প্রেস বিজ্ঞপ্তি
১৭-মে, ২০২৩

ঐতিহাসিক এক আয়োজনের মধ্য দিয়ে জামেয়া আহমদীয়া যুক্তরাজ্যের সমাবর্তন অনুষ্ঠিত


আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধানের হাতে শাহেদ ডিগ্রি সনদ লাভ করলেন ৬৮ জন শিক্ষার্থী

আহমদীয়া মুসলিম জামা’ত এটি আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করছে যে, ১৩ মে ২০২৩ জামেয়া আহমদীয়া যুক্তরাজ্য-এর সমাবর্তন অনুষ্ঠান সারের হেযেলমিয়ারে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়েছে।

অনুষ্ঠানটিতে সভাপতিত্ব করেন আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.)।

বিগত ৪ বছরে উত্তীর্ণ, কিন্তু কোভিড-১৯ বিশ্বজনীন মহামারীর কারণে যারা সেই সময়ে তাদের সনদ লাভ করতে পারেন নি, সেই সব মুবাল্লেগ (ধর্ম-প্রচারক)-দের নিয়ে এ বছর একটি যৌথ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হলো।

২০১৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে উত্তীর্ণ ৬৮ জন মুবাল্লেগ হুযূর আকদাসের নিকট হতে তাদের শাহেদ ডিগ্রি সনদ গ্রহণের সম্মান লাভ করেন, যা নিয়ে এ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠান থেকে উত্তীর্ণ ছাত্র সংখ্যা ১৯৯-এ উপনীত হলো।

ছাত্রবৃ্ন্দ তাদের ডিগ্রি সনদ গ্রহণের পর, হুযূর আকদাস এক ঈমানোদ্দীপক ভাষণ প্রদান করেন যেখানে তিনি তাদের সামনের দায়িত্বের গুরুত্ব সম্পর্কে তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেন।

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“সর্বদা স্মরণ রাখবেন যে, যে উদ্দেশ্যে আপনারা জামেয়া আহমদীয়ায় ভর্তি হয়েছিলেন তা অর্জনের জন্য আপনাদেরকে সর্বদা চেষ্টা করে যেতে হবে। সেই উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যে কিছু প্রশিক্ষণ নিয়ে আপনারা জামেয়া থেকে বের হচ্ছেন, এমন না যে সেই লক্ষ্য আপনারা অর্জন করে ফেলেছেন। আপনাদেরকে উক্ত লক্ষ্য অর্জনের জন্য পথ দেখানো হয়েছে যে, এই হলো সেই বৈশিষ্ট্যসমূহ যা একজন জীবন উৎসর্গকারী মুরব্বী ও মুবাল্লেগের থাকা উচিত। সুতরাং, এই বিষয়কে সর্বদা স্মরণ রাখুন যে, এখন আপনাদের দায়িত্ব বেড়ে গেল, আর এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আপনাকে স্বয়ং পরিশ্রম করতে হবে।”

হুযূর আকদাস বলেন যে, মোবাল্লেগদের সর্বদা নিজ নিজ কাজের আত্ম-মূল্যায়ন করতে হবে, যেন দেখা যায় তারা সফলভাবে তাদের লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন কি না।

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“একজন উত্তম মুরব্বী ও মুবাল্লেগের উচিত প্রতিনিয়ত আত্ম-মূল্যায়ন করা যে, আমরা আমাদের উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছি কি, বা তার কিছু অর্জন করেছি, বা কোনো অংশের জন্য চেষ্টা চলমান রয়েছে কি? আমাদের ইবাদতের মান কি উচুঁ স্তরে উপনীত হয়েছে? আমাদের জ্ঞান কি উঁচু স্তরে উপনীত হয়েছে? আমাদের নৈতিকতার মান কি উচুঁ স্তরে উপনীত হয়েছে? … এ বিষয়টি সর্বদা স্মরণ রাখবেন যে, এখন আপনাদেরকে মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী হতে হবে, বা মানুষজন আপনাদের নিকট প্রত্যাশা রাখে যে, মুরব্বীগণ তাদের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী হবেন। তাই, একজন মুরব্বী হিসেবে নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনয়ন করতে হবে। যখন আপনারা এই আত্ম-বিশ্লেষণ করবেন, তখন তা আপনাদেরকে এক উচ্চমানের মুরব্বী হওয়ার পথে অগ্রসর করবে। আপনাদের চেষ্টা থাকবে যে, আমাদেরকে এই উঁচু মান অর্জন করতে হবে।”

হুযূর আকদাস দ্বিতীয় খলীফাতুল মসীহ্‌র দিকনির্দেশনার আলোকে বেশকিছু গুণাবলি তুলে ধরেন যা একজন মুবাল্লেগের অবলম্বন করা উচিত। এ নির্দেশনাসমূহ বই আকারেও ছাপা হয়েছে।

সাহসিকতা নিয়ে বলতে গিয়ে, হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“আপনাদেরকে সঠিক ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গী নির্ভীকচিত্তে বর্ণনা করতে হবে। এমনটি করবেন না যে, অন্যের মন রক্ষার্থে আপনি নীরব থাকলেন; কিংবা, নিজেকে বাঁচানোর জন্য এমনভাবে মতামত পেশ করলেন যাতে বিষয়বস্তু স্পষ্ট না হয়। বরং, দৃঢ়চিত্ততা ও সাহসিকতার সাথে আপনাদেরকে নিজের মতামত পেশ করতে হবে। বর্তমান সমাজে অনেক ব্যাধি রয়েছে যেগুলো প্রজ্ঞার সাথে, দৃঢ়ভাবে এবং সংশোধনের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা প্রত্যেক মুরব্বীর দায়িত্ব।”

হুযূর আকদাস বলেন যে, যদি কেউ প্রজ্ঞাবান হন, তবে তার মতামত মুক্তভাবে প্রকাশ করতে পারেন; কিন্তু, এমনভাবে, যেন মানুষ বুঝতে পারে এবং অসন্তুষ্ট না হয়।

অপর এক গুণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে, হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“এরপর এ বিষয়টিও প্রত্যেক মুবাল্লেগ ও মুরব্বীর জন্য আবশ্যক যে, আপন-পর সকলের জন্য তার হৃদয়ে যেন সহানুভূতির প্রেরণা লালন করেন। তাদের দুঃখ-কষ্ট অনুভব করুন। যখন মানুষজন এমন আন্তরিক সহানুভূতি দেখবেন, তখন আপনাদের সাথে তাদের একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি হয়ে যাবে। ফলে তরবিয়তের (নৈতিক চরিত্র গঠনের) কাজও সহজতর হবে, তবলীগের (ধর্ম প্রচারের) কাজও সহজতর হবে।”

হুযূর আকদস মুবাল্লেগদের আরও উপদেশ প্রদান করেন যে, তাদের বার্তা আরও ফলপ্রসূভাবে পৌঁছানোর জন্য তারা যেন সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহ এবং খবরাখবর সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন।

উন্নত নৈতিক মূল্যবোধ অর্জন ও চর্চার ক্ষেত্রে বিশ্বে আহমদী মুসলমানদের কীভাবে নেতৃত্বের অবস্থানে থাকা উচিত – এ সম্পর্কে বলতে গিয়ে, হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“আমাদেরকেই বিশ্বে (নৈতিক ও আধ্যাত্মিক) বিপ্লব সাধন করতে হবে, বিশ্ববাসীকে আমাদের অনুসরণ করাতে হবে, বিশ্ববাসীকে ইসলামের সঠিক শিক্ষা সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। তাই আমাদের সদস্যদের তরবিয়তের জন্য, আর অন্যদের কাছে ইসলামের সঠিক বার্তা পৌঁছানোর জন্যও একজন মুরব্বী ও মুবাল্লেগের আচার-আচরণ মর্যাদাপূর্ণ হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

হুযূর আকদাস আরও বলেন যে, মোবাল্লেগদেরকে শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদ নামায পড়ার অভ্যাস করতে হবে এবং অবশ্যই মসজিদে বা নামায সেন্টারে দৈনিক বা’জামাত পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করতে হবে।

প্রত্যেক প্রয়োজনে আল্লাহ্ তা’লার দিকে ঝুঁকার গুরুত্বের বিষয়ে বলতে গিয়ে, হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“সর্বদা এই অনুভূতি লালন করতে হবে যে, দোয়া ও ইবাদত ছাড়া আমরা কিছুই না। আমাদের সকল কাজ কেবল দোয়ার মাধ্যমেই সাধিত হচ্ছে, আর এটিই জামা’তের উন্নতির মাধ্যম। এর দ্বারাই তবলীগ ও তরবিয়তের কাজ সাধিত হচ্ছে। আল্লাহ্ তা’লার অনুগ্রহরাজি আকর্ষণ করা ছাড়া আমরা কিছুই অর্জন করতে পারবো না। আর আল্লাহ্ তা’লার অনুগ্রহরাজি আকর্ষণ করার জন্য ইবাদত খুবই গুরুত্বপূর্ণ, দোয়ার প্রতি মনোনিবেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যিক্‌রে ইলাহী (আল্লাহ্‌র স্মরণে সময় কাটানো) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিষয়ে আমাদের মনোযোগী হওয়া অত্যাবশ্যক।”

জ্ঞানে সমৃদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বলতে গিয়ে, হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) মুবাল্লেগদের উপদেশ প্রদান করেন এবং বলেন:

“নিজের জ্ঞানগত অবস্থার উন্নতির জন্য চেষ্টা করতে থাকুন। কখনো মনে করবেন না যে, ‘আমি জ্ঞান অর্জন অনেক করে ফেলেছি, আর আমি সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম।’ জাগতিক জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি, ধর্মীয় জ্ঞান বৃদ্ধির জন্যও চেষ্টা করতে থাকুন। ধর্মীয় জ্ঞান লাভের কোনো শেষ নেই। মহানবী (সা.)-এর এক হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘কবরে যাওয়া পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন করতে।’ তাই আমাদের সর্বদা জ্ঞানে সমৃ্দ্ধির জন্য সাধনা করতে হবে।”

হুযূর আকদাস বলেন এমন জ্ঞান ইসলামের বিরুদ্ধে অমুসলিমদের উত্থাপিত আপত্তি ও আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিরুদ্ধে মিথ্যা দাবিসমূহের ফলপ্রসূ জবাব দেওয়ার জন্য আবশ্যকীয়।

হুযূর আকদাস মোবাল্লেগদের অন্যের জন্য ত্যাগ স্বীকার করার গুণ আয়ত্ত করতে বলেন।

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“এটি স্মরণ রাখবেন যে, অন্যের জন্য ত্যাগ স্বীকারের বিষয়টি মুরব্বীর মাঝে অনেক বেশি থাকা আবশ্যক। এটি মানুষকে আপনাদের নিকটতর করবে এবং এতে আপনার কথায় প্রভাব সৃষ্টি হবে। … মানুষের জন্য কেবল সহানুভূতি থাকলেই চলবে না; বরং, আরও উঁচু স্তরে উপনীত হয়ে তাদের জন্য ত্যাগের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।”

হুযূর আকদাস আরও বলেন যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অন্যান্য নিত্যনতুন মাধ্যম আয়ত্ত করতে হবে যেন ইসলামের বাণী প্রচার করা যায়।

হুযূর আকদাস কঠোর পরিশ্রম ও চেষ্টার সঙ্গে দোয়ার সংমিশ্রণের গুরুত্বের কথা আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়ে বক্তৃতা শেষ করেন।

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) বলেন:

“আমাদের কাছে যা উপায়-উপকরণ আছে তা ব্যবহার করে, আমাদের যে জ্ঞান আছে তা ব্যবহার করে, আমাদের দ্বারা যতটুকু প্রচেষ্টা সম্ভব তা করে, এরপর দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহ্‌ তা’লার দিকে ঝুঁকতে হবে এবং আমাদের প্রচেষ্টাসমূহের ফলপ্রসূ ফলাফলের জন্য তাঁর নিকট দোয়া করতে হবে। আমরা যদি এমনভাবে দোয়া করি তাহলে আমাদের পরিশ্রম আশিসমণ্ডিত হবে।”

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) দোয়া করেন এবং বলেন:

“আল্লাহ্ তা’লা আমাদের সকল প্রচেষ্টায় বরকত প্রদান করুন, আপনাদেরকে কর্মক্ষেত্রেও সাফল্য দান করুন। যেখানেই যাকে মুরব্বী হিসেবে নিয়োজিত করা হয়েছে, সেখানই উত্তমরূপে ধর্মের সেবার তৌফিক দান করুন। আল্লাহ্ তা’লা আপনাদের সকলকে খিলাফতের ‘সুলতানে নাসীর’-এ (সাহায্যকারী শক্তিতে) পরিণত করুন। কার্যক্ষেত্রে আপনারা তেমন হয়ে যান, যা আল্লাহ্ তা’লা একজন জীবন উৎসর্গকারীর নিকট প্রত্যাশা করেন, যেমনটি প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.) প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন, আর যা এক পবিত্র দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, বিশ্বে সত্যিকার বিপ্লব আনয়নকারী হোন।”