প্রেস বিজ্ঞপ্তি
২৮-অক্টোবর, ২০২৩

ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধে সংঘটিত অন্যায়ে বিশ্ব-নেতৃবৃন্দর দায়বদ্ধতার পরিপ্রেক্ষিতে আগতপ্রায় বিশ্বযুদ্ধের বিষয়ে সতর্ক করলেন বিশ্ব-মুসলিম নেতা


“যতক্ষণ পর্যন্ত তারা [বিশ্ব-নেতৃবৃন্দ] কেউ সাহস করে যুদ্ধবিরতির চেষ্টা না করবেন, তারা নিশ্চিতভাবে পৃথিবীকে ধ্বংসের পানে ধাবিত করার জন্য দায়ী সাব্যস্ত হবেন।”
আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) অন্যায্য নীতিতে সম্পৃক্ততার জন্য বিশ্ব-নেতৃবৃন্দের দায়ের ওপর আলোকপাত এবং ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের সংবাদ পরিবেশনে পশ্চিমা গণমাধ্যমের পক্ষপাতদুষ্টতার সমালোচনা করে, এক আগতপ্রায় বিশ্বযুদ্ধের বিষয়ে সতর্ক করেছেন এবং বিগলিত চিত্তে দোয়ার জন্য এক তাগিদপূর্ণ আহ্বান করেছেন।
যুক্তরাজ্যের ইসলামাবাদে মুবারক মসজিদে শত শত মুসল্লির উপস্থিতিতে প্রদত্ত হুযূর আকদাসের জুমু’আর খুতবা আহমদীয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা সম্প্রচারিত বৈশ্বিক স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল এমটিএ ইন্টারন্যাশনাল-এর মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে লক্ষ-কোটি মানুষের নিকট সম্প্রচারিত হয়।
এক বৈশ্বিক যুদ্ধের ঝুঁকির বিষয়ে সতর্ক করে হুযূর আকদাস বলেন:
“যুদ্ধ পরিস্থিতি যেভাবে দ্রুতগতিতে তীব্র আকার ধারণ করছে আর ইসরায়েল সরকার এবং পরাশক্তিগুলোকে যে নীতি অবলম্বন করতে দেখা যাচ্ছে তার ফলে এখন বিশ্বযুদ্ধ দুয়ারে অপেক্ষমান বলে মনে হচ্ছে। আর বতর্মানে কতক মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানও এ কথা নির্দ্বিধায় বলা শুরু করেছেন। রাশিয়া, চীন ও অনুরূপভাবে পশ্চিমা বিশ্লেষকগণও একথা বলতে এবং লিখতে শুরু করেছেন যে, এখন এই যুদ্ধের পরিধি ব্যাপকতর হবে বলে মনে হচ্ছে। তাৎক্ষণিকভাবে যদি বিচক্ষণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয় তবে পৃথিবীর ধ্বংস অনিবার্য। সবকিছু সংবাদে আসছে, পরিস্থিতি আপনাদের সামনে রয়েছে।”
হুযূর আকদাস যুদ্ধবিরতির আহ্বান করা বা নৃশংসতার নিন্দা জ্ঞাপনে পশ্চিমা শক্তিগুলোর নেতৃবৃন্দের ন্যায়বিচার ও সৎসাহসের অভাবের সমালোচনা করেন।
হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:
“যতক্ষণ পর্যন্ত তারা [বিশ্ব-নেতৃবৃন্দ] কেউ সাহস করে যুদ্ধবিরতির চেষ্টা না করবেন, [ততক্ষণ পর্যন্ত] তারা নিশ্চিতভাবে পৃথিবীকে ধ্বংসের পানে ধাবিত করার জন্য দায়ী সাব্যস্ত হবেন।”
হুযূর আকদাস হামাস-এর ৭ অক্টোবরের আক্রমণের প্রত্যুত্তরে ইসরায়েলী বোমা হামলার মাত্রার বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন, যেখানে বিগত কয়েক সপ্তাহে আবাসিক ভবন, হাসপাতাল ও সাধারণ জনগণের ব্যবহার্য অবকাঠামো মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর ৩,০০০ এর অধিক নিরীহ শিশুসহ আনুমানিক ৭,০০০ ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছে।
হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:
“ইসরায়েলী সরকারের প্রতিনিধি বলছে, ‘হামাস আমাদের নিরীহ জনগণকে হত্যা করেছে, আমরা প্রতিশোধ নেবো।’ অথচ এ প্রতিশোধ এখন সকল সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে। বর্ণনা অনুযায়ী যত সংখ্যক ইসরায়েলী প্রাণের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার চার-পাঁচগুণ ফিলিস্তিনীদের প্রাণহানি ঘটেছে। তাদের ভাষ্যমতে যদি হামাসকে নিশ্চিহ্ন করা তাদের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তবে তাদের সাথে সরাসরি যুদ্ধ করুক; নারী, শিশু, বৃদ্ধদেরকে কেন লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে? তাছাড়া তাদেরকে খাদ্য, পানি, চিকিৎসা সবকিছু থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। এই রাষ্ট্রগুলোর মানবাধিকার এবং যুদ্ধনীতির যাবতীয় দাবি-দাওয়া এখানে এসে থমকে যায়।”
হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) তাদের অবস্থানের জন্য সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার ন্যায় কতিপয় ব্যক্তির প্রশংসা করেন। ওবামা ২৩ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে এক বিবৃতিতে গাজায় খাদ্য, পানি ও জ্বালানী সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার ইসরায়েলী নীতির সমালোচনা করেন।
হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:
“তবে হ্যাঁ, কেউ কেউ এদিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেছেন, যুদ্ধ যদি করতেই হয় তবে সমরনীতিকে দৃষ্টিপটে রেখে যুদ্ধ করা উচিত, বেসামরিক নিরীহ জনগণের ওপর অত্যাচার করা উচিত নয়।”
হুযূর আকদাস জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এরও উল্লেখ করেন, যিনি ২৪ অক্টোবর, ২০২৩ বলেন, “যুদ্ধেরও কিছু নিয়ম-নীতি রয়েছে”, আর তিনি বেসামরিক জনগণের নিরাপত্তা ও গাজায় মানবিক সহায়তার জন্য সুযোগ প্রদানের আহ্বান জানান। মি. গুতেরেস এ সংঘাতের কিছু ঐতিহাসিক পটভূমি তুলে ধরে বলেন, ৭ই অক্টোবরের হামাস-এর আক্রমণও “একেবারে শূন্য থেকে উদয় হয় নি।”
মহাসচিবের মন্তব্য সম্পর্কে হুযূর আকদাস বলেন:
“জাতিসংঘের মহাসচিবও একই কথা বলেছিলেন। এটি শুনে ইসরায়েল সরকার হৈ চৈ করে; অথচ পৃথিবীর অবশিষ্ট শান্তির দাবিদাররা, যারা নিজেদেরকে শান্তি প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত বা চ্যাম্পিয়ন মনে করে, তারা (জাতিসংঘ) মহাসচিবের ভাষণের সমর্থনে টুঁ শব্দ পর্যন্ত করে নি, বরং অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।”
হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধের সংবাদ পরিবেশনে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের স্পষ্ট পক্ষপাতদুষ্টতা তুলে ধরে বলেন যে, কোনো কোনো ঘটনাকে ও দৃষ্টিকোণকে অযথাই অন্য ঘটনার চেয়ে অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে।
“পশ্চিমা মিডিয়া একপক্ষের সংবাদকে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করে আর অন্যপক্ষের যে কোনো সংবাদ আড়ালে পড়ে যায়। যেমন, কয়েক দিন আগে [হামাস এর হাত থেকে] মুক্তিপ্রাপ্ত এক মহিলা বলেছিলেন, বন্দি অবস্থায় আমার সাথে সদাচরণ করা হয়েছে। এ সংবাদকে আড়াল করে, এই সংবাদকে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করেছে যে, ‘হামাসের বন্দিশালা নরকতুল্য’।”
হুযূর আকদাস ৮৫-বছর বয়স্কা ইয়োচেভেড লিফশিৎয এর কথা বলছিলেন, যিনি ২৪ অক্টোবর, ২০২৩ মুক্তির সময় তার সাবেক বন্দীকারীদের সাথে হাত মিলিয়ে তারপর বিদায় নেন।
“সার্বিক পরিস্থিতিকে সকলের সামনে রাখাই তো ন্যায়পরায়ণতা। এরপর বিশ্ববাসীকে সিদ্ধান্ত নিতে দিন যে, কে অত্যাচারী এবং কে অত্যাচারিত; আর কোন্‌ সীমা পর্যন্ত এ যুদ্ধ বৈধ, আর কোন্‌ পর্যায়ে এ যুদ্ধ শেষ হওয়া উচিত। তাই, সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টিপটে আসা উচিত, একপেশে রায় নয়।”
হুযূর আকদাস বলেন যে, যেহেতু পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল এবং ক্রমাগত বিপজ্জনক হয়ে উঠছে, মুসলিম বিশ্বের এই কষ্টদায়ক পরিস্থিতি লাঘবের জন্য আহমদী মুসলমানদের হৃদয়ে গভীর বেদনা ধারণ করা উচিত।
তিনি আহমদী মুসলমানদের নিজ গণ্ডিতে এ পয়গাম পৌঁছানোর এবং অন্যায়-অবিচারের পরিসমাপ্তির জন্য জোর দোয়ার বিষয়ে তাগিদ প্রদান করেন।
হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:
“আমাদের দোয়ার প্রতি অধিক মনোযোগ দেওয়া উচিত। অন্যায়-অত্যাচার বন্ধের জন্য নিজ নিজ গণ্ডিতে চেষ্টা এবং দোয়া করা উচিত। অত্যাচারিত মুসলমানদের জন্যও এবং মুসলমান রাষ্ট্রগুলোর একটি সামগ্রিক ও দূরদর্শিতামূলক পরিকল্পনা তৈরির জন্য দোয়া করা উচিত। মুসলমানদের কষ্ট লাঘবে আমাদের বিশেষ বেদনা থাকা উচিত। আমরা তো সেই মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর মান্যকারী যিনি মুসলমানদের পক্ষ থেকে আমাদেরকে কষ্ট দেয়া সত্ত্বেও তাদের প্রতি সহমর্মিতার আবেগের বহিঃপ্রকাশ এভাবে এক ফার্সী পংক্তিতে প্রকাশ করেছেন যে, ‘হে আমার হৃদয়! তুমি তাদের প্রতি সদয় হও। কেননা, তারা তো আমার নবীর (সা.) প্রতি ভালোবাসারই দাবি করে!’ সুতরাং, মহানবী (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসার দাবি হলো, আমরা যেন মুসলমানদের জন্য অধিক পরিমাণে দোয়া করি। আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে এর তৌফিক দিন এবং মুসলমানদেরও এবং বিশ্ববাসীকেও বিবেক দিন। আমিন।”