আপত্তি: মুহাম্মদী বেগম এবং আহমদ বেগ সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হয়নি
আপত্তি: মুহাম্মদী বেগম এবং মির্যা আহমদ বেগ সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হয়নি। আল্লামা আব্দুল মজিদ তার পুস্তকের ৩৩, ৩৪ ও ৩৫ নম্বর পৃষ্ঠায় আরো দু’টি ভবিষ্যদ্বাণী উল্লেখ করে আপত্তি করেছেন। এই দু’টি ভবিষ্যদ্বাণী পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। একটি ভবিষ্যদ্বাণী সম্বলিত ইলহাম হল, বিকরুন ওয়া সাইয়্যেবুন। মির্যা সাহেব এর উল্লেখ করে নিজে বলেছেন, তার সাথে একজন কুমারী নারীর বিয়ে হবে এবং পরে আরেকজন বিধবা নারীর সাথে বিয়ে হবে। আর অপর ইলহামটি হল, মুহাম্মদী বেগমের সাথে বিয়ে সংক্রান্ত। তার মূল আপত্তি হল, মির্যা সাহেব নিজে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, তার সাথে এক বিধবা নারীর তথা মুহাম্মদী বেগমের বিয়ে হবে। এই ভবিষ্যদ্বাণীটি বাস্তবায়িত হয় নি।
উত্তর: মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী(আ.) এক যুগ পর্যন্ত এমনটিই বুঝেছিলেন একথা সত্য। মির্যা সাহেব প্রাথমিক পর্যায়ে ‘বিকরুন ওয়া সাইয়্যেবুন‘ ইলহাম অনুযায়ী মনে করতেন, তার সংসারে একজন কুমারী তার স্ত্রী হয়ে এসেছেন অর্থাৎ হযরত নুসরত জাহান বেগম(রা.) এবং আরেক জন বিধবা তাঁর স্ত্রী হয়ে আসবেন অর্থাৎ ভবিষ্যদ্বাণীর শর্ত পূরণ হলে মুহাম্মদী বেগম স্ত্রী হয়ে তার ঘরে আসবেন। উভয় ভবিষ্যদ্বাণী কাছাকাছি সময়ে প্রাপ্ত হওয়ায় মির্যা সাহেব উপরোক্ত ব্যাখ্যাই সকলকে অবগত করেছেন। ‘বিকরুন ওয়া সাইয়েবুন‘-এর অর্থ নিরূপন করার জন্য মুহাম্মদী বেগমের ভবিষ্যদ্বাণীটির সত্যাসত্য জানা আবশ্যক। এই দু’টি ভবিষ্যদ্বাণী যাচাই করতে গিয়ে সর্বপ্রথম মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী(আ.) রচিত গ্রন্থে মুহাম্মদী বেগম সংক্রান্ত যে ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে তা তুলে ধরছি।
মুহাম্মদী বেগমের বিষয়ে আপত্তি তোলা হয়, হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী(আ.) নাকি হীন কামচরিতার্থে তার এক নিকট আত্মীয়ার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চেয়েছিলেন। তিনি আল্লাহর নাম ভাঙিয়ে (নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক) তার সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, এই মেয়ের সাথে নাকি তার বিয়ে হবেই হবে যা পূর্ণ হয় নি।
পাঠকের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে, বিষয়টি মোটেও এরকম নয় বরং অনেক বড় একটি ধর্মীয় দর্শন উন্মোচিত করার জন্য এবং জীবন্ত খোদার পরিচয় দেয়ার নিমিত্তে মুহাম্মদী বেগম ও তার পিতা আহমদ বেগের পরিবারের বিষয়ে নিদর্শন প্রকাশিত হয়েছিল। ঘটনার বিবরণ নিম্নরূপ:
হযরত মির্যা সাহেবের নিকটাত্মীয় মির্যা আহমদ বেগ সামাজিক কদাচারে লিপ্ত ছিল, সে ধর্ম বিদ্বেষী ছিল। কেবল ধর্ম বিদ্বেষীই নয় বরং তারা ধর্মীয় শিক্ষা ও আদর্শকে হাসিবিদ্রুপ ও কটাক্ষ করত। ঐশী শিক্ষার বিষয়ে সমালোচনা করত, পবিত্র কুরআনের অবমাননা করত এবং নাস্তিক্যবাদের অনুসারী ছিল। ১৮৯৩ সালে লেখা ‘আয়েনায়ে কামালাতে ইসলাম‘ গ্রন্থে হযরত মসীহ্ মাওউদ(আ.) তাদের এই দুরাবস্থা প্রকাশ্যে তুলে ধরে তাদের সব অপকর্মের একটি চিত্র পৃষ্ঠা ৫৬৬ ও ৫৬৭-তে বর্ণনা করেন। তারা হযরত মির্যা সাহেবের কাছে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ চেয়ে এবং মির্যা সাহেবের সত্যতার প্রমাণ চেয়ে রসূলে করিম(সা.)-কে অকথ্য ভাষায় গালি সম্বলিত একটি চিঠি দিয়েছিল। যদিও তাদের এসব অনাচার অনেক বছর আগ থেকেই চলছিল কিন্তু বিষয়টিকে সবিস্তারে অনেক বছর পর হযরত মির্যা সাহেব ১৮৯৩ সনে জনসমক্ষে প্রকাশ করেন।
এ প্রেক্ষিতে হযরত মির্যা সাহেব আল্লাহর কাছে মিনতি করে দোয়া করেছিলেন, ইয়া রাব্বি ইয়া রাব্বি উনসুর আব্দাকা ওয়াখযুল আ‘দাআকা। অর্থাৎ, হে আমার প্রভু, হে মালিক আমার! তোমার এই অধম বান্দাকে সাহায্য কর এবং তোমার শত্রুদের অপদস্ত কর। এ প্রেক্ষিতে হযরত মির্যা সাহেবকে ইলহাম করে আল্লাহ তাদের প্রতি নিজ ক্রোধের ঘোষণা দেন। এ ঘোষণার অনুবাদ তুলে ধরছি,
“নিশ্চয় আমি তাদের অবাধ্যতা ও ঔদ্ধত্য প্রত্যক্ষ করেছি। অচিরেই আমি তাদেরকে নানাবিধ বিপদে জর্জরিত করব। তুমি দেখবে আমি তাদের সাথে কী আচরণ করি এবং আমি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান। নিশ্চয় আমি তাদের নারীদেরকে বিধবা এবং তাদের পুত্রসন্তানদের এতিম এবং তাদের বাড়িঘরকে ধ্বংসাবশেষে পরিণত করতে যাচ্ছি। যেন তারা তাদের ঔদ্ধত্যের এবং কৃতকর্মের স্বাদ গ্রহণ করে। কিন্তু আমি তাদেরকে এক নিমিষে ধ্বংস করব না বরং পর্যায়ক্রমে শাস্তি দিব যেন তারা সৎপথে ফিরে আসে এবং তওবাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। নিশ্চয় আমার অভিশাপ তাদের ওপর, তাদের গৃহের প্রাচীরের ওপর, তাদের ছোট ও বড়দের প্রতি, তাদের নারী ও পুরুষদের প্রতি আপতিত হতে যাচ্ছে, এমনকি তাদের অতিথিদের প্রতিও যারা তাদের গৃহে প্রবেশ করবে– আর এরা সবাই অভিশপ্ত”(আয়েনায়ে কামালাতে ইসলাম: পৃষ্ঠা ৫৬৯)
এই হচ্ছে মির্যা আহমদ বেগ সংক্রান্ত সেই মূল ভবিষ্যদ্বাণী যেটা প্রকাশ না করে আহমদী বিরোধী আলেম-উলামা ভবিষ্যদ্বাণীর একটি খণ্ডিত চিত্র উপস্থাপন করে থাকেন। উপরোক্ত ভবিষ্যদ্বাণীতে উল্লেখ রয়েছে, আমি তাদেরকে এক নিমিষে ধ্বংস করব না বরং পর্যায়ক্রমে শাস্তি দিব যেন তারা সৎপথে ফিরে আসে এবং তওবাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। উদ্দেশ্য শাস্তি দিয়ে ধ্বংস করা নয় বরং উদ্দেশ্য হল, আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ এবং তাদেরকে প্রত্যাবর্তন করার বা তওবা করার সুযোগ দেয়া। এদেরকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী(আ.) চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালান। ‘আয়েনায়ে কামালাতে ইসলাম‘ গ্রন্থে হযরত মির্যা সাহেব এ বিষয়ে লিখেছেন, আল্লাহর কাছে তিনি কেবল তাদের শাস্তির জন্যই দোয়া করেন নি বরং তাদেরকে রক্ষা করার চেষ্টাও করেছেন। এরই অংশ হিসেবে তিনি তার নিকটাত্মীয় মির্যা আহমদ বেগের মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন যেন আল্লাহর জীবন্ত নিদর্শনের ছোঁয়া লাভ করে তাদের পরিবারের সদস্যগণ ও সমমনারা আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা পায়। মহানবী(সা.)-এর জীবনে আমরা এর উদাহরণ দেখতে পাই। ইসলামের ঘোর শক্র আবু সুফিয়ানের মেয়েকে রসূল(সা.) বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছেন। এর ফলে তার বংশ ও পরিবার নবুয়্যতের আধ্যাত্মিক কিরণ থেকে জ্যোতি লাভ করতে পেরেছে। একই কথা হযরত সাফিয়্যা বিনতে হুয়াই বিন আখতাব(রা.) এর জন্যও প্রযোজ্য।
‘আয়েনায়ে কামালাতে ইসলাম‘ গ্রন্থেও উক্ত ভবিষ্যদ্বাণী প্রকাশের আগে ১৮৮৬ সনের ২০শে ফেব্রুয়ারী হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী(আ.) যে বিজ্ঞাপন ছাপিয়েছিলেন তাতে তিনি বলেছিলেন, ‘তারা যদি তওবা না করে অবশেষে ধ্বংস হয়ে যাবে। তাদের বাড়িতে বিধবাদের আধিক্য হবে, তাদের দেয়াল ও প্রাচীরেও ঐশী ক্রোধ বর্ষিত হবে। কিন্তু তারা যদি অনুশোচনা করে তাহলে আল্লাহ্ তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করবেন‘ (বিজ্ঞাপন ১৮৮৬, ২০শে ফেব্রুয়ারী)
হযরত মির্যা সাহেব ১৮৮৮ সালের ১৫ই জুলাই আরেকটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেছিলেন। এতে তিনি একটি স্বপ্নের উল্লেখ করেন যাতে তিনি মুহাম্মদী বেগমের নানীকে সম্বোধন করে সাবধান করেছিলেন। হযরত মির্যা সাহেব বলেন, “স্বপ্নে এই মহিলাকে দেখলাম, তার চোখে-মুখে কান্নার ছাপ ছিল। আমি তাকে স্বপ্নে বলেছিলাম, তুমি তওবা কর, তুমি তওবা কর! তোমার পরিবার পরিজনের প্রতি শাস্তি নেমে আসতে যাচ্ছে। একজন মারা যাবে এবং তার পক্ষ থেকে অবশিষ্ট রয়ে যাবে কয়েকটি কুকুর” (বিজ্ঞাপন ১৫ জুলাই ১৮৮৮ এবং তবলীগে রিসালত, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২০)
আল্লাহর পক্ষ থেকে সাবধানবাণীর প্রেক্ষিতে মুহাম্মদী বেগমের সাথে যে বিয়ের প্রস্তাবটি করা হয়েছিল তাতে হযরত মির্যা সাহেব লিখেছিলেন, মির্যা আহমদ বেগ তার মেয়েকে যদি আমার সাথে বিয়ে না দেয় আর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ থেকে ক্ষান্ত না হয়, সেক্ষেত্রে অন্যস্থানে মেয়েকে বিয়ে দেয়ার তিন বছর অতিক্রান্ত হবার আগেই মুহাম্মদী বেগের পিতা আহমদ বেগ মৃত্যুবরণ করবে। আর যার সাথে বিয়ে হয়েছে যদি সে তওবা না করে তাহলে সেও বিয়ের আড়াই বছর পর মারা যাবে আর মুহাম্মদী বেগম বিধবা হবার পর আমার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবে।
পাঠক! ভাল করে লক্ষ্য করুন, প্রতিটি ক্ষেত্রে তওবার কথা, আল্লাহর কাছে অনুশোচনা করা এবং ধর্মবিদ্বেষ দূর করার কথা বলা হচ্ছে আর এটি স্পষ্টভাবে একটি শর্তযুক্ত সাবধানবাণী।
এটি একটি শর্তসাপেক্ষ ভবিষ্যদ্বাণীও বটে। তওবা করলে আল্লাহ্ দয়া করবেন আর তওবা না করলে ঐশী শাস্তি ধাপে ধাপে অবতীর্ণ হবে। ১৮৮৬ সালের বিজ্ঞাপন, ১৮৮৮ সালের বিজ্ঞাপন এবং ১৮৯৩ সালে আয়েনায়ে কামালাতে ইসলামের ভবিষ্যদ্বাণীটি আরেকবার লক্ষ্য করুন। ১৮৮৮ সালের ভবিষ্যদ্বাণীতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, একজন মারা যাবে। যখন মির্যা আহমদ বেগ ধৃষ্টতা দেখিয়ে মির্যা সুলতান মুহাম্মদের সাথে মেয়ে মুহাম্মদী বেগমের বিয়ে দেয় তখন তার ঔদ্ধ্যত্বের কারণে তার বিরুদ্ধে ঐশী সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়ে যায়। ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী মির্যা আহমদ বেগ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মারা গেল। এত স্পষ্ট ও জোরালোভাবে হযরত মির্যা সাহেবের ভবিষ্যদ্বাণী কার্যকর হয়েছিল যার কারণে মৌলবী মোহাম্মদ হোসেন বাটালভীর মত মির্যা সাহেবের ঘোর বিরোধীও এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। সে তার নিজ পত্রিকায় লিখেছে:“যদিও এই ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হয়েছে– তবে এলহামের কারণে নয় বরং জ্যোতির্বিদ্যার মাধ্যমে“ [ইশায়াতুস সুন্নাহ, ৫ম খণ্ড, ৬ই সেপ্টেম্বর ১৮৯৪ সানের বিজ্ঞাপন দ্রষ্টব্য] এই ঘটনার পর মির্যা আহমদ বেগের গোটা পরিবার সম্বিত ফিরে পায় এবং তারা তওবা করে। তাই পরম দয়ালু খোদা তাদের তওবা গ্রহণ করে তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করেন এবং শাস্তির অন্যান্য ভবিষ্যদ্বাণী স্থগিত হয়ে যায়।
বিজ্ঞ প্রাজ্ঞ আলেম মাত্রই জানেন, ভবিষ্যদ্বাণী দু’ ধরনের হয়ে থাকে। একটি হল, সুসংবাদবাহী ভবিষ্যদ্বাণী তথা ‘ওয়াদা‘ এবং অপরটি শাস্তির বার্তা সম্বলিত সতর্কবাণী যাকে ‘ওয়াঈদ‘ও বলা হয়। ক্রোধ প্রকাশক ভবিষ্যদ্বাণী বা ‘ওয়াঈদ’ শর্তসাপেক্ষ হয়ে থাকে।
হযরত ইউনুস(আ.)-এর জাতি তাদের ধ্বংসের নির্ধারিত দিনের একদিন আগে তওবা করে রক্ষা পেয়েছিল। তেমনিভাবে ফেরাউনের জাতি উপর্যুপরি অন্যায়ের কারণে ক্রোধভাজন হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে বারবার ছাড় দেয়া হয়েছিল।
হযরত মুহাম্মদ(সা.)-এর যুগের কাফেররা বারবার ঔদ্ধত্য দেখানোর পরও আল্লাহ্ তা’লা বলেছেন, আল্লাহ্ তাদেরকে ততদিন পর্যন্ত শাস্তি দিতে যাচ্ছেন না যতদিন তুমি (হে মুহাম্মদ) তাদের মাঝে বসবাস করছ। আর আল্লাহ্ তাদেরকে ততক্ষণ শাস্তি দিতে যাচ্ছেন না যতক্ষণ তারা ইস্তেগফারে রত থাকবে‘ (সূরা আনফাল: ৩৪)
সতর্কবার্তা সম্বলিত ভবিষ্যদ্বাণীর বিষয়ে এই হচ্ছে ঐশী বিধান। শর্ত পূর্ণ হলে শাস্তি আপতিত হয় আর শর্ত পূর্ণ না হলে শাস্তি স্থগিত হয়ে যায়। এটিই আল্লাহ তা’লার সুন্নত।
পাঠকবৃন্দ, আল্লামা আব্দুল মজিদ ও তার সমমনারা উক্ত ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে যতই কটাক্ষ করুন না কেন মুহাম্মদী বেগম এবং তার পরিবার তা করেন নি। তারা বুঝতে পেরেছিলেন, হযরত মির্যা সাহেব সত্য। মুহাম্মদী বেগমের স্বামী সুলতান মুহাম্মদ এ কথা স্বীকার করে বলেছেন, “আমি মির্যা সাহেবকে আগেও বুযুর্গ মনে করতাম এখনও করি। কিন্তু আক্ষেপ আমি তার সাথে সাক্ষাত করার সৌভাগ্য লাভ করতে পারি নি।” (২০/০৬/১৯১৩ তারিখে লেখা পত্র যা তিনি ‘আম্বালা ক্যান্ট’ থেকে স্বহস্তে লিখেছিলেন)
মির্যা আহমদ বেগ ও তার পরিবার সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণী যে শর্তানুযায়ী অক্ষরে অক্ষরে পূর্ণ হয়েছে তার আরেকটি অকাট্য প্রমাণ তুলে ধরছি। যে পরিবার সম্বন্ধে এই শাস্তিমূলক ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল তাদেরই অনেকে মির্যা সাহেবকে গ্রহণ করেছেন। অথচ কোন লম্পট ব্যক্তি যদি কুপ্রবৃত্তির অধীন হয়ে এ ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী করে তবে সংশ্লিষ্ট পরিবার মরে গেলেও উক্ত লম্পটকে কখনও গ্রহণ করবে না। কিন্তু আলোচ্য ভবিষ্যদ্বাণীর ফলাফল ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। একদিকে মির্যা আহমদ বেগ ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী মারা গেল আর অমনি তার পরিবারের লোকজন অনুতপ্ত হয়ে নিজেদের সংশোধন করে ফেলে। তাদের মধ্যে খোদাভীতি সৃষ্টি হয় আর তারা খোদার জ্বলন্ত নিদর্শন দেখতে পায়। এমনকি অনুতপ্ত হয়ে তারা মির্যা সাহেবের কাছে ক্ষমা ও দোয়া চেয়ে চিঠিও লেখে। শুধু তাই নয়, এই ভবিষ্যদ্বাণীর পূর্ণতার কিছুকাল পর সেই পরিবারের অনেক সদস্য মির্যা সাহেবের বয়াত করে তার জামাতভুক্ত হন। বয়াতকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন– (১) মির্যা আহমদ বেগের বিধবা স্ত্রী স্বয়ং অর্থাৎ মুহাম্মদী বেগমের মা, (২) আহমদ বেগের এক পুত্র মির্যা মোহাম্মদ বেগ, (৩) আহমদ বেগের এক মেয়ে ইনায়াত বেগম, (৪) তারই আরেক মেয়ে সরদার বেগম, (৫) আহমদ বেগের ছেলের ঘরের নাতি মির্যা মাহমুদ বেগ ও (৬) আহমদ বেগের আরেক মেয়ে মাহমুদা বেগম। এছাড়া আহমদ বেগের দুই জামাতাও বয়েত করেন। যদিও উক্ত ভবিষ্যদ্বাণীতে নিজেদের রক্ষা করার জন্য কেবল তওবা করার শর্ত ছিল, বয়াত করতে হবে বলে আদৌ কোন শর্ত ছিল না, তথাপী তারা স্বতস্ফূর্তভাবে বয়াত করেছিলেন। মুহাম্মদী বেগমের নাতি নাতনিরা আজও আহমদীয়া জামাতের নিষ্ঠাবান সদস্য অর্থাৎ হযরত মির্যা গোলাম আহমদ সাহেবের সত্যায়নকারী। এদের আহমদী হবার কারণ হল, তারা মির্যা সাহেবের দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর অস্তিত্বের জ্বলন্ত নিদর্শন দেখেছে। মূল ভবিষ্যদ্বাণীতে যেভাবে একজন দাম্ভিকের মৃত্যু সংবাদ দেয়া ছিল ঠিক সেভাবেই পূর্ণ হয়েছে। যে পরিবার সম্বন্ধে এই ভবিষ্যদ্বাণী, যারা এই ভবিষ্যদ্বাণীর ফলাফল স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছে এবং বাহ্যত ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে তারাই যখন নিজেদের আমলের মাধ্যমে অর্থাৎ মির্যা সাহেবের বয়াত করার মাধ্যমে উক্ত ভবিষ্যদ্বাণীকে সত্য বলে ঘোষণা দিচ্ছে, সেক্ষেত্রে ‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদের এত হৈচৈ, এত আপত্তি প্রবাদ বাদী নীরব আর সাক্ষী সরব’-এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ!
‘আল্লামা’ আব্দুল মজিদ! মৌলভী মোহাম্মদ হোসেন বাটালভীর স্পষ্ট স্বীকারোক্তি ও মির্যা আহমদ বেগের পরিবারভুক্ত লোকদের মির্যা সাহেবের বয়াত করার পরও আপনার মত বিচক্ষণ আলেমে দ্বীনের কোন সাফাই বক্তব্য থাকতে পারে কি?
মুহাম্মদী বেগম ও মির্যা আহমদ বেগ সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণী বিশ্লেষণের পর এখন আমরা আবার ফিরে আসি ‘বিকরুন ওয়া সাইয়েবুন‘ ইলহাম প্রসঙ্গে।
পাঠকবৃন্দ নিঃসন্দেহে এতক্ষণে বুঝে গেছেন, ভবিষ্যদ্বাণী আলেমুল গায়েব আল্লাহ্ স্পষ্ট না করা পর্যন্ত কোন বান্দা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারে না, কেবল নিজের ধারণা ব্যক্ত করতে পারে। মুহাম্মদী বেগমের সাথে মির্যা সাহেবের বিবাহ বন্ধনের ভবিষ্যদ্বাণী থেকে মির্যা সাহেব ইজতেহাদ করেছিলেন হয়তো মুহাম্মদী বেগমই বিধবা হয়ে মির্যা সাহেবের পরিবারভুক্ত হবেন। কিন্তু আল্লাহ্ প্রদত্ত শর্ত পূর্ণ না হওয়ায় মুহাম্মদী বেগমের সাথে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী(আ.) এর বিয়ে হয় নি। ফলে, মির্যা সাহেব প্রাপ্ত ইলহাম থেকে যে ইজতেহাদ করেছিলেন তা বাস্তবে ফলে নি। এতে অবাক হবার কিছু নেই। নবীদের দ্বারাও ইজতেহাদে ফলাফল নির্ণয়ে ব্যত্যয় হতেই পারে।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশায় এরকম একাধিক ঘটনা রয়েছে। যেমন, আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বপ্নযোগে তাওয়াফ করার দৃশ্য দেখে মহানবী(সা.) হজ্জ করতে গিয়ে বুঝতে পারেন, সেই বছর হজ্জের ইঙ্গিত ছিল না। আবার, হযরত মুহাম্মদ(সা.) নিজে বলেছেন, আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম, আমি খেজুর বাগানের দিকে হিজরত করছি, আমি মনে করেছিলাম, সম্ভবত আমরা ইয়ামামার দিকে হিজরত করব। কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম ইয়ামামার দিকে ইঙ্গিত ছিল না বরং ইঙ্গিত মদিনার দিকে ছিল। হুযুর(সা.)-এর এই স্বপ্ন দেখে ব্যাখ্যা করা ও পরবর্তীতে স্বপ্ন ভিন্নরূপে বাস্তবায়িত হওয়া সাব্যস্ত করছে,আল্লাহর পক্ষ থেকে ভবিষ্যদ্বাণী সম্বলিত ওহী, স্বপ্ন, কাশফ ইত্যাদির প্রকৃত তত্ত্ব ও রহস্য বাস্তবায়িত হবার পরই পরিপূর্ণভাবে উদঘাটিত হয়। এর আগ পর্যন্ত অনেক সময় বিষয়টি নবী রসূলদের কাছেও অস্বচ্ছ থাকতে পারে। একই প্রসঙ্গে মুহাম্মদ(সা.)-এর পূর্বেকার নবী হযরত নূহ(আ.)-এর একটি ঘটনা তুলে ধরতে পারি। আল্লাহ্ তা’লা তার নবীর সাথে অঙ্গিকার করেছিলেন, প্লাবন আসছে তুমি নৌকায় চড়। আমি তোমার পরিবারবর্গকে রক্ষা করব। পরবর্তীতে নূহ(আ.) তার এক ছেলেকে আহ্বান জানানো সত্ত্বেও নৌকায় আরোহনে সে অস্বীকৃতি জানায়, ফলে প্লাবন তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তখন হযরত নূহ(আ.) দোয়া করেছিলেন, হে আমার প্রভু! আমার ছেলে আমার পরিবারভুক্ত আর তোমার অঙ্গিকার যে সত্য তা–ও আমি জানি (সূরা হুদ ৪৬)। আমার ছেলের তাহলে এ কী হল? আল্লাহ উত্তর দিয়ে বলেছিলেন, হে নূহ! সে তোমার পরিবারভুক্ত নয়। যদিও সে তোমার ঔরসজাত পুত্র কিন্তু সে তোমার সেই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত নয় যাকে রক্ষা করার আমি অঙ্গিকার করেছি। কেননা সে অসৎকর্মে লিপ্ত থাকত। অর্থাৎ এক্ষেত্রে ‘পরিবার’ বলতে সৎকর্মশীল আধ্যাত্মিক অনুসারীদের বুঝানো হয়েছিল। বুঝা গেল, হযরত নূহ(আ.) ভবিষ্যদ্বাণীটিকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করেছিলেন অথচ প্রকৃত মর্ম ছিল এর চেয়ে ভিন্ন। আবার, নেনোভার অধিবাসীদের বিষয়ে হযরত ইউনুস(আ.)-আল্লাহর পক্ষ থেকে জেনে শাস্তির যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তা-ও একটি সতর্কবাণী ছিল যার সময়সীমা ছিল চল্লিশ দিন। কিন্তু এ সময়সীমা অতিক্রান্ত হবার পরও নেনেভার অধিবাসীরা তওবা ও ইস্তেগফারের মাধ্যমে রক্ষা পেয়েছিল। বোঝা গেল, সতর্কবাণী তথা ‘ওয়াঈদ’ অনুশোচনা ও সংশোধন না করলে কার্যকর হয়। অথচ হযরত ইউনুস(আ.) মনে করেছিলেন, তার জাতি ৪০ দিনের মাথায় ধ্বংস হতে বাধ্য! এসমস্ত বিষয় পবিত্র কুরআন দ্বারা সাব্যস্ত এবং প্রত্যেক বিদগ্ধ আলেম এ বিষয়গুলো জানেন। ঠিক একইভাবে মির্যা সাহেবও তার আলোচ্য ইলহামের যে ব্যাখ্যাই বুঝেছিলেন তাতে আপত্তি করা কারও সাজে না। পরবর্তীকালের ঘটনাবলী স্পষ্ট করে দিয়েছে, ভবিষ্যদ্বাণীতে উল্লিখিত কুমারী ও বিধবা উভয় অংশই তার সহধর্মীনি হযরত নুসরত জাহান বেগম(রা.)-এর মাধ্যমেই পূর্ণ হবার ছিল এবং সেভাবেই হয়েছে। অর্থাৎ তিনি কুমারী অবস্থায় তার স্ত্রী হয়ে আসবেন এবং স্বামীর মৃত্যুতে বিধবা অবস্থায় রয়ে যাবেন। অতএব পবিত্র কুরআন অনুযায়ী হযরত মির্যা সাহেবের ভবিষ্যদ্বাণীর পূর্ণতা অকাট্যভাবে প্রমাণিত। এ সত্ত্বেও কেউ যদি হঠকারিতা দেখিয়ে মির্যা সাহেবের বিরুদ্ধে আপত্তি করতে চায় এর দায়দায়িত্ব আপত্তিকারীর ওপরই বর্তায়।
অন্যান্য উত্তর
- আপত্তি: মির্যা সাহেব রসূল (সা.)-কে হেলাল এবং নিজেকে বদর আখ্যা দিয়েছেন
- আপত্তি: মির্যা সাহেব লিখেছেন, তার সিংহাসন সবার ওপরে
- আপত্তি: মির্যা সাহেব নিজেকে দরুদ শরীফের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করেছেন
- আপত্তি: মির্যা সাহেব লিখেছেন ইয়ালাস খোদাতা’লার নাম
- আপত্তি: মির্যা সাহেবের উপর অন্য ভাষায় ইলহাম হল কেন?
- আপত্তি: মির্যা সাহেব বলেছেন, মাহদীর মাধ্যমে মহানবী (সা.) এর দ্বিতীয় আগমন হবে
- আপত্তি: মির্যা সাহেব নতুন নবুয়্যত, ধর্ম, কিবলা, নামায এবং কুরআন বানিয়েছেন
- আপত্তি: মির্যা সাহেবের কথা- একটি নতুন বাহন আবিষ্কার হবে যা আগুন দ্বারা চলবে
- আপত্তি: মির্যা সাহেব বলেন, কুরআনে তাঁর নাম ইবনে মরিয়ম রাখা হয়েছে
- আপত্তি: মির্যা সাহেব রেশমী লুঙ্গি পরিধান করেছিলেন যা হারাম