প্রেস বিজ্ঞপ্তি
২৩-মে, ২০২৩

“জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত ধর্মের সেবা করে যান” – যুক্তরাজ্যের মজলিসে শূরার ভাষণে আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান


“আপনারা সকলে যুগ-খলীফার প্রকৃত সুলতানে নাসীর (সাহায্যকারী শক্তি) সাব্যস্ত হোন”
– হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.)

২০-২১ মে ২০২৩, লন্ডনের বাইতুল ফুতূহ মসজিদে অনুষ্ঠিত আহমদীয়া মুসলিম জামা’ত যুক্তরাজ্যের জাতীয় মজলিসে শূরায় ২১ মে তারিখে এক ঈমানোদ্দীপক ভাষণ প্রদান করেন আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.)।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’ত কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মজলিসে শূরা এই জামা’তের মূল পরামর্শ সভা যেখানে ইসলামের শান্তিপূর্ণ শিক্ষার প্রচার ও প্রসারকে বেগবান করতে কর্মপরিকল্পনার প্রস্তাবসমূহ আলোচিত হয়ে থাকে।

বাইতুল ফুতূহ মসজিদে উপস্থিত হওয়ার পর হুযূর আকদাস মজলিসে শূরার প্রতিনিধিদের উদ্দেশে ভাষণ প্রদান করেন এবং তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য তুলে ধরেন।

হুযূর আকদাস শূরা প্রতিনিধিবৃন্দের দায়িত্বাবলি সম্পর্কে ১২ মে, ২০২৩-এ তাঁর প্রদত্ত জুমুআ’র খুতবার কথা উল্লেখ করেন এবং পুর্নব্যক্ত করেন যে, শূরায় উপস্থিত হয়ে কেবল মতামত প্রদান করার চেয়েও শূরা প্রতিনিধিবৃন্দের দায়িত্বের পরিধি অনেক বড়।

প্রতিনিধিদের উদ্দেশে বলতে গিয়ে, হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“শূরা সমাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বরং, আপনাদের মনে করা উচিত যে, আপনার দায়িত্ব মাত্র শুরু হলো। [শূরার] আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর খলীফাতুল মসীহ্ (আই.) কর্তৃক যা অনুমোদিত হয় তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার জন্য প্রত্যেক প্রতিনিধির এবং পদাধিকারীর অবশ্যই কঠোর প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। এ বিষয়টি চিন্তায় রেখে, আমি দোয়া করি যেন আল্লাহ্ তা’লা আপনাদেরকে প্রয়োজনীয় প্রেরণা ও কর্তব্যনিষ্ঠার সাথে সেবা করার তৌফিক প্রদান করেন। আপনারা সকলে যুগ-খলীফার প্রকৃত সুলতানে নাসীর (সাহায্যকারী শক্তি) সাব্যস্ত হোন এবং বর্তমান যুগে আল্লাহ্ তা’লা প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.)-কে যে উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছেন তার পূরণকারী হোন।”

হুযূর আকদাস ১৯৪৪ সালের মজলিসে শূরায় দ্বিতীয় খলীফাতুল মসীহ্ (রা.)-এর প্রদত্ত এক ঐতিহাসিক ভাষণের কথা বর্ণনা করেন এবং শূরা প্রতিনিধিদের দায়িত্বাবলি সম্পর্কে বেশ কয়েকটি বিষয় সেই বক্তৃতা থেকে উল্লেখ করে বলেন যে, তাদের অবশ্যই মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সাহাবাদের মতো হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

হুযূর আকদাস প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.)-এর একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করেন যেখানে বলা হয়েছে, “তোমরা যখন আমার সাথে যুক্ত হও, তখন সাহাবাদের সাথে মিলিত হবে”।

দ্বিতীয় খলীফাতুল মসীহের বক্তব্যের আলোকে হুযূর আকদাস বলেন যে, এমন নয় যে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সময়ে বসবাসরত মানুষেরাই কেবল তাঁর সাহাবী হিসেবে গণ্য হওয়ার সুযোগ লাভ করবেন।

‘সাহাবী’ উপাধি সম্পর্কে বলতে গিয়ে, হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“[‘সাহাবী’] শব্দটির মাঝে আরও গভীরতর অর্থ লুক্কায়িত আছে। মহানবী (সা.)-এর সাহাবী বলতে তাকে বুঝায় যার হৃদয় আল্লাহ্ তা’লার প্রিয়তমের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রে আধ্যাত্মিকভাবে পরিশুদ্ধ ও রূপান্তরিত। তিনি এমন এক ব্যক্তি যার আধ্যাত্মিকতার স্পন্দন তার প্রভুর নিশ্ছিদ্র আনুগত্যে স্পন্দিত হয়। তিনি এমন এক মানুষ যার ঈমান ও নিষ্ঠা বিশুদ্ধ এবং যিনি তার ধর্মবিশ্বাসের জন্য সম্ভাব্য সকল প্রকার ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত …”

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) আরও বলেন:

“সহচর হওয়ার জন্য নেতার শারীরিক নৈকট্য আবশ্যকীয় নয়; বরং, সাহচর্যের জন্য মৌলিক শর্ত হলো এক আধ্যাত্মিক এবং মানসিক সম্পর্ক-বন্ধন যার সাথে নিশ্ছিদ্র বিশ্বস্ততা সম্পর্কযুক্ত।”

একজন সাহাবী হওয়ার জন্য যেসব গুণাবলি দরকার তা ব্যক্ত করতে গিয়ে, হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“এক অনুগত সাহাবী হওয়ার জন্য তিনটি গুণ আবশ্যকীয় – সেই ব্যক্তির সত্যতার উপর দৃঢ় বিশ্বাস ও প্রত্যয়, তাঁর মতো হওয়ার প্রচেষ্টা এবং তাঁর মূল্যবোধ ও শিক্ষা অনুযায়ী জীবনযাপনের চেষ্টা করা।”

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) আরও অগ্রসর হয়ে বলেন:

“ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, বেশিরভাগ মানুষ, যারা মহানবী (সা.)-এর বরকতময় সাহচর্য লাভের সম্মান লাভ করেছেন, তারা প্রকৃত সাহাবীর মর্যাদা লাভ করেছেন। একই সাথে, হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) [দ্বিতীয় খলীফাতুল মসীহ্] বলেন যে, এটাও সত্য যে, মহানবী (সা.)-এর উম্মাহ্-র মধ্যে অগণিত মানুষ রয়েছেন যারা মহানবী (সা.)-এর বাহ্যিক নৈকট্য লাভ না করেও সাহাবী হওয়ার মর্যাদা লাভ করেছেন। তাকওয়া ও আন্তরিকতা তাদেরকে সময় ও ভৌগোলিক দূরত্ব অতিক্রম করিয়েছে এবং প্রকৃত সাহাবীদের মধ্যে গণ্য করিয়েছে। তারা এই সম্মান এজন্য লাভ করেছেন যে, তারা মহানবী (সা.) এর ভালোবাসায় নিমগ্ন ছিলেন এবং আল্লাহ্ তা’লার নৈকট্য অর্জনের জন্য সীমাহীন আবেগের সাথে প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন।”

হুযূর আকদাস বলেন, ইসলামের ইতিহাস জুড়ে ইসলামের অগণিত সেবক এই মর্যাদা লাভ করেছেন; যদিও বাহ্যিকভাবে তারা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সান্নিধ্য পান নি।

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“যদিও তারা মহানবী (সা.)-কে বাহ্যিকভাবে দেখতে পারেন নি, তবে তাদের ধর্মপরায়ণ হৃদয়ের অন্তঃস্থলে প্রোথিত আধ্যাত্মিকতার চোখ তাদেরকে তাঁর দর্শন লাভ করার এবং তাঁর সাথে এক অটুট বন্ধন গড়ার তৌফিক প্রদান করেছে।”

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) আরও বলেন:

“বর্তমান যুগে প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.)-এর পতাকাতলে সমবেত হয়ে এবং তাঁর বয়আত গ্রহণ করার পর, যারা তাঁর মিশনকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করবে তারাও তাঁর সাহাবী হওয়ার মর্যাদা অর্জন করতে পারবেন। সুতরাং, আমি আপনাদের সকলকে প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.)-এর শব্দগুলোর ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে অনুরোধ করছি যেখানে তিনি বলেছেন যে, ‘তোমরা যখন আমার সাথে যুক্ত হও, তখন সাহাবাদের সাথে মিলিত হবে’। মহানবী (সা.) ও প্রতিশ্রুত মসীহ (আ.) এর আধ্যাত্মিক সাহচর্য লাভের যে চিরন্তন উপহার মহান আল্লাহ্ তা’লা মানবজাতিকে দিয়েছেন তার সুযোগ গ্রহণ করার চেষ্টা করুন।”

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) আরও বলেন:

“এটি দাবি করে যে, প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.)-কে মানার পর, মহানবী (সা.)-এর সুন্নত অনুসারে আমরা আরও বেশি আমল করতে, তাঁর শিক্ষাকে আত্মস্থ করতে এবং আল্লাহ্ তা’লার সঙ্গে জীবন্ত সম্পর্ক গড়তে সচেষ্ট হই। এর দাবি এই যে, আমরা সম্ভাব্য সকল ধরনের ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকি এবং ইসলামের বাণী প্রচারের জন্য গভীর ও দৃঢ় সংকল্প ধারণ করি।”

হুযূর আকদাস বলেন, উচ্চ আধ্যাত্মিক মর্যাদা অর্জনের জন্য কখনো কখনো মানুষ ও জামা’তকে কঠিন কষ্টের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হতে হয়। তখন তাদেরকে অবশ্যই “ধৈর্য এবং আল্লাহ্ তা’লার ওপর অবিচল আস্থা” নিয়ে অগ্রসর হতে হবে।

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“অবশ্যই, আল্লাহ্ তা’লার পথে কখনো কখনো প্রতিকূলতা ও কষ্ট থাকে, যার মাধ্যমে তিনি মানুষকে আধ্যাত্মিক মুক্তি ও প্রকৃত স্বাধীনতার পথ প্রদর্শন করেন। জাগতিকতা ও বস্তুবাদিতার শৃঙ্খল থেকে একবার মুক্তি পাওয়ার পর কোনো ব্যক্তি তার সকল শক্তি ধর্মীয় শিক্ষা অনুসারে জীবনযাপনে এবং এর প্রচারে নিয়োজিত করতে পারে। এটিও হয়ে থাকে যে, কখনো কখনো, পরীক্ষার মাধ্যমে আল্লাহ্ তা’লা তাঁর [আল্লাহ্‌র] গৌরব ও মহিমা প্রদর্শন করেন। তিনি মানুষকে উপলব্ধি করাতে চান যে, তিনি একাই নিশ্চিত করবেন যে, প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.)-এর জামা’ত ক্রমাগত ফুলে ফলে সুশোভিত হতে থাকবে এবং তিনি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠির সাহায্য-সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল নন।”

লক্ষ-কোটি আহমদী মুসলমান মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি আন্তরিকভাবে নিবেদিত, তা উল্লেখ করে, হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“এই যুগে আমাদের জামা’তের সদস্যরাই সাহাবীদের মহৎ ও ধর্মপরায়ণ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে নিজেদের জীবন যাপনে সচেষ্ট রয়েছেন এবং ধর্মের জন্য যেকোনো প্রকার ত্যাগ স্বীকোরের জন্য প্রস্তুত রয়েছেন। আমরা যত দুঃখ-কষ্টই ভোগ করি না কেন, মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের সময়ে সাহাবাদের কষ্টের সাথে তার তুলনা হতে পারে না। আহমদী মুসলমানগণ, ইনশাল্লাহ্, সর্বদা আমাদের বিশ্বাসে অটল ও দৃঢ়চিত্ত থাকবে। আমরা কেবল মৌখিকভাবে প্রত্যেক প্রকার ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকার কথা বলি না, বরং, বাস্তবিকই বিশ্ব জুড়ে আহমদীগণ প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.)-এর মিশনকে আরও অগ্রসর করার লক্ষ্যকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য অসাধারণ আত্মত্যাগ স্বীকার করেছেন।”

শেষ লগ্নে, হুযূর আকদাস প্রতিনিধিবর্গকে হযরত আবু বকর (রা.)-এর আল্লাহ্ তা’লার প্রতি বিশ্বাস ও অবিচলতার কথা স্মরণ করিয়ে দেন, যিনি মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর পর সবচেয়ে কঠিন সময়ে মুসলমানদেরকে একত্র করেছেন।

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“কখনো ভুলে যাবেন না আমরা সেই সকল মানুষ যারা নিজেদের ধর্মকে জাগতিকতার ওপর প্রাধান্য দেওয়ার অঙ্গীকার করেছি এবং শপথ করেছি যে, প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.)-এর মিশনকে শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত প্রত্যেক প্রকার ত্যাগ স্বীকার করে হলেও পূর্ণ করতে চেষ্টা করবো। জামা’তের অগ্রগতির জন্য এবং ধর্মীয় লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদেরকে অবশ্যই একই প্রত্যয় লালন করতে হবে এবং আবু বকর (রা.)-এর মতো আল্লাহ্ তা’লার প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে। তিনি চরম বিপর্যয়ের সময়েও স্থিরপ্রতিজ্ঞ এবং অবিচল ছিলেন। আমরা যদি আমাদের জীবন কেবল এমন করে যাপন করতে পারি যেরূপ মহানবী (সা.)-এর সাহাবারা করেছিলেন, কেবল তখনই আমরা প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.) এর আগমনের উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারবো।”

বক্তৃতার শেষাংশে, হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের সদস্যরা আপনাদেরকে শূরার প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করে আপনাদের প্রতি যে আস্থা রেখেছেন এবং এর মাধ্যমে ধর্মের সেবা করার আপনারা যে সুযোগ পেয়েছেন তার প্রতি সর্বদা মানোযোগ নিবদ্ধ রাখুন। সর্বদা স্মরণ রাখুন যে, আপনাদের কেবল নামে মাত্র কোনো অঞ্চলের প্রতিনিধি হওয়া উচিত নয়। বরং, বাস্তবিকই, আপনাদের উচিত ব্যক্তিগত ও জাগতিক সকল আকাঙ্ক্ষা সরিয়ে রেখে সকল শক্তি প্রকৃত লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োগ করা, যা হলো শেষ নিশ্বাস ত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত ধর্মের সেবা করা।”