প্রেস বিজ্ঞপ্তি
১৩-সেপ্টেম্বর, ২০২৩

ঈমানোদ্দীপক ভাষণের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হলো জলসা সালানা জার্মানি ২০২৩


স্টুটগার্টে অনুষ্ঠিত তিন-দিনের ধর্মীয় সম্মেলনে বিশ্বের ‍বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৪৭,০০০ এরও বেশি মানুষের যোগদান

৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) এক ঈমানোদ্দীপক ভাষণের মধ্য দিয়ে জার্মানির ৪৭তম জলসা সালানা (বার্ষিক সম্মেলন) সমাপ্ত করেন।

এ বছরের সম্মেলনে জামার্নিতে আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের শতবর্ষ উদযাপিত হয় এবং কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারীর পর থেকে চার বছরে এই প্রথম সেই দেশে হুযূর আকদাস জলসা সালানায় অংশগ্রহণ করে এর শোভাবর্ধন করেন।

তিন দিনের জলসা সালানার একটি বিশেষ আকর্ষণ ছিল রবিবার অপরাহ্ণের বয়আতের (দীক্ষা গ্রহণ) পর্ব। অংশগ্রহণকারীরা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.)-এর পঞ্চম খলীফা হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.)-এর হাতে আনু্ষ্ঠানিকভাবে দীক্ষা গ্রহণ করেন।

অংশগ্রহণকারীর খলীফা পর্যন্ত বিস্তৃত মানব-শৃঙ্খল গঠন করেন এবং ঐক্যবদ্ধভাবে বয়আতের শব্দগুলো পুনরাবৃত্তি করেন।

হুযূর আকদাস তাঁর ভাষণ শুরু করতে গিয়ে উল্লেখ করেন যে, বিগত বছরগুলোর মতো এ বছরের জলসা সালানার সমাপ্তি অধিবেশনেও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষকে ইসলাম-প্রদত্ত অধিকারসমূহের ওপর তাঁর আলোচনার ধারা অব্যাহত রাখবেন।

হুযূর আকদাস পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারা-২:২৮১ আয়াত তিলাওয়াত করেন, যেখানে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে অনুসরণীয় নৈতিক পদ্ধতির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে কীভাবে এটি সমাজে শান্তি বয়ে আনে। উক্ত আয়াতটি মুসলমানদেরকে এ ধরনের আলোচনায় অংশ নেওয়ার সময়ে সাক্ষী রাখার নির্দেশনা প্রদান করে।

উক্ত আয়াতটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে, হুযূর আকদাস বলেন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, এ আদেশটির অনুসরণ করা হয় না।

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“অনেক এমন ঘটনা সামনে আসে যেখানে এ বিষয়ে খেয়াল রাখা হয় না, সাক্ষীদের ভয় দেখানো হয় বা যারা লিখেন তাদেরকে থামিয়ে দেওয়া হয়, অথবা আদৌ লেখাই হয় না, ঠিকমত চুক্তি সম্পাদিত হয় না, ফলে পরবর্তীতে ঝগড়া-ঝাঁটি এবং লড়াই হয়ে থাকে। আজকাল উন্নত বিশ্বের মানুষের তো ইদানিং এ বিষয়ে চিন্তার উদ্রেক হয়েছে যে, এগুলো আইনগতভাবে সম্পাদিত হওয়া উচিত, সবকিছুর লিখিত দলিল থাকা উচিত। কিন্তু, ইসলাম আজ থেকে ১৪ শত বছর পূর্বে এই বিস্তারিত নির্দেশ প্রদান করেছে, যেন ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেন ও ক্রয়-বিক্রয় নির্বিবাদে সম্পন্ন হতে পারে।”

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) শুরুতে তিলাওয়াত করা আয়াতের আলোকে ঋণগ্রস্তদের অধিকারও তুলে ধরেন এবং বলেন:

“ঋণগ্রস্তের জন্য স্বাচ্ছন্দ্যের অধিকারও ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছে। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন যে, মহানবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি সংকটাপন্ন ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে বাড়তি সময় দেয়, বা তার ঋণের কিছু অংশ ছেড়ে দেয়, আল্লাহ্‌ তা’লা কিয়ামতের দিনে তাকে আরশের ছায়াতলে স্থান দান করবেন, আর ওই দিন আরশের ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না। এক মু’মিন, যিনি আরশের ছায়া নিয়ে চিন্তিত, তার জন্য এটি কত বড় নিশ্চয়তা! এগুলো হলো সেই সকল বিষয় যেগুলো একটি সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা করে।”

এরপর, হুযূর আকদাস ইসলাম-প্রদত্ত সাধারণ মানুষের অধিকার সম্পর্কে আলোকপাত করেন এবং পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারা-২:৮৪ আয়াত পাঠ করেন যেখানে বলা হয়েছে:

“আর [সেই সময়কে স্মরণ করো] যখন আমরা বনী ইসরাঈলের নিকট হতে এক অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম: ‘তোমরা আল্লাহ্‌কে ব্যতীত অন্য কারো উপাসনা করবে না, এবং সদ্ব্যবহার করবে তোমাদের পিতা-মাতার প্রতি, আত্মীয়-স্বজনের প্রতি, এতিমদের প্রতি এবং দরিদ্রের প্রতি, আর মানুষের সঙ্গে উত্তমরূপে কথা বলবে, এবং নামায পড়বে ও যাকাত প্রদান করবে’; অতঃপর অল্প কয়েকজন ব্যতিরেকে তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিলে।”

হযরত মির্যা মসরূরর আহমদ (আই.) কুরআনের এই আয়াতটি ব্যাখ্যা করে বলেন:

“এই দৃষ্টান্ত উপস্থাপনের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে বলা হয়েছে, তোমাদেরকে নিজেদের ওপর কিছু নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। সকল প্রকারের অধিকার এর মধ্যে বর্ণনা করা হয়েছে। এর সৌন্দর্য এই যে, এখানে কেবল নিকটজন ও আত্মীয়দের কথা বলা হয় নি, কিংবা, সীমিত পরিসরে বঞ্চিত শ্রেণীর মানুষের কথা বলা হয় নি; বরং, সমগ্র মানবজাতির সঙ্গে সদাচরণের এবং তাদের অধিকার আদায়ের আদেশ প্রদান করা হয়েছে। এটি সেই সুন্দর শিক্ষা যা বিশ্বে শান্তির নিশ্চয়তা প্রদান করে। পূর্ববর্তী নবীগণের অনুসারীগণ তাদের শিক্ষাকে ভুলে গেছে, অথচ মুসলমানদের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে যে, ‘তোমরা আবার ভুলে যেও না, তোমরা সর্বদা স্মরণ রাখবে।’ ”

তাঁর ভাষণে হুযূর আকদাস ইসলামের শিক্ষা অনুসারে অপরাপর ধর্মাবলম্বীর সাথে একজন আহমদী মুসলমানের আচরণ কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেন।

প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ (আ.)-এর লেখনী থেকে উদ্ধৃত করে হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“যদি কেউ দেখে যে, তার হিন্দু প্রতিবেশীর বাড়িতে আগুন লেগে গেছে এবং আগুন নেভাতে তাদের সাহায্যার্থে সে এগিয়ে না আসে, তবে আমি সত্য সত্যই বলছি যে, এমন ব্যক্তি আমার সম্প্রদায়ভুক্ত নয়। যদি আমার অনুসারীদের মধ্যে কেউ দেখে যে, কোনো খ্রিস্টানকে কেউ হত্যা করতে উদ্যত হয়েছে এবং সে তাকে বাঁচাতে এগিয়ে না আসে, তবে আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করছি যে, এমন ব্যক্তি আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।”

হুযূর আকদাস ইসলামের প্রাথমিক যুগে খুলাফায়ে রাশেদীনের আন্তরিক প্রচেষ্টাসমূহর কথা তুলে ধরেন। হুযূর আকদাস জনস্বার্থে সেতু, মসজিদ, রাস্তা ও অন্যান্য ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে হযরত উমর (রা.)-এর প্রবল ইচ্ছার কথা উল্লেখ করেন।

হুযূর আকদাস উল্লেখ করেন, ইসলাম জনগণকে এমন দ্ব্যর্থহীন অধিকার প্রদান করেছে যার নমুনা অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“আজ ইউরোপের দেশগুলো সম্পর্কে বলা হয় যে, সাধারণ মানুষকে এখানে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়। এই সকল সুযোগ-সুবিধা সর্বপ্রথম ইসলাম প্রদান করেছে, তাদের অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠা করেছে। যদি মুসলমান সরকারগুলো আজ এই বিষয়ে দৃষ্টি দেয় এবং এর ওপর আমল করতে থাকে, তবে তাদের অভ্যন্তরীণ বিবাদসমূহ শেষ হয়ে যাবে।”

পরিশেষে, হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“খোদা তা’লা আমাদেরকে ইসলামের শিক্ষা অনুসারে এ সকল অধিকার অনুধাবন এবং আমাদের নিজেদের দায়িত্বে যে সকল অধিকার রয়েছে সেগুলো রক্ষা করার তৌফিক দান করুন। বিভিন্ন সময়ে যেভাবে আমি বর্ণনা করে আসছি, ইসলাম প্রত্যেক শ্রেণির মানুষের অধিকার সবিস্তারে বর্ণনা করেছে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন বছরে আমি প্রায় পঁচিশটি এমন অধিকারের কথা বর্ণনা করেছি। এই সকল অধিকার আদায় হলো সেই মূলনীতি যা প্রত্যেক শান্তিপূর্ণ সমাজের ও বিশ্বের শান্তির নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারে। আর, ইসলামই সেই ধর্ম যা এত সুক্ষ্মতার সাথে এ সকল অধিকার আদায়ের বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।”

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) আরও বলেন:

“সুতরাং, প্রত্যেক আহমদীর যেখানে নিজের মাঝে পবিত্র পরিবর্তন এনে অধিকার আদায়ের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, সেখানে এর পাশাপাশি এই শিক্ষাকে পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ারও প্রয়োজন রয়েছে। বিশ্ববাসীকে ইসলামের সৌন্দর্যসমূহ সম্পর্কে অবহিত করার আবশ্যকতা রয়েছে। মুসলমানদের কাছেও এই সুন্দর শিক্ষা তুলে ধরার আবশ্যকতা রয়েছে, আর অমুসলিমদেরকেও এ সম্পর্কে অবহিত করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।”