প্রেস বিজ্ঞপ্তি
০৭-আগস্ট, ২০২৩

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.)-এর ঈমানবর্ধক ভাষণের মধ্য দিয়ে শেষ হলো ৫৭তম জলসা সালানা যুক্তরাজ্য


আহমদীয়া মুসলিম জামা’তে যোগদান করলো ২,১৭,১০০ এর অধিক মানুষ

৩০ জুলাই, ২০২৩ এক ঈমানবর্ধক ভাষণের মধ্য দিয়ে আহমদীয়া মুসলিম জামা’ত যুক্তরাজ্যের ৫৭তম বার্ষিক সম্মেলন (জলসা সালানা) সমাপ্ত করলেন আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.)।
হ্যাম্পশায়ারের অল্টনে অবস্থিত হাদীকাতুল মাহ্দীতে অনুষ্ঠিত জলসা সালানায় ৪১,৬৫০-এর অধিক মানুষ অংশগ্রহণ করেন।

কোভিড-১৯ এর পর এটিই ছিল প্রথম পূর্ণাঙ্গীন আন্তর্জাতিক জলসা এবং এতে ১১৮টি দেশ থেকে মানুষজন অংশগ্রহণ করেন। পুরো অনুষ্ঠানমালা এমটিএ ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে সরাসরি সম্প্রচারিত হয় এবং অনলাইনে স্ট্রিমিং করা হয়।

তিন দিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত জলসা সালানার একটি বিশেষ আকর্ষণ ছিল রবিবারের বয়আত (আনুগত্যের দীক্ষা) গ্রহণের পর্বটি। অংশগ্রহণকারীরা পুনরায় প্রতিশ্রুত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর পঞ্চম খলীফা হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.)-এর হাতে আনু্ষ্ঠানিকভাবে আনুগত্যের অঙ্গীকার করেন।

অংশগ্রহণকারীরা খলীফা পর্যন্ত বিস্তৃত এক মানব-শৃঙ্খল গঠন করেন এবং একত্রে বয়আতের বাক্যগুলো পুনরাবৃত্তি করেন।

এ অনুষ্ঠানের পূর্বে হুযূর আকদাস ঘোষণা করেন যে, গত বছর পৃথিবীর ১১৪টি দেশ থেকে ২,১৭,১৬৮ জন আহমদীয়া মুসলিম জামা’তে যোগদান করেছেন।

সমাপনী ভাষণে হুযূর আকদাস মানবজাতিকে ইসলাম প্রদত্ত উন্নত অধিকারের উপর আলোকপাতের ধারা অব্যাহত রাখেন, যা অন্য যেকোনো ধর্মবিশ্বাস বা মতবাদের তুলনায় শ্রেষ্ঠতর। এটি ছিল উক্ত বিষয়ে ২০১৯, ২০২১ ও ২০২২ সালের জলসা সালানা যুক্তরাজ্যের সমাপনী অধিবেশনগুলোতে হুযূর আকদাস প্রদত্ত ভাষণগুলির ধারাবাহিকতায় চতুর্থ পর্ব।

কীভাবে আহমদী মুসলমানদের গর্বিত হওয়া উচিত যে, ইসলাম সমাজের সকল শ্রেণির মানুষকে পূর্ণাঙ্গ অধিকার প্রদান করে, এ বিষয়ে বলতে গিয়ে হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“অন্যদের নিকট ইসলামের শিক্ষা প্রচারে কখনোই আমাদের কুন্ঠিত বোধ করা কিংবা হীনমন্যতায় ভোগা উচিত নয়। ইসলামের আইন-কানুন ও শিক্ষা প্রকৃতিতে চিরস্থায়ী। এগুলো এতটাই সর্বাঙ্গীণ যে, সময়ের সাথে সাথে তা পরিবর্তন করার কোনো প্রয়োজন নেই। বস্তুবাদী মানুষজন তাদের মতানুযায়ী মানবাধিকার রক্ষার জন্য আইন তৈরী করে। কিছুদিন পর তারা এর দুর্বলতা অনুধাবন করে, আর নিজেরাই নিজেদের প্রণীত আইনের বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠায়, বলে যে, এর মধ্যে এমন ভারসাম্যহীনতা ছিল এবং এর ইতিবাচক দিকের চেয়ে নেতিবাচক দিকই বেশি। এভাবে আইনটি উপহাসের পাত্রে পরিণত হয়। সুতরাং, আজ আমাদের দায়িত্ব আমরা যেন বিশ্ববাসীকে মানুষের সত্যিকার অধিকার সম্পর্কে অবহিত করি এবং তাদেরকে পথ নির্দেশ প্রদান করি যে, বিভিন্ন শ্রেণির অধিকার সমুন্নত রেখে কীভাবে একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যায়।”

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) আরও বলেন:

“এ মৌলিক বিষয়টি সর্বদা মনে গেঁথে রাখতে হবে যে, বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের অধিকার কারো দ্বারা সত্যিকার অর্থে তখনই সমুন্নত রাখা সম্ভব যদি তার এই দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে, একজন পরম সত্তা আছেন যিনি আমাদের প্রতিটি কাজ পর্যবেক্ষণ করছেন, হিসাব রাখছেন এবং আমরা যদি তাঁর নির্দেশনা পালনে ব্যর্থ হই তাহলে আমাদেরকে [তাঁর কাছে] জবাবদিহি করতে হবে। … আমাদের এ বিষয়টিও সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে যে, আমাদের কেবল খোদা তা’লার অধিকার রক্ষা করলেই চলবে না, যিনি আসমান-যমীনের স্রষ্টা এবং এক ও অদ্বিতীয় খোদা; বরং, তাঁর সৃষ্টির অধিকারও প্রদান করতে হবে; কারণ, তিনি তাঁর সৃষ্টিকে খুব ভালোবাসেন। যখন আমরা এভাবে চিন্তা করি তখনই খোদা তা’লার ওপর দৃঢ় বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ধর্মের আবশ্যকতাও মানুষ অনুধাবন করতে সক্ষম হয়।”

হুযূর আকদাস বলেন, বিগত তিনটি জলসা সালানার ভাষণগুলোতে তিনি সমাজের ২১টি ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির মানুষকে ইসলাম যে অধিকার প্রদান করে তা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।

এ বছর হুযূর আকদাস দরিদ্র ও বঞ্চিত শ্রেণির অধিকার এবং সমাজে তাদের দেখাশোনার বিষয়টি ইসলাম কীভাবে নিশ্চিত করে তা সম্পর্কে আলোচনা করেন।

মিসকীন (অভাবী)-দের দেখাশোনার গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে, হুযূর আকদাস পবিত্র কুরআনের ৯:৬০ আয়াত উদ্ধৃত করেন:

“সদকা কেবল গরীব, মিসকীন এবং সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের এবং তাদের জন্য যাদের হৃদয়ে প্রীতি সঞ্চার করতে হয় এবং দাস-মুক্তির জন্য এবং ঋণগ্রস্তদের জন্য এবং আল্লাহর পথে জিহাদকারী এবং পথিকদের জন্য — আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত বিধান। বস্তুত, আল্লাহ্ সর্বজ্ঞানী, পরম প্রজ্ঞাময়।”

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, “তোমাদের মধ্য থেকে যারা দুর্বল শ্রেণির রয়েছে, তাদের মাধ্যমেই তো তোমরা সাহায্য পাও, আর রিয্ক লাভ করো। অর্থাৎ, এই গরীব শ্রেণির মানুষেরা তোমাদের জন্য কাজ করে থাকে এবং ধনীরাও তাদের কাজের মাধ্যমে উপকৃত হয়। তাই, তাদের দেখাশোনা করো, আর তাদের প্রয়োজনসমূহ মেটানোর জন্য তাদের কাজের যথাযথ প্রতিদান প্রদান করো, যেন তাদের মধ্যে কোনো প্রকার অস্থিরতা সৃষ্টি না হয়। আজকাল প্রায়শই যেসব ধর্মঘট ও বিক্ষোভ হচ্ছে তা মজুরি সঠিকভাবে প্রদান না করার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই সংঘটিত হচ্ছে। এমনটি ধনী দেশসমূহেও হচ্ছে। শিক্ষিত শ্রেণিও বিক্ষোভ করে, কখনো ডাক্তারও ধর্মঘটে যায়, কখনো অন্যান্য শ্রেণি-পেশার কর্মচারীরাও ধর্মঘটে যায়। এমনটি সারা বিশ্বজুড়ে হচ্ছে। কিছু দেশে বিদ্রোহ হচ্ছে এবং অন্যান্য জায়গায় সামরিক অভ্যুত্থান হচ্ছে। এ সবই এ কারণে হচ্ছে যে, গরীবদের অধিকার প্রদান করা হচ্ছে না। গরীবদেরকে তাদের প্রাপ্য না দিয়ে ধনীরা নিজেদের পকেট ভর্তি করছে।”

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রীতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) উল্লেখ করেন, একবার খয়বরে হযরত উমর (রা.) কিছু সম্পত্তি লাভ করেন, তিনি মুহাম্মদ (সা.)-এর নিকট আসেন এবং তিনি (সা.) তাকে বলেন, ‘তুমি চাইলে উক্ত সম্পত্তি মানবসেবার জন্য দান করতে পারো।’ তাই হযরত উমর (রা.) উক্ত সকল সম্পদ গরীব ও অভাবীদের প্রয়োজনে নিয়োজিত করেন।

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ অপর এক হাদীস উল্লেখ করেন যেখানে বলা হয়েছে:

“বিধবা বা অভাবীর সেবায় সংগ্রামে নিয়োজিত ব্যক্তির অবস্থা সেই ব্যক্তির ন্যায় যে জিহাদে গমন করে।”

হুযূর আকদাস খুলাফায়ে রাশেদীন, অর্থাৎ, ইসলামের [প্রথম] চারজন খলীফা কীভাবে গরীবদের দেখাশোনা করতেন এ সম্বন্ধে তাঁদের জীবন থেকে আরও ঘটনাসমূহ উল্লেখ করেন।

হুযূর আকদাস বলেন, হযরত উমর (রা.)-এর সময়ে একটি আদমশুমারি হয়েছিল, যেন প্রত্যেক ব্যক্তির, সে ধনীই হোক কিংবা গরীব, ইসলামী সরকারের অধীনে খাদ্য ও বস্ত্রের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করা যায়। সুতরাং, ইসলামে যে রাষ্ট্র-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা নিশ্চিত করেছিল যেন গরীব জনগোষ্ঠীর নিজেদের মৌলিক চাহিদা পূরণে সংগ্রাম করতে না হয়।

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“ইসলামই সেই এক ধর্ম যা জাতীয় পর্যায়েও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। ইসলামের শিক্ষা অনুসারে প্রত্যেক ব্যক্তির অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান প্রদান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ইসলামই সর্বপ্রথম এই অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠা করেছে। বর্তমানে রাষ্ট্রসমূহ এর অনুকরণের চেষ্টা করছে, কিন্তু, পরিপূর্ণভাবে নয়। দুর্ভাগ্যক্রমে, অল্প কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত, মুসলমান দেশসমূহও এই দায়িত্ব পালন করছে না। যদি মুসলমানরা তাদের এই দায়িত্ব পালন করা শুরু করে, তবে তাদের ভাগ্য বদলে যাবে। এর মাধ্যমে মানুষের হতাশা ও অস্থিরতা দূরীভূত হবে, আর, ধর্মঘট, সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও বিক্ষোভ বন্ধ হয়ে যাবে।”

হুযূর আকদাস হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর জীবন থেকেও ঘটনাসমূহ বর্ণনা করেন যে, কীভাবে তিনি অভাবীদের সেবাযত্ন করতেন। তিনি (আ.) কাদিয়ানে দামী ঔষধ ক্রয় করতেন এবং গরীব ও অভাবীরা তাঁর বাড়ি থেকে বিনামূল্যে চিকিৎসা গ্রহণের জন্য তাঁর নিকট আসতো। মাঝে মাঝে এ কাজে তাঁর মূ্ল্যবান সময় থেকে কয়েক ঘণ্টাও ব্যয় হয়ে যেত।

একবার তাঁর এক সাহাবী দেখলেন, অনেকক্ষণ সময় ধরে মসীহ্ মওউদ (আ.) তাঁর বাড়িতে আগত রোগীদের সেবা প্রদান করছেন এবং এটি করতে গিয়ে তিন ঘণ্টা সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। তিনি মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে বললেন, এই মানুষদেরকে দেখা ও সেবা প্রদান করার কাজটি শ্রমসাধ্য এবং তাঁর জন্য কষ্টের কারণ, আর তাঁর অন্যান্য মূল্যবান কাজ থেকেও তাঁকে বিরত রাখে। তাই, তাঁর উচিত তাঁর নিকট আগত গরীবদেরকে সেবা প্রদান করার কাজটি এড়িয়ে যাওয়া।

মসীহ্ মওউদ (আ.) উত্তর প্রদান করতে গিয়ে বলেন:

“অন্যান্য ধর্মীয় কাজের মতো এটিও ধর্মীয় কাজ। এই সকল মানুষজন গরীব এবং নিকটে কোনো হাসপাতাল নেই। আমি তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সকল অ্যালোপ্যাথি ও ইউনানী ঔষধ সংগ্রহ করে রাখি, যা সময়ে সময়ে কাজে লাগে। এটি অনেক পুণ্যের কাজ; আর একজন মু’মিনের এ কাজে অলস বা উদাসীন হওয়া কিংবা অবহেলা করা উচিত নয়।”

তাঁর ভাষণের শেষলগ্নে হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে সকল প্রকার ঔদ্ধত্ব ও অহংকার থেকে [রক্ষা করুন এবং] গরীব ও অভাবীদেরকে [তাদের প্রাপ্য] অধিকার প্রদান করার তৌফিক প্রদান করুন। বিশ্বজুড়ে আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের মাঝে সকল দেশে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হোক যার মাঝে ইসলামের শিক্ষার প্রকৃত চিত্র ফুটে ওঠে।”



অতিরিক্ত ছবি

সমাপ্ত
আরো তথ্যের জন্য যোগাযোগ করুন: media@pressahmadiyya.com