চতুর্থ অভিযোগ: “আমাকে যারা নবী মানে না তাদের মায়েরা বেশ্যা” (আয়নাতে কামালাত পৃঃ ৫৪৭)।
মুফতী নূরানী তার পুস্তিকার ১১ নং পৃষ্ঠায় বলেছেন, কাদিয়ানীদের বিশ্বাস ও বক্তব্য: “আমাকে যারা নবী মানে না তাদের মায়েরা বেশ্যা” (আয়নাতে কামালাত পৃঃ ৫৪৭)।
আমাদের বক্তব্য:
নাউযুবিল্লাহ মিন যালিক। মুফতী নূরানীকে আমরা তার উল্লেখিত এই বাক্যটি ‘আয়নায়ে কামালাতে ইসলাম’ পুস্তক থেকে হুবহু দেখানর চ্যালেঞ্জ করছি।
‘আমাকে যারা নবী মানে না তাদের মায়েরা বেশ্যা’ –এমন কোন কথা বা বাক্য হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ:) কক্ষনো বলেন নি। বলতেও পারেন না। এটা এক জঘন্য অপবাদ । জনগণকে বিভ্রান্ত ও উত্তেজিত করার জন্য তাঁর আরবী বক্তব্যের বিকৃত অনুবাদ করে পাকিস্তানী মোল্লারা যেসব বই-পুস্তক ছাপিয়েছে সেগুলো থেকে নকল করে বই ছাপালে এমনটি ঘটাই স্বাভাবিক। সত্যিকারের আলেম অন্যের চর্বিত চর্বণ ভক্ষণ করে না। নিজে মূল উৎস থেকে অনুসন্ধান করে, যাচাই করে তবে কথা বলে।
পাঠকের অবগতির জন্য উল্লেখ করা আবশ্যক, হযরত মির্যা সাহেব তাঁর জামাতকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন: ‘গালিয়াঁ সুনকে দোয়া দো, পাকে দুখ্ আরাম দো।’ অর্থাৎ তোমরা বিরোধীদের গালাগালি শুনে তাদের জন্য দোয়া করো, আর তাদের কাছে দু:খ পেয়ে তাদের জন্য স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করো। যার শিক্ষা এত মহান ও সুন্দর তিনি কীভাবে উক্ত কথাটি বলতে পারেন—অন্ততঃ একবার ভেবে দেখা দরকার! তিনি কখনও এ কথা বলেন নি। প্রকৃতপক্ষে, আয়েনায়ে কামালাতে ইসলাম’ পুস্তকে তিনি কয়েক পৃষ্ঠাব্যাপী একটি বিশেষ প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। তার আলোচনার সূচনা হয়েছে এভাবে:
‘আমার বয়স যখন প্রায় কুড়ি বছর তখন থেকেই ইসলাম ধর্মকে সমর্থন দানের এবং খৃষ্টান ও আর্য সমাজীদের সাথে ধর্ম বিষয়ে তর্কযুদ্ধ করার বিষয়টি আমার হৃদয়ে গেথে দেয়া হলো। এ উদ্দেশ্যে আমি কয়েকটা রচনা লিখেছি। …. তদনুযায়ী আমি বারাহীনে আহমদীয়া, সুরমা চাশমায়ে আরিয়া ও আয়েনায়ে কামালাতে ইসলাম প্রভৃতি পুস্তক লিখেছি যেগুলো পবিত্র ইসলামের সমর্থনে রচিত।” এরপরে পৃষ্ঠা ৫৪৭-এ
তিনি বলেছেন, “কুল্লু মুসলিম অর্থাৎ প্রত্যেক মুসলমান এসব পুস্তককে প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখে আর এগুলোতে বর্ণিত গভীর তত্ত্ব ও শিক্ষায় উপকৃত হয় আর (ইসলামের প্রতি) আমার আহ্বানকে সমর্থন জানায়। তবে
‘যুররিয়াতুল বাগায়া’ যাদের অন্তরে আল্লাহ মোহর মেরে দিয়েছেন তারা এর বিপক্ষে।”
এই ছিল মির্যা সাহেবের বক্তব্য । এই বক্তব্যে ইসলাম-বিরোধীদের বিপক্ষে মির্যা সাহেবের অবস্থানকে মুসলমানরা সাদরে গ্রহণ করেছে বলে তিনি এখানে উল্লেখ করেছেন। বাস্তবেও এমনই ঘটেছিল । যেই মাত্র এসব ইসলামী পুস্তক ও গ্রন্থ হযরত মির্যা সাহেব প্রকাশ করলেন ইসলাম-বিদ্বেষী আর্য সমাজী নেতা পন্ডিত লেখরাম পেশাওয়ারী এগুলোর বিরুদ্ধে বই লিখলেন যার নাম ছিল ‘খাবতে আহমদীয়া আওর তাকযীবে বারাহীনে আহমদীয়া। অন্যদিকে মুসলমানরা হযরত মির্যা সাহেবের সমর্থন
করলেন। আহলে হাদীস সম্প্রদায়ের বড় নেতা মৌলভী মুহাম্মদ হোসেন বাটালভী তার পত্রিকায় হযরত মির্যা সাহেবের রচিত বারাহীনে আহমদীয়া গ্রন্থের সমর্থনে একটি বিশেষ পর্যালোচনামূলক সংখ্যা বের করলেন (ইশায়াতুস সুন্নাহ: ৭ম খন্ড, পৃ: ১৬৯ দ্রষ্টব্য)। তিনি সুরমা চশমায়ে আরিয়া গ্রন্থের প্রশংসা করলেন তার একই পত্রিকার পরবর্তী এক সংখ্যায় (৯ম খন্ড, পৃ: ১৪৯ থেকে ১৫৮ ব্রষ্টব্য)। কেবল তা-ই নয়, লাহোরের বিখ্যাত মুসলিম বুক ডিপো হযরত মির্যা সাহেবের রচিত গ্রন্থ সুরমা
চশমায়ে আরিয়া নিজ খরচে পুন:মুদ্রণ করে বিতরণ করে। এই ছিল তখনকার মুসলমান সমাজের প্রতিক্রিয়া। অতএব মুফতী নূরানী উপস্থাপিত অভিযোগটি ডাহা মিথ্যা। তিনি মির্যা সাহেবের পরিবেশিত বিষয়বস্তুকে অসৎ উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছেন।
‘যুররিয়াতুল বাগায়া’ শব্দটির অনুবাদ বেশ্যার বংশধর করা মস্ত বড় ভুল কেননা এটি একটি বাগধারা। আরবীতে ইবনুস সাবিল (পথচারী বা মুসাফির) বলতে আক্ষরিক অর্থে যেমন রাস্তার ঔরসজাত সন্তান বুঝায় না তেমনি যুররিয়াতুল বাগায়া’ শব্দটিও আক্ষরিক অর্থে ব্যবহার হয় না।
আরবী ভাষার বিখ্যাত অভিধান তাজুল উরুস’-এ লেখা আছে, ‘আল বাগিয়্যাতু ফিল ওয়ালাদে নাকিবুর রুশদে ওয়া ইউক্ালু হুওয়া ইবনু বাগিয়্যাহ’ অর্থাৎ কাউকে বাগিয়্যার সন্তান বলার অর্থ হলো, সে হেদায়াত থেকে বঞ্চিত। আরও মজার বিষয় হচ্ছে, হযরত মির্যা সাহেব আরেক স্থলে নিজেই এই ব্যাগিয়া-র অনুবাদ করে গেছেন। সাদুল্লাহ লুধিয়ানী নামক এক ঘোর বিরোধীর লাঞ্ছিত মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী করে তিনি ইবনুল বাগা শব্দটি ব্যবহার করেন আর নিজেই এর অনুবাদ করেন হে বিদ্রোহী ব্যক্তি।
(আল হাকাম পত্রিকা, একাদশ সংখ্যা, নম্বর ৭, ২৪শে ফেব্রুয়ারী, ১৯০৭, পৃ: ১৩)। এরপরও যদি কোন বিরোধী হঠকারিতাবশত এটাকে গালি হিসেবে বর্ণনা করে তবে নিজেকে গালি দেয়ার অপরাধে সে নিজেই দোষী সাব্যস্ত হবে, মির্যা সাহেব এজন্য দায়ী নন।
‘মুফতী’ নূরানী তার পুস্তিকার ১২ নম্বর পৃষ্ঠায় হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ:)-এর বিরুদ্ধে লম্পট ও দুশ্চরিত্রের অধিকারী হবার অপবাদ দিয়েছেন। আবার অসংখ্য নারীর সতিত্ব নষ্ট করার জঘন্য অপবাদ দিতেও তিনি কুণ্ঠাবোধ করেন নি। এই জঘন্য রটনার বিরুদ্ধে আমরা কেবল সর্বশক্তিমান সর্বজ্ঞ আল্লাহর কাছেই মিনতি জানাতে পারি। হে আল্লাহ্! মিথ্যাবাদীর বিচার তুমিই করতে পারো । লা’নাতুল্লাহে আলাল কাযেবীন। আজকের ‘মুফতী’ নূরানী হযরত মির্যা সাহেবের বিরুদ্ধে জঘন্য মিথ্যাচারের আশ্রয় নিচ্ছেন কিন্তু হযরত মির্যা সাহেবের সমসাময়িক খোদাভীরু আলেমরা মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তাকে কীভাবে মূল্যায়ন করেছেন তা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন।
(ক) মওলানা আবুল কালাম আজাদ উপমহাদেশের একজন সর্বজনবিদিত বিখ্যাত আলেম ছিলেন। তিনি হযরত মির্যা সাহেবের মৃত্যুতে শোক প্রকাশের পাশাপাশি তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে প্রবন্ধ লিখেন। তার এই লেখা ১৯০৮ সালের ২০শে জুন তারিখে পাঞ্জাবের উকিল পত্রিকায় (অমৃতসর থেকে) প্রকাশিত হয়। মাওলানা আজাদ লিখেছেন:
“তিনি (অর্থাৎ হযরত মির্যা সাহেব) এক অতি মহান ব্যক্তি ছিলেন। তার লেখা এবং কথায় যাদু ছিল। তার মস্তিষ্ক মূর্তিমান বিস্ময় ছিল। তার দৃষ্টি ছিল প্রলয়-স্বরূপ এবং কন্ঠস্বর কিয়ামত সদৃশ। তার অঙ্গুলি-সংকেতে বিপ্লব সংঘটিত হতো। তার দু’টি মুষ্টি বৈদু্যতিক ব্যাটারীর মত ছিল। তিনি ত্রিশ বছর যাবৎ ধর্ম জগতে ভূমিকম্প ও তুফানের ন্যায় বিরাজমান ছিলেন।
তিনি প্রলয়-বিষাণ হয়ে নিদ্রিতদেরকে জাগ্রত করতেন। তিনি আজ জগত থেকে বিদায় গ্রহণ করেছেন। ইসলামের বিরুদ্ধবাদীদের বিরুদ্ধে তিনি যেরূপ বিজয়ী সেনাপতির কর্তব্য সম্পাদন করেছেন তাতে আমরা এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য, যে মহান আন্দোলন আমাদের শত্রুদেরকে দীর্ঘকাল যাবৎ বিপর্যস্ত করে রেখেছিল তা যেন ভবিষ্যতেও জারি থাকে। খৃষ্টান এবং হিন্দু আর্যসমাজীদের বিরুদ্ধে মির্যা সাহেব যে সব পুস্তক রচনা করেছেন, তা সর্বসাধারণের মাঝে সমাদর লাভ করেছে। ……….”
(খ) ‘জমিদার’ পত্রিকার সম্পাদক মৌলভী জাফর আলী সাহেবের পিতা মৌলভী সিরাজ উদ্দিন সাহেব হযরত মির্যা সাহেবের মৃত্যুতে স্মৃতিচারণ করে লিখেছেনঃ
“মির্যা গোলাম আহমদ ১৮৬০-৬১ খৃষ্টাব্দে সিয়ালকোট জেলায় চাকুরীরত ছিলেন। তখন তার বয়স ২২/২৩ বছর হবে। আমি স্বচক্ষে দেখে সাক্ষ্য দিচ্ছি, তিনি যৌবনে একজন খুবই নেক এবং খোদাভীরু বুযুর্গ ছিলেন।” (জমিদার পত্রিকা, ৮ জুন- ১৯০৮)
(গ) অমৃতসর থেকে প্রকাশিত উকিল পত্রিকার সম্পাদক মওলানা আব্দুল্লাহ আল এমাদী তাঁর পত্রিকায় লেখেন,
“চরিত্রগত দিক থেকে মির্যা সাহেবের আঁচলে একটি ক্ষুদ্র দাগও
দৃষ্টিগোচর হয় নি। তিনি এক পবিত্র জীবন যাপন করেছেন।” (উকিল পত্রিকা, ৩০ মে, ১৯০৮)
অ-আহমদী প্রখ্যাত আলেমদের পক্ষ থেকে এসব স্বীকারোক্তি ইতিহাসে সংরক্ষিত। তাই চাঁদের মুখে থু থু ফেলার অপচেষ্টা না করাই ‘মুফতী নূরানীর জন্য সমীচীন হবে। আল্লাহর ওলীর বিরুদ্ধাচরণ স্বয়ং আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার নামান্তর। এ যুদ্ধে কোন মুফতী’ বা ‘মওলানা’ কখনও জয়যুক্ত হতে পারবে না!
অন্যান্য উত্তর
- মাসিক মদীনা পত্রিকার প্রশ্নোত্তরের কলামের উত্তর – ইমাম মাহদীর আগমন ও নিদর্শন স্বরূপ চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ
- মাসিক মদীনার মিথ্যাচারের উত্তর – পবিত্র কুরআনের কিছু অংশ ছেটে ফেলা এবং ঈসা (আঃ)-কে শূলীবিদ্ধ করে মেরে ফেলা হয়েছে
- ইসলামী প্রতীকসমূহের ব্যবহার আহ্মাদী ফিরকার জন্য আইনতঃ নিষিদ্ধ হওয়া উচিত কি?
- মাসিক মদীনায় প্রকাশিত “আহমদী সম্প্রদায় : আমার বক্তব্য” – আপত্তির উত্তর
- ঈসা (আ.) কি আসবেন? – মাসিক মদিনায় প্রকাশিত প্রশ্নের উত্তর
- মাসিক মদীনা পত্রিকায় “কাদিয়ানী মতবাদ একটি ফেৎনা” শীর্ষক প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ত উত্তর
- হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.)-এর মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল?
- হযরত মির্যা সাহেবের মৃত্যুতে বিখ্যাত মনীষীরা কি বলেছিলেন?
- মৌলবী সানাউল্লাহ অমৃতসরীর পরিণাম কি হয়েছিল?
- মির্যা সাহেবের মৃত্যু সম্পর্কিত অপবাদ খণ্ডন