মাসিক মদীনা পত্রিকার প্রশ্নোত্তরের কলামের উত্তর – ইমাম মাহদীর আগমন ও নিদর্শন স্বরূপ চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ


জুন ২০০৩ মাসিক মদীনা পত্রিকায় প্রশ্নোত্তর কলামে হযরত ইমাম মাহদী (আঃ)-এর আগমন প্রসঙ্গে জনৈক ব্যক্তি জানতে চেয়েছেন, “বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ইমাম মাহ্দীর আবির্ভাব সম্পর্কে ব্যাপকভাবে লেখালেখি চলছে। উল্লেখ্য যে, ইমাম মাহ্দীর আবির্ভাবের নিকটবর্তী সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ হবে। কিন্তু খায়রুল হাশর’ নামক কিতাবে উল্লেখিত আছে যে, ইমাম মাহদীর আবির্ভাবের পূর্বেকার রমযান মাসে দু’বার সূর্যগ্রহণ এবং দু’বার চন্দ্রগ্রহণ হবে। বিষয়টি দয়া করে বিস্তারিত জানাবেন।” উত্তরদাতা বলেছেন,

“ইমাম মাহদীর আবির্ভাব হবে, একথা হাদীস শরীফের অনেক বর্ণনায় আছে। মুহাদ্দেসগণ এ হাদীস খানাকে বিতর্কহীন সর্ববাদীসম্মত হাদীসরূপে উল্লেখ করে থাকেন। তার আবির্ভাব চরম হতাশাজনক মুহূর্তে আকস্মিকভাবে ঘটবে। আগেকার কিছু, আলামতের কথা হাদীস শরীফে আছে। তবে চন্দ্রগ্রহণ সূর্যগ্রহণের কথা হাদীস শরীফে এসেছে বলে আমার জানা নেই। কাশফ’ এর অধিকারী সাধক ব্যক্তিগণের বক্তব্য থেকে চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণের কথা জানা যায়। একবার চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ এবং দু’বার গ্রহণের কথা রয়েছে। তবে এগুলি অকাট্য আলামত নয়। সুতরাং খায়রুল হাশর কিতাবের বর্ণনার দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে ফেলা ঠিক হবে না, বরং অপেক্ষা করতে হবে।”

“জুলাই ২০০৩ মাসিক মদীনা পত্রিকায় একই প্রশ্নোত্তর কলামে এক ব্যক্তি জানতে পেরেছেন, “শাহ নিয়ামাতুল্লাহ কাশ্মীরীর ভবিষ্যদ্বাণী পুস্তকে পড়েছি, ৫৬৮ হিজরী সনে বলেছেন, আজ থেকে ৮১৫ বছর পর অর্থাৎ ১৩৮৪ হিজরী সনে ইমাম মাহ্দীর জন্ম হবে। আবার জ্বীন ডিকশনও বলেছেন, ১৯৬২ ইংরেজীর ৪ঠা ফেব্রুয়ারী ইয়ামেনের এক কৃষক পরিবারে তার জন্ম হয়েছে। ২০০৩ ইংরেজী সনের মধ্যে তার আত্মপ্রকাশ ঘটবে। নাজমুল সাহেব মাসিক মদীনায় লিখেছেন, আমি এখনই ইমাম মাহদীর পদধ্বনি শুনতে পাই। সম্পাদক সাহেব এক পর্যায়ে বলেছেন, তাঁর জন্য আমাদেরকে অন্যূন চল্লিশ বছর অপেক্ষা করতে হবে। আমি দ্বিধা – দ্বন্দ্বে ভুগছি। সিদ্ধান্ত চাই। উত্তরদাতা বলেছেন, “মুসলিম উম্মাহর চরম এক দুর্দিনের সময় হযরত ইমাম মাহদীর আবির্ভাব হবে একজন ত্রাণকর্তা নেতৃসুরুষ রূপে। এ বিষয়ে কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকার অবকাশ নেই। তবে তিনি
কখন আবির্ভূত হবেন এ সম্পর্কিত সঠিক তথ্য অর্থাৎ দিন তারিখ বলতে পারে না। কিন্তু আলামত বর্ণনা করা হয়েছে। এসব আলামত বিশ্লেষণ করেই অনেকে বলেন যে, তার আবির্ভাবের সময়টা খুবই নিকটবর্তী।
অনেকেই আসন্ন রমযান মাসের ভিতরে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের ঘটনাকে মাহদীর আগমনের নিশ্চিত আলামত বিবেচনা করতে চান। অনেকেই আবার এ রমযানেই ইমাম মাহ্দী ভূমিষ্ঠ হবেন বলেও অনুমান করেন। মোটকথা সব কিছু অনুমান ছাড়া আর কিছু নয়। এ বিষয়ে জল্পনা কল্পনা করার ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের নিষেধাজ্ঞা আছে। অনেকেই ইমাম মাহদীর আবির্ভাবের দিন তারিখ দিয়ে জল্পনা-কল্পনা জায়েয নয় বলে বলে থাকেন।’

প্রশ্ন এই যে মহাপুরুষের আগমন সম্পর্কে জেনে-বুঝে-চিনে গ্রহণ করার নিমিত্তে হযরত রসূলে করীম (সঃ)-কঠোর নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, “যখন তাঁকে দেখতে পাবে তাঁর হাতে বয়াত করো, যদিও বরফের উপর হামাগুড়ি
দিয়েও যেতে হয়, নিশ্চয় তিনি আল্লাহর খলীফা আল্ মাহ্দী” (সুনানে ইবনে মাজাহ)।

“তোমাদের মধ্যে যে কেউ ইমাম মাহদীকে পাবে তার উপর ঈমান আনবে এবং তাকে আমার সালাম পৌছিয়ে দিবে” (কনফুল উম্মাল)।
“অতঃপর আল্লাহতাআলার খলীফা ইমাম মাহদী আসবেন, তোমরা তাঁর আগমন – বার্তা শুনা মাত্রই তার নিকট হাজির হয়ে বয়াত করবে” (ইবনে মাজাহ্)।
“প্রত্যেক মুসলমানের উপর ওয়াজিব হবে, সর্বতোভাবে ইমাম মাহদীর সাহায্য করা, তার ডাকে সাড়া দেয়া” (আবু দাউদ)।

আল্লাহ্তাআলা বলেন,

“যারা আমার পথে পরিশ্রম করবে, নিশ্চয়ই তাদেরকে আমার রাস্তা দেখাবো” (সূরা আনকবৃত)।

বর্ণিত আছে যে, আল্লাহতাআলার দিকে যে একপা এগিয়ে যায় তার দিকে আল্লাহতাআলা দশ পা এগিয়ে আসেন”। জানা বুঝা এবং চিনার জন্য প্রয়োজন বোধে হযরত রসূল করীম (সঃ) সুদূর চীন দেশে যেতে বলেছেন”। এতদসত্ত্বেও হযরত ইমাম মাহ্দী (আঃ) সম্পর্কে জেনে বুঝে-চিনে গ্রহণ করার পথে বাধার সৃষ্টি করে আলেম-ওলামা মুফতী মাওলানাগণ নিষেধাজ্ঞা জারী করতঃ ফতুয়াবাজী করার পিছনে আসল কারণটা কী? বর্ণিত আছে যে, যখন ইমাম মাহদী (আঃ) যাহির হবেন, মৌলভী মাওলানাগণই তার প্রধান শত্রু হবে। কেননা তারা মনে করবে যে, তাকে মানলে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকবে না। এবং জনসাধারণ ও তাদের মাঝে পার্থক্য উঠে যাবে” (ফতুহাতে মক্কিয়া, ৩৭৩ পৃঃ)।

সত্যানুসন্ধিৎসু ভ্রাতৃবৃন্দের সমীপে নিবেদন, মহান আল্লাহতাআলা বড়ই মেহেরবানীপূর্বক যে জ্ঞান-বিবেক-বুদ্ধি-যুক্তি বিচার-বিবেচনা শক্তি দান করেছেন, সেই বিবেক-বুদ্ধি ও বিবেচনা-শক্তি দ্বারা বর্তমান মুসলিম জাতির করুণ অবস্থা এবং পীর-মুর্শীদ ও আলেম ওলামাদের ক্রীয়াকলাপ একটু গভীরভাবে তলিয়ে দেখুন। অন্যান্য দেশের কথা বাদ দিয়ে আমাদের এই বাংলাদেশেই অগণিত পীর-মুর্শীদ যাদের সংখ্যা নির্ণয় কঠিন। এক পীরের সাথে আরেক পীরের কোন মিল নেই। তাদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করলে মনে হয় যেন তারা নিজেরাই একেকজন একেকটা শরীয়তধারী নবী। আলেমে আলেমে মিল নেই। নেই কোন নেতা, নেই একতা, ভ্রাতৃত্ববোধ যেন চির বিদায় গ্রহণ করেছি। মুসলমান জাতির এরূপ অধঃপতন চরম দুর্দিনে আল্লাহ্‌ তাআলার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আঃ)-কে আখেরী জমানার প্রতিশ্রুত মহাপুরুষ হযরত ইমাম মাহদী ও মসীহ্ মাওউদ (আঃ)রূপে কাদিয়ানের আবির্ভুত করেছেন। তিনি এসে দলাদলি রেষারেষি হিংসা-বিদ্বেষ ঝগড়া-কলহ মারামারি স্বার্থের হানাহানি ইত্যাদি ভুলে গিয়ে এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই হিসাবে সকল প্রকার মতপার্থক্য বিসর্জন দিয়ে আল্লাহতাআলার রজ্জকে দৃঢ় হস্তে ধারণ করতঃ একতাবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানালেন। অনেক ওলামা পীর মুর্শীদ যদি তার ডাকে সারা দিয়ে তাঁর প্রতি ঈমান আনয়ন করে তাহলে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি যাবে নষ্ট হয়ে। থাকবে না ধর্মের নামে পীর মুরীদীর লাভজনক ব্যবসায়। সহজে বিনা পরিশ্রমে আয় রোজগারের পথ যাবে বন্ধ হয়ে। বন্ধ হয়ে যাবে মহা পুণ্য হাসিলের নামে মৌলুদ পড়িয়ে আয়-রোজগার করা। হয়তো বা অনেকেই জানেন যে, হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আঃ) প্রতিষ্ঠিত আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বই-পুস্তক পাঠ করতে আলেম-উলামা মুফতী মাওলানাগণ নিষেধাজ্ঞা জারী করতঃ কাফির হয়ে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে ফতওয়া দিয়ে থাকেন। প্রশ্ন এই যে, এর প্রকৃত কারণ কী? কারণ মাত্র একটাই,  হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আঃ)-কে গ্রহণ করা ব্যতীত আর কোন পথ নেই। আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বই পুস্তক পাঠ করলে জানলে বুঝলে ও চিনলে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন হয়ে ধর্মের নামে তাদের ধোঁকাবাজির মুখোশ উন্মোচন হয়ে যাবে।
আল্লাহতাআলা বলেন,

“বহু সংখ্যক আলেম পীর-মুর্শীদ সেজে জনগণের মাল অন্যায়ভাবে খায় এবং তাদেরকে আল্লাহর রাস্তা থেকে ফিরিয়ে রাখে” (সূরা তওবা)

কোন কালেই আলেম-ওলামা মুফতী মাওলানাগণের কল্পনা ও ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী কোন মহাপুরুষের আগমন হয় নি। যদি তাই হতো তাহলে আবুল হাকাম কখনও আবু জাহলরূপে অভিশপ্ত হতো না। নবী-রসূল
প্রেরণ করা স্বয়ং আল্লাহ্তাআলার কাজ। কোন জ্যোতির্বিদের কল্পনা ও ধারণার কাজ নয়।
আল্লাহতাআলা বলেন,

“ওহী ব্যতীত আল্লাহ্ নশ্বর মানবের সাথে কথা বলেন না, অথবা পর্দার আড়াল থেকে অথবা তিনি রসূল প্রেরণ করেন এবং তিনি যা ইচ্ছা করেন তা তার উপর অবতীর্ণ করেন। নিশ্চয় তিনি মহান ও সর্বজ্ঞ” (সূরা শূরা)।

“তুমি বল, প্রত্যেক ব্যক্তি (তার নিজের পরিণামের) অপেক্ষা করছে। অতএব তোমরাও (নিজেদের পরিণামের) অপেক্ষা করতে থাক এবং অচিরেই তোমরা জানতে পারবে যে, কারা সরল ও সুদৃঢ় পথের অনুসরণকারী এবং কারা হেদায়াতপ্রাপ্ত” (সূরা ত্বা-হা)।

প্রসিদ্ধ সহী হাদীস দারকুতনী ১৮৮ পৃঃ এবং অন্যান্য প্রসিদ্ধ হাদীসে হযরত ইমাম মাহদী (আঃ)-এর আগমন সম্পর্কিত নিদর্শন একই রমযান মাসে চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণের উল্লেখ আছে, যা আলেম উলেমা মুফতী মাওলানাগণ না জানার ভান করে গোপনীয়তা অবলম্বন করতঃ এড়িয়ে চলেন। সেই নির্দ্ধারিত চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ সংঘটিত হয়ে গেছে। যার চোখ আছে সে দেখতে পেরেছে যার কান আছে সে শুনতেও পেরেছে।

হযরত রসূল করীম (সঃ) বলেছেন,

“আমার মাহ্দীর জন্য দু’টি নিদর্শন রয়েছে, যখন হ’তে আল্লাহতাআলা পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তখন হতে এ দু’টি নিদর্শন অন্য প্রত্যাদিষ্ট ব্যক্তি রসূলের সময়ে প্রকাশিত হয় নি। এদের মাঝে একটি এই যে, প্রতিশ্রুত মাহ্দীর যুগে রমযান মাসে চন্দ্রগ্রণ এর প্রথম রাত্রে হবে, অর্থাৎ ত্রয়োদশ তারিখে এবং সূর্যগ্রহণ এর দিনগুলোর মধ্যম দিনে হবে, অর্থাৎ একই রমযান মাসের ২৮ তারিখে। এরূপ ঘটনা পৃথিবীর শুরু হতে কোন রসূল বা নবীর যুগে কখনও প্রকাশিত হয় নি। কেবল প্রতিশ্রুত মাহ্দীর যুগে এটা হওয়া নির্ধারিত।”

হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আঃ) ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিশ্রুত ইমাম মাহ্দী (আঃ)-এর দাবী ঘোষণা করতঃ বয়াত গ্রহণ আরম্ভ করেন। তিনি ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দে মসীহ্ মাওউদ হওয়ার দাবী ঘোষণা করেন। তার দাবীর সত্যতার
নিদর্শনরূপে ১৮৯৪ খ্রীষ্টাব্দে পূর্ব-গোলার্ধে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ সংঘঠিত হয়। এবং ১৮৯৫ খ্রীষ্টাব্দে পশ্চিম-গোলার্ধে অর্থাৎ আমেরিকায় একই রমযান মাসে চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ সংঘটিত হয়ে হযরত রসূল করীম (সঃ)-এর পবিত্র বাণী অক্ষরে অক্ষরে পূর্ণ হয়ে গেছে। কেউ যদি এগুলোকে কানে না তুলে অগ্রাহ্য করে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতে চায় তাহলে এগুলো কখনও মিথ্যা হয়ে যাবে না। হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আঃ) উক্ত
চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণকে নিজের মাহ্দী হওয়ার দলীল সাব্যস্ত করে শত শত বিজ্ঞাপন আরবী, উর্দু, ফার্সি ভাষায় পুস্তক প্রকাশ করতঃ জগদ্বাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন। তাকে অমান্য অগ্রাহ্য ও অস্বীকার করার অর্থ স্বয়ং হযরত রসূল করীম (সঃ)-কে অমান্য অগ্রাহ্য ও অস্বীকার করা। পরিশেষে প্রার্থনা করি সত্যকে জানার, বুঝার, চিনার ও গ্রহণ করার জন্য আল্লাহ্‌তাআলা সকলের হৃদয়-দ্বার উন্মুক্ত করে দিন, আমীন।

-সরফরাজ এম, এ সাত্তার রঙ্গু চৌধুরী

হযরত ইমাম মাহদী (আঃ)-এর আগমন প্রসঙ্গে

পাক্ষিক আহ্‌মদী – নব পর্যায় ৬৬বর্ষ | ৬ষ্ঠ সংখ্যা | ৩০শে সেপ্টেম্বর ২০০৩ইং  | পৃষ্ঠা: ৩১-৩২