মহানবী (সা.)-এর জীবনী: উহুদের যুদ্ধকালীন কতিপয় ঘটনা এবং ফিলিস্তিনের জন্য দোয়ার আহ্বান

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৯-জানুয়ারি, ২০২৪

মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিলবিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম ও আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ১৯শে জানুয়ারি, ২০২৪ তারিখে যুক্তরাজ্যের (ইসলামাবাদস্থ) মসজিদ মুবারক-এ “মহানবী (সা.)-এর জীবনী: উহুদের যুদ্ধকালীন কতিপয় ঘটনা এবং ফিলিস্তিনের জন্য দোয়ার আহ্বান” বিষয়ক জুমুআর খুতবা প্রদান করেন। প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় মহানবী (সা.)-এর জীবনচরিত বর্ণনার ধারাবাহিকতায় উহুদের যুদ্ধকালীন বিভিন্ন ঘটনার বিশদ বর্ণনা করেন। খুতবার শেষাংশে হুযূর (আই.) ফিলিস্তিনের নির্যাতিত মুসলমান ভাইবোনদের জন্য দোয়ার আহ্বান জানান এবং সম্প্রতি প্রয়াত কতিপয় নিষ্ঠাবান আহমদীর স্মৃতিচারণ করেন ও নামাযান্তে গায়েবানা জানাযা পড়ান।
তাশাহ্‌হুদ, তা’আউয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, উহুদের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আরো কিছু ঘটনা বর্ণনা করব। যেমনটি বলা হয়েছিল, শত্রুরা এ ঘোষণা দিয়েছিল যে, মুহাম্মদ (সা.) নিহত হয়েছেন। মুসলমানরা যখন একথা শোনে তখন তাদের অবস্থা কি হয়েছিল সে সম্পর্কে উল্লেখ আছে, ইবনে কামিয়া যখন এ ধারণ করে যে, সে মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যা করেছে তখন তার ঘোষণা শুনে মুসলমানদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। যদিও ঘোষণাকারী কে ছিল এ সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনায় মতবিরোধ রয়েছে।
এ সংবাদ শুনে মুসলমানদের মাঝে কেউ কেউ বলে, যেহেতু মুহাম্মদ (সা.) শহীদ হয়ে গেছেন তাই চলো আমরা আমাদের জাতির কাছে ফিরে যাই, তারা হয়ত আমাদেরকে এমতাবস্থায় ভালো কোনো পরামর্শ দিবে। কেউ আবার বলে, মুহাম্মদ (সা.)-এর শাহাদতের পর আমাদের জীবিত ফিরে যাওয়ার কোনো অর্থ নেই। আরেকজন সাহাবী বলেন, মুহাম্মদ (সা.) শহীদ হলেও আল্লাহ্ তা’লা তো চিরঞ্জীব। তাই আল্লাহ্‌র নামে যুদ্ধ করতে থাকো। হযরত মির্যা বশীর আহমদ সাহেব (রা.) এ সম্পর্কে লিখেছেন, মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর সংবাদ শুনে মুসলমানরা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। প্রথমত, কিছু মুসলমান এ সংবাদ শুনে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে মদীনায় ফেরত চলে গিয়েছিল। তখনকার পরিস্থিতি এবং লোকদের হৃদয়ের অবস্থা অনুসারে আল্লাহ্ তা’লা তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন বলে কুরআনে উল্লেখ আছে। তবে তাদের মদীনায় যাওয়ার ফলে সেখানেও অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং লোকেরা দলে দলে উহুদের প্রান্তর অভিমুখে ছুটে আসতে থাকে। দ্বিতীয় দল হলো তারা, যারা মহানবী (সা.)-এর শাহাদতের সংবাদ পেয়ে কোনো কিছু করাকে অনর্থক মনে করে হতোদ্যম হয়ে বসে পড়েছিল। তৃতীয়ত সেই দল, যারা সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি ছিল এবং অনবরত যুদ্ধ করে যাচ্ছিল। আর তাদের একটি অংশ মহানবী (সা.)-এর চারপাশে সমবেত হয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু শত্রুদের উপর্যুপরি আক্রমণের কারণে বারংবার তারা বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ছিল, তবে সুযোগ পেতেই আবার মহানবী (সা.)-এর চতুষ্পার্শ্বে সমবেত হচ্ছিল।
এ সময় উতবা বিন আবী ওয়াক্কাসের নিক্ষিপ্ত পাথর লেগে মহানবী (সা.)-এর একটি দাঁত শহীদ হয়ে গিয়েছিল। এরপর আব্দুল্লাহ্ বিন শিহাবের নিক্ষিপ্ত পাথর তাঁর কপালে আঘাত করে। এর ক্ষণিক পরেই ইবনে কামিয়ার নিক্ষিপ্ত পাথর মহানবী (সা.)-এর গালে আঘাত করে যার ফলে তাঁর শিরস্ত্রাণের দুটি আংটা তাঁর গালে বিদ্ধ হয়ে যায়।
যাহোক, হযরত আবু উবায়দা (রা.) সর্বপ্রথম মহানবী (সা.)-এর উজ্জ্বল দু’নয়ন দেখে তাঁকে শনাক্ত করতে পারেন যে, তিনি (সা.) জীবিত আছেন। তখন তিনি যতটা সম্ভব উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলেন, ‘হে মুসলমানরা আনন্দিত হও! মহানবী (সা.) জীবিত আছেন’। আরেক বর্ণনানুযায়ী, হযরত কা’ব বিন মালেক (রা.) তাঁকে প্রথমে দেখে এ ঘোষণা করেছিলেন। যাহোক, মহানবী (সা.)-এর জীবিত থাকার সংবাদ পেয়ে সাহাবীরা পুনরায় তাঁর চতুষ্পার্শ্বে সমবেত হতে থাকেন। অতঃপর মহানবী (সা.) সাহাবীদের নিয়ে নিরাপদে একটি ঘাঁটির উদ্দেশ্যে অগ্রসর হন। আর এভাবেই তিনি (সা.) যুদ্ধের মোড় ঘুরে যাওয়ার পর চরম ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও একজন নিপুণ যোদ্ধার মতো নিজের সাহাবীদের প্রাণ রক্ষা করতে এবং কাফিরদেরকে মনোবাসনা ব্যর্থ করতে সক্ষম হন।
পথিমধ্যে মক্কার এক নেতা উবাই বিন খাল্‌ফ মহানবী (সা.)-এর ওপর আক্রমণ করতে চেয়েছিল। সে বলেছিল, যদি মুহাম্মদ (সা.) বেঁচে যায় তাহলে আমার রক্ষা নাই। আরেক বর্ণনানুযায়ী সে একটি ঘোড়ায় আরোহণ করে বলে, “আমি এর ওপরে আরোহিত অবস্থায় মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যা করব”। প্রথমে সাহাবীরা তাকে প্রতিহত করতে চান, কিন্তু মহানবী (সা.) বলেন, “না। আমিই তাকে হত্যা করব”। এরপর যখন সে নিকটে আসে তখন মহানবী (সা.) স্বয়ং তাকে বর্শা দ্বারা আঘাত করেন যার ফলে সে মাটিতে পড়ে যায়। সেখান থেকে উঠে চিৎকার করতে করতে সে পালিয়ে যায়। যদিও সে তৎক্ষণাৎ মারা যায়নি, কিন্তু মক্কা পৌঁছানোর পূর্বেই সে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে।
মহানবী (সা.) পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণের পর দেখেন, হঠাৎ কুরাইশের একটি দল ওপরে উঠে আসছে। তাদেরকে দেখে তিনি (সা.) দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ্! আমাদের ওপর তারা বিজয়ী হতে পারে না। হে আল্লাহ্! আমাদের শক্তি ও সামর্থ্য নেই, কেবল তোমার ওপরই আমরা ভরসা করি।’ এরপর হযরত উমর (রা.) একটি সৈন্যদল নিয়ে কাফিরদের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হন এবং তাদেরকে পিছু হটতে বাধ্য করেন।
একটি বর্ণনায় আছে, মহানবী (সা.)-এর পবিত্র মুখমণ্ডলে আঘাতের কারণে রক্ত ঝরছিল এবং তিনি নিজেও দুটি বর্ম পরিধান করে রেখেছিলেন, তাই পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণের সময় দুর্বলতা ও বর্মের ওজনের কারণে তিনি পড়ে যাচ্ছিলেন। এটি দেখে হযরত তালহা (রা.) তাঁকে নিজের কাঁধে বহন করে ওপরে তুলে দেন। তখন মহানবী (সা.) বলেন, ‘তালহার জন্য জান্নাত নির্ধারিত হয়ে গেছে’। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, হযরত আবু বকর (রা.) উহুদের স্মৃতিচারণ করে বলতেন, সেই দিনটি সম্পূর্ণরূপেই তালহার দিন ছিল।
মহানবী (সা.)-এর গাল থেকে শিরস্ত্রাণের আংটা বের করার বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে, মহানবী (সা.)-এর চেহারার যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেজন্য হযরত আবু উবায়দা (রা.) নিজের হাত দ্বারা সেটি টেনে বের করতে চাননি, বরং নিজের দাঁত দিয়ে সেটি টেনে বের করার চেষ্টা করেন। এটি দেখে আবু বকর (রা.) আফসোস করে বলেন, “হায়! আমি কেন তার স্থলে ছিলাম না”। আবু উবায়দা (রা.) দাঁত দিয়ে আংটা টেনে বের করতে গেলে দুবারে তার দুটি দাঁত খুলে পড়ে যায়, অথচ বর্ণিত হয়েছে, সম্মুখের বা কর্তন দাঁতবিহীন লোকদের মাঝে তিনিই সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ ছিলেন।
এরপর মহানবী (সা.)-এর প্রাথমিক চিকিৎসা করা হয়। তিনি সারা দেহে সত্তরটি আঘাত পেয়েছিলেন। তিনি এতটা আহত হয়েছিলেন যে, আঘাতের স্থানগুলো থেকে অনবরত রক্ত ঝরছিল। তিনি (সা.) প্রথমে নিজেই ক্ষতস্থান থেকে রক্ত মুছছিলেন আর আফসোস করে বলছিলেন, ‘সেই জাতি কীভাবে সফল হতে পারে যারা তাদের নবীকে আহত করেছে এবং তাঁর রুবাই তথা কর্তন দাঁত ভেঙ্গে দিয়েছে অথচ তিনি তাদেরকে খোদার দিকে আহ্বান করেন।’ বুখারী শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত ফাতেমা (রা.) মহানবী (সা.)-এর আঘাতপ্রাপ্ত স্থান ধুয়ে দিচ্ছিলেন আর হযরত আলী (রা.) সেখানে পানি এনে ঢেলে দিচ্ছিলেন। কিন্তু রক্ত প্রবাহ বন্ধ হচ্ছে না দেখে হযরত ফাতেমা (রা.) বস্তার একটি টুকরো পুড়িয়ে তা ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেন যার ফলে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় মহানবী (সা.)-এর প্রচন্ড তৃষ্ণা লাগলে হযরত মুহাম্মদ বিন মাসলামা (রা.) নিকটবর্তী একটি ঝর্ণা থেকে তাঁর জন্য সুপেয় পানি নিয়ে আসেন এবং তিনি তা থেকে পান করেন। এরপর মহানবী (সা.) তার জন্য দোয়া করেন। হুযূর (আই.) বলেন, এই বর্ণনার ধারা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে ইনশাআল্লাহ্।
এরপর হুযূর (আই.) বলেন, “আমি ফিলিস্তিনিদের জন্য ধারাবাহিকভাবে দোয়ার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করছি। এখন তো মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ফিলিস্তিনিদের বাঁচানোর পরিবর্তে নিজেরাই যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে। পাকিস্তান ও ইরান পরস্পর যুদ্ধ করছে, পরস্পর পরস্পরের ওপর বোমা নিক্ষেপ করছে। এর ফলে অবস্থা আরো অবনতির দিকে যাচ্ছে। আল্লাহ্ তা’লা প্রকৃত অর্থে তাদেরকে নিজেদের লক্ষ্য অনুধাবনের তৌফিক দিন এবং আল্লাহ্ করুন, মুসলমানরা যেন এক উম্মতে পরিণত হতে সক্ষম হয়”।
পরিশেষে হুযূর (আই.) সৈয়দ মওলুদ আহমদ সাহেবের স্মৃতিচারণ করেন যিনি সৈয়দ দাউদ মুজাফফর শাহ্ সাহেবের পুত্র ছিলেন এবং সম্প্রতি ৭৬বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন, إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ। তিনি হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) এবং সৈয়্যদা উম্মে তাহের সাহেবার দৌহিত্র ছিলেন। এরপর হুযূর বুরকিনা ফাসোর ডোরি রিজিওনের মাহদীয়াবাদ জামাতের প্রেসিডেন্ট মুকাররম আকমীদ আগ মুহাম্মদ সাহেবের স্মৃতিচারণ করেন, যিনি সম্প্রতি ৬৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন, إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ। হুযূর আনোয়ার (আই.) তাদের রূহের মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করে দোয়া করেন এবং জুমুআর নামাযের পর প্রয়াতদের গায়েবানা জানাযা পড়ানোর ঘোষণা প্রদান করেন।