হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.)-এর মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল?


হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.)-এর মৃত্যু সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী

হযরত আহমদ কাদিয়ানী (আঃ) ৭৩ বৎসর ৩ মাস বয়সে ১৯০৮ সনের ২৬শে মে মোতাবেক ২৪শে রবিউসসানী, ১৩২৬ হিজরী সকাল ১০ টায় লাহোরে পরলোকগমন করেন এবং পর দিবস ২৭শে মে তারিখে কাদিয়ানে সমাহিত হন (বর্তমান গবেষণা অনুযায়ী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মৃত্যুও এ দিবসেই হয়েছিল)।
হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ)-এর উপর ১৮৬৫ খৃষ্টাব্দে তার আয়ু সম্পর্কে একটি ইলহাম হয় যা এরূপ ছিল:

ثَمَا نِيْنَ حَوْلاً اَو قَرِيْبًا مِنْ ذَالِكَ اَوْ تُزِیدُ عَلَيْهِ سِنِينَ اَوْ تَنْكُثُ

(تذکرہ۳۲۵)

(সামানীনা হাওলান আও কারীবাম্ মিন যালেকা আও তুযীদু আলায়হে সিনীনা আও তানকুসু।)

অর্থাৎ “তোমার আয়ু আশি বছরের কাছাকাছি অথবা উহা হতে দু-চার বছর কম বা বেশী হবে।”

উক্ত ইলহামের পর ১৯০৪ ও ১৯০৫ সনে হযরত মসীহ মাউওদ (আঃ)-এর উপরে তার মৃত্যু সম্পর্কে আরো বহু ইলহাম হয়। যদ্বারা তিনি স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে, তার মৃত্যু অত্যাসন্ন। তখন তিনি ‘আল ওসীয়্যত’ নামক একখানা পুস্তক লিখেন।
উহাতে ঐ সমুদয় ইলহামসমূহের কথা উল্লেখ করে জামাতকে সম্বোধন করে বলেছিলেন যে, তার মৃত্যু অত্যাসন্ন এবং তার মৃত্যুর পর “কুদরতে সানীয়ার” আবির্ভাব হবে এবং তিনি ঐ কুদরতে সানীয়াকেই ‘খেলাফত আলা মিনহাজেন নবুওয়ত” অনুযায়ী ইসলামী খেলাফত বলে আখ্যায়িত করেন।

অতঃপর ১৯০৮ সনের ২৯শে এপ্রিলে যখন হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ) লাহোর সফর করেন (যা তাঁর জীবনের শেষ সফর ছিল) তখন ঐ সফরের পূর্বে ও পরে তার উপর আরো তিনটি ইলহাম হয়েছিল:

اَلرَّحِيْلُ ثُمَّ اَلرَّحِيْلُ وَالْمَوْتُ قَرِيْبٌ

(১) আর রাহীলো, সুম্মার রাহালো, ওয়াল মাওতো করীবুন।

اَلرَّحِيْلُ ثُمَّ اَلرَّحِيْلُ اِنَّ اَللّهَ يَحْمِلُ كُلَّ حَمْلٍ

(২) আর রাহীলো, সুম্মার রাহলো, ইন্নাল্লাহা ইয়াহমেলো কুল্লা হামলিন।

مَكُن تَكِيه بَرْ عُمْرِنَا پاءدار

(تذکرہ)

(৩) মাকুন তাকিয়া বার উমরে না পায়দার।

অর্থাৎ- (১) (ইহা) তোমার জীবনের শেষ সফর: তোমার মৃত্যু সন্নিকট ;
(২) ইহা তোমার জীবনের শেষ সফর, তোমার মৃত্যু পর (তোমার পরিবার ও জামাতের) সকল গুরুদায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ্ই বহন করবেন,

(৩) তোমার নশ্বর জীবনের উপর কোন ভরসা করো না।

এ সফরে হুযুর (আঃ)-এর লাহোর আগমনের পর তিনি লাহোরে হিন্দু মুসলমানদের অনুরোধে, তাদের এক সমাবেশে বক্তৃতার জন্য পয়গামে সুলেহ’ নামক একখানা পুস্তক রচনায় মনোনিবেশ করেন। উক্ত পুস্তক লেখার সময়ই দিবারাত্র পরিশ্রম করার ফলে হুযুর (আঃ) গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। হুযুর লাহোরে আহমদীয়া বিল্ডিং-এ অবস্থিত ডাক্তার মির্যা ইয়াকুব বেগ সাহেবের বাড়ীতে অবস্থান করেছিলেন। অসুস্থ হওয়ার পর ডাক্তার মির্যা ইয়াকুব বেগ সাহেব, হযরত হেকিম মৌলানা নূরুদ্দীন সাহেব ও লাহোরের ইংরেজ সিভিল সার্জন হুযুরের চিকিৎসা করেন। উক্ত সফরে হুযূরের বেগম সাহেবা সৈয়্যদা নুসরত জাহা বেগম ও ছেলেমেয়েরা সঙ্গে ছিলেন।

ভবিতব্যের লেখা পূর্ণ হওয়া অবশ্যম্ভাবী। পুর্বেই আল্লাহ্ হুযুরকে তার মৃত্যু সম্পর্কে অবহিত করে দিয়েছিলেন। উক্ত ভবিষ্যদ্বাণী মোতাবেক ২৬শে মে, ১৯০৮ সনে হুযূর (আঃ) লাহোরে ইন্তেকাল করেন। (ইন্না লিল্লাহে ……….. রাজেউন)।

যেদিন হুযূর ইন্তেকাল করেন তার পূর্ব রাত্রিতেই হুযুরের জ্যেষ্ঠ কন্যা মোবারেক বেগম সাহেবা একটি গুরুত্বপূর্ণ রুইয়া দেখেছিলেন। তিনি রুইয়াতে দেখেছিলেন
“হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ)-এর বাড়ীর দরজায় এসে মরহুম হযরত মৌলানা আব্দুল করীম সাহেব (রাঃ) হুযুরকে ডাক দিয়ে বলছেন যে, হযরত রসূলে করীম (সাঃ) কাদিয়ানে তশরীফ এনেছেন এবং হুযুরকে রসূল করীম (সাঃ) তার নিকট হাজির হতে আদেশ করেছেন। উত্তরে হুযূর বললেন যে, আমার মযমুন লেখা প্রায় শেষ। মযমুন লেখা শেষ করেই আমি হুযুরের খেদমতে হাজির হয়ে যাব।”

যেভাবে মোবারেক বেগম সাহেবা রুইয়া দেখেছিলেন ঠিক সেভাবেই হুযূর তার শেষ বই পয়গামে সুলেহা লেখা শেষ করার পরই ইন্তেকাল করেছিলেন।

كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ وَيَبْقَىٰ وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ

(سورہ الرحمن: ۲۸)

– উহার (ভূপৃষ্ঠের) উপর যা কিছু আছে সবই নশ্বর ; এবং অবিনশ্বর হয়ে থাকবে (কেবল) তোমার প্রতিপালকের সত্তা যিনি প্রতাপ ও সম্মানের অধিপতি।’ (৫ঃ২৭-২৮)

 

সৈয়্যদ মোবারেক বেগম সাহেবার উপরোক্ত রুইয়া সম্পর্কে ইংরেজী ভাষায় হযরত আকদসের একজন জীবন চরিত লেখক লিখেছেন:

“In reply the Promised Messiah said, please go and tell them that I shall come soon after I finish this article. According to this heavenly sign, the Promised Messiah finished his booklet *Poigham-e-Sulah” on evening of the 25th May, 1908 and the next morning at Ten O’clock he passed away and reported his arrival to the Holy Prophet. (ইন্না লিল্লাহে ……… রাজেউন)।

 

হুযূরের মৃত্যুর পূর্বের দিন হুযূর ডাক্তারের নিকট গিয়েছিলেন। ফিরে এসে তাঁর পকেটেযে টাকা ছিল তা তিনি টমটম ওয়ালাকে ভাড়া বাবদ দিয়ে দিলেন। তার সন্তান-সন্ততিদের জন্য কোন টাকা পয়সা রেখে যাননি। তখন হযরত বেগম সাহেবা তার ছেলেমেয়েদের সম্বোধন করে বলেছিলেনঃ

بچو! گھر خالی دیکھ کر یہ نہ سمجھنا کہ تمھارے اَبا تمہارے لیے کچھ نھیں چھوڑ کرگئے- انھوں نےآسمان پر تمہارے لیے دعاٶں کا ایک بڑا بھای خزانہ چھوڑا ہے- جو تمہیں وقت پر ملتا رہے گا

অর্থাৎ  “বৎস ! তোমাদের পিতার মৃত্যুর পর ঘর শূন্য দেখে মনে করো না যে, তোমার আব্বা তোমাদের জন্য কিছুই রেখে যাননি। তিনি তোমাদের জন্য আসমানে অনেক দোয়ার ভান্ডার রেখে গেছেন যা তোমরা তোমাদের জীবনে সর্বদাই লাভ করতে থাকবে এবং তা কোনদিন নিঃশেষ হবে না।” – (হযরত মির্যা বশীর আহমদ (রাঃ) রচিত পুস্তক “দুররে মকনুন”, ৯০ পৃষ্ঠা)

 

“এই বৎসর ২৪শে মে তারিখে আমার ওয়ালেদা সাহেবার পীড়া উপলক্ষে হযরত সাহেবকে লাহোরে যাইতে হয়। যাত্রাকালে তাহার এই এলহাম হয়।

 

“মাবাশ আইমান আজ বাজি এ রোজগার” (কালের লীলার উপর নিশ্চিন্ত থাকিও না)

তিনি বলিলেন, “এই এলহাম দ্বারা বোধ হয় যে কোন ভয়ানক ঘটনা সংঘটিত হইবে।”

ঘটনাক্রমে ঐ দিবস রাত্রে আমার ছোট ভাই মির্যা শরীফ আহমদ পীড়িত হয়ে পড়ে। এজন্য সে দিন রওয়ানা স্থগিত হইল। পর দিন বাটাল ষ্টেশনে গেলে পর জানা গেল যে, সীমান্ত প্রদেশে অশান্তি উপদ্রব আরম্ভ হওয়ায় গাড়ীর সংখ্যা যথেষ্ট নহে। গাড়ী রিজার্ভ করা গেল না। দুই তিন দিন বাটালায় অপেক্ষা করা গেল। হযরত গৃহে আসিয়া বলিলেন,

“আল্লাহতা’লার তরফ হইতে এলহাম হওয়া আর এদিকে নানা বাধা আরম্ভ হওয়া ইহার ভিতর রহস্য আছে। আমার বিবেচনায় কিছুকাল বাটালায় অবস্থান করা সঙ্গত। ইহাতে আবহাওয়ারও বদল হইবে। চিকিৎসার জন্য একজন লেডী ডাক্তার ডাকা হউক।”

কিন্তু পরিবার বর্গের সকলে ধরিয়া পড়িলেন, লাহোর যাইতেই হইবে।

অবশেষে কয়দিন অপেক্ষার পর তিনি লাহোরে গেলেন। লাহোরে পৌছিতেই এক তুমুল আন্দোলন উপস্থিত হইল। মৌলবীগণ পূর্বের ন্যায় তাহার বিরুদ্ধে একত্র হইলেন। তিনি যে বাড়ীতে বাস করিতেন তাহার নিকটেই একটা খোলা মাঠ ছিল। ঐখানেই তাহার বিরুদ্ধে সভার পর সভা হইতে লাগিল। প্রত্যহ আসরের পর রাত্রি ৯টা ১০টা পর্যন্ত মিটিং হইতে লাগিল। এই সকল সভায় তাহাকে অশ্লীল ভাষায় গালি দেওয়া হইত। তাহার বাড়ীতে ঢুকিবার একটি মাত্র রাস্তা ছিল। সুতরাং তাহার শিষ্যগণের বড়ই কষ্ট হইতে লাগিল। তিনি তাহাদিগকে আশ্বাস দিয়া বলিতেন,

“তোমারা সহ্য করিয়া থাকিবে। গালি দ্বারা আমার কোন ক্ষতিই হইবে না। তোমরা একটু ও প্রত্যুত্তর না করিয়া চুপ করিয়া যাতায়াত করিবে। ঐ দিকে চাহিও না। তাহারা এবার কিছু কাল লাহোরে অবস্থান করিবেন এই ইচ্ছা প্রকাশ করায় তার জমাতের অনেক লোক সে স্থানে সমবেত হইতে লাগিল। সব সময়েই মানুষের ভীড় থাকিত। অন্য লোক ও তাহার সহিত দেখা করিতে আসিত। এই সময় হিন্দুস্থানের সম্ভ্রান্ত বংশীয় লোকগণ বরং প্রকৃত পক্ষে সমুদয় পৃথিবীর উচ্চ বংশের লোকেরাই ধর্মের প্রতি একেবারে উদাসীন হইয়া পড়িয়া ছিলেন। এজন্য হযরত মসীহ মাওউদ তাহাদিগকে কিছু উপদেশ দিবার নিমিত্ত তাহার পরিচিত লাহোরের একজন বিশেষ সন্ত্রান্ত গয়ের আহমদী দ্বারা তাহাদিগকে নিমন্ত্রণ করাইলেন। আহারের পূর্বে তিনি বক্তৃতা আরম্ভ করেন। বক্তৃতা কিছু লম্বা হইয়া পড়িল। তাহাদের মধ্যে এক ব্যক্তিকে নিতান্ত উদ্বিগ্নভাব দেখিয়া সকলেই বলিয়া উঠিলেন, আহার তো আমাদের রোজই হইয়া থাকে, কিন্তু এই রূহানী আহার কেবল আজই আমাদের ভাগ্যে ঘটিল। প্রায় দুই ঘন্টা পর্যন্ত তাহার বক্তৃতা হয়। পর দিন এই বক্তৃতা সম্বন্ধে গুজব উঠে যে মির্যা সাহেব তাহার নবুওয়তের দাবী প্রত্যাহার করিয়াছেন। লাহোরের কতিপয় উর্দু দৈনিক সংবাদ পত্রেও ঐ খবর প্রকাশিত হয়। হযরত সাহেব তখনই ঐ সংবাদের এক প্রতিবাদ প্রকাশ করিয়া বলেন যে, তিনি কখনও নবুওয়তের দাবী ফিরাইয়া লন নাই। তিনি কেবল এই কথা অস্বীকার করিতে চান যে, তিনি কখনও কোন নূতন শরীয়ত আনয়ন করেন নাই তাহার শরীয়ত তাহাই রহিয়াছে যাহা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আনয়ন করিয়াছিলেন।

হযরত আহমদের সর্বদাই পেটের অসুখ ছিল। কেবল দাস্ত হইত । লাহোর আগমনের পর তাহার পীড়া বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। সর্বদাই লোক তাহার সাক্ষাৎ লাভের প্রত্যাশায় অপেক্ষা করিত। এজন্য তাহার একটুও বিশ্রামের অবসর হইত না। এই অবস্থার মধ্যে তাহার এই এলহাম হয়, “আর রাহিল সুম্মার রাহিল” (যাত্রার সময় আগত : যাত্রার সময় আগত)। এই এলহামের বিবরণ অবগত হইয়া তাহার শিষ্যবর্গ ব্যস্ত হইয়া পড়েন। কিন্তু তখনই কাদিয়ান হইতে এক ব্যক্তির মৃত্যু সংবাদ পাইয়া তাহারা মনে করিলেন এই এলহাম এই ব্যক্তির সম্পর্কে হইয়াছে। ইহাতে তাহারা অনেকটা আশ্বস্ত হইলেন। এ বিষয় হযরত সাহেবকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন—না, এই এলহাম একজন উচ্চদরের লোকের সম্বন্ধে হইয়াছে। এই সংবাদে আমার ওয়ালেদা সাহেবা অত্যন্ত ঘাবড়াইয়া তাঁহাকে বলেন, “চলুন কাদিয়ানে ফিরিয়া যাই।” তিনি উত্তর করিলেন, “এখন কাদিয়ানে ফিরিয়া যাওয়া আমার সাধ্যাতীত। যদি খোদাতা’লা লইয়া যান তবেই যাইতে পারি”

আশ্চর্যের বিষয় এমন এলহাম সত্ত্বেও তিনি তাহার দৈনন্দিন কার্য্যের একটুকু ও পরিবর্তন করেন নাই। সমস্ত কার্য ঠিক পূর্বের ন্যায়ই চলিতে লাগিল। এইরূপ পীড়িতাবস্থায় ও হিন্দু মুসলমানের মধ্যে শান্তি ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপনের উদ্দেশ্যে তিনি এক বক্তৃতা করিবেন বলিয়া স্থির করিলেন। বক্তৃতা লেখা আরম্ভ হইল। এই প্রবন্ধের নাম ‘পয়গামে সুলেহ’ রাখা হয়। ইহাতে তিনি আরও অসুস্থ হইয়া পড়িলেন। যে দিন তাহার বক্তৃতা লিখা শেষ হয় সেই দিবস রাত্রিকালে এক এলহাম হয়। “মাকুন তাকিয়া বর উমরে না পায়দার” (ভঙ্গুর জীবনের উপর ভরসা করিও না)। তিনি তৎক্ষণাৎ এই এলহাম তাহার পরিবারের মধ্যে প্রচার করিয়া বলিলেন, “ইহা আমার সম্বন্ধে উক্ত হইয়াছে।” সেই দিন বক্তৃতা রচনা শেষ করিয়া ছাপাইবার নিমিত্ত পাঠান হইল।
রাত্রিকালে তাহার দাস্ত হইতে থাকে। ইহাতে তিনি অত্যন্ত দুর্বল হইয়া পড়েন।

তিনি আমার ওয়ালেদা সাহেবাকে ঘুম হইতে জাগাইলেন। তিনি হযরতের দুর্বল অবস্থা দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার কেমন বোধ হইতেছে?” তিনি বলিলেন, “যাহা আমি বলিয়াছিলাম, তাহাই।” ইহার পর তাহার আর একবার দাস্ত হয়। ইহাতে তিনি একেবারে শক্তিহীন হইয়া পড়িলেন। তিনি আদেশ করিলেন “মৌলবী নূরদ্দীন সাহেবকে ডাকিয়া আন।” উক্ত মৌলবী সাহেব সম্বন্ধে পূর্বে বলা হইয়াছে। তিনি এজকন বিখ্যাত হেকিম ছিলেন। তৎপর হযরত বলিলেন, “মাহমুদ (অত্র গ্রন্থকার) ও মীর সাহেবকে (তাহার শ্বশুর) জাগাও।” আমার শয্যা তাহার শয্যার নিকটেই ছিল।
আমি উঠিয়া দেখি তাহার সময় সন্নিকট। একজন ডাক্তার আসিয়া চিকিৎসা আরম্ভ করিলেন। কিন্তু কোন ফল দেয়া গেল না। শেষে তাহার শরীরে কয়েকবার ইঞ্জেকশন করা হয়। ইহার পর তিনি শুইয়া পড়িলেন। তাহার গলা একেবারে বসিয়া গিয়াছিল। কিছু বলিতে চাহিলেন, কিন্তু পারিলেন না। দোয়াত কলম আনিতে বলিলেন; কিছু লিখিতে পারিলেন না। কলম হাত হইতে পড়িয়া গেল। আবার শুইয়া পড়িলেন। একটু পরে তন্দ্রার ভাব আসিল। দিনের বেলায় প্রায় সাড়ে দশটার সময় তাহার সুপবিত্র আত্মা এই বিশ্ব জগতের প্রকৃত মালেক, সেই সত্য স্বরূপের চরণতলে আশ্রয় গ্রহণ করিল, যাঁহারা প্রেরিত ধর্মের সেবায় তাঁহার পবিত্র জীবন অতিবাহিত হইয়াছিল। “ইন্না লিল্লাহে ও ইন্না ইলায়হে রাজেউন”। মৃত্যুকালে আল্লাহ্ আল্লাহ্ এই কথাটি তাহার মুখাগ্রে ছিল।

তাহার মৃত্যুর সংবাদ বিদ্যুতের মত চারিদিকে বিস্তৃত হইয়া পড়িল। ভিন্ন ভিন্ন জামাতের নিকট তারে সংবাদ পাঠান হইল। সেই দিন সন্ধ্যার সময় ও পরদিন প্রাতঃকালে এই মহাপুরুষের মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হইল।

তিনি স্বীয় বিরুদ্ধ মতাবলম্বী ও শক্রগণের সহিত যে শিষ্টাচার ও ভদ্রতাচরণ করিয়া গিয়াছেন তাহা যেমন একদিকে চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবে, অপর দিকে তাহার মৃত্যুতে যে অপার আনন্দের রোল পড়িয়াছিল তাহাও বিস্মৃত হইবার নহে। লাহোরের একজন সাধারণ লোক আধ ঘন্টার মধ্যেই যে গৃহে তাহার পবিত্র লাস রক্ষিত হইয়াছিল তাহার নিকটবর্তী এক স্থানে আসিয়া নানাবিধ আনন্দের গীত গাহিয়া স্বীয় হৃদয়ের পরিচয় দিয়াছিল। কেহ কেহ নানা প্রকার সং সাজিয়া তাহাদের অন্তরের বিভীষিকাময় নীচাশয়তার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিতেও কুণ্ঠাবোধ করে নাই।

তাহার প্রতিষ্ঠিত জামাতের সহিত তাহার সম্বন্ধে কীরূপ প্রীতিপূর্ণ ছিল তাহা এই ঘটনা হইতেই প্রতীয়মান হইবে। অনেকের মানসিক অবস্থা এরূপ হইয়া গিয়াছিল যে, তাহার পবিত্র লাশ তাহাদের সমক্ষে অবস্থিত দেখিয়াও যেন তাহাদের মন কিছুতেই মানিতে চাহিল না যে, তাহাদের বন্ধুর সহিত তাহাদের চিরবিচ্ছেদ ঘটিয়াছে। প্রথম মসীহের শিষ্যগণের সহিত দ্বিতীয় মসীহের এই প্রভেদ ছিল যে, প্রথম মসীহের শিষ্যগণ স্বীয় প্রভুকে ক্রুশে-বিদ্ধ দেখিবার পর তাহাকে পুনঃ জীবিতাবস্থায় অবতীর্ণ হইতে দেখিয়া আশ্চর্যান্বিত হইয়াছিল ; তাহারা কিছুতেই বুঝিতে পারে নাই মসীহ কীরূপে জীবিত থাকিতে পারেন। আর বর্তমান মসীহের শিষ্যগণ আজ কিছুতেই বুঝিতে পারিল না যে, তাহাদের মসীহের মৃত্যু কীরূপে সম্ভব হইতে পারে।

আজ হইতে তেরশত বৎসর পূর্বে এক মহাপুরুষ “খাতামুন্নাবিয়ীন” (শ্রষ্ঠতম নবী) রূপে ধরাতলে আগমন করিয়াছিলেন। তাহার মৃত্যু হইলে তৎকালীন কবি মম্ম পীড়িতত্ত্বরে গাহিয়াছিলেনঃ

“তুমি আমার চোখের পুত্তলি ছিলে। তোমার মৃত্যুতে আমার চক্ষু অন্ধকার হইয়া গিয়াছে। এখন হইতে আর কাহারও উপর মৃত্যুর ছায়া আসিয়া পড়িল কিনা তাহা আমি জানিতে চাহি না। কারণ আমি এত দিন কেবল তোমার মরণের ভয়েই ভীত ছিলাম।”

আজ তের শত বৎসর পরে সেই নবীরই একজন গোলামের মৃত্যুতেও ঠিক এই রকমের আর এক দৃশ্যের পুনরাভিনয় হইল। যাঁহারা তাঁহাকে চিনিয়াছিলেন তাহাদের দৃষ্টি পার্থিব সুখ অতিক্রম করিয়া পরকালের উপর নিবন্ধ হইয়াছিল। তাহার প্রস্থানের পর আজ * আট বৎসর অতীত প্রায় কিন্তু তাহাদের মনের এমনি অবস্থা যে শত বৎসর অতীত হইলেও যে দিন তাহাদের খোদাতা’লার প্রিয় রসূল তাহাদেরই মধ্যে চলাফেরা করিতেন সেই দিনের কথা তাহারা কখনই ভুলিতে পারিবেন না।

দুঃখ বেদনা মানুষকে দিশাহারা করিয়া তুলে। আমিও হযরত মসীহ মাওউদের (আঃ) মৃত্যুর কথা বলিতে বলিতে কোথায় আসিয়া পড়িয়াছি। আমি বলিতেছিলাম যে, সাড়ে দশটার সময় তাহার প্রাণবায়ু বহির্গত হয়। তখন তাহার পবিত্র লাশ কাদিয়ানে বহন করিয়া লইয়া যাওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়। সন্ধ্যার সময় তাহার জামাতের লোক বিষন্ন মনে লাশ লইয়া গাড়ীতে রওয়ানা হইলেন। যে এলহাম তিনি কিছুকাল পূর্বে সংবাদ পত্রসমূহে প্রচার করিয়াছিলেন এবং যাহাতে বলা হইয়াছিল যে, তাহার লাশ কাফনে জড়াইয়া কাদিয়ানে আনা হইয়াছে আজ সেই এলহাম এইরূপে পূর্ণ হইল। বাটালী পৌছিলে পর লাশ তখনই কাদিয়ানে আনা হয়।

কাদিয়ানে তখন বাহিরের জামাতসমূহের শত শত প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। সকলে হযরত মৌলবী হেকিম নূরুদ্দীন সাহেবকে তাহার খলীফা বলিয়া একবাক্যে স্বীকার করিয়া তাহার হস্তে বয়াত নেন। “আল ওসীয়্যত” নামক পুস্তকে হযরত মসীহ মাওউদ যে ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলেন তাহা এইক্ষণ এইরূপে পূর্ণ হইল। তিনি বলিয়াছিলেন যে, সেই নবীর (হযরত মুহাম্মদের-সাঃ) মৃত্যুর পর খোদাতা’লা যেমন বিশ্বাসীগণের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য হযরত আবু বকর সিদ্দীককে দাঁড় করাইয়াছিলেন,  তাঁহার মৃত্যুর পরও তাঁহার জামাতের জন্য তদ্রুপ একজনকে দাড় করাইবেন। তৎপর খলীফা তাহার ‘জানাযা’ পাঠ করেন। দ্বিপ্রহরের পর তাহার ‘দফন’ কার্য সমাধা হয়। এক্ষেত্রে তাহার আরও একটি এলহাম পূর্ণ হইল।

“২৭শে তারিখে আমার সম্বন্ধে ঘটনা।” এই এলহাম তিনি ১৯০২ সনের সেপ্টেম্বর মাসে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রচারিত করেন। ২৬শে মে ১৯০৮ তারিখ তিনি মৃত্যু বরণ করেন এবং ২৭শে মে তাহার দাফন কার্য সম্পন্ন হয়। উক্ত এলহামের সহিত আর একটি কথাও সন্নিবদ্ধ ছিল। ‘ওয়াক্ত রসিদ’ (সময় আগত)। এক্ষণে ইহার অর্থও পরিষ্কার হইয়া গেল।

তাঁহার মৃত্যুর পর ইংরেজী ও দেশীয় সংবাদ পত্রসমূহে ঘোর মতভেদ থাকা সত্ত্বেও একথা স্বীকৃত হইয়াছে যে, বর্তমান যুগে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী একজন মহা পুরুষরূপে জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন।

বিনীত
মির্যা মাহমুদ আহমদ
কাদিয়ান

__________

*১৯১৬ খৃষ্টাব্দ।

সূত্র: সীরাতে ‘সুলতানুল কলম’ [হযরত ইমাম মাহ্‌দী (আ:)-এর জীবন চরিত] – পৃষ্ঠা: ১০২ – ১০৮