লাহোরে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক আন্তঃধর্ম মহা সম্মেলনে মাওলানা নূরুদ্দীন (রাঃ)-এর বক্তব্য


মাহমুদ আহমদ সুমন, ওয়াকফে যিন্দেগী

২৬শে ডিসেম্বর ১৮৮৬ সালে লাহোরে আন্তঃধর্ম সম্মেলনের ব্যবস্থা করা হয়। উক্ত সম্মেলনে ২৭শে ডিসেম্বর দ্বিতীয় দিনে সম্মেলনের ব্যবস্থাপকরা হযরত হেকীম মাওলানা নূরুদ্দীন (রাঃ)-কে উক্ত অধিবেশনের সভাপতি মনোনীত করেন। সে উপলক্ষ্যে তিনি (রাঃ) সংক্ষিপ্ত ও জ্ঞানগর্ভ এক বক্তৃতা প্রদান করেন। আন্তঃধর্ম মহাসম্মেলনের রিপোর্ট বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়। নিম্নে পাক্ষিক আহ্‌মদীর ‘ইসলামী নীতিদর্শন’ শতবার্ষিকী সংখ্যার সৌজন্যে তুলে ধরা হলো

হযরত মাওলানা নূরুদ্দীন (রাঃ) তাশাহুদ তাআউয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর-তাঁর বক্তব্যে বলেন, খোদা তাআলার অনুগ্রহ, তাঁর বিশেষ আশিস ও তাঁর সার্বজনীন লালন পালন সাধন এবং তাঁর ঐ আশিস যা বিশেষ বিশেষ বান্দাদের উপর বর্ষিত হয়, যদি মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকতো তা হলে তাঁর অস্তিত্ব কিভাবে বিদ্যমান থাকতে পারতো! তাঁর অজস্র অনুগ্রহরাজির মধ্যে যা বর্তমান কালে তিনি আমাদের উপর বর্ষিত করেছেন তার মধ্যে রয়েছে জ্ঞানার্জনের উপকরণসমূহ এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপক বিস্তার সমূহ যেমন – পর্যাপ্ত পরিমাণ কাগজ উৎপাদন, প্রেস-ছাপাখানার আবিষ্কার, ডাক বিভাগের প্রবর্তন ও উন্নয়ন, যার ফলে স্বল্প ব্যয়ে আমরা নিজেদের ধ্যান-ধারণা দূর-দূরান্তের দেশসমূহে সহজেই পৌঁছাতে পারছি। এর সাথে আরও রয়েছে বেতার যন্ত্রসমূহের উন্নত ব্যবস্থা, রেলগাড়ী ও জাহাজ যোগে আরামদায়ক সফর। এসব কিছুই করুণাময় খোদা তাআলার মহাদান বিশেষ। যদি মানুষ তাঁর শোকরগুজারী না করে তাহলে অবশ্যই আযাবে পতিত হবে। কিন্তু যে শোকর করে খোদা অবশ্যই তাকে প্রবৃদ্ধি দান করেন।

তিনি (রাঃ) বলেন, শৈশবে আমি দেখেছি, যে সব বই-পুস্তক আমাদের জন্য অতি কষ্টলভ্য ছিল এবং সেগুলো কাউকে দেখাতেও ইতস্ততঃ ও সংকোচ বোধ করতাম; কিন্তু কিছু দিন থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, কনষ্টান্টিনোপল থেকে ভাল মানের পুস্তকাদি আসছে, তেমনিভাবে আলজিরিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়া, ত্রিপলী এবং মিশর থেকেও ওইসব আমরা অনায়াসে ঘরে বসে পাচ্ছি। এমন অবস্থায় প্রত্যেকেরই একান্ত কর্তব্য তারা যেন নিরাপদ যুগে আল্লাহ্‌র নেয়ামত দ্বারা বেশী বেশী উপকৃত হোন। ধর্ম আমার দৃষ্টিতে এমন একটি বিষয় যে, কোন ব্যক্তিই দুনিয়াতে নীতিহীন জীবন যাপন করতে পারে না। সরকারী আইনের উদ্দেশ্য হোল মানবাধিকার সংরক্ষণ করা, কিন্তু এইসব আইন-কানুন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেসব সীমা ধার্য করা হয়েছে সেগুলি এই প্রকারের যে, তার মাধ্যমে অপরাধ দমন করাতো অবশ্য সম্ভব কিন্তু অপরাধের মূলে যে আদি কারণ সমূহ রয়েছে সেগুলোকে নিবারণ করা তাদের ক্ষমতা বহির্ভূত; যেমন, যদি কোন ব্যক্তি বলপূর্বক ব্যভিচার করে তাহলে সরকার এর শস্তি তো দিতে পারে, কিন্তু কুদৃষ্টি, কুসংসর্গ- কু কামনা যা মানুষের অন্তর্দেশে সৃষ্টি হয় এবং নানা প্রকার অপরাধ তাকে প্রলুব্ধ করে, সরকারের আইন ওই গুলিকে প্রতিরোধ করতে পারে না। এর প্রতিবিধান কেবল ধর্মে রয়েছে যা আমাদেরকে এইসব বিষয় থেকে বিরত রাখে। ধর্মই আমাদের কিছু ক্রিয়াকলাপের প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে।

অর্থাৎ মু’মিন এবং দুস্কার্যকারী এক রকম হতে পারে না। নিজেদের বিশ্বাস এবং কার্যকলাপের দিক দিয়ে তারা একে অপরের সমান হতে পারে না। এটি কেবল ধর্মেরই বিধান যা দুষ্কার্যকারীকে সেই সব বিষয়েও অপরাধী সাব্যস্ত করে এবং তাতে লিপ্ত হতে নিষেধ করে যেগুলোকে দমন করা সরকারী আইনের গন্ডির বহির্ভূত। যেমন-অসৎকর্ম কিছু এমন আছে যেগুলো বিবেকের দৃষ্টিতেও এবং দলিলের দৃষ্টিতে যদিও গর্হিত বলে পরিগণিত হয় এবং সরকারী শাসকবর্গ বা সমাজের অপরাপর ব্যক্তিবর্গও ঐগুলোকে সম্পূর্ণভাবে অসদাচারণ বলেই গণ্য করে তথাপি স্বয়ং সরকারের কাছে-না প্রশাসক হিসেবে, না সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের কাছে এসব (কুকর্ম) বন্ধ করার জন্য আদেশ-ভিত্তিক কোন প্রতিরোধ ব্যবস্থা আছে। যেমন-মদ্যপান বা ভোগ-বিলাসীতা। তাই উভয় পক্ষের সম্মতিতে সংঘটিত অন্যায় কাজ-কর্ম ও অপরাধসমূহ দমন করার উদ্দেশ্যে কার্যকরী কোন আইন যদি হতে পারে তবে তা কেবল ধর্মেরই বিধান হতে পারে-যা কেবলমাত্র অপরাধকে প্রতিরোধ করে না বরং অন্তরে উদগত সেই সব ধ্যান-ধারণা ও বিপদাবলীর উপরেও তার নিয়ন্ত্রণ বিস্তৃত রয়েছে- যা ঐ সব অপরাধ ও অসদাচরণ-এর মূল কারণ। এ থেকে পরিস্কার বুঝা গেল যে, যখন স্বভাবতঃই মানুষ সামাজিক ও সংস্কারপ্রিয় প্রাণী হওয়ার কারণে অনিবার্য ও প্রকৃতিগতভাবে একটি আইনের মুখাপেক্ষী; তখন তার জন্য আইন কেবল আল্লাহ্‌র শরীয়তই হতে পারে যার মধ্যে সংস্কার ও সভ্যতার পূর্ণতা উৎকর্ষের নিমিত্তে যথোচিত বিধি-বিধান বিদ্যমান রয়েছে এবং এই শরীয়তেই মানবজতির সংশোধনের জন্য সেই ব্যক্তি নিহিত রয়েছে। আর এই শরীয়ত মানুষের প্রকৃতির উপর এত ব্যাপক ক্রিয়াশীল প্রাধান্য বিস্তারকারী যা সরকারী কোন আইনে আদৌ পরিলক্ষিত হয় না তা সে আইন যত বাধ্যতামূলক শক্তিশালী হোক না কেন, তবুও সম্ভবপর নয়। সুতরাং ধর্মের বিষয়ে মানুষের মধ্যে আন্তরিক আগ্রহ সৃষ্টি করা আসলে -শান্তি স্থাপনার্থে সরকারের প্রণয়নকৃত আইনসমূহের কেবল সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারেই নয়, পরন্তু বিপদাবলীমুক্ত নিরাপত্তা সংরক্ষণের প্রাথমিক পদক্ষেপও বটে। এমন অত্যাবশ্যকীয় বিষয়ের উপর চিন্তা-ভাবনা করা খুবই প্রয়োজন। চিন্তা-ভাবনা থাকলে প্রয়োজনানুযায়ী ব্যবস্থাও হয়ে যায়। বর্তমান যুগে যখন আল্লাহ্‌ তাআলা আমাদেরকে নানাবিধ উপকরণাদি প্রদান করেছেন তখন তা আল্লাহ্‌ তাআলার না শোকরগুযারী হবে যদি আমরা খোদা প্রদত্ত এই সব নেয়ামত দ্বারা উপকৃত হয়েও সেইসব আইন কানুনের উপর চিন্তা না করি যেগুলি খোদা স্বয়ং ধর্ম প্রণয়ন ও প্রবর্তন করে আমাদের আমলসমূহ ও কার্যকলাপকে ওইগুলোর তত্ত্বাবধানে অধীনস্ত করে দিয়েছেন। তাই অত্যধিক আবশ্যক যেন আমরা সব ধর্মের রক্ষণাবেক্ষণ করি, আর এই সভার আয়োজনও এই উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে। এজন্য আমার অন্তরের দোয়া এই যে- যেভাবে গতকালের দিনটি শান্তি ও স্বস্তির সাথে অতিবাহিত হয়েছে তদ্রূপ আজকের দিনটিও যেন অতিবাহিত হয়।

পাক্ষিক আহ্‌মদী - ৩১শে মে, ২০০৮ইং