মহানবী (সা.)-এর জীবনী: বদর যুদ্ধ পরবর্তী ঘটনা এবং ফিলিস্তিনের জন্য দোয়ার আহ্বান

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৭-নভেম্বর, ২০২৩

মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিলবিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম ও আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ১৭ নভেম্বর, ২০২৩ তারিখে যুক্তরাজ্যের (ইসলামাবাদস্থ) মসজিদ মুবারক-এ “মহানবী (সা.)-এর জীবনী: বদর যুদ্ধ পরবর্তী ঘটনা এবং ফিলিস্তিনের জন্য দোয়ার আহ্বান” বিষয়ক জুমুআর খুতবা প্রদান করেন। প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় বদরের যুদ্ধের অনতিপর সংঘটিত মহানবী (সা.)-এর জীবনচরিতের কতিপয় ঘটনা তুলে ধরেন আর শেষদিকে ফিলিস্তিনের নির্যাতিত মুসলমান ভাইবোনদের জন্য দোয়ার আহ্বান জানান এবং বিশ্ববাসীকে এর ভয়ানক মন্দ পরিণাম সম্পর্কে সাবধান করেন।
তাশাহ্‌হুদ, তা’ঊয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, গত খুতবার শেষাংশে মহানবী (সা.)-এর জীবনচরিতের যে অংশে ফুরাত বিন হায়ানের ইসলাম গ্রহণের ঘটনা বর্ণিত হচ্ছিল এর বিস্তারিত বিবরণ হলো, সে বদরের যুদ্ধে আহত অবস্থায় বন্দী হলেও কোনোভাবে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিল। এরপর হযরত আবু বকর (রা.) তাকে দেখতে পেয়ে বলেন, এবার তো এসব পরিত্যাগ করো আর মুসলমান হয়ে যাও। তখন ফুরাত একজন আনসারী ভাইয়ের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় বলতে থাকেন, আমি মুসলমান হয়ে গিয়েছি। হযরত আবু বকর (রা.) মহানবী (সা.)-কে তার ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি অবহিত করলে তিনি (সা.) বলেন, যদি সে একথা বলে থাকে তাহলে এটি তার এবং তার খোদার সাথে সম্পর্কিত। অতঃপর তিনি (সা.) তাকে মুক্ত করে দেন।
এরপর হুযূর (আই.) সীরাত খাতামান্ নবীঈন পুস্তকের আলোকে যায়েদ বিন হারেসার অভিযানের ঘটনা বর্ণনা করেন যার উল্লেখ বিগত খুতবায়ও করা হয়েছিল। কুরাইশরা বদরের যুদ্ধের পর ব্যবসার উদ্দেশ্যে মদীনার নিকটবর্তী সমুদ্রপথে সিরিয়ায় যাওয়া নিরাপদ মনে করছিল না, তাই এর পরিবর্তে তারা নজদের পথ দিয়ে ইরাক হয়ে সিরিয়া যাওয়ার পরিকল্পনা করে এবং তিনটি বাণিজ্যিক কাফেলা বিশাল সম্পদ নিয়ে যাত্রা করে। মহানবী (সা.) তাদের যাত্রার সংবাদ পেয়ে যায়েদ বিন হারেসা (রা.)’র নেতৃত্বে একটি সেনাদল সেদিকে প্রেরণ করেন, তিনি (রা.) অত্যন্ত সতর্কতা ও কৌশলে তাদেরকে পরাস্থ করেন। এমনকি কুরাইশরা ভয় পেয়ে নিজেদের সমস্ত মালপত্র ফেলে রেখে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। এরপর যায়েদ বিন হারেসা (রা.) ও তার সাথীরা সেসব মালে গণিমত নিয়ে মদীনায় ফেরত আসেন।
সেই দিনগুলোতে ইহুদীদের নেতা কা’ব বিন আশরাফের হত্যার ঘটনাও ঘটে। বদরের যুদ্ধের পর ইহুদীরা চুক্তি ভঙ্গ করে প্রকাশ্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। এর একটি প্রমাণ হলো, কা’ব বিন আশরাফের বিরোধিতা ও ঘৃণ্য কর্মকা-। এ কারণে একদিন মহানবী (সা.) বলেন, কা’ব বিন আশরাফের বিষয়টি কে নিস্পত্তি করবে? তখন মুহাম্মদ বিন মাসলামা (রা.) তাকে হত্যা করার ইচ্ছা পোষণ করেন। অতঃপর মহানবী (সা.)-এর অনুমতি পেয়ে তিনি কা’ব বিন আশরাফের বাড়িতে যান। তিনি তার কাছে গিয়ে বাহানাস্বরূপ বলেন, মুহাম্মদ (সা.) আমাদের কাছে সদকা চেয়ে আমাদেরকে আর্থিক কষ্টে ফেলেছেন। তাই আমি তোমার কাছে কিছু অর্থ ঋণ নিতে এসেছি। এ সুযোগে কা’ব বিন আশরাফ প্রথমে তাকে মুহাম্মদ (সা.)-কে পরিত্যাগ করতে বলে, নতুবা তাদের স্ত্রীদের কিংবা তাদের পুত্রদের বন্ধক রাখতে বলে। মুহাম্মদ বিন মাসলামা (রা.) এর কোনোটি করতে সম্মত হননি, বরং নিজেদের যুদ্ধের বর্ম বা অস্ত্রশস্ত্র জামানতস্বরূপ গচ্ছিত রাখতে সম্মত হন। তখন কা’ব বিন আশরাফ তাকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রাতে আসার কথা বলে। সেদিন রাতে মুহাম্মদ বিন মাসলামা (রা.) আরো দু’জনকে সাথে নিয়ে কা’ব বিন আশরাফের কাছে যান আর তার সুগন্ধির প্রশংসা করে ও তার দেহে লাগানো সুগন্ধির সৌরভ নেওয়ার বাহানায় তাকে ধরে ফেলেন এবং সঙ্গীদের সাহায্যে তাকে হত্যা করেন এবং মদীনায় ফিরে মহানবী (সা.)-কে এই হত্যার সংবাদ জানান।
মদীনায় এ ঘটনার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর একদল ইহুদী মহানবী (সা.)-এর কাছে এসে অভিযোগ জানালে তিনি (সা.) সামগ্রীকভাবে কা’ব বিন আশরাফের চুক্তিভঙ্গ, যুদ্ধের উস্কানী দেয়া, বিশৃংখলা সৃষ্টি, নোংরা কবিতা রচনা এবং তাঁকে (সা.) হত্যার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবগত করেন। যার ফলে তারা ভীত হয়ে নিশ্চুপ হয়ে যায়। এরপর মুহাম্মদ (সা.) পুনরায় ইহুদীদের কাছ থেকে শান্তিচুক্তি গ্রহণ করেন। ইতিহাসে কোথাও এমন ঘটনা পাওয়া যায় না যে, ইহুদীরা কা’ব বিন আশরাফের হত্যার উল্লেখ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কখনো কোনো আপত্তি করেছে কেননা তারা অনুধাবন করেছিল যে, কা’ব তার কৃত অপরাধের প্রাপ্য শাস্তি পেয়েছে।
অনেক ঐতিহাসিক এই আপত্তি করে যে, মহানবী (সা.) তাকে বিনা অপরাধে হত্যা করিয়েছেন? একেবারে স্পষ্ট যে, এটি বিনা অপরাধে ছিল না, কেননা কা’ব বিন আশরাফ মহানবী (সা.)-এর সাথে চুক্তিবদ্ধ ছিল আর মুসলমানদের বিরুদ্ধে কিছু করা তো দূরের কথা, বরং সে এই অঙ্গীকারও করেছিল যে; বাইরের কোনো শত্রু মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করলে সে মুসলমানদেরকে সাহায্য করবে। কিন্তু এই চুক্তির বিরুদ্ধে সে মুসলমানদের সাথে প্রতারণা করেছে এবং মদীনায় নৈরাজ্য ও অশান্তি সৃষ্টির বীজ বপন করে মুসলমানদের বিপক্ষে যুদ্ধের জন্য লোকজনকে উস্কানোর চেষ্টা করেছে আর মহানবী (সা.)-কে হত্যার গোপন ষড়যন্ত্র করেছে। এসব অপরাধের কারণে তার ব্যপারে এরূপ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। হুযূর (আই.) বলেন, বর্তমান যুগের কথিত সভ্য দেশগুলোতেও এরূপ কুকর্ম, নৈরাজ্য সৃষ্টি, নোংরা কবিতা রচনা, যুদ্ধের উস্কানি দেয়া, হত্যার ষড়যন্ত্র, সন্ধিচুক্তি ভঙ্গের মতো অপরাধ করা হলে তাকে শাস্তি দেয়া হয়- অতএব ইসলামের বিরুদ্ধে কেন এ আপত্তি করা হয়?
দ্বিতীয় আপত্তি এটি করা হয় যে, তাকে গোপনে রাতের আঁধারে কেন হত্যা করা হয়েছিল? প্রথমত এর উত্তর হলো, সে সময়ে আরবে শাস্তি প্রদানের জন্য বা বিচারকার্য সম্পাদনের কোনো নির্ধারিত আদালত ছিল না, যেখানে তার নামে বিচার দিয়ে সাজার রায় পাওয়া যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে চুক্তির নিয়মানুযায়ী মহানবী (সা.)-কে এই অধিকার দেয়া হয়েছিল যে, তিনি যে কোনো অরাজকতাপূর্ণ পরিবেশে যা যথার্থ মনে করবেন সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। কাজেই, দেশের শান্তি-শৃঙ্খলার কথা চিন্তা করে কা’ব এর কৃত অপরাধের কারণে তাকে হত্যার নির্দেশ দেয়া- দোষের কিছু ছিল না। বিশেষতঃ যখন ইতিহাস থেকে এটি প্রমাণিত যে, ইহুদীরা যখন কা’ব এর অপরাধের ফিরিস্তি শোনে তখন তারাও নীরব হয়ে যায় এবং এ বিষয়ে আর কোনো আপত্তি করে নি।
এরপর হুযূর (আই.) বলেন, মহানবী (সা.)-এর সাথে হযরত হাফসা বিনতে উমর (রা.)’র বিয়েও তৃতীয় হিজরীতে হয়েছিল। হযরত হাফসা (রা.)’র স্বামী বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং ফেরার সময় অসুস্থ হয়ে ইন্তেকাল করেন। এরপর হযরত উমর (রা.) হযরত উসমানে (রা.)’র সাথে সাক্ষাৎ করে তার কাছে নিজের মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব দেন। হযরত উসমান (রা.) বলেন, আমি চিন্তা করে পরে বলব। এরপর হযরত উমর (রা.) হযরত আবু বকর (রা.)’র সাথে সাক্ষাৎ করে তার কাছে নিজের মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। তিনিও নীরবতা অবলম্বন করেন। হযরত উমর (রা.) এতে খুবই কষ্ট পান এবং মহানবী (সা.)-এর সমীপে এই ঘটনা উল্লেখ করেন। মহানবী (সা.) বলেন, চিন্তা কোরো না। এরপর তিনি (সা.) স্বয়ং তাকে বিয়ে করেন। হযরত হাফসার স্বামীর মৃত্যুর কারণে তার কষ্টের কথা চিন্তা করে, হযরত উমর (রা.)’র সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে এবং হযরত হাফসা (রা.) শিক্ষিতা ছিলেন বিধায় মুসলমান নারীদের তবলীগ ও তা’লীমের কথা চিন্তা করে মহানবী (সা.) হযরত হাফসা (রা.)-কে বিয়ে করেন। এ বিয়ে হওয়ার পর হযরত আবু বকর এবং হযরত উসমান (রা.) উভয়ে হযরত উমর (রা.)-কে বলেন, আমরা মহানবী (সা.)-এর অভিপ্রায় সম্পর্কে জানতাম তাই আপনার প্রস্তাবে সম্মত হইনি।
তৃতীয় হিজরীতে হযরত আলী (রা.) ও ফাতেমা (রা.)’র ঘরে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয় যার নাম মহানবী (সা.) হাসান রাখেন। একবার হাসান (রা.) সদকার একটি খেজুর নিয়ে মুখে পুড়েছিলেন। মহানবী (সা.) তার মুখ থেকে সেটি টেনে বের করেন আর বলেন, আহলে বায়তের জন্য সদকা হারাম। মহানবী (সা.) ফাতেমা (রা.)’র দুই সন্তানকে অনেক ভালোবাসতেন। তিনি তাদের জন্য দোয়া করেন, হে আল্লাহ্! আমি এই বাচ্চাদেরকে ভালোবাসি, তাই তুমিও তাদেরকে ভালোবাস আর যারা তাদেরকে ভালোবাসে তাদেরকেও তুমি ভালোবাস।
পরিশেষে হুযূর (আই.) বলেন, যেভাবে আমি গত কয়েক শুক্রবার থেকে বলছি, ফিলিস্তিনিদের জন্য দোয়া অব্যাহত রাখুন। এখন যুলুম সীমাতিক্রম করছে। হামাসের সাথে যুদ্ধের নামে নিস্পাপ নারী, শিশু, বৃদ্ধদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। আল্লাহ্ তা’লা মুসলমান দেশগুলোকে বিবেক দিন। হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) ৭২-৭৩ বছর পূর্বে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হতে বলেছিলেন। হয় তারা এক এক করে মরবে নতুবা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবে। মুসলমান রাষ্ট্রগুলো কেউ কেউ কথা বলছে, কিন্তু তাদের কণ্ঠস্বর নিতান্তই ক্ষীণ। জাতিসংঘ প্রধানও ইতিবাচক কথা বলছে, কিন্তু এর কোনো প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে না। মনে হচ্ছে বিশ্ববাসী পৃথিবীকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। তথাপি এ ধ্বংসের পর যারা বেঁচে থাকবে তাদেরকে আল্লাহ্ তা’লা বিবেক দিন, যাতে তারা খোদা তা’লার প্রতি আকৃষ্ট হয়। যাহোক, আমাদের এ বিষয়ে অনেক দোয়া করা উচিত। আল্লাহ্ তা’লা বিশ্ববাসীর প্রতি কৃপা করুন, (আমীন)।