মহানবী (সা.)-এর জীবনী: উহুদের যুদ্ধে নারী সাহাবীদের পরম ধৈর্য ও বিশ্বের পরিস্থিতির আলোকে নির্দেশনা

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৮-মার্চ, ২০২৪

মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিলবিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম ও আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ৮ই মার্চ, ২০২৪ তারিখে যুক্তরাজ্যের (ইসলামাবাদস্থ) মসজিদ মুবারক-এ “মহানবী (সা.)-এর জীবনী: উহুদের যুদ্ধে নারী সাহাবীদের পরম ধৈর্য ও বিশ্বের পরিস্থিতির আলোকে নির্দেশনা” বিষয়ক জুমুআর খুতবা প্রদান করেন। প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় মহানবী (সা.)-এর জীবনচরিত বর্ণনার ধারাবাহিকতায় উহুদের যুদ্ধে দু’জন সাহাবীর দাফনকার্যের বিবরণ এবং কয়েকজন নারী সাহাবীর আত্মনিবেদনের ঘটনা বর্ণনা করেন। খুতবার শেষাংশে হুযূর (আই.) বিশ্বের ভয়াবহ পরিস্থিতির আলোকে নির্দেশনা করেন; পরিশেষে ফিলিস্তিন, ইয়েমেন ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের উল্লেখ করে দোয়ার আহ্বান জানান।
তাশাহ্‌হুদ, তা’উয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর উহুদের যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর দোয়া গৃহীত হওয়ার ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, হযরত সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস (রা.) বলেন, “শত্রুরা যখন পুনরায় ফেরত এসে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করে তখন আমি বলি, হয় আমি নাজাত লাভ করব, না হয় শহীদ হবো। সেই মুহূর্তে হঠাৎ আমি একজন রক্তিম চেহারার অধিকারী লোককে দেখি, যিনি কঙ্কর হাতে নিয়ে মুশরিকদের উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করেন আর তিনি ছিলেন স্বয়ং হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি (সা.) আমাকে ডেকে তার সামনে বসান। এরপর আমি তির নিক্ষেপ করতে থাকি আর দোয়া করতে থাকি, ‘হে আল্লাহ্! এগুলো তোমার তির, তুমি এর দ্বারা তোমার শত্রুদের ঘায়েল করো।’ মহানবী (সা.)ও আমাকে তির এগিয়ে দিচ্ছিলেন আর দোয়া করছিলেন, ‘হে আল্লাহ্! তুমি সা’দ এর দোয়া গ্রহণ করো। হে আল্লাহ্! সা’দ এর তিরকে লক্ষ্যভেদ করাও। হে সা’দ! তোমার জন্য আমার পিতা-মাতা নিবেদিত। তুমি অনবরত তির নিক্ষেপ করতে থাকো।’” আল্লামা যুহরী লিখেছেন, সেদিন সা’দ (রা.) এক হাজার তির নিক্ষেপ করেছিলেন।
হযরত তালহা (রা.)’র সাহসিকতা সম্পর্কে হযরত আবু বকর (রা.) বর্ণনা করেন, “সে দিনটি সম্পূর্ণরূপে হযরত তালহার দিন ছিল। হযরত তালহা মহানবী (সা.)-এর সুরক্ষায় নির্ভিক সৈন্যের ন্যায় দণ্ডায়মান ছিলেন। এছাড়া হযরত আবু উবায়দা বিন জাররা (রা.)ও মহানবী (সা.)-এর সুরক্ষায় প্রাণপন লড়াই করছিলেন। সে সময় মহানবী (সা.)-এর নিচের পাটির একটি দাঁত ভেঙ্গে গিয়েছিল, তাঁর পবিত্র চেহারা ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল এবং শিরস্ত্রাণের একটি আংটা তাঁর গালে বিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তথাপি মহানবী (সা.) আমাদেরকে বলেন, তোমরা উভয়ে তালহাকে সাহায্য করো। তাঁর ক্ষত সারানোর ব্যবস্থা করো।”
হযরত যিয়াদ বিন সাকান (রা.)’র সাথে মহানবী (সা.)-এর ভালোবাসাপূর্ণ সম্পর্কের ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে, হযরত যিয়াদ বিন সাকান (রা.)’র পাঁচজন সাথী মহানবী (সা.)-এর সুরক্ষায় একে একে শাহাদত বরণ করেন। এরপর যিয়াদ (রা.) যখন গুরুতর আহত হন তখন মুসলমানদের একটি দল তার কাছে পৌঁছে এবং মুশরিকদেরকে পিছু হটতে বাধ্য করে। সে সময় মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ মোতাবেক সাহাবীরা তাকে তাঁর কাছে নিয়ে আসেন। তিনি (সা.) নিজের পা এগিয়ে দেন এবং তার ওপরে হযরত যিয়াদ (রা.) মাথা রাখেন আর এভাবেই মহানবী (সা.)-এর চরণে শায়িত অবস্থায় তিনি শাহাদত বরণ করেন।
এরপর হুযূর (আই.) মদীনায় অবস্থানরত নারী সাহাবীদের পরম ধৈর্য ও আল্লাহ্‌র প্রতি সন্তুষ্টির দৃষ্টান্ত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, হযরত হামনা বিনতে জাহাশ (রা.) সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, প্রথমে যখন তাকে তার ভাই এবং মামা হযরত হামযা (রা.)’র মৃত্যু সংবাদ দেয়া হয় তখন তিনি বলেন, “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।” এরপর তার স্বামী হযরত মুসআব (রা.)’র শাহাদতের সংবাদ দেয়া হলে, তিনি কাঁদতে থাকেন আর ব্যাকুল হয়ে বলেন, “হায় পরিতাপ!” তাকে জিজ্ঞেস করা হয় যে, “তুমি এ কথা কেন বললে?” তিনি বলেন, “আমার এতীম সন্তানদের বিষয়ে দুশ্চিন্তা করে আমার মুখ থেকে এই বাক্য বের হয়েছে।” একথা শুনে মহানবী (সা.) তার অর্থাৎ, হযরত মুসআব (রা.)’র সন্তানদের জন্য দোয়া করেন, “হে আল্লাহ্! তাদের অভিভাবক ও বয়োজেষ্ঠ্যরা যেন তাদের প্রতি স্নেহ ও দয়াসুলভ আচরণ করে এবং তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করে।”
হযরত হিন্দ বিনতে আমর (রা.) সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, তার ভাই, স্বামী ও পুত্রের শাহাদতের সংবাদ লাভের পর প্রথমত তিনি নিজে তাদের লাশ উটে বহন করে মদীনায় নিয়ে এসেছেন। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.)’র সাথে তার পথিমধ্যে সাক্ষাৎ হলে তিনি তাকে যুদ্ধের পরিস্থিতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন, এর উত্তরে তিনি বলেন; ‘মহানবী (সা.) ভালো আছেন আর তিনি ভালো থাকলে এর পর সমস্ত বিপদাপদ আমাদের জন্য তুচ্ছ’। এরপর তিনি যখন মহানবী (সা.)-এর কাছে আসেন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, “তোমার স্বামী {আমর বিন জমুহ্ (রা.)} যুদ্ধে আসার পূর্বে তোমাকে কিছু বলেছিল কি?” হযরত হিন্দ (রা.) বলেন, “যাত্রার পূর্বে কিবলামুখি হয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ্! তুমি আমাকে আমার পরিবার-পরিজনের কাছে লজ্জিত অবস্থায় ফিরিয়ে এনো না এবং আমাকে শাহাদতের পদমর্যাদা দান করো।’”
হযরত মির্যা বশীর উদ্দিন মাহমুদ আহমদ সাহেব (রা.) বলেন, এক নারী সাহাবী মহানবী (সা.)-এর শাহাদতের সংবাদ শুনে উহুদ অভিমুখে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে এক সাহাবীর সাথে সাক্ষাৎ হলে তিনি মহানবী (সা.)-এর ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞেস করেন। সেই সাহাবী প্রথমে তাকে তার ভাইয়ের শাহাদতের সংবাদ শোনান। কিন্তু তিনি সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে পুনরায় মহানবী (সা.)-এর সংবাদ জানতে চান। তখন সেই সাহাবী তাকে তার স্বামীর শাহাদতের সংবাদ দেন। কিন্তু তারপরও তিনি ভ্রুক্ষেপহীনভাবে মহানবী (সা.) কেমন আছেন তা জানতে চান। অতঃপর সেই সাহাবী তাকে তার পুত্রের শাহাদতের সংবাদ দেন। তখন সেই নির্ভীক নারী সাহাবী অত্যন্ত আবেগের সাথে বলেন, “যদি মহানবী (সা.) ভালো থাকেন তাহলে পৃথিবীর সমস্ত বিপদাপদ আমার কাছে তুচ্ছ।” এটি সেই ঐকান্তিক ভালোবাসা ও ভক্তি ছিল যা খোদা তা’লা মহানবী (সা.)-এর প্রতি সাহাবীদের হৃদয়ে প্রোথিত করে দিয়েছিলেন। খোদা তা’লার বিপরীতে তারা নিজেদের মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-স্বামীর প্রতিও কোনোরূপ ভ্রুক্ষেপ করতেন না। তাদের দৃষ্টিতে শুধু একটি বিষয়ই থাকতো যে, খোদা তা’লা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট কি-না? এজন্যই আল্লাহ্ তা’লা তাদের প্রতি স্বীয় সন্তুষ্টির বহিঃপ্রকাশ করেছেন অর্থাৎ, ‘রাযিয়াল্লাহু আনহা’ বলেছেন যার অর্থ হলো, আল্লাহ্ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট। হুযূর (আই.) বলেন, অবশিষ্ট ঘটনা ইনশাআল্লাহ্ আগামীতে বর্ণনা করা হবে।
এরপর হুযূর (আই.) বলেন, ফিলিস্তিনের মুসলমানদের জন্য দোয়া করুন, আল্লাহ্ তা’লা তাদের জন্য স্বাচ্ছন্দ্য সৃষ্টি করুন। শত্রুরা সকল প্রকার নোংরা চিন্তাভাবনা ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাদেরকে ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে। পরাশক্তিগুলো যুদ্ধ বন্ধ করার পরিবর্তে উষ্কানি দেয়ার চেষ্টা করছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট গত সোমবার যুদ্ধবিরতির কথা বলেছিল এখন আবার রমযানের পূর্বে যুদ্ধবিরতির কথা বলেছে; তাও আবার মাত্র ছয় সপ্তাহের জন্য। আসলে এটিও ইসরাঈলীদের বিশ্রাম ও আরামের কথা চিন্তা করে করছে। অতএব, আল্লাহ্ তা’লাই একমাত্র তাদেরকে প্রতিহত করতে পারেন। আহমদীদেরকে নিজেদের গণ্ডিতে সাহায্যের এবং যোগাযোগের কাজ চালিয়ে যাওয়া উচিত। রাজনীবিদদের পত্র লিখতে থাকা উচিত। আল্লাহ্ তা’লা ফিলিস্তিনিদেরও দোয়া করার এবং নিজেদের আধ্যাত্মিক অবস্থাকে উন্নত করার তৌফিক দিন।
এরপর হুযূর (আই.) বলেন, ইউক্রেন এবং রাশিয়ার যুদ্ধে ইউরোপ আমেরিকার সরাসরি অংশগ্রহণের সংবাদ আসছে। এর ফলে বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা আরও প্রবল হচ্ছে। এর জন্য দোয়ার পাশাপাশি আহমদীদের হোমীও ঔষধের কোর্স সম্পূর্ণ করা উচিত এবং বাড়িতে কমপক্ষে ২/৩ মাসের অতিরিক্ত খাবার মওজুদ রাখা উচিত। আল্লাহ্ তা’লা বিশ্ববাসীকে বিবেক-বুদ্ধি দিন। ইয়েমেনের আহমদীদের জন্যও দোয়া করুন। আল্লাহ্ তা’লা দ্রুত তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করুন আর ইয়ামেনী সেনাবাহিনী যে সন্দেহ করছে যে, আহমদীয়া জামা’ত দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করছে; তাদের এই অহেতুক সন্দেহ দূর করুন। আল্লাহ্ তা’লা বিশ্ববাসীকে বিবেক-বুদ্ধি দিন, তারা যেন পার্থিবতার নোংরামিতে নিমজ্জিত হওয়ার পরিবর্তে আল্লাহ্ তা’লার প্রতি আকৃষ্ট হয়। মুসলমান দেশগুলোকেও ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তৌফিক দিন। আর আমাদেরকেও তৌফিক দিন, আমরা যেন আল্লাহ্ তা’লার বাণী বিশ্বের প্রত্যেক মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারি।
পরিশেষে হুযূর (আই.) মুকাররম তাহের ইকবাল চীমা সাহেবের বেদনাদায়ক শাহাদতের সংবাদ প্রদান করেন, যাকে সম্প্রতি পাকিস্তানে অজ্ঞাত পরিচয় মোটর সাইকেল আরোহীরা গুলিবিদ্ধ করে শহীদ করেছে, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। শাহাদতকালে চীমা সাহেব বাহাওয়ালপুর জেলার চক ৮৪ জামা’তের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। হুযূর (আই.) তার সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণের পর বলেন, আল্লাহ্ তা’লা শহীদের প্রতি দয়া ও ক্ষমাসুলভ আচরণ করুন এবং তার পদমর্যাদা উন্নীত করুন আর তার উত্তরাধিকারীদের ধৈর্য ও দৃঢ় মনোবলের তৌফিক দিন, আমীন।