প্রেস বিজ্ঞপ্তি
০২-জুলাই, ২০২৩

ইসলামাবাদ থেকে ঈদুল আযহার খুতবা প্রদান করলেন আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান


“যদি আমরা আল্লাহ্‌ তা’লার সাথে এক বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করতে পারি, তাহলে এই বিরোধিতা দেখতে দেখতে বাতাসে মিলিয়ে যাবে” – হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.)

২৯ জুন, ২০২৩ টিলফোর্ডের ইসলামাবাদে মুবারক মসজিদ থেকে ঈদুল আযহার খুতবা প্রদান করেন আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.)।

বৈশ্বিক টেলিভিশন চ্যানেল এমটিএ ইন্টারন্যাশনাল-এর মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে লক্ষ-কোটি আহমদী মুসলমান তাদের খলীফার ঈদের খুতবা সরাসরি শোনার এবং তাদের আধ্যাত্মিক নেতার পরিচালিত দোয়ায় যোগদানের সুযোগ লাভ করেন।

খুতবায়, হুযূর আকদাস ঈদে পশু কোরবানির অন্তরালে নিহিত দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করেন এবং পাকিস্তানে আহমদী মুসলমানগণ যে সকল দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন তার ওপর আলোকপাত করেন, যেখানে ঈদে পশু কুরবানির ধর্মীয় বিধান পালন করা থেকেও তাদেরকে বিরত রাখা হচ্ছে।

খুতবার শুরুতে হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) পবিত্র কুরআনের ২২:৩৮ আয়াত পাঠ করেন যেখানে বলা হয়েছে:

“তাদের মাংস ও তাদের রক্ত কখনো আল্লাহ্‌র কাছে পৌঁছে না; বরং, তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়া পৌঁছে। এভাবেই তিনি এগুলোকে তোমাদের সেবায় নিয়োজিত করে দিয়েছেন যেন তোমরা আল্লাহ্‌র শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো; কারণ, তিনি তোমাদেরকে হেদায়েত দান করেছেন। আর তুমি সৎকর্মপরায়ণদের সুসংবাদ দাও।”

পাকিস্তানে আহমদী মুসলমানদের পরিস্থিতির সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে, হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“পাকিস্তানে এই ঈদে আহমদীদেরকে তাদের আবেগ ও অনুভূতির কুরবানী করতে হয়। আল্লাহ তা’লার ফযলে আহমদীগণ আর্থিক কুরবানীতে অভ্যস্ত; বরং, এই যুগে প্রাণের কুরবানী দেওয়া, আর কেবলমাত্র আল্লাহ তা’লার খাতিরে প্রাণের কুরবানী দেওয়ার মর্ম যতটা আহমদীদের মধ্যে রয়েছে আর কারও মাঝে তা পাওয়া দুষ্কর হবে। … যখন তাদেরকে ঈদের সময় পশু কুরবানীর ধর্মীয় বিধান পালন করতেও বাধা প্রদান করা হয়, তখন তারা যে ব্যথা অনুভব করেন তা কল্পনা করাও কঠিন। অথচ পাকিস্তানে, আইনের নামে, আহমদীদেরকে এই পশু কুরবানী করতে বাধা দেওয়া হচ্ছে, আর এই সবই করা হচ্ছে তথাকথিত মোল্লাদের কথায়।”

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) আরও বলেন:

“কখনো কখনো (আইন প্রয়োগকারী সংস্থার) কর্মকর্তারা মোল্লাদের ভয়ে বা ব্যক্তিগত রেষারেষির জের ধরে আহমদীদেরকে কুরবানী দিতে বাধা প্রদান করে। এসব মানুষ খোদার চেয়ে মানুষকে বেশি ভয় করে। তারা জানে না যে, অন্যায় কখনো দীর্ঘকাল চলতে পারে না। এরা আজকে তাদের শক্তির উন্মত্ততায় যা খুশি তাই করছে; কিন্তু, ইনশাআল্লাহ্‌ একদিন তারা আল্লাহ্‌ তা’লার পাকড়াওয়ের মধ্যে এসে যাবে। কিন্তু, আহমদীদেরকে এই দিনগুলোতে যেখানে নিজেদের আবেগ-অনুভূতির কুরবানী পেশ করতে হচ্ছে, আর এই আবেগ-অনুভুতির কুরবানী কোনো মামুলী বিষয় নয়; সেখানে এই আবেগ-অনুভূতিকে খোদা তা’লার দরবারে দোয়াতে পরিণত করার চেষ্টা করুন। দোয়াতে বড় শক্তি রয়েছে। হযরত হাজেরা ও হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর দোয়া ও আহাজারি এবং ব্যাকুলতা ও আল্লাহ্‌ তা’লার ওপর ভরসাই ছিল যা পানির এক প্র্রস্রবণকে প্রবাহিত করেছিল, আর এর শহর গড়ে তুলেছিল, এমন শহর যা ইসলামের মরকযে [কেন্দ্রে] পরিণত হয়েছিল।”

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) আরও বলেন:

“সুতরাং, আমাদেরকে কুরবানীর ঈদ থেকে কেবল এই শিক্ষায় গ্রহণ করা যথেষ্ট নয় যে, আমাদেরকে পশুর কুরবানী করতে হবে, আর এটাই সব। কুরবানীর প্রেরণার পিছনে প্রকৃত বিষয় হলো আল্লাহ্‌ তা’লার সন্তুষ্টিকে কামনা করা আর তাকওয়া অর্জন করা।”
হুযূর আকদাস বলেন যে, যেখানে আহমদী মুসলমানদের কুরবানী করতে বাধা দেওয়া হচ্ছে, সেখানে পাকিস্তানে এমন মানুষ রয়েছে যারা বড় অংকের টাকা দিয়ে মূল্যবান পশু ক্রয় করে লোক দেখানোর জন্য সেটির কুরবানী দিচ্ছে, যদিও বাস্তবতা এই যে, তাদের সম্পদ ন্যায়পথে উপার্জিত নয়।

পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে, হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) আরও বলেন:

“পাকিস্তানের মানুষ একদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে হইচই করছে, অপরদিকে লক্ষ টাকার পশু কুরবানীর জন্য ক্রয় করা হচ্ছে। যদি এই মানুষগুলোই সততার সাথে জীবন-যাপন করতো, নিজেদের কর আদায় করতো, তাহলে এই মুদ্রাস্ফীতি যা নিয়ে সেখানে শোরগোল তা সমাপ্ত হতো, আর দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা পেতো। কিন্তু, বস্তুতপক্ষে, সেখানে তো পুরো ব্যবস্থাপনাই দুর্নীতিগ্রস্ত, তাই কোন কিছু বলে কোন লাভ নেই … কিন্তু, যদি কোন আহমদী আল্লাহ্‌ তা’লার সন্তুষ্টি অর্জন করতে চান, তবে তাকে তাকওয়ার পথে চলতে হবে এবং নিজের অবস্থার পর্যালোচনা করতে হবে। যদি আমাদের মাঝে তাকওয়া থেকে থাকে এবং যদি আমাদের সকল কর্ম আল্লাহ্‌ তা’লার সন্তুষ্টির খাতিরে হয়ে থাকে, তবে আল্লাহ তা’লা হৃদয়ের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত, আমাদের আবেগ-অনুভূতি সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞাত। তিনি আমাদের পশু কুরবানী করা ছাড়াই আমাদেরকে কুরবানীর পুরস্কার দান করতে পারেন। … যদি আমরা তাকওয়ার এই মানে উপনীত হতে পারি, আল্লাহ্‌ তা’লার সাথে এক বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করতে পারি, তাহলে এই বিরোধিতা দেখতে দেখতে বাতাসে মিলিয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ্‌; আর আমরা সকল ইসলামী কুরবানী পরিপূর্ণ স্বাধীনতার সাথে আদায় করতে পারবো।”

হুযূর আকদাস বলেন যে, একদিকে যেখানে ঈদে পশু কুরবানীর পিছনে যে প্রেরণা কাজ করে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আর বাহ্যিকভাবে এই কুরবানী সম্পন্ন করাও বিশেষ গুরুত্ব রাখে। সুতরাং, যাদের সুযোগ আছে এবং যারা সামর্থ্যবান তাদের অবশ্যই এই কুরবানী করা উচিত।

পশু কুরবানীর গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে, হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“এই বাহ্যিক পশুর কুরবানী একটি সুন্নত, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুসৃত রীতি। এই ইব্রাহীমী সুন্নতকে ইসলামে বিশেষভাবে পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। আর আঁ-হযরত (সা.) সর্বদা এই কুরবানী করেছেন। বরং, এমনকি উম্মতের দরিদ্রদের পক্ষ থেকেও তিনি (সা.) পশু কুরবানী করেছেন। এই বিষয়টির তাৎপর্য আপনাদের পক্ষে এখানে উন্নত বিশ্বে অনুধাবন করা কঠিন; কিন্তু, গরীব দেশগুলোতে যখন কুরবানীর মাংস বণ্টন করা হয়, তখন তাদের (গরীবদের) আনন্দ দেখার মত হয়ে থাকে। সেখানে অগণিত মানুষ এমন থাকেন যারা হয়তোবা দুই বছর মাংস খাওয়ার সুযোগ হয় নি! আর তারা এমনটি প্রকাশও করে থাকেন। সুতরাং, এই বাহ্যিক কুরবানীও বান্দার হক আদায় করার একটি উপায়, আর এর ফলেও আল্লাহ্ তা’লার ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়; কেননা, এর মাধ্যমেও আল্লাহ্‌ তা’লার সৃষ্টির সেবা আল্লাহ্‌ তা’লার ভালোবাসার খাতিরে মানুষ করে থাকে।”

হুযূর আকদাস বলেন যে, বাহ্যিক কর্মের এক প্রভাব কোন ব্যক্তির আধ্যাত্মিকতার ওপর পরে এবং উভয়ে একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আর তাই, ঈদে পশু কুরবানী বাহ্যিকভাবেও সম্পাদন করা আবশ্যক; কেননা এটি আমাদের দৃষ্টি সেই কুরবানীর দিকে আকর্ষণ করে, যেখানে আল্লাহ্‌ তা’লার খাতিরে নিজেদের আবেগ ও অনুভূতির কুরবানী করতে হয়।

ঈদ উপলক্ষে পশু কুরবানীর কল্যাণ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে, হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“ইসলামের প্রতিটি আদেশের পিছনে এক প্রজ্ঞা ও দর্শন থাকে। কিছু মানুষ আমাকে লিখে থাকেন যে, কুরবানী বা সদকা হিসেবে পশু কুরবানী করে কী লাভ? এর স্থলে এ অর্থ দিয়ে অমুক কাজ করলে তা আরো ভালো হতো। এটি মূলত ঐ সকল মানুষ বলে থাকেন, যাদের খাদ্যের চাহিদা পূরণে কোন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় না। আর তাই, তারা খাদ্যের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেন না। তারা ওই সকল মানুষের অবস্থা অনুধাবন করতে পারেন না, যাদের মাংস তো দূরে থাক, খাবার কেনারই সামর্থ্য নেই। হ্যাঁ এটা সত্য যে, সামর্থ্যবান মানুষ যখন ঈদের কুরবানীর জন্য লক্ষ টাকা খরচ করে থাকেন, তখন দরিদ্রদের অন্যান্য প্রয়োজন পূরণের জন্যও দান-খয়রাত করা উচিত; যেন তারা তাদের সেই সকল প্রয়োজন পূরণ করতে পারেন।”

খুতবার শেষাংশে, হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“আল্লাহ তা’লা আমাদেরকে সঠিক উপলব্ধির সাথে কুরবানীর প্রেরণা অনুধাবন করার তৌফিক দান করুন, আর আমাদেরকে নিজেদের অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি করার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থাকে খোদা তা’লার সন্তুষ্টি অনুযায়ী ঢেলে সাজানোর তৌফিক দান করুন। আমরা যেন একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ্‌ তা’লার হয়ে যাই, আর আল্লাহ্‌ তা’লাও অতি শীঘ্র আমাদের জন্য বিরুদ্ধেবাদীদের হাত থেকে মুক্তির উপকরণ সৃষ্টি করুন।”