহেব নিজের জন্য প্রদর্শিত নিদর্শন সম্বন্ধে বলেন, “যা কিছু আমার সমর্থনে প্রকাশিত হয়েছে তা বস্তুতঃ হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এরই মু’জেযার অন্তর্ভুক্ত।”
সুতরাং হযরত মুহাম্মদ (সঃ) হতে (নাউযুবিল্লাহ্) শ্রেষ্ঠ হবার অথবা তাঁকে (সঃ) অবমাননা করার যে অপবাদ দেয়া হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও উস্কানীমূলক। তিন হাজার মু’জেযার যে উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে, তাঁর ব্যাখ্যা হযরত মির্যা সাহেব স্বয়ং দিয়েছেন।
তিন হাজার মু’জেযার অর্থ হলো সাহাবাদের সাক্ষ্য দ্বারা সাব্যস্ত মু’জেযাসমুহ, যার মধ্যে ভবিষ্যদ্বাণীসমূহ যোগ করা হয়। নুযুলুল মসীহর ২৩ পৃষ্ঠায় হযরত মির্যা সাহেব বলেন “যা কিছু আমাকে দেয়া হয়েছে ঐ সব কিছুই তাঁর (সঃ)।”
সুধীবৃন্দ, আমাদের আবেদন উপরোক্ত উদ্ধৃতিগুলি পাঠ করতঃ আহমদীয়া মুসলিম জামাতের উপরে আরোপিত অপবাদগুলি যাচাই করুন এবং সত্যকে অনুধাবন করুন।
হযরত মির্যা সাহেব বলেছেন-
অর্থাৎ ঃ “প্রত্যেক কল্যাণ হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর মাধ্যমেই লাভ করা যায়।”
বস্তুতঃ সকল বরকত তাঁরই মাঝে নিহিত। হযরত মির্যা সাহেবের নিদর্শনাবলীর যত লক্ষ্যই হোক না কেন তার সাকল্যটাই বস্তুতঃ হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এরই বদৌলতে।
(২) দুনিয়াতে এমন কোন নবী হয় নি, যার নাম আমাকে দেয়া হয় নি। আমি হলাম আদম, আমি নূহ, আমি ইব্রাহীম …আমি হলাম মুহাম্মদ (সঃ) (তাতিম্মা হাকীকাতুল ওহী)।
উত্তর: হযরত মির্যা সাহেবের উপর এই অপবাদ দেয়া হয় যে, তিনি তাতিষ্মা হাকীকাতুল ওহীর ৮৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “দুনিয়াতে এমন কোন নবী অতিবাহিত হয় নি যার নাম আমাকে দেয়া হয় নি। আমি হলাম আদম, আমি নূহ, আমি ইব্রাহীম, আমি হলাম মুহাম্মদ” । আমি উত্তর দিবার পুর্বে হযরত মির্যা সাহেবের লেখা আসল অংশটি তুলে ধরছিঃ
অর্থাৎ ঃ আমি আদম, আমি নূহ, আমি ইব্রাহীম, আমি ইসহাক, আমি ইয়াকুব, আমি
ইসমাঈল, আমি মূসা, আমি দাউদ, আমি ঈসা, ইবনে মরিয়ম, আমি মুহাম্মদ (সঃ)
বুরুজীভাবে (প্রতিচ্ছায়া রূপে)। যেভাবে আল্লাহতাআলা এই কিতাব (লিখার সময়) এই সকল নাম আমাকে দিয়েছেন এবং আমার সম্বন্ধে বলেছেন
অর্থাৎ তুমি নবীদের পোষাকে খোদার পাহলোয়ান। সুতরাং আবশ্যক ছিল যে, প্রত্যেক নবীর মর্যাদা আমার মধ্যে যেন পাওয়া যায় এবং প্রত্যেক নবীর এক বৈশিষ্ট্য আমার দ্বারা যেন প্রকাশিত হয় (রূহানী খাযায়েন, ২২তম খণ্ড তাতিম্মা হাকীকাতুল ওহী, ৫২১ পৃষ্ঠা)।
(ক) হযরত মির্যা সাহেব তাঁর উক্তিতে নিজেই ব্যাখ্যা দিয়ে দিয়েছেন যে,
“নবীদের এই বৈশিষ্ট্যগুলো আমার মধ্যে বুরুজী অর্থাৎ প্রতিচ্ছায়ারূপে আছে।” এবং তা থাকা ইমাম মাহ্দীর জন্য আবশ্যক ছিল। এতে হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর কোন অবমাননা নেই। কেননা, এই সব বৈশিষ্ট্য তো হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর অপরিসীম আধাত্মিক শক্তি, বরকত ও কল্যাণবর্ষিতার ফলশ্রুতিস্বরূপই প্রাপ্ত হওয়া গেছে। কারো স্বকীয় অধিকারে পাওয়া যায় নি। হযরত মির্যা সাহেব কোথাও একথা বলেন নি যে, তিনি স্বীয় অধিকার বলে এসব নেয়ামত প্রাপ্ত হয়েছেন।
(খ) উম্মতে মুহাম্মদীয়ার বিশিষ্ট ইমাম ও আধ্যাত্মিক জগতের এক উজ্জল নক্ষত্র
হযরত ইমাম বাকের (রাঃ) হযরত ইমাম মাহদী (আঃ) সম্বন্ধে বলেছেন :
অর্থাৎ ঃ ইমাম মাহ্দী বলবেন, হে লোক সকল! তোমাদের মধ্যে যদি কেউ ইব্রাহীম এবং ইসমাঈলকে দেখতে চাও তাহলে শুনে নাও আমিই ইব্রাহীম ও ইসমাঈল। তোমাদের মধ্য থেকে যদি কেউ মূসা ও ঈসাকে দেখতে চাও তাহলে সে যেন শুনে নেয়, আমি মূসা ও আমিই ঈসা, তোমাদের মধ্য থেকে যদি কেউ ঈসা ও শামাউনকে দেখতে চায় তাহলে সে যেন শুনে নেয় ঈসা ও শামউন আমি । এবং তোমাদের মধ্য থেকে যদি কেউ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ও আমীরুল মু’মিনীন (খলীফায়ে রাশেদগণ)-কে দেখতে চায় তাহলে সে যেন শুনে নেয় আমিই মুহাম্মদ (সঃ) এবং আমীরুল মু’মিনীন (বেহারুল
আনওয়ার, ১৩ খন্ড, ২০২ পৃঃ)।
· হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর একটি হাদীস হযরত ইমাম বাকের (রহঃ)-এর উপরোক্ত …
‘ ফরমানকে সত্যায়িত করে। হযরত নবী করীম (সঃ) বলেন ঃ
হযরত নু’মান ইবনে বশীর (রাঃ) ও হুযায়ফা (রাঃ) বর্ণনা করেন,হুযুর (সঃ) বলেছেন, আল্লাহতাআলা যতক্ষণ ইচ্ছা করবেন তোমাদের মাঝে নবুওয়ত স্থায়ী থাকবে [অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত আঁ হযরত (সঃ) দুনিয়ায় জীবিত থাকবেন]। এরপর আল্লাহতাআলা নবুওয়তকে তুলে নেবেন। তখন যুলুম, অত্যাচার ও উৎপীড়নের রাজত্ব কায়েম হবে। উহা ততক্ষণ পর্যন্ত বর্তমান থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ চাইবেন,
অতঃপর আল্লাহতাআলা উহা উঠিয়ে নিবেন। অতঃপর শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা লাভ করবে এবং আল্লাহ্তাআলার ইচ্ছা অনুযায়ী তা স্থায়ী থাকবে । এরপর আল্লাহতাআলা তা তুলে নেবেন। এরপর নবুওয়তের পদ্ধতি অনুযায়ী (মাহ্দী মা’হুদ ও মসীহ্ মাওউদ কর্তৃক) খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে। এপর হুযুর (সঃ) চুপ হয়ে গেলেন (আহমদ, বায়হাকী, মিশকাত শরীফ)।
উপরোক্ত হাদীসের মাঝে আছে “নবুওয়তের পদ্ধতিতে পুনরায় খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে” এই বাক্যটিকে সঠিকভাবে অনুধাবন করলেই হযরত ইমাম মাহ্দী (আঃ)-এর শান (মর্যাদা) ও উম্মতের মধ্যে তার স্থান কি পর্যায়ের হবে তা পরিষ্কারভাবে বুঝা যায়।
(গ) হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (রহঃ)-কে “তাযকেরাতুল আওলিয়াতে”
খোদাদশী ব্যক্তিবর্গের সর্দার, অদ্বিতীয় আলেম ও আল্লাহর খলীফা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ঐ কিতাবেই লিখা আছে।
“একব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞেস করল, “আরশ কী?” তিনি বললেন, “আমি”। সে
জিজ্ঞেস করল, “কুরসী (আসন) কী?” তিনি উত্তরে বললেন, “আমি”। জিজ্ঞাসা করা হল, “লওহ কী?” তিনি বললেন, “আমি”। সে জিজ্ঞাসা করল, “সালাম কি?” তিনিবললেন, “আমি”। সে বলল, “আল্লাহ্র অনেক সম্মানিত ব্যক্তি আছেন যেমন ইব্রাহীম, মূসা এবং মুহাম্মদ (সঃ)।” তিনি বললেন, “আমি এদের সবই।” লোকেরা জিজ্ঞাসা করল, “আল্লাহর বান্দাতো হযরত জিবরাঈল, ইসরাফিল, মিকাইল আলায়াহেস সালাম।” তিনি উত্তরে বললেন, “আমি সবই” (তাযকেরাতুল আওলিয়া, উর্দু ১৫৬ পৃষ্ঠা)।
আহমদীয়া মুসলিম জামাতের প্রতিষ্ঠাতার বিরুদ্ধে অপবাদকারীদের নিকট আমার আবেদন, তারা হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (রহঃ)-এর উপরোক্ত উদ্ধৃতিরও সেই ব্যাখ্যা করুন।
(ঘ) হযরত যুনায়েদ (রহঃ) হযরত আবূ ইয়াযিদ (রহঃ)-এর সম্বন্ধে বলেন ঃ
অর্থাৎঃ আবূ ইয়াযীদ আমাদের মধ্যে জিবরাঈল-এর মর্যাদা রাখেন। হযরত
যুনায়েদ (রহঃ)-এর এই বর্ণনা ও উক্তিকে উপমহাদেশের বিশিষ্ট বুযর্গ ও পীর হযরত দাতাগঞ্জ বখশ (রহঃ)ও কবুল করেছেন এবং উপরোক্ত উক্তিটিকে তাঁর তাসাওউফ এর বিখ্যাত পুস্তক “কাশফুল মাহযুবে” লিপিবদ্ধ করেছেন (কাশফুল মাহযুব উর্দু, ১২২ পৃষ্ঠা যিকর মাশায়েখে তাবা তাবেঈন)
উপরোক্ত বর্ণনা ও বক্তব্য সম্বদ্ধে হযরত মির্যা সাহেবের বিরুদ্ধে অপবাদ
আরোপকারীদের যে ব্যাখ্যা হবে, হযরত মির্যা সাহেবের বেলাতেও এরূপ বক্তব্য ও বর্ণনার জন্য কি সেই ব্যাখ্যা নেওয়া যেতে পারে না?
(ঙ) বড় পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) বলেন,
অর্থাৎঃ মে’রাজের রাত্রে যখন খোদার বন্ধুকে আকাশে নিয়ে যাওয়া হলো, তখন আল্লাহতাআলা সকল আম্বিয়া ও ওলীগণের আত্মাগুলোকে তাঁর (সঃ) অভ্যর্থনা ও দর্শনের জন্য পাঠালেন। তারপর যখন হুযুর (সঃ) আল্লাহর আরশের নিকট পৌঁছালেন, তখন তিনি (সঃ) দেখলেন যে, “আরশ” অনেক বড় এবং উঁচু যার উপরে সিড়ি ব্যতিরেকে উঠা সম্ভবপর নয়। তার (সঃ) সিড়ির প্রয়োজন হলো। তখন আল্লাহ্তাআলা আমার (গাউসুল আযম) আত্মাকে পাঠিয়ে দিলেন। সুতরাং আমি নিজ কাধকে সিড়ির জায়গায় রাখলাম। যখন হুযুর (সঃ) আমার কাঁধে পা রাখলেন তখন তিনি (সঃ) আল্লাহ্তাআলাকে আমার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলেন, “এ কে?” আল্লাহ্তাআলা উত্তর দিলেন, ‘সে তোমার ছেলে, যার নাম আব্দুল কাদের (মুনাকেব তাজুল আওলিয়া, ৮ পৃঃ)।
এই বর্ণনাতে কি হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর অবমাননা হয় নি ? এতে কি সাব্যস্ত হয় না যে, হযরত মুহাম্মদ (সঃ) হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ)-এর সাহায্যে পৌঁছেছেন।’
উপরোক্ত উদ্ধৃতিটির ব্যাখ্যা আর কি হতে পারে? এরূপ বিশ্বাস পোষণ করা হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর অবমাননা নয় কি? এর ফয়সালা পাঠকদের উপর ছেড়ে দিলাম।
(৩) হুযুর (সঃ) খৃষ্টানদের তৈরী পনির খেয়ে নিতেন অথচ এ কথা প্রসিদ্ধ যে, সেই পনির শূকরের চর্বি মিশ্রিত থাকে (পত্রিকা আল ফযল)।
হযরত মির্যা সাহেবের উপর এই অপবাদ দেয়া হয়েছে যে, তিনি লিখেছেন, হুযূর (সঃ) খৃষ্টানদের হাতের তৈরী পনির খেয়ে নিতেন, অথচ এ কথা প্রসিদ্ধ যে, সেই পনিরে শূকরের চর্বি মিশ্রিত হতো (পত্রিকা আল ফযল)।
উত্তর: উপরোক্ত অপবাদটি সম্পূর্ণভাবে উদ্দেশ্যমূলক প্রতারণা মাত্র। আসল বিষয়টি তুলে ধরা হয় নি। হযরত মির্যা সাহেব এক ব্যক্তির প্রশ্নের উত্তরে তাকে দীর্ঘ পত্রে লিখেন। পত্রটির মধ্যে লিখেনঃ
অর্থাৎ খৃষ্টানদের তৈরী পনির খেয়ে নিতেন। অথচ এ কথা প্রচলিত ছিল যে, তার মধ্যে শূকরের চর্বি মিশ্রিত হ’ত। নিয়ম ইহাই যে, যতক্ষণ পর্যন্ত সুনিশ্চিত হওয়া না যায় (যে, এটা পবিত্র) ততক্ষণ পর্যন্ত প্রত্যেক আহার্য বস্তুই পবিত্র। শুধু সন্দেহের দরুন কোন বস্তু অপবিত্র হয় না (পত্রিকা আল ফযল হতে উদ্ধৃত ২২-২-১৯২৪)।
পত্রের উপরোক্ত অংশটি প্রকাশ করে যে, ইসলাম সন্দেহকে প্রশ্রয় দেয় না, শুধু নিশ্চিত বিশ্বাসের উপর জোর দেয়। হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর আমলও তা বলে দেয় যে, নিশ্চিত বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমেই কোন ফয়সালা করা যেতে পারে। কেননা,
অর্থাৎ ধর্ম সহজ এবং কুরআন করীমও এই শিক্ষা দেয়।
অর্থাৎ নিশ্চয় সন্দেহ সত্যের মোকাবেলায় কোন কাজে আসে না(আন্ নযমঃ ২৯ আয়াত)।
হযরত মির্যা সাহেব শূকর-চর্বি মিশ্রিত পনিরের যে কথা উল্লেখ করেছেন, এটা তাঁর নিজস্ব ভাষ্য নয় বরং প্রসিদ্ধ ইসলামী ইতিহাসের বিভিন্ন পুস্তকে এ কথা উল্লেখ রয়েছে। যেমন যুরকানী শরাহ্ আল মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া” চতুর্থ খন্ড ৩৩৫ পৃষ্ঠায় হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর এ ব্যাপারে একটি রেওয়ায়াত রয়েছে। হযরত শেখ যইনুদ্দীন বিন আব্দুল আযীয তার পুস্তক ‘ফাতহুল মুঈন শারাহ্ কুররাতুল আয়েন” এর মধ্যে বাবুস্ সালাতের অন্তর্গত একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন
এই হাদীসটিকে ফাতওয়া ইযহারুল হক নামক পুস্তকেও লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
ফাতওয়া ইযহারুল হক পুস্তকটি মৌলভী আতা মুহাম্মদ সাহেব ১৮৭৫ সনে লাহোর থেকে ছাপান। এই পুস্তকটি প্রকাশনার ব্যাপারে উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম ও খতীব মৌলভী নযীর আহমদ সাহেব দেহলভীর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। শুধু তাই নয়, তিনি ফতওয়ার এই পুস্তকটিতে নিজের স্বাক্ষরও দিয়েছেন।উপরে বর্ণিত হাদীসের অনুবাদ পুস্তকটিতে এভাবে করা হয়েছেঃ
অর্থাৎ এবং ‘যুখ’ এর তৈরী সম্বন্ধে প্রসিদ্ধি ছিল যে, ইহা শূকরের চর্বি দিয়ে বানানো হতো। এবং শামে’র (সিরিয়া) তৈরী পনিরের সম্বন্ধে প্রসিদ্ধি ছিল যে, তা শূকরের তরল চর্বি দিয়ে বানানো হতো। হুযুর (সঃ)-এর নিকট এই পনির আনা হলো। সুতরাং তিনি (সঃ) তা খেলেন এবং এর সম্বন্ধে কাউকে জিজ্ঞেস করলেন না। – (ফতওয়া ইযহারুল হক, পৃঃ ১৭-১৮)।
উপরোক্ত উদ্ধৃতি দ্বারা ইহাই প্রতীয়মান হয় যে, হযরত মির্যা সাহেব হযরত রসূল করীম (সঃ)-এর অবমাননা করেন নি। সুধীবৃন্দের জন্য হযরত মির্যা সাহেবের লেখা: হতে কয়েকটি উদ্ধৃতি পেশ করতঃ হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর প্রতি তার গভীর প্রেম ও ভালোবাসার প্রমাণ দিয়ে এই অধ্যায়টি শেষ করছি। মির্যা সাহেব বলেছেন।
- “ আমার মস্তক আহমদ (সঃ) এর চরণধূলায় লুণ্ঠিত, আমার হৃদয় সর্বদা মুহাম্মদ (সঃ)-এর জন্য কুরবান।” (ফাসী দুর্রে সমীন)
- “খোদার পরে, মুহাম্মদ (সঃ)-এর প্রেমে আমি বিভোর, ইহা যদি কুফরী হয়, খোদার কসম, আমি শক্ত কাফের” (ফাসী দুর্রে সমীন)
- “ মানব জাতির জন্য জগতে আজ কুরআন ব্যতিরেকে আর কোন ধর্মগ্রন্থ নেই এবং আদম সন্তানের জন্য মুহাম্মদ (সঃ) ভিন্ন কোনই রসূল ও যোজক নেই। অতএব, তোমরা সেই মহা গৌরবসম্পন্ন নবীর সাথে প্রেমসূত্রে আবদ্ধ হতে চেষ্টা কর এবং অন্য কাউকেও তার (সঃ) উপর কোন প্রকারের শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করিও না যেন আকাশে তোমরা মুক্তি-প্রাপ্ত বলে পরিগণিত হতে পারো” (কিশতিয়ে নূহ)
- “খোদা সেই ব্যক্তিকে ভালোবাসেন, যে তার পবিত্র গ্রন্থ কুরআনকে বিধিবদ্ধ আইন বলে স্বীকার করে, তাঁর রসূল হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-কে প্রকৃত খাতামুল আম্বিয়া বলে বিশ্বাস করে এবং নিজেকে তার কল্যাণের ভিখারী বলে জ্ঞান করে” (চশমায়ে মা’রেফত)
অন্যান্য উত্তর
- মাসিক মদীনা পত্রিকার প্রশ্নোত্তরের কলামের উত্তর – ইমাম মাহদীর আগমন ও নিদর্শন স্বরূপ চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ
- মাসিক মদীনার মিথ্যাচারের উত্তর – পবিত্র কুরআনের কিছু অংশ ছেটে ফেলা এবং ঈসা (আঃ)-কে শূলীবিদ্ধ করে মেরে ফেলা হয়েছে
- ইসলামী প্রতীকসমূহের ব্যবহার আহ্মাদী ফিরকার জন্য আইনতঃ নিষিদ্ধ হওয়া উচিত কি?
- মাসিক মদীনায় প্রকাশিত “আহমদী সম্প্রদায় : আমার বক্তব্য” – আপত্তির উত্তর
- ঈসা (আ.) কি আসবেন? – মাসিক মদিনায় প্রকাশিত প্রশ্নের উত্তর
- মাসিক মদীনা পত্রিকায় “কাদিয়ানী মতবাদ একটি ফেৎনা” শীর্ষক প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ত উত্তর
- হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.)-এর মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল?
- হযরত মির্যা সাহেবের মৃত্যুতে বিখ্যাত মনীষীরা কি বলেছিলেন?
- মৌলবী সানাউল্লাহ অমৃতসরীর পরিণাম কি হয়েছিল?
- মির্যা সাহেবের মৃত্যু সম্পর্কিত অপবাদ খণ্ডন