প্রেস বিজ্ঞপ্তি
০৫-অক্টোবর, ২০২৩

ঈমানোদ্দীপক ভাষণ এবং ইসলামের সেবায় মুসলিম যুবকদের ঐতিহাসিক অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে মজলিস খোদ্দামুল আহমদীয়া যুক্তরাজ্যের জাতীয় ইজতেমা সমাপ্ত


“আহমদী মুসলমান হিসেবে আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে এই দায়িত্ব দিয়েছেন, আমরা যেন পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকা পর্যন্ত আহমদীয়াতের পতাকা সমুন্নত রাখি। তিনি আমাদেরকে মানবজাতিকে রক্ষার এবং সেই দিনটির জন্য নিরলসভাবে চেষ্টা করার কঠিন দায়িত্ব ও চ্যালেঞ্জ প্রদান করেছেন, যে-দিন ইসলামের ভালোবাসা ও শান্তির বাণী সকল মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করবে।” – যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত ৬,৯০০ আহমদী মুসলিম যুবকের উদ্দেশে ভাষণে হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.)

১ অক্টোবর ২০২৩, এক ঈমানোদ্দীপক ভাষণের মধ্য দিয়ে আহমদীয়া মুসলিম বালক ও যুবকদের সংগঠন, মজলিস খোদ্দামুল আহমদীয়া যুক্তরাজ্যের জাতীয় ইজতেমা (বার্ষিক সম্মেলন) সমাপ্ত করেন আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.)।

কিংস্লি-র ওল্ড পার্ক ফার্মে অনুষ্ঠিত তিন দিনের এ আয়োজনে ৬,৯০০ এর অধিক যুবক ও বালক যোগদান করেন, যা অংশগ্রহণকারীদের নিবেদিতচিত্তে ধর্ম পালনে অনুপ্রেরণা যোগায়।

হুযূর আকদাস তাঁর ভাষণে খোদ্দামদেরকে তাদের মৌলিক দায়িত্বাবলির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি অঙ্গীকার গ্রহণ করেন যা বিশ্বকে ইসলামের প্রকৃত শান্তিপূর্ণ শিক্ষা অবগত করা এবং নিজেদেরকে বরকতময় খিলাফত ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখা নিশ্চিত করে।

পুরো বক্তৃতা জুড়ে হুযূর আকদাস আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের দ্বিতীয় খলীফা হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.)-এর একটি ভাষণের উল্লেখ করেন যেখানে তিনি মজলিস খোদ্দামুল আহমদীয়ার সদস্যদের নিকট প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেন।

ভাষণের শুরুতেই হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) এই বলে শুরু করেন যে, পৃথিবীতে মানুষের জন্ম-মৃত্যু স্বাভাবিক বিষয়। প্রত্যেকে জন্ম নেয়, পৃথিবীতে জীবন অতিবাহিত করে এবং মৃত্যুবরণ করে। একই সঙ্গে, তিনি (রা.) বুঝিয়ে বলেন যে, কোনো সম্প্রদায় বা জাতির সুদীর্ঘকাল জীবিত থাকার ও উন্নতি করার সুযোগ রয়েছে। কোনো কোনো জাতি কয়েক দশক এমনকি কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত টিকে থাকে। আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের ক্ষেত্রে তিনি বলেন, আহমদী যুবকদের আন্তরিকভাবে শপথ গ্রহণ করতে হবে যেন তারা আমাদের জামা’তের অস্তিত্ব ও চিরন্তন সাফল্য নিশ্চিত করার জন্য তাদের দায়িত্বাবলি পূর্ণ করে। এর জন্য প্রয়োজন প্রজন্মের পর প্রজন্মের আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের সত্যিকার শিক্ষামালার ওপর আমল করা এবং পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে উক্ত বাণী পৌঁছে দেওয়া।”

মানুষ যেন আল্লাহ্ তা’লার দিকে ফিরে আসে সে জন্য মসীহ মওউদ (আ.) তাঁর অন্তরে যে গভীর বেদনা রাখতেন, হুযূর আকদাস তা বর্ণনা করেন।

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“প্রশ্নাতীতভাবে, এই যুগে প্রত্যেক আন্তরিক খাদেমকে অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে যেন মানবজাতি মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর প্রতি ঈমান আনে … আহমদী মুসলমান হিসেবে আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে এই দায়িত্ব দিয়েছেন আমরা যেন পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকা পর্যন্ত আহমদীয়াতের পতাকা সমুচ্চ রাখি। তিনি মানবজাতিকে রক্ষার এবং সেই দিনটির, যখন ইসলামের ভালোবাসা ও শান্তির বাণী সকল মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করবে, তার জন্য নিরলসভাবে চেষ্টা করার কঠিন দায়িত্ব ও চ্যালেঞ্জ আমাদেরকে প্রদান করেছেন।”

হুযূর আকদাস বলেন কীভাবে একটি দিন আসবে যখন আধ্যাত্মিক উপায়ে ইসলামের বিজয় অর্জিত হবে। যার অর্থ অজস্র মানুষ আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের সদস্য হিসেবে যোগদান করবে।

হুযূর আকদাস হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর একটি কাশফ্ বা দিব্যদর্শন বর্ণনা করেন যেখানে তিনি (আ.) সারা বিশ্ব থেকে অশ্বারোহিত রাজাদের বহর দেখেন যারা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর সত্যতার সাক্ষ্য দিচ্ছিল।

উক্ত দিব্যদর্শনের উল্লেখ করে হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“এই দিব্যদর্শনে একটি অসাধারণ ভবিষ্যদ্বাণী নিহিত রয়েছে যে, সেখানে আল্লাহ্ তা’লা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে সুসংবাদ দিয়েছিলেন যে, এমন একদিন আসবে যখন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া এবং জার্মানির মতো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, রাজা বা রাষ্ট্রপতিগণ আহমদীয়াতের সত্যতা স্বীকার করে নেবেন। প্রকৃতপক্ষে, আল্লাহ্ তা’লার ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী এমন এক সময় আসবে যখন এত বড় সংখ্যায় মানুষ আহমদীয়াত গ্রহণ করবে যে, অন্য সকল ধর্মমত তুলনামূলকভাবে তাৎপর্যহীন হয়ে পড়বে।”

আধ্যাত্মিক উপায়ে এই বিজয় অর্জন করার জন্য হুযূর আকদাস বলেন, আহমদী মুসলমান যুবকদের অবশ্যই আল্লাহ্ এবং তাঁর সৃষ্টির প্রতি দায়িত্বাবলি পালন করতে হবে।

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর মিশনের স্থায়িত্বের রূপরেখা তুলে ধরেন এবং বলেন:

“বর্তমান যুগে মহানবী (সা.), যাঁর মর্যাদা অন্যান্য সকল নবী থেকে অনেক ঊর্ধ্বে, তাঁর বিশুদ্ধ প্রতিবিম্ব এবং সেবক হিসেবে আল্লাহ্ তা’লা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে প্রেরণ করেছেন। যদি হযরত নূহ (আ.)-এর সম্প্রদায়ের স্থায়িত্ব এক হাজার বছর হয়ে থাকে তাহলে মহানবী (সা.)-এর মসীহের যুগের স্থায়িত্ব তার থেকে বেশি হওয়া উচিত এবং ইনশাল্লাহ্ হবেও, এবং কয়েক হাজার বছর টিকে থাকবে; কেননা, তাঁর (সা.) শিক্ষা এবং মর্যাদা নূহ (আ.) থেকে অনেক সুদূরপ্রসারী। মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেছেন, আল্লাহ্ তা’লা তাঁকে জানিয়েছেন যে, তাঁর জামা’ত ও ইসলাম ধর্ম শেষ সময় পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে।”

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর মিশনের সাথে কীভাবে খিলাফত ব্যবস্থা গভীরভাবে যুক্ত তা তুলে ধরতে গিয়ে, হুযূর আকদাস ‘আল-ওসীয়্যত’ পুস্তক থেকে মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বাণী উদ্ধৃত করেন:

“আমি খোদার পক্ষ থেকে এক কুদরত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছি এবং আমি খোদার মূর্তিমান কুদরত। আমার মৃত্যুর পর আরো কয়েকজন ব্যক্তি তাঁর কুদরতের দ্বিতীয় বিকাশ হবেন।”

এই কথার অর্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“এখানে মসীহ্ মওউদ (আ.) স্পষ্ট বলেছেন যে, তাঁর মৃত্যুর পর পৃথিবীতে পুনরায় খিলাফত ব্যবস্থা কায়েম হবে এবং শেষ সময় পর্যন্ত টিকে থাকবে। ফলে, প্রত্যেক আহমদীর অবশ্যই আন্তরিকভাবে নিজেদেরকে খিলাফতের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে এবং আহমদী পিতা-মাতার এটি অঙ্গীকার করতে হবে যে, তারা যেমন তাদের সন্তান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে ইসলাম প্রচারের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করবেন, তেমনি খিলাফত ব্যবস্থার সঙ্গে বিশ্বস্তভাবে যুক্ত থাকার গুরুত্বও জাগ্রত রাখবেন।”

হুযূর আকদাস যুবকদের নিকট থেকে একটি অঙ্গীকার গ্রহণ করেন, যা ইতোপূর্বে হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) গ্রহণ করেছিলেন। অংশগ্রহণকারীরা শপথ গ্রহণ করার সময়ে আবেগপূর্ণপরিবেশ দেখা যায়; এক আবেগঘন পরিবেশের উদ্ভব হয়; কারণ, যুবকরা ইসলামের শান্তিপূর্ণ শিক্ষা প্রচারের এবং খিলাফতের সঙ্গে চিরকাল অনুগত থাকার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

সকল অংশগ্রহণকারী দাঁড়িয়ে যান এবং একত্রে তাদের ইমামের পেছনে শপথ গ্রহণ করেন। শপথের বাক্যগুলো হল:

“ইসলামের বরকতময় পতাকাকে শেষ সময় পর্যন্ত সকল দেশে সমুন্নত রাখার জন্য আমি সম্ভাব্য সব ত্যাগ স্বীকার করব, তা যত কঠিনই হোক না কেন। আমি আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত খিলাফত ব্যবস্থাকে রক্ষা ও শক্তিশালী করার জন্য দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে সংগ্রাম করার অঙ্গীকার করছি। আমি সবসময় আমার সন্তান ও তাদের বংশধরদেরকে খিলাফতের সাথে দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত থাকতে এবং এর কল্যাণ পেতে উদ্ধুদ্ধ করবো যেন আহমদীয়া খিলাফত শেষ সময় পর্যন্ত সুরক্ষিত থাকে। আর যাতে আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের মাধ্যমে ইসলামের প্রচার শেষ দিন পর্যন্ত চলমান থাকে এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পতাকা পৃথিবীর অন্য যে কোন পতাকার চেয়ে অনেক উঁচুতে উন্নীত করা যায়।”

এরপর হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) শপথটি মূল উর্দু ভাষায় পুনরায় উল্লেখ করেন এবং বলেন:

“শপথটি গ্রহণ করার পর আপনাদেরকে অবশ্যই এটি অনুসারে জীবনযাপন করার চেষ্টা করতে হবে। আপনাদেরকে নিয়মিত এটি পড়তে হবে, যেন আপনারা দায়িত্বাবলি সম্পর্কে সচেতন থাকেন। গুরুত্ব সহকারে এ নিয়ে চিন্তা করুন, আপনার বিশ্বাস ও দায়িত্বের প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করুন। জেনে রাখুন, আপনি ঐ সময় পর্যন্ত স্থির হয়ে বসতে পারেন না, যতক্ষণ ইসলামের শান্তিপূর্ণ শিক্ষা পৃথিবীর প্রত্যেক গ্রাম, শহর ও দেশে পৌঁছে না যায় এবং এই সত্য বিশ্বব্যাপী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ গ্রহণ না করে।”

হুযূর আকদাস বলেন যে, ধন-সম্পদ ও পার্থিব চেষ্টা-সাধনা যেন কখনোই আহমদী মুসলমান যুবকদেরকে তাদের উদ্দেশ্য থেকে বিভ্রান্ত না করে।

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“যেকোনো জাতি বা সম্প্রদায়ের বিজয়ের পথে যে বিষয়টি সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় তা হলো যদি এর সদস্যরা অর্থ ও সম্পদের জন্য লালায়িত থাকে। এই ধরনের পার্থিব লালসা মানুষকে সহজেই কলুষিত করতে পারে এবং ধর্ম ও ধর্মীয় উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ত্যাগ স্বীকার করার সংকল্পকে দুর্বল করে দিতে পারে। সুতরাং, পশ্চিমা দেশগুলোতে বসবাসরত আপনারা সকলেই অর্থ উপার্জন বা ধনী হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় নিজেদেরকে নিমজ্জিত করবেন না। বরং, সর্বদা আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন যে, তিনি আপনার প্রয়োজন পূরণ করবেন। ইনশাআল্লাহ্, তিনি আপনার সহায় হবেন এবং আপনার ধারণার বাইরের নানা উপায়ে আপনার চাহিদা পূরণ করবেন। তিনি আপনার সমস্ত অসুবিধা দূর করবেন, যদি আপনি তাঁর প্রতি আন্তরিক হন। সুতরাং, অর্থ উপার্জন বা অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতার প্রতিযোগিতায় যোগ দিবেন না। বরং, আপনাদের প্রতিযোগিতা এমন হওয়া উচিত যা আপনাকে আল্লাহ্ তা’লার দিকে অগ্রসর করে।”

ভাষণের শেষ দিকে হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) আরও একবার আহমদী মুসলমান যু্বকদেরকে তাদের দায়িত্বাবলি অনুধাবন করা ও পূরণ করার প্রয়োজনীয়তার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“আমাদেরকে অবশ্যই আমাদের কর্তব্যসমূহ বুঝতে হবে; যেন, আল্লাহ্ না করুন, এমনটি কখনোই না হয় যে, আমাদের অবহেলা ও নিষ্ক্রিয়তার কারণে আল্লাহ্ তা’লা আমাদের ত্যাগ করেন এবং আধ্যাত্মিক বিপ্লব সাধনের দায়িত্ব পরবর্তী প্রজন্মের নিকট অর্পণ করেন। বরং, প্রত্যেক খোদ্দাম তথা প্রত্যেক আহমদীর অবশ্যই তাদের সকল দোয়া ও শক্তি মানবজাতিকে আধ্যাত্মিকভাবে জাগ্রত করার বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনের প্রতি নিবদ্ধ করতে হবে, যেন আল্লাহর একত্ব ও মহানবী (সা.)-এর সত্যতার সাক্ষ্যদানকারী পতাকা বিশ্বের অন্য যেকোনো পতাকার চেয়ে উঁচুতে স্থান লাভ করে।”