প্রেস বিজ্ঞপ্তি
০২-সেপ্টেম্বর, ২০২৩

স্টুটগার্টে জলসা সালানা জার্মানি ২০২৩ শুরু


“নিঃসন্দেহে, এটি পবিত্র কুরআনই, যা কিনা সত্যিকার পথ প্রদর্শন করবে এবং এটাই সেই মাধ্যম, যা কোনো ব্যক্তিকে সক্ষম করবে ধর্মকে দুনিয়ার উপর প্রাধান্য দিতে।” – হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.)

১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) এর জুমুআর খুতবার মধ্য দিয়ে আহমদীয়া মুসলিম জামা’ত জার্মানির ৪৭তম জলসা সালানা (বার্ষিক সম্মেলন) শুরু হয়।

জুমু’আর খুতবা প্রদানের পূর্বে হুযূর আকদাস আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের পতাকা (লিওয়ায়ে আহমদীয়া) উত্তোলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে জলসার উদ্বোধন করেন। পাশাপাশি জার্মানির জাতীয় পতাকাও উত্তোলন করা হয়।

খুতবার শুরুতে হুযূর আকদাস উল্লেখ করেন যে, কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারীর পর চার বছরে এই প্রথম পুরো পরিসরে মহামারীর পূর্বের মতো জলসা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।

এ বছর আহমদীয়া মুসলিম জামা’ত জার্মানি শতবর্ষে পদার্পণ করছে; এ বিষয়ে হুযূর আকদাস দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইসলামের সেবার ক্ষেত্রে আহমদী মুসলমানদের ওপর অর্পিত দায়িত্বাবলির রূপরেখা পুরো খুতবার জুড়ে তুলে ধরেন।
হুযূর আকদাস বলেন যে, অনেক আহমদী মুসলমান আহমদীয়া মুসলিম জামা’ত জামার্নির শতবর্ষ উপলক্ষ্যে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন। অবশ্যই এটি আনন্দের কারণ যে, এ দেশে প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.)-এর মিশন একশ’ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। হুযূর আকদাস বলেন এটিও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যে, “এ সময়ে আমরা কী অর্জন করতে পেরেছি এবং কীভাবে আমাদের ঈমান রক্ষা করেছি?”

হুযূর আকদাস অংশগ্রহণকারীদের জামার্নিতে আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের সাদামাটা শুরুর কথা স্মরণ করিয়ে দেন এবং বর্ণনা করেন কীভাবে অনেক আহমদী মুসলমান তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা অন্বেষণে এ দেশে এসেছেন।

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“যখন জার্মানিতে আহমদীয়া মুসলিম জামা’ত প্রতিষ্ঠিত হয় তখন এখানে [জার্মানিতে] খুবই অল্প লোক ছিল। পরবর্তীতে, পাকিস্তানের পরিস্থিতি বদলে যায়, আর সারাবিশ্বের পরিস্থিতিও পরিবর্তিত হয়, যার ফলে অনেক আহমদী এ দেশে আসেন এবং বসবাস করতে শুরু করেন। তারা এজন্য এখানে আসেন যে, তারা আহমদী ছিলেন, আর আহমদী হওয়ার কারণে নিজ দেশে আল্লাহ্ তা’লা ও তাঁর রসূল (সা.)-এর শিক্ষার ওপর আমল করা এবং খোলাখুলিভাবে এর অভিব্যক্তি প্রকাশে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। তারা এখানে আসেন এবং তারা সেই ধর্মীয় স্বাধীনতা লাভ করেন যে, তারা প্রকাশ্য তাদের ধর্ম পালন করার সুযোগ লাভ করেন। অতএব, তাদের বিশেষ যত্নের সাথে নিজেদের মাঝে পবিত্র পরিবর্তন আনয়ন করে তারপর তার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার চেষ্টা করা উচিত, যেভাবে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) তাঁর জামা’তের নিকট প্রত্যাশা করেছেন।”

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) আরও বলেন:

“আমাদের প্রতিনিয়ত নিজেদেরকে জিজ্ঞেস করতে হবে যে, আমরা কি নিজেদের আধ্যাত্মিক অবস্থার উন্নতির সাথে সাথে আমাদের সন্তানদেরকেও ধর্মের সঙ্গে যুক্ত রাখার জন্য বিশেষভাবে চেষ্টা করেছি, যাতে তারা সেই নিষ্ঠাবানদের মধ্যে শামিল হতে পারে যেমনটি হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) প্রত্যাশা করেছেন? যদি করে থাকি, তাহলে এটিই হবে সেই প্রকৃত কৃতজ্ঞতা, যা শতবর্ষ পূর্ণ হওয়ায় আমরা আদায়কারী হবো, আর যার প্রত্যাশা একজন আহমদীর নিকট থেকে করা যেতে পারে। অন্যথায়, কেবল জাগতিক রীতিতে শতবর্ষ উদযাপনে কোনো লাভ নেই।”

খুতবায় হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) ইউরোপের দেশসমূহে সাম্প্রতিক সময়ে কুরআন পুড়িয়ে ফেলার ঘটনা নিয়ে বক্তব্য প্রদান করেন এবং এসকল বিদ্বেষমূলক কাজকর্মের প্রকৃত কারণ নিয়ে আলোকপাত করেন।

হযরত মির্যা মসরূর মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“কেন অমুসলমানদের মধ্যে কুরআন পুড়ানোর ধৃষ্টতা তৈরি হয়েছে? কারণ, আমরা প্রকৃত অর্থে কুরআনের শিক্ষা অনুসরণ করা ছেড়ে দিয়েছি। এ কারণে তারা দুঃসাহসী হয়ে উঠেছে। এর জন্য, আমরা, [অর্থাৎ] মুসলমানরাও দায়ী।”

হুযূর আকদাস একজন ব্যক্তির উন্নতি এবং আধ্যত্মিক সমৃদ্ধির জন্য কুরআন থেকে দিকনির্দেশনা অর্জনের গুরুত্ব তুলে ধরেন।

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের জন্য পবিত্র কুরআন থেকে পথনির্দেশনা গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ। নিঃসন্দেহে, এটি পবিত্র কুরআনই, যা কিনা সত্যিকার পথ প্রদর্শন করবে এবং এটাই সেই মাধ্যম, যা কোনো ব্যক্তিকে সক্ষম করবে ধর্মকে দুনিয়ার ওপর প্রাধান্য দিতে। সুতরাং, আমাদেরকে খতিয়ে দেখতে হবে যে, আমাদের মধ্যে কতজন কুরআন পড়ে, তা নিয়ে চিন্তা করে এবং সেই অনুসারে কাজ করতেও চেষ্টা করে।”

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) ধারাবাহিকতায় আরও বলেন:

“আহমদীরা প্রায়ই বিভিন্ন প্রশ্ন করে থাকে। কুরআন মনোযোগ সহকারে পড়লে এর উত্তর তারা নিজেরাই খুঁজে পেতে পারে। যখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কুরআনের আলোকে কোনো বিষয় উপস্থাপন করা হয় তখন শ্রোতারা অভিভূত হয়ে পড়েন এবং পবিত্র কুরআনের সৌন্দর্য স্বীকার করে নেন। তাই, প্রত্যেক আহমদীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কুরআনকে কাজে লাগানো উচিত। যেখানে এটি আমাদের চরিত্র গঠনের জন্য পথনির্দেশ প্রদান করবে, সেখানে অন্যদের নানা আপত্তির জবাব দেওয়ার অসাধারণ হাতিয়ার হিসেবেও কাজ করবে।”

খুতবায়, হুযূর আকদাস হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) আধ্যাত্মিকতার মান উন্নয়নে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেন এবং বলেন, এটি [ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন] করলে “খোদার অস্তিত্ব, ইসলাম ও আহমদীয়াতের সত্যতার ওপর এক দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাবে।”

খুতবার শেষ দিকে, হুযূর আকদাস উল্লেখ করেন যে, আহমদীয়া মুসলিম জামা’ত জার্মানির ন্যাশনাল আমীর তাঁকে জার্মানি জামা’তের জন্য আগামী শতাব্দীর টার্গেট সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন।

হুযূর আকদাস বলেন, তাদেরকে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) কর্তৃক নির্দেশিত নৈতিক ও আধ্যাত্মিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য চেষ্টা করতে হবে এবং কিছু প্রশ্ন উপস্থান করেন যা নিয়ে তাদের চিন্তা-ভাবনা করা উচিত।

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“আমরা কি সত্যিকার অর্থে আল্লাহ্ তা’লার সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক সৃষ্টি করতে পেরেছি? দৈনন্দিন নামাযে আমরা কি সর্বোচ্চ স্তরে উপনীত হতে পেরেছি? আমরা কি দৈনিক নামাযের সময়ে সকল জাগতিক কাজ ছেড়ে দিয়ে নামাযের জন্য উপস্থিত হচ্ছি, নাকি নিছক নতুন মসজিদ তৈরির বিষয়েই শুধু জোর দিচ্ছি? আমরা কি প্রতিদিন পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করছি? আমরা কি কুরআনে সক্রিয়ভাবে আল্লাহ্ তা’লার নির্দেশনা তালাশ করছি এবং সেগুলোর ওপর আমল করার চেষ্টা করছি? আমরা কি ধর্মের সঙ্গে সন্তানদেরকে সম্পৃক্ত রাখার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি? আমরা কি কেবল তাদের জাগতিক জ্ঞান অর্জনের দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখছি, নাকি তাদের ধার্মিকতার বিষয়েও আমাদের উদ্বেগ রয়েছে? আমরা কি পারস্পরিক আচরণের ক্ষেত্রে এমন উচ্চ নৈতিক গুণাবলী গড়ে তুলেছি যে, আমরা ‘একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল’ হওয়ার কুরআনের শিক্ষার অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত হয়েছি? আমরা কি উন্নত নৈতিক গুণাবলি প্রদর্শন করে অন্যদেরকে ইসলামের অনুপম সুন্দর শিক্ষা সম্পর্কে পরিচিত করে তুলছি, নাকি উত্তম চরিত্র প্রদর্শন করে আমরা কেবল নিজেদেরকে শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে সাব্যস্ত করার চেষ্টাই শুধু করছি?”

হুযূর আকদাস বলেন, অমুসলমানরা তাঁর কাছে অনুভূতি প্রকাশ করেছে যে, আহমদী মুসলমানরা উন্নত নৈতিকতা প্রদর্শন করে থাকে। কিন্তু, একই ব্যক্তিরা যদি ইসলামী শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রকাশ করে তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায় যেসকল আহমদী মুসলমান তাদের পরিচিত ছিল, তারা তাদেরকে ইসলামী শিক্ষা সম্পর্কে অবগত করে নি।

হুযূর আকদাস গুরুত্বারোপ করেন যে, আহমদী মুসলমানরা যেন ইসলামের বাণী অমুসলমানদের নিকট পৌঁছায় এবং নিশ্চিত করে যে, তাদের আশেপাশের মানুষেরা এই প্রকৃত শান্তির বাণী সম্পর্কে অবগত। তাদের উন্নত নৈতিকতা ইসলামের বাণী পৌঁছানোর মাধ্যম হওয়া উচিত।

আগামী শতাব্দীতে নিজেদের জন্য লক্ষ্য নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে হুযূর আকদাস বলেন যে, তাদের উচিত তাঁর খুতবায় হযরত মসীহ্‌ মওউদ (আ.)-এর শিক্ষার আলোকে বর্ণিত সর্বোচ্চ নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মান অর্জনের বিষয়ে মনোযোগ নিবদ্ধ করা।

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“আগামী শতাব্দীর জন্য আমাদের নতুন লক্ষ্য কী? তা এই যে, আমরা যেন হযরত আকদাস মসীহ্‌ মওউদ (আ.) এর বর্ণিত লেখনীর আলোকে আমি যে জীবন বিধানের ওপর আলোকপাত করেছি তার ওপর আমল করা। আমাদের এ দাবি সত্য প্রমাণ করে দেখাতে হবে যে, আমরা মানুষের হৃদয় জয় করতে এসেছি এবং তাদের মনে এক খোদার অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত প্রত্যয় জাগাতে এবং মানবজাতিকে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পদতলে সমবেত করতে চলেছি। সুতরাং, এই দিক থেকে আমাদের আত্মবিশ্লেষণ করতে হবে।”

হুযূর আকদাস জুমুআর খুতবা শেষ করার পূর্বে আবারও ধর্মকে পার্থিবতার ওপর অগ্রাধিকার প্রদানের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে বলেন:

“আহমদীয়া মুসলিম জামা’ত জার্মানির উচিত নতুন শতবর্ষে এক নব প্রতিজ্ঞা নিয়ে প্রবেশ করা যে, ধর্মকে পার্থিবতার ওপর প্রাধান্য দান করে আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জনে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা গ্রহণ করবো। আর নিজেদের সন্তানাদি এবং পরবর্তী প্রজন্মসমূহকেও এই নসীহত করতে থাকবো এবং এমনভাবে তাদের তরবিয়ত (চরিত্র গঠন) করবো যে, আল্লাহ তা’লার সাথে জীবন্ত সম্পর্ক স্থাপনের আকাঙ্ক্ষা যেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে স্থানান্তরিত হতে থাকে। আল্লাহ্‌ আমাদেরকে এর তৌফিক দান করুন।”

জুমুআর নামাযের পর হুযূর আকদাস মজলিস খোদ্দামুল আহমদীয়া জার্মানির প্রস্তুতকৃত মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনচরিত সংক্রান্ত ওয়েবসাইট muhammad.de-এর উদ্বোধন করেন।