IAAAE – উন্নয়নশীল দেশসমূহের সহায়তার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী স্বপ্ন [IAAAE-এর আন্তর্জাতিক সিম্পোজিয়াম ২০২২-এ আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান, পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) এর ভাষণ]

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস

২০-ডিসেম্বর, ২০২২

মসরূর হল, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, যুক্তরাজ্যে

৫ মার্চ ২০২২ ইন্টারন্যাশনাল এসোসিয়েশন অফ আহমদী আর্কিটেক্ট্‌স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স (IAAAE)-এর বার্ষিক সিম্পোজিয়ামে আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান, পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ, হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বক্তব্য প্রদান করেন। সিম্পোজিয়ামটি যুক্তরাজ্যের টিলফোর্ডস্থ, ইসলামাবাদের মসরূর হলে অনুষ্ঠিত হয়। হুযূর আকদাসের ভাষণের বঙ্গানুবাদ নিম্নে প্রদত্ত হল।

তাশাহুদ, তাআব্বুয ও তাসমীয়ার পর হযরত হযরত খলীফাতুল মসীহ আল খামেস (আই.) বলেন:

আল্লাহ্‌র ফযলে আজ IAAAE তাদের বার্ষিক সিম্পোজিয়াম আয়োজনের সুযোগ লাভ করেছে। আমার বিশ্বাস, কোভিডের কারণে আপনাদের বিগত সিম্পোজিয়ামটি ভার্চুয়ালভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল; আর তাই প্রায় তিন বছর পর আপনারা সশরীরে সমবেত হয়েছেন।

যাহোক, আমি দোয়া ও আশা করি যে, অনুষ্ঠানটি আয়োজনের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়েছে এবং এটি অংশগ্রহণকারী সকলের জন্য কল্যাণকর সাব্যস্ত হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ [সকল প্রশংসা আল্লাহ্‌র]। IAAAE সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু অত্যন্ত উঁচুমানের কাজ করেছে এবং মানবজাতির সেবায় এর অবদান বৃদ্ধি করে চলেছে। যদি আপনারা IAAAE এর প্রতিষ্ঠাকাল এবং প্রাথমিক বছরগুলোর দিকে ফিরে তাকান, তবে লক্ষ করবেন যে, আজকের তুলনায় সেই সময়ে এর কর্মকাণ্ডের পরিধি অনেক ক্ষুদ্র ছিল। সেই সময়ে এটি অভাবের মাঝে জীবন ধারণকারীদের সহায়তার উদ্দেশ্যে কিছু ছোটখাটো প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ছোট ছোট ড্রাইসেল ব্যাটারি চালিত বাতি তৈরি করে তা বণ্টন করা। জামা’তের [আহমদীয়া মুসলিম জামা’ত] মধ্যে IAAAE জলসা সালানার সময়ে কিছু সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে সহযোগিতা করে এবং অনুবাদের যে ব্যবস্থা রয়েছে তার উন্নতিকল্পে কিছু প্রয়াস গ্রহণ করে। সেই ক্ষুদ্র সূচনা থেকে সময়ের সাথে সাথে IAAAE-এর কর্মপরিধি বিবর্তিত ও প্রসারিত হতে শুরু করে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু সদস্য বৃহত্তর পরিসরে রুটি প্রস্তুত করার জন্য রাবওয়াহ্‌তে রুটি প্লান্ট তৈরি করার বিষয়ে কাজ করেন। ধীরে ধীরে, কিন্তু সুনিশ্চিতভাবে, এই সংগঠনটি পাকিস্তানের বাইরে ক্রমাগতভাবে উন্নতি লাভ করে এবং এর কর্মকাণ্ডের সম্প্রসারণ করতে থাকে।

এখন আল্লাহ্‌র ফযলে IAAAE এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যেখানে মানবতা এবং জামা’তের সেবায় এটি বেশকিছু উন্নত মানের প্রকল্প এবং বড় আকারের নির্মাণ কাজ হাতে নিয়েছে এবং সম্পন্ন করেছে। উদাহরণস্বরূপ, IAAAE এককভাবে এবং হিউম্যানিটি ফার্স্ট এর মত অন্যান্য সংগঠনের সাথে সহযোগিতামূলকভাবে আফ্রিকায় পানির পাম্প স্থাপন বা মেরামতের মাধ্যমে স্থানীয় মানুষের জন্য পানির পরিষেবা পৌঁছে দিয়ে অত্যন্ত কল্যাণকর কাজ সম্পন্ন করেছে।

উপরন্তু, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, IAAAE প্রত্যন্ত এলাকায় বেশ কয়েকটি ‘মডেল ভিলেজ’ নির্মাণ করেছে, যেগুলো স্থানীয় জনগণের নিকট বেশকিছু নিত্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা ও সেবা পৌঁছে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষেই, ‘মডেল ভিলেজ’-গুলো স্থানীয় জনসাধারণের জীবনের ওপর এক প্রত্যক্ষ প্রভাব সৃষ্টি করেছে এবং উন্নততর জীবন-যাত্রার মান নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় মৌলিক সুবিধাদি প্রদান করে পূর্বাপেক্ষা তাদের জন্য আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্য সৃষ্টি করেছে। এ বিষয়টি অত্যন্ত সন্তুষ্টির কারণ যে, ‘মডেল ভিলেজ’ এবং IAAAE-র অন্যান্য বড় বড় প্রকল্প সম্ভাব্য ন্যূনতম ব্যয়ে সম্পূর্ণ হয়েছে যা নিশ্চিত করেছে যে, আমাদের সীমিত সম্পদ মানবতার সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সেবা এবং কল্যাণে ব্যয় হয়। এ প্রসঙ্গে, আমি অবহিত আছি যে, আপনাদের কতিপয় সদস্য নিরলসভাবে কাজ করেছেন এবং চীন পর্যন্ত সফর করেছেন, যেন সেখানকার স্থানীয় নির্মাতা এবং বিক্রেতাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়, যাতে প্রয়োজনীয় সামগ্রী ন্যূনতম মূল্যে ক্রয় করা সম্ভব হয়। আল্লাহ্‌ তা’লা তাদের সকলের প্রয়াসের সর্বোত্তম পুরস্কার দান করুন যারা IAAAE-র সীমিত সম্পদে অনেক বেশি দূর অগ্রসর হওয়ার বিষয়টিকে বাস্তবে পরিণত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

আমার কাছে প্রেরিত সর্বশেষ রিপোর্ট অনুসারে, বিগত দুই বছরে, নয়টি দেশের মানুষ আপনাদের ‘ওয়াটার ফর লাইফ’ প্রকল্প থেকে কল্যাণমণ্ডিত হয়েছে। এই সময়ে IAAAE শতাধিক পানির পাম্প মেরামত করে কার্যকর পর্যায়ে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছে, এবং এর ফলে আফ্রিকার সবচেয়ে দারিদ্র্যক্লিষ্ট হাজার হাজার মানুষ বিশুদ্ধ পানির সুবিধা লাভ করেছে। আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় কষ্টের বিষয় হল বিশুদ্ধ সুপেয় পানির অভাব, আর তাই, পানি-সরবরাহ-ব্যবস্থা স্থাপনের মাধ্যমে, IAAAE ওই সকল মানুষ যারা দারিদ্র্য এবং বঞ্চনার সবচেয়ে কঠিন শিকার, তাদের জন্য প্রকৃত অর্থেই জীবনকে বদলে দেওয়া এক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। তারা যখন তাদের দ্বারপ্রান্তে প্রথমবারের মতো বিশুদ্ধ পানির প্রবাহ দেখতে পায় তখন তাদের আনন্দ-উচ্ছ্বাসের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

অনুরূপভাবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, জার্মানির IAAAE-র প্রতিনিধিদল মানবজাতির সেবায় এবং তাদের জীবনকে উন্নত করার লক্ষ্যে একগুচ্ছ কল্যাণকর প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বিশেষত, IAAAE এর তড়িৎ প্রকৌশলী এবং টেকনিশিয়ানগণ আফ্রিকার সবচেয়ে প্রত্যন্ত কিছু এলাকায় সফর করেছেন এবং কঠোর পরিশ্রম করে সেই সকল পল্লী অঞ্চলের স্থানীয় জনসাধারণের কল্যাণের জন্য সেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা করেছেন। তারা সেখানে মফস্বল শহর এবং গ্রামগুলোর সামাজিক সমাবেশের স্থানগুলোতে টেলিভিশনের সংযোগ স্থাপন করেছেন, যার মাধ্যমে স্থানীয় জনসাধারণ এমটিএ দেখার সুযোগ পাচ্ছেন, আর এভাবে এই স্থাপনা তবলীগ (ধর্মপ্রচার) এবং তরবিয়ত (নৈতিক প্রশিক্ষণ)-এর মাধ্যম সাব্যস্ত হয়েছে। উপরন্তু, টিভি এবং যোগাযোগ অবকাঠামো স্থাপনের মাধ্যমে, স্থানীয় জনসাধারণ বিস্তৃত পরিসরে বিশ্বের সাথে পরিচিত হচ্ছে এবং সর্বশেষ উন্নয়ন ও প্রযুক্তির জ্ঞান লাভ করছে। সুতরাং, IAAAE-এর প্রচেষ্টা কেবল দুঃখ-কষ্ট ও বঞ্চনার প্রশমনের কারণ হচ্ছে না, বরং শিক্ষা এবং তথ্য সরবরাহের এক উৎসে পরিণত হচ্ছে। আশা করা যায় যে, এই সকল দৃশ্য ও সংবাদ অবলোকন স্থানীয় শিশু-কিশোরদেরকে অনুপ্রাণিত করবে, যেন তারা যত বেশি সম্ভব দীর্ঘ সময় শিক্ষা লাভ করে এবং নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে, যাতে তারা তাদের নিজেদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে এবং তাদের দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে। এভাবে আপনাদের সেবার কেবল স্বল্পস্থায়ী প্রভাব থাকবে না, বরং ইনশাআল্লাহ স্থানীয় মানুষদেরকে নিজেদের শিক্ষিত করে তোলার এবং তাদের দিগন্তকে প্রসারিত করার সুযোগ করে দিয়ে তাদের ওপর দীর্ঘ মেয়াদী সুপ্রভাব রাখতে সমর্থ হবে।

শেষ পর্যন্ত কেবলমাত্র শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমেই বঞ্চিত দেশসমূহে বসবাসকারীগণ সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে এবং প্রজন্মান্তরে দারিদ্র্যের যে দুষ্টচক্র তাদেরকে জর্জরিত করে রেখেছে তা থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে পারবে। এর ফলস্বরূপ IAAAE-এর যে সকল সদস্য সমাজের সবচেয়ে দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষগুলোর শিক্ষার ব্যবস্থা করবেন তারা তাদের দোয়ার উত্তরাধিকারী হবেন এবং নিশ্চিতভাবে আল্লাহ্‌ তা’লার আশিস এবং পুরস্কার লাভ করবেন।

আরো অগ্রসর হয়ে, আপনাদের স্মরণ থাকবে যে, কয়েক বছর পূর্বে আমি আমার এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলাম যে, IAAAE যেন বিশ্বের প্রত্যন্ত এবং বঞ্চিত অংশগুলোতে বিশুদ্ধ পানির সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে, আর আমি আনন্দিত যে, আপনারা এই ক্ষেত্রে অনেক ভালো কাজ করেছেন, যেমনটি আমি ইতোমধ্যেই উল্লেখ করেছি। প্রকৃতপক্ষে, ‘মডেল ভিলেজ’ স্কিমের মাধ্যমে, আপনাদের ওপর প্রাথমিকভাবে অর্পিত কাজকে আপনারা আরো এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

তথাপি, আমরা এখন অত্যন্ত সঙ্গিন ও বিপদসংকুল সময় অতিক্রম করছি, আর তাই IAAAE-এর অবশ্যই পর্যালোচনা এবং মূল্যায়ন করতে হবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কীভাবে এটি মানবজাতির সেবা করতে পারে। বিশেষ করে ইউক্রেনে যা সংঘটিত হচ্ছে এবং রাশিয়া ও পাশ্চাত্য জগতের মধ্যে বর্ধিষ্ণু শত্রুভাবাপন্নতার প্রেক্ষাপটে, বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগময় ও আশঙ্কাজনক। বিশ্বের এক বড় অংশের ওপর এক অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং অশুভ ছায়া বিরাজ করছে আর, খোদা না করুন, যদি বর্তমান সংকট আরও ঘনীভূত হয়, তাহলে তার পরিণাম হবে অচিন্তনীয়। এটি মোটেই বাহুল্য হবে না যদি বলা হয় যে, পৃথিবী ধ্বংসের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে, আর এমন ধ্বংসযজ্ঞ ও বিভীষিকার ভয়াবহ ঝুঁকি রয়েছে যার তুলনা আমরা ইতোপূর্বে দেখি নি। অতএব, IAAAE-এর জন্য মানবতার সেবার ক্ষেত্রে তাদের প্রচেষ্টা বৃদ্ধি করার এবং যাবতীয় সম্ভাব্য পরিণামের জন্য পূর্ব-প্রস্তুতি গ্রহণের এখনই সময়।

বলা হচ্ছে যে, কিছু অতি ধনাঢ্য ব্যক্তি একটি বৈশ্বিক যুদ্ধের ঝুঁকি বিবেচনা করে নিজেদের জন্য অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সমৃদ্ধ বিশালায়তন ভূতল বাংকার নির্মাণ করেছেন। এমন বাঙ্কারসমূহ ওই কতক বিশেষ সুবিধাভোগী মানুষকে হয়তো রক্ষা করতে পারে, কিন্তু বাকি মানবতার পরিণাম কী হবে? উপরন্তু, যারা ভূগর্ভস্থ স্থাপনায় গিয়ে নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হবেন, তাদের এই অলীক ধারণা পোষণ করা উচিত নয় যে, কোনো শক্তিশালী বাঙ্কার তাদেরকে একটি বিশ্ব-যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণাম থেকে সুরক্ষা দিবে। কারও জন্য, ভূগর্ভে একাকী জীবনযাপন করার ফলে তাদের মাঝে নানা রকম মানসিক স্বাস্থ্য-সমস্যা, হতাশা এবং উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা দেখা দিবে। অধিকন্তু, সেসব ধনী ব্যক্তি যখন তাদের বাঙ্কার থেকে বের হয়ে আসবেন এবং দেখতে পাবেন যে, জীবনধারায় আমূল পরিবর্তন এসেছে, তখন তারা কী করবেন? যখন তারা দেখতে পাবেন যে, সেই সব দরিদ্র লোকজন, যাদের ওপর তারা দিন-রাত নির্ভর করতেন, তারা এরই মাঝে মৃত্যু কিংবা পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন এবং বিশ্ব জুড়ে অন্ধকারের মেঘ ছেয়ে গেছে, তখন তারা কী করবেন? এমতাবস্থায় সকল মানুষের, তারা ধনী হন বা দরিদ্র, অনুধাবন করা উচিত যে, আজ যা সংঘটিত হচ্ছে তা সকলকে প্রভাবিত করার সম্ভাবনা রয়েছে এবং মানবজাতির ভবিষ্যৎ এক সুগভীর ঝুঁকির মুখে রয়েছে। একদিকে, যেখানে আমাদের অবশ্যই দোয়া করতে হবে যেন বিশ্ব-নেতাদের বোধোদয় হয় এবং সময় থাকতেই তারা উত্তেজনার লাগাম টানেন। তেমনিভাবে, খোদা না করুন, যদি কোনদিন এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি এসেই যায়, তবে সমাজের পুনর্গঠনে সামনের সারিতে কাজ করার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।

সুনিশ্চিতভাবে, এ রকম যুদ্ধের পরিণামে, বিশ্বকে তিল তিল করে পুনর্গঠনে মানবজাতি এক বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। আর আহমদী মুসলমান হিসেবে, আমাদের কর্তব্য হবে, সেই প্রচেষ্টার একেবারে সামনের সারিতে থাকা। সুতরাং, প্রথম ধাপ হিসেবে IAAAE-এর উচিত হবে একটি বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা যে, কীভাবে স্বল্প খরচে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধাসহ আবাসন দ্রুত গতিতে নির্মাণ করা সম্ভব, যেন ঘরহারা মানুষের পুনর্বাসন করা সম্ভব হয়। এমন একটি পরিকল্পনা কেবল বর্তমান পরিস্থিতির অবনতির ক্ষেত্রেই কাজে লাগবে এমন নয়; বরং, এমনকি স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও, আমাদের আহমদী স্থপতিদের মানসম্মত সুযোগ-সুবিধাসহ স্বল্প-খরচের আবাসনের বিষয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত; কেননা, এটি জামা’তকেও এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করবে। অনুরূপভাবে, আপনাদের এমন পরিকল্পনা প্রস্তুত করা উচিত, যা নিশ্চিত করবে যে, আমাদের মসজিদ, মিশন হাউস এবং অন্যান্য স্থাপনাসমূহ যেন সম্ভাব্য সর্বনিম্ন খরচে এবং দীর্ঘস্থায়িত্বকে বিবেচনায় রেখে উন্নত মানসম্পন্নভাবে নির্মাণ করা হয়।

যদি, খোদা না করুন, বৃহত্তর পরিসরে কোন যুদ্ধের সূচনা হয়, তবে আমরা কেবল আশা এবং দোয়া করতে পারি যেন, এমনটি হয় যে, অন্তত কিছু কিছু অঞ্চল ধ্বংসযজ্ঞ এবং গোলযোগ থেকে মুক্ত থাকে। উদাহরণস্বরূপ, এমন হতে পারে যে, আফ্রিকান দেশসমূহ, কতিপয় দ্বীপ এবং কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চল সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তদনুসারে, আমাদের এমন একটি ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে যেখানে পশ্চিমা বিশ্বের আপেক্ষিক শান্তি ও নিরাপত্তার ওপর নির্ভর করা আর সম্ভবপর হবে না; আর তাই মানবতার চাহিদা পূরণের জন্য, বিশ্বের অন্যান্য অংশের উন্নয়ন আমরা কীভাবে করতে পারি তা আমাদের পর্যালোচনা করা উচিত। আমাদের বিবেচনা ও চিন্তা করা উচিত যে, আমরা কীভাবে সেইসব স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে পারি, যেন তারা নিজেদেরকে ঋণের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে পারে এবং মর্যাদা ও সম্মানের সাথে দাঁড়াতে পারে। পৃথিবীর দরিদ্রতম এবং সবচেয়ে সুবিধা-বঞ্চিত দেশগুলোকে সাহায্য করার জন্য আমাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানো উচিত; যেন কেবলমাত্র বৃহৎ শক্তিসমূহের উচ্ছিষ্ট বা দানের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে, তারা উঠে দাঁড়াতে পারে এবং এবং বিশ্বকে পথ দেখানোর ও বিশ্বের ভবিষ্যৎ উন্নয়নে তাদের নিজ নিজ ভূমিকা পালন করার মত অবস্থানে থাকতে পারে।

ফলস্বরূপ, IAAAE-কে অবশ্যই একটি দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি মাথায় রেখে কাজ করতে হবে। এমনকি যদি কোনভাবে বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বৈশ্বিক টানাপোড়েনের কোন প্রকার সমাধান হয়েও যায়, তবুও আমাদের জামা’ত এবং একটি সংগঠন হিসেবে IAAAE-এর সর্বদা ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা করা উচিত এবং দেখার চেষ্টা করা উচিত উন্নয়নশীল বিশ্বের অবস্থাকে উন্নত করার জন্য আমরা কী ভূমিকা পালন করতে পারি। আমাদের পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করা উচিত যে, উন্নয়নশীল দেশগুলি কীভাবে তাদের সীমিত সম্পদ সর্বোত্তম সম্ভাব্য অবকাঠামো, প্রযুক্তি এবং পরিষেবাসমূহ অর্জনের জন্য ব্যবহার করতে পারে। এটিকে আপনাদের নিজেদের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করা উচিত যে, যেসব জাতি অন্তহীন ঋণ, দারিদ্র্য ও দুর্দশায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে, তারাও যেন একদিন অগ্রসর ও শিল্পোন্নত জাতিসমূহের পাশাপাশি সমমর্যাদার স্থান দখল করে নিতে পারে, ইনশাআল্লাহ।


শেষ করার পূর্বে আমি আরো উল্লেখ করতে চাই যে, IAAAE নাইজেরিয়াতে একটি টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট নির্মাণ করছে, আর আমি দোয়া করি যেন আপনারা যথা শীঘ্র সম্ভব এই প্রকল্প শেষ করতে সমর্থ হন এবং এর পরে একে সর্বোত্তমভাবে পরিচালনা করেন। আমি দোয়া করি যেন নাইজেরিয়ার মানুষ এবং আফ্রিকা মহাদেশের সমস্ত এলাকার মানুষ যেন এ থেকে অশেষ কল্যাণমণ্ডিত হতে পারেন। উপরন্তু, আমি প্রত্যাশা রাখি যে, এই ইন্সটিটিউটটি IAAAE এর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত অনেকগুলি ইনস্টিটিউটের মধ্যে প্রথম সাব্যস্ত হবে, যেগুলো স্থানীয় জনসাধারণের প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষা সেবায় নিয়োজিত হবে, যেন তারা নিজেদের দু’ পায়ে দাঁড়াতে পারেন এবং তাদের নিজেদের দেশ ও জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে এক প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে পারেন। তাদের দারিদ্র্যক্লিষ্ট পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত তাদের সকল নৈরাশ্য এবং উদ্বেগ চিরতরে বিলীন হয়ে যাক।

উপরন্তু, যদি এবং যখন তাদের পরিস্থিতির উন্নতি হয়, আমি দোয়া করি যেন তাদের মাঝে সেইরূপ স্বার্থপর কর্মপন্থা এবং লোভ বিকশিত না হয়, যা পরাশক্তিগুলোর একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিঃসন্দেহে ধনী ও শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর সীমাহীন লোভের কারণেই তারা দুর্বল রাষ্ট্রসমূহের ওপর তাদের আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা করে এবং অন্যের সম্পদ থেকে অন্যায়ভাবে লাভবান হওয়ার জন্য সদা তৎপর থাকে। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, রাশিয়া, পশ্চিমা বিশ্ব বা অন্যান্য পরাশক্তিগুলোর যে কোনটির পক্ষ থেকেই হোক না কেন, অর্থ ও সম্পদের জন্য এই অবিরাম আকাঙ্ক্ষাই মানবজাতিকে এমন একটি বিপজ্জনক পথে পরিচালিত করেছে, যা বিশ্ব-শান্তিকে ধ্বংস করার জন্য হুমকি স্বরূপ। সুতরাং, আমাদের সবাইকে অবশ্যই আল্লাহ্‌ তা’লার কাছে এই বর্তমান সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য আন্তরিকভাবে দোয়া করতে হবে।

আমি এটাও বলতে চাই যে, আল্লাহ্ না করুন, যদি বিশ্বের রাজনৈতিক শক্তিগুলো বিশ্বকে যুদ্ধ ও ধ্বংসের জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের দিকে ঠেলে দিতে বদ্ধপরিকর থাকে, তাহলে আহমদী মুসলমান হিসেবে আমাদের কাজ হবে, সেই সময়ে ছিন্ন-ভিন্ন টুকরোগুলোকে একত্র করা এবং মানবজাতির জ্বলন্ত ক্ষতের ওপর এক প্রশমনকারী সুশীতল মলম প্রয়োগ করার জন্য প্রস্তুত থাকা। সমাজ পুনর্গঠনে এবং মানবজাতিকে আরও অশান্তি ও দুঃখ থেকে রক্ষা করার জন্য সংগ্রাম করা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হবে। সুতরাং, বর্তমান সংঘাত প্রশমিত বা ঘনীভূত হওয়া নির্বিশেষে, যেভাবে আমি বলেছি, আফ্রিকা এবং পৃথিবীর অন্যান্য বঞ্চিত এলাকার মানুষকে যথাসম্ভব সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা, অবকাঠামো ও প্রশিক্ষণ প্রদানে আমাদেরকে সচেষ্ট হতে হবে, যেন তারা ভবিষ্যতে উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হতে পারে, ইনশাআল্লাহ।

হয়তোবা আপনাদের কেউ কেউ মনে করবেন যে, আমি যা বলছি তা আপনাদের নাগালের অনেক বাইরে। তথাপি, যদি আমরা আন্তরিক এবং পরিপূর্ণভাবে নিবেদিত হয়ে থাকি, তবে আমি দৃঢ় বিশ্বাস রাখি যে, আল্লাহ্‌ তা’লার সাহায্যে আমরা এমন কার্যকর পরিকল্পনা এবং বৃহদাকার প্রকল্প দাঁড় করাতে সক্ষম হবো যে, সরকারসমূহ এবং বিশ্ব-নেতৃবর্গ আমাদের সহায়তা ও দক্ষতা কামনা করবে, ইনশাআল্লাহ।

এই কথাগুলোর সাথে, আমি দোয়া করি যেন আল্লাহ্‌ তা’লা আপনাদেরকে আপনাদের প্রখর মস্তিষ্ক, খোদাপ্রদত্ত মেধা এবং যোগ্যতা দ্বারা IAAAE-এর বিভিন্ন প্রকল্পকে সর্বদা উন্নত এবং এগুলোর পরিসর বা ব্যাপ্তি আরও প্রশস্ত করার সামর্থ্য দান করেন। যেখানে আপনারা বর্তমানে বিশ্বের বঞ্চিত অংশগুলোতে বাসকারী মানুষের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করছেন, আমি দোয়া করি যে IAAAE আরো সুদুরপ্রসারী উদ্যোগসমূহ গড়ে তোলার মাধ্যমে এখন তার উন্নতির পরবর্তী স্তরের যাত্রা শুরু করবে, যেগুলো কয়েক প্রজন্ম জুড়ে বিশ্বকে কল্যাণমণ্ডিত করবে। আল্লাহ্‌ তা’লা আপনাদেরকে এমনটিই করার দূরদৃষ্টি এবং সক্ষমতা দান করুন। পরিশেষে আমি দোয়া করি, যেন আল্লাহ্ তা’লা IAAAE-এর সকল সদস্যকে বিগত কয়েক বছরের অনুরূপ নিষ্ঠা ও নিবেদনের সাথে কাজ করে যাওয়ার তৌফিক দান করেন, এবং তিনি যেন আপনাদের সকলকে আপনাদের ঐকান্তিক প্রয়াসসমূহের জন্য পুরস্কৃত করেন। আমীন। জাযাকাল্লাহ্‌ [আল্লাহ্‌ পুরস্কৃত করুন]।

অনুবাদ: আব্দুল্লাহ শামস বিন তারিক