ইসলামে খেলাফতের গুরুত্ব


আলহাজ্জ এ. কে. রেজাউল করীম

ইসলামে খেলাফতের গুরুত্ব ও কল্যাণ সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমেই দেখতে হবে যে, খিলাফত সম্পর্কে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন কুরআন মজীদে কী এরশাদ করেছেন।

কুরআন মজীদের সূরা নূর-এ আল্লাহ্ বলেনঃ

“ওয়াদাল্লাহুল্লাযীনা আমানু মিনকুম ওয়া আমেলুস্ সালিহাতে লা’ ইয়াস্ তাখলিফান্নাহুম ফিল আরজে কামাস্ তাখলাফাল্লাযিনা মিন্ ক্বাবলিহিম” (সূরা নূরঃ ৫৬)
অর্থাৎ তোমাদের মাঝে যারা ঈমান আনবে, এবং সৎকার্যসমূহ সম্পাদন করবে, আল্লাহ্ তাদের সাথে ওয়াদা করছেন যে, তিনি তাদেরকে পৃথিবীতে খিলাফত দান করবেন, যেমন ভাবে তাদের পূর্ববর্তীদেরকে খিলাফত দান করেছিলেন।

এ খিলাফত কী? খলীফা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কী ধারণা? আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে, সমাজে, গ্রাম এলাকায় এর অবস্থান কী আসুন তা’ তলিয়ে দেখি।

আমাদের দেশে বাংলা ভাষায় কুরআন মজীদের বহু অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কুরআন মজীদের খিলাফত সম্পর্কিত উপরোক্ত আয়াতটির অর্থ খুঁজতে ক’টি অনুবাদ পাঠে এ শব্দটির অর্থ সম্পর্কে উদাসীনতা পরিদৃষ্ট হয়। ঢাকার বিখ্যাত এমদাদিয়া লাইব্রেরী নূরানী কুরআন শরীফ নামে মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর মূল থেকে মাওলানা নূরুর রহমান সাহেব যে বাংলা তরজমা করেছেন, তাতে খিলাফত শব্দের অর্থ করা হয়েছে ‘আধিপত্য দান’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের অধ্যাপক ডঃ মুস্তাফিজুর রহমান সাহেব (খোশরোজ কিতাব মহল থেকে প্রকাশিত) একই শব্দের অর্থ করেছেন, ‘রাজত্ব দান’। মৌলানা ফজলুর রহমান ও মৌলানা আবুল কালাম আযাদ সাহেবরা করেছেন ‘শাসন কর্তৃত্ব দান’। আর আরবী ডিকশনারী ও অধিকাংশ মোফাচ্ছেরীনের মতকে গ্রহণ করে হযরত ইমাম মাহ্‌দী (আঃ) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামা’ত এ শব্দটির অর্থ করেছে-‘খলিফা নিযুক্ত’ বা খিলাফত প্রতিষ্ঠা করবেন। আমার ধারণা-এ খিলাফত বা খলীফার অর্থ নিয়ে বিপত্তি বলে আজ অধিকাংশ আলেমগণ বা মুসলমানগণ এর প্রয়োগ, অবস্থান ও কল্যাণ সম্পর্কে উদাসীন। এ যে ইসলামের জন্য নেয়ামত বা সঞ্জীবনী সুধা তা’ সত্যিকারভাবে অনুধাবন করতে পারছে না বলেই হয়তবা বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে যারা জামা-কাপড় সেলাই করে তাদেরকে দর্জি বা খলীফা বলা হয়। আবার কোন কোন অঞ্চলে যারা নৌকার ছই বা থাকার ঘর বানায়, তাদেরকেও ছইয়াল বা খলীফা বলে। বিষয়টাকে এতই ফেলনা মনে করা হয় যে, কোন কোন অঞ্চলে যারা খতনা করার কাজ করে, তাদেরকেও হাযাম বা খলীফা বলা হয়।

আবার আমাদের বাংলাদেশে বা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর পীর সাহেবদের প্রতিনিধিকেও খলীফা বলা হয়। পীর সাহেব হন খলীফার নিয়োগদাতা। তিনি তার জীবদ্দশাতেই এ নিয়োগদান করেন। অবচেতন আত্মা এ নেয়ামতের প্রয়োজন অনুভব করে বলেই হয়ত এমনটি করা হয়। দুনিয়ার কোন কোন দেশে রাজনৈতিক দল গঠন করেও ইসলামে এর অত্যাবশ্যকীয়তা প্রকাশ করা হয়। নিজ নিজ আধিপত্য বিস্তার ও অর্থ সম্পদের লোভ-লালসা আজ মুসলমানদেরকে আল্লহ্ প্রদত্ত নেয়ামত খুঁজে পাওয়া থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। আর এ জন্যই পৃথিবীতে আজ মুসলমানরা অন্য ধর্মের মানুষের কাছে মারও খাচ্ছে।

এখন প্রশ্ন হলো, আমরা যে খিলাফত বা খলীফার কথা বলব, তার অর্থ কারো পিছন পিছন আসা বা স্থলাভিষিক্ত হওয়া। আর এর নিয়োগ দাতা আল্লাহ্-আর তিনি (আল্লাহ্) মুমেনদের সাথে এ ওয়াদা করেছেন।

নবী আসেন মানুষকে ঈমানদার, খোদার হুকুম পালনকারী বান্দা বানানোর জন্য। নবী যে সব কাজ মানুষের কল্যাণের জন্য করেন, তারই ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন খলিফা। এজন্য নবীর ইন্তেকালের পর আল্লাহ্ তাঁর অনুগত বান্দাদের মধ্যে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত করেন। খলীফা বানানো আল্লাহ্‌র কাজ। মানুষ খলীফা বানালে, সে মানুষেরা আল্লাহ্‌র সাহায্য পাবে কিভাবে? আল্লাহ্ এ ব্যবস্থা রেখেছেন যে, নবী রাসুলগণের রূহানী সত্তা বা রূহানী ফয়েজ যেন পৃথিবীর ঈমানদার মানুষের মধ্যে বিরাজমান থাকে। তাই খলীফা বা খেলাফতের দায়িত্ব সম্পর্কে প্রত্যেকটি মু’মেনের স্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরী। মু’মিনদের জন্যে নবূওয়াতের পর যে বিষয়টি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য তা’ হচ্ছে খিলাফত।

নবুওয়াতের দায়িত্ব যেমন হাঈয়ুন ও কাঈয়ুম, ওয়াহেদ ও লা-শরীক খোদার প্রকাশ্য অস্তিত্ব পেশ করা, মানব হৃদয় ও মানব বুদ্ধির আকাশে ঐশী আলোর বন্যা প্রবাহিত করা; মানুষের মন ও মেধা, বোধ ও বোধির পবিত্রতা-পরিপক্কতা সাধন করা এবং মানুষকে আল্লাহ্-মিলনের সরল পথে অবিচলরূপে পরিচালিত করা। খেলাফতের দায়িত্বও ঠিক তাই। নবুওয়াতের মাধ্যমে যেমন খোদা তাআলার শক্তি ও মহিমার প্রকাশ ঘটে, খেলাফতের মাধ্যমেও তেমনি খোদা তাআলার শক্তি ও মহিমার পুন:প্রকাশ ঘটে। এ যুগে আগমনকারী প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ (আঃ) বলেছেন, “খোদা তা’আলা দুই প্রকার ‘কুদরত’ বা শক্তি ও মহিমা প্রকাশ করেন। প্রথমে নবীগণের মাধ্যমে তাঁর কুদরতের এক হস্ত প্রদর্শন করেন, আবার যখন নবীর মৃত্যুর পর বহুবিপদ-আপদ উপস্থিত হয় এবং দুশমন শক্তি লাভ করে মনে করতে থাকে যে, এই (নবীর) কার্য ব্যর্থ হয়ে গেছে। ……………..তখন খোদা তা’আলা পুনরায় তাঁর মহাশক্তির প্রকাশ ঘটান এবং পতনোন্মুখ জামা’তকে রক্ষা করেন। অতএব, যাঁরা ধৈর্য ধারণ করেন তাঁরাই খোদা তা’আলার সেই মোজেযা প্রত্যক্ষ করেন, যেমন করেছিলেন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) এর সময়ে।

আসুন! এখন দেখি খলীফা কিভাবে নির্বাচিত হন?

আল্লাহ্‌ তা’আলা কুরআন শরীফে বার বার উল্ল্যেখ করেছেন যে, তিনি নিজেই তাঁর খলীফা নির্বাচন করেন। যেমন বলেছেন, ‘ইন্নি জাইলুন ফীল আরযে খলীফা’ (সূরা বাকারাঃ ৩১) নিশ্চয় আমি পৃথিবীতে খলীফা/খেলাফতঃ কায়েম করতে চলেছি। সূরা নূর আয়াত ৫৬-এ আল্লাহ্ খিলাফত প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেনঃ তিনি খলীফা মনোনীত করবেন বা খিলাফত প্রতিষ্ঠিত করবেন যেমন তিনি পূর্ববর্তীদের মাঝে করে আসছেন। এতে এটা স্পষ্ট যে, তিনি উম্মতে মুহাম্মদীয়ার মাঝেও খিলাফত প্রতিষ্ঠিত করবেন। এ ওয়াদা সর্বশেষ ধর্মগ্রন্থ আল কুরআনে দেয়া হয়েছে। তাই, এটা উম্মতে মুহাম্মদীয়ার জন্য, অতীত উম্মতের জন্য নয় এ কথা বলাই বাহুল্য।

সাধারণত খিলাফত বা খলীফা দু’রকমে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে থাকে। প্রথমত-নবীউল্লাহ্ খলীফাতুল্লাহ্। খলীফাতুল্লাহ্ নবী সরাসরি ওহীর মাধ্যমে নির্বাচিত বা মনোনীত হন। এ অর্থে সকল নবী রসূলগণ আল্লাহ্‌র খলীফা বা খলীফাতুল্লাহ্। দ্বিতীয়ত-খলীফাতুল্লাহ্ নবীউল্লাহ্‌র ইন্তেকালের পরে তাঁর অনুগত জামাতের মধ্যে আল্লাহ্ ‌তা’আলা একজনকে খলীফা হিসাবে নির্বাচন করেন। ইনি খলীফাতুর রসূল হন।

হযরত মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন, তোমাদের ধর্ম শুরু হয়েছে নবুওয়তের মাধ্যমে। আল্লাহ্ যতদিন চান, তা’ কায়েম থাকবে, তারপর খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে, আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় এ খিলাফত উঠে যাবে এবং রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় এ রাজতন্ত্রও নানাভাবে চলার পর তা-ও একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে এবং আবার ‘খিলাফত আলা মিনহাজেন নবুওয়ত’ অর্থাৎ নবুওয়ত পরবর্তী খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে। এ ধারার খেলাফতের সময় পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। এখানে বলা প্রয়োজন যে, হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর যে খেলাফতে রাশেদার কথা আমরা জানি তার আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র ত্রিশ বা বত্রিশ বছর এবং এভাবে হযরত রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর ভবিষ্যদ্বানীটি পূর্ণ হয়েছে।

হযরত মুহাম্মদ খাতামাননাবীঈন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সবচেয়ে প্রিয় সাহাবী, উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হযরত আবু বকর (রাঃ) সকল খলীফাগণের মাঝে সর্বোচ্চ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ খলীফা ছিলেন। কুরআন মজীদে বিভিন্ন আয়াতে তার প্রশংসার কথা উল্ল্যেখ আছে। পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর যুগে প্রথম দিকে মনে হয়েছিল যে, মুসলিম জাহানের মাঝে কোন শৃঙ্খলা বা একতা বা শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। কিন্তু অল্পকাল পরেই দেখা গেল শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে এবং সমস্ত মুসলিম জাহান একতাবদ্ধ হয়েছে। তারপর প্রমাণিত হয়েছে যে, হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর যুগই শ্রেষ্ঠ যুগ ছিল।

আমি যে হাদীসটি উল্ল্যেখ করেছি, তারই পথ বেয়ে খোদার প্রতিশ্রুতি ও তার রাসূল (সাঃ) এর ভবিষ্যদ্বানী পূর্ণ করে হযরত মীর্যা গোলাম আহ্‌মদ কাদিয়ানী এ যুগে, এ উম্মতে আল্লাহ্‌র খলীফা ইমাম মাহ্‌দী ও প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ (আঃ) হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। হযরত ইমাম মাহ্‌দী ও প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ আলাইহেস সালামের ইন্তেকালের পর ১৯০৮ সনের ২৭শে মে তারিখে কায়েম হয়েছে ‘খিলাফত আলা মিনহাজেন নবূওয়াত’।

এ খেলাফতের অর্থাৎ আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামাতের প্রথম খলিফা হলেন হাফেয মৌলানা হাজীউল হারামাইন শরীফাইন হেকিম নূরুদ্দীন সাহেব (রাজীঃ) আর সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমান ও পঞ্চম খলিফা হচ্ছেন আমীরুল মুমেনীন সায়্যেদেনা হযরত মীর্যা মাসরূর আহ্‌মদ (আই:)।

হযরত খলীফা আউয়াল (রাঃ) বলেন,

‘আমি খোদার কসম খেয়ে বলছি, আমাকেও খোদা খলীফা বানিয়েছেন, যেমন তিনি আদম (আঃ) এবং আবু বকর (রাঃ) ও ওমর (রাঃ) কে খলীফা বানিয়েছেন।’ ( বদর, ৪ জুলাই ১৯১২ ইং)

তিনি আরো বলেন,

‘আমাকে যদি কেউ খলীফা বানিয়ে থাকে, তবে খোদা তা’আলা বানিয়েছেন এবং নিজ প্রজ্ঞার মাধ্যমে বানিয়েছেন। খোদার মনোনীত খলীফাকে কেউ পদচ্যুত করতে পারে না।………ঐ ব্যক্তি মিথ্যুক, যে বলে আমরা খলীফা বানিয়েছি।’ (আল হাকাম, ২১ জানুয়ারী ১৯১৪ ইং, আল ফযল লন্ডন, ২১ জানুয়ারী ২০০০ইং)

আসুন, এ খেলাফতের কল্যাণ সম্পর্কে কিছুটা বলে আমার বিষয়বস্তুর আলোচনা শেষ করি। খিলাফত মূলতঃ এরূপ তৌহীদের প্রতিফলন বা বিকাশ যে, আল্লাহ্ তা’আলা মানব জাতিকে একজন ইমামের হাতে একত্রিত করে রাখতে চান, দেখতে চান। তাই নবী প্রেরণ করেন। নবীর পরে খিলাফত কায়েম করেন। প্রত্যেক মানুষকে পৃথক পৃথক করে হেদায়েত, রহমত, বরকত নাযেল করা তৌহীদের বিপরীত। আল্লাহ্ অতি মহান। তিনি মানুষকে একা একা জীবন যাপনের সুযোগ দেননি।

হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ) তাঁর মৃত্যুর পর আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর জামাতের মাধ্যমে যে খিলাফত কায়েম করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সে সম্পর্কে লিখেছেনঃ

“অতএব, হে বন্ধুগণ! যেহেতু আদিকাল হতে আল্লাহ্ তা’আলার বিধান এই যে, তিনি দুটি কুদরত বা শক্তি প্রদর্শন করেন। যেন বিরোধীদের দু’টি মিথ্যা উল্লাসকে ব্যর্থ করে দেন। অতএব এখন এটা সম্ভবপর না যে তিনি তাঁর চিরন্তন নিয়ম পরিহার করবেন। কারণ তোমাদের জন্য দ্বিতীয় কুদরত দেখাও প্রয়োজন এবং উহার আগমন তোমাদের জন্য শ্রেয়। কেননা উহা স্থায়ী, যার ধারাবাহিকতা কিয়ামত পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হবে না। সেই দ্বিতীয় কুদরত আমি না যাওয়া পর্যন্ত আসতে পারে না। (অর্থাৎ খিলাফত)। আমি যখন চলে যাব তখন খোদা তোমাদের জন্য সেই দ্বিতীয় কুদরত (খিলাফত) প্রদান করবেন, যা চিরকাল তোমাদের সঙ্গে থাকবে।” (আল ওসীয়্যত; অনুবাদ-সেপ্টেম্বর, ১৯৯১সংস্করণ, পৃষ্ঠাঃ ১৫)

হযরত খলীফাতুল মসীহ রাবে (রাহেঃ) বলেছেনঃ

“খেলাফতের প্রতিশ্রুতি শর্তসাপেক্ষ, এ পুরস্কার কেবল তারাই পেতে পারে যারা রাতদিন সৎকর্ম ও ন্যায়পরায়ণতার মাঝে অতিবাহিত করে। সুতরাং প্রত্যেক আহ্‌মদীর কর্তব্য নিজ জীবনকে সৎকর্ম ও ন্যায়পরায়ণতার মধ্যে পরিবেষ্টিত করে রাখে, যেন খিলাফত পুরোদমে পুরোশক্তির সাথে বিস্তৃত ও প্রসারতা লাভ করে, এমন গাছের মত দৃঢ় হয়ে যায়, যার শাখা প্রশাখা আকাশে চলে যায় এবং শিকড় মাটিকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে থাকে।” (খুতবা জুমুআ ১১ই জুন ১৯৮২ ইং, আলফযল ২২ জুন ১৯৮২ ইং পুনরায় ৬ ফেব্রুয়ারী ২০০১ ইং)

সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে এ অনন্য ও ঐতিহাসিক খেলাফতের নেতৃত্বে বিভিন্ন ব্যবস্থাপনাসমূহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছেঃ

(ক) নেযামে ওসীয়তঃ

হযরত ইমাম মাহ্‌দী ও মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর অনুসারীরা নিজেদের উপার্জনের ১/৩ ভাগ থেকে শুরু করে কমপক্ষে ১/১০ ভাগ হারে নিয়মিত চাঁদা দেবেন এবং স্বেচ্ছায় নিজ নিজ সম্পত্তিরও এ হিসাবে অংশ প্রদান করবেন।

এ বিপুল অর্থে বিশ্বের দারিদ্র পীড়িত মানুষগুলোর জীবন-জীবিকা, বাসস্থান, বস্ত্র, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা সম্বলিত এক নূতন আদর্শ ইসলামি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। এটি হবে খলীফার নেতৃত্বাধীন সুদবিহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায়ও সাহায্যের ব্যবস্থা থাকবে। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে ভিক্ষুকবিহীন বিশ্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। কোন অভাবী বৃদ্ধ, বিধবা অনাহারে থাকবে না। এ কার্যক্রম তৌহীদ ও ইসলাম প্রচারের অতিরিক্ত ও আনুসঙ্গিক হবে।

এ ব্যবস্থাটির অধীনে এ যাবত বহু আহ্‌মদী তাদের ধন সম্পদ দান করে এ ব্যবস্থাকে অগ্রগামী করেছেন। বর্তমান খলীফার ইচ্ছা চলমান খেলাফতের শতবর্ষ পূর্তি উৎসবে আহ্‌মদীয়া জামাতের উপার্জনশীল অর্ধেক সদস্যই এ ব্যবস্থার অধীনে চলে আসবেন।

(খ) নেযামে বায়তুল মালঃ

এ ব্যবস্থায় অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রত্যেক আহ্‌মদী মুসলমান (যারা হযরত ইমাম মাহ্‌দী (আঃ) বা তাঁর খলীফার হাতে বয়েত করেছেন) স্বেচ্ছায় তার উপার্জনের ১/১৬ ভাগ হারে চাঁদা দেবেন। এতে কুরআন মজীদে বর্ণিত ‘ওয়া মিম্মা রাযাকনাহুম ইউনফেকুন’ অর্থাৎ রিযক থেকে আল্লাহ্‌র রাস্তায় দান-নির্দেশের বাস্তবায়ন হবে। এ অর্থে সারা বিশ্বে তৌহীদ ও সুন্নাহ্‌র প্রচার ও প্রতিষ্ঠা হবে। জামা’ত ব্যবস্থাপনার সকল ব্যয় এ অর্থে নির্বাহ হবে। বর্তমানে আহ্‌মদীয়া জামাতে এ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।

(গ) কাযাবোর্ডঃ

পৃথিবীর যে সব দেশে এ পর্যন্ত জামা’ত প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, সে সব দেশে জামাতে আহ্‌মদীয়ার সদস্যদের বিবিধ অভিযোগ ও বিরোধ মীমাংসার জন্য রয়েছে এ কাযা বোর্ড। এ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ফলে রাষ্ট্রীয় আইনে মোকদ্দমা দায়ের করার প্রয়োজন হয় খুব কম। যে সব বিষয়ে রাষ্ট্রীয় আইনের আশ্রয় নেয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়, সেখানে আইন-আদালতে যাবার অনুমোদন দেয় জামা’ত। তবে কোন বিষয় আদালত পর্যন্ত গড়ালে তাতে জামা’ত হস্তক্ষেপ করে না। এ কাযা বোর্ডের কল্যাণে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে না।

(ঘ) অঙ্গসংগঠন সমূহঃ

চল্লিশোর্ধ প্রবীণদের জন্য রয়েছে মজলিসে আনসারুল্লাহ্।

পনর থেকে চল্লিশ পর্যন্ত তরুণদের রয়েছে মজলিস খোদ্দামুল আহ্‌মদীয়া।

ছেলে শিশু থেকে পনর বছর পর্যন্ত শিশু কিশোরদের জন্য আতফালুল আহ্‌মদীয়া।

নারীদের জন্য রয়েছে লাজনা ইমাইল্লাহ্।

মেয়ে শিশু ও কিশোরীদের জন্য নাসেরাতুল আহ্‌মদীয়া।

প্রত্যেকটি সংগঠন যুগ খলীফার নির্দেশনায় নিজ নিজ গন্ডীতে দ্বীনি তা’লীমসহ ধর্মীয় জ্ঞান তথা তরবিয়তের ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

ইসলাম প্রচার ও মানবজীবনের সকল চাহিদা পুরণের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা’লীমুল ইসলাম কলেজ ও ওয়াকফে নও স্কীম। তথ্য প্রযুক্তির বর্তমান যুগে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে MTA International নামে নিজস্ব টেলিভিশন চ্যানেল চালু ছাড়াও Internet এর মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে তৌহীদ ও রিসালতের কার্যাবলী। গত ২৩শে মার্চ, ২০০৭ থেকে আরব বিশ্বের মানুষগুলোর জন্য MTA এর পৃথক চ্যানেল mta-3 চালু হয়েছে।

হযরত মুসলেহ মাওউদ (রাঃ) লিখেছেন,

“আহ্‌মদীয়া জামা’ত যদি খেলাফতের উপর ঈমান রাখে এবং এর জন্য সঠিক অর্থে সংগ্রাম করতে থাকে তাহলে এ ব্যবস্থা কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে। শয়তান কখনই এর মাঝে বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না।” (আল ফযল ইন্টারন্যাশনাল লন্ডন, ১০ জুন ২০০৫ ইং)

হযরত খলীফাতুল মসীহ্‌ রাবে (রাহেঃ) বলেছেনঃ

“আমি আপনাদেরকে শুভ সংবাদ দিচ্ছি যে, এরপর আহ্‌মদীয়া খিলাফত কখনও ভয়ংকর বিপদে পড়বে না ইনশাআল্লাহ্। আহ্‌মদী জামা’ত এখন আল্লাহ্‌র দৃষ্টিতে সাবালক (বালেগ) হয়েছে। শত্রুর কোন দৃষ্টি; শত্রুর কোন অন্তর, শত্রুর কোন চেষ্টা এ জামাতের চুল বাঁকা করতে পারবে না। আহ্‌মদীয়া খিলাফত ইনশাআল্লাহ্ ঐ সমস্ত শান-শওকত মান-মর্যাদা নিয়েই বৃদ্ধি ও বিকাশ লাভ করতে থাকবে। যে শান-শওকতের প্রতিশ্রুতি আল্লাহ্ তা’আলা হযরত মসীহ্ মাওউদ (আঃ) কে দিয়েছেন। কমপক্ষে এক হাজার বছর পর্যন্ত এ জামা’ত জীবিত থাকবে। সুতরাং দোয়া করতে এবং আল্লাহ্‌র প্রশংসার গীত গাইতে থাকুন এবং নিজেদের (বয়আতের) প্রতিজ্ঞার নবায়ন করুন”। (আল ফযল; ২৮ জুন, ১৯৮২ ইং, লন্ডন আল ফযল ইন্টারন্যাশনাল; ১৩ জুন ২০০৩ ইং)

হযরত মির্যা মাসরূর আহ্‌মদ, খলীফাতুল মসীহ্‌ খামেস (আই:) তাঁর প্রথম জুমুআর খুতবায় (২৫ এপ্রিল ২০০৩ ইং) হযরত মসীহ্ মাওউদ (আঃ) এর ভবিষ্যদ্বাণী পড়ে শোনালেনঃ

“আমি বড় দাবী ও দৃঢ়তার সাথে বলছি, আমি সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত আর আল্লাহ্‌ তা’আলার ফযলে এ ক্ষেত্রে আমারই বিজয় অবধারিত। যতদূর আমি আমার দূরদৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখেছি সমস্ত পৃথিবীকে আমি আমার পদতলে সমর্পিত দেখতে পেয়েছি। আর নিকট ভবিষ্যতে আমি এক মহান বিজয় লাভ করতে যাচ্ছি। কেননা আমার কথার সমর্থনে আরেকজন কথা বলছে …।”

সমাপ্তি টানার আগে আমি এ কথা স্পষ্ট করে সবাইকে স্মরণ করাতে চাই যে, আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামাতে প্রতিষ্ঠিত খেলাফতের বর্তমান বয়স ৯৯ বছর। ইনশাআল্লাহ্ আগামী বছর অর্থাৎ ২০০৮ সনে মহাসমারোহে খেলাফতে আহ্‌মদীয়ার শতবার্ষিকী পালিত হবে। এ জন্য পুরো জামা’ত হুযূর (আই:) এর নির্দেশে দোয়া, ইস্তেগফার, নফল নামায, নফল রোজা রাখছে। আগামী ২৭ মে ২০০৮ তারিখে সারা পৃথিবীর সব দেশে পশু কুরবানী ও বিশেষ ইবাদত-বন্দেগী এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আহ্‌মদীরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের এ উৎসব পালন করবে।

আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান খলীফা সায়্যেদনা হযরত মীর্যা মাসরূর আহ্‌মদ (আই:) সমগ্র আরবের মানুষগুলোর জন্য mta-3 নতুন চ্যানেলের উদ্বোধন করে গত ২৩শে মার্চ ২০০৭ লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ্ মসজিদে খুতবার মাধ্যমে সমগ্র আরবের মুসলমান ভাইদেরকে হযরত ইমাম মাহ্‌দীর (আঃ) খলীফার হাতে বয়েত করার প্রেমময় আহ্বান জানিয়েছেন।

আমাদের আহ্‌মদীয়া খেলাফতের নেযাম বা ব্যবস্থাপনা অতি উত্তম। যে কেউ হুযূর (আই:) এর খেদমতে শ্রদ্ধার সাথে মহব্বতভরা পত্র লিখতে পারেন। গোড়া থেকেই ছোট বড়, মহিলা পুরুষ হুযূর আনোয়ার (আই:)-কে নিজ পিতার স্থলে স্থান করে সব যুগে সব কালে পত্র লিখে মনের কথা বলে থাকেন। যুগ খলীফা জবাবে মহব্বতভরা সাড়া দেন। হযরত সাহেবের হৃদয় নিংড়ানো দোয়ার বরকতে কল্যাণ লাভ করে। খলীফার সাথে রয়েছেন মুত্তাকী আলেম বা’আমল এমন আলেম যারা বড় উঁচু স্তরের মুত্তাকী; খোদাভীরু এবং ন্যায়পরায়ন ও সৎকর্মশীল। তারা খলীফার সাহায্যের জন্য সর্বক্ষণ কর্মব্যস্ত থাকেন। খলীফা তাদের সাথে পরামর্শ করেন। অসাধারণ কল্যাণবহ খেলাফতের এ ধারাকে আমরা দৃঢ়ভাবে আঁকড়িয়ে থাকবো, এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

পাক্ষিক আহ্‌মদী - ৩১শে মে ২০০৭