মহানবী (সা.)-এর জীবনী: বদর যুদ্ধ পরবর্তী ঘটনা এবং হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দোয়ার আহ্বান

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১০-নভেম্বর, ২০২৩

মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিলবিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম ও আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ১০ নভেম্বর, ২০২৩ তারিখে যুক্তরাজ্যের (ইসলামাবাদস্থ) মসজিদ মুবারক-এ “মহানবী (সা.)-এর জীবনী: বদর যুদ্ধ পরবর্তী ঘটনা এবং হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দোয়ার আহ্বান” বিষয়ক জুমুআর খুতবা প্রদান করেন। প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় বদরের যুদ্ধের অনতিপর সংঘটিত মহানবী (সা.)-এর জীবনচরিতের কতিপয় ঘটনা তুলে ধরেন। খুতবার শেষাংশে হুযূর (আই.) সম্প্রতি প্রয়াত কতিপয় নিষ্ঠাবান আহমদীর স্মৃতিচারণ করেন ও নামাযান্তে গায়েবানা জানাযা পড়ান।
তাশাহ্‌হুদ, তা’ঊয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, বদরের যুদ্ধের অব্যবহিত পর মহানবী (সা.)-এর জীবনচরিতের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করা হচ্ছিল। এর মাঝে দ্বিতীয় হিজরী সনের একটি ঘটনা হলো, জান্নাতুল বাকী প্রতিষ্ঠা। মহানবী (সা.)-এর মদীনায় আগমনের আগ পর্যন্ত সকল গোত্রের নিজেদের পৃথক পৃথক কবরস্থান ছিল যেখানে তারা তাদের মৃতদের সমাহিত করত। হযরত উবায়দুল্লাহ্ বিন আবি রাফে (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) এমন একটি স্থানের অনুসন্ধান করছিলেন যেখানে পৃথকভাবে কেবলমাত্র মুসলমানদের কবরস্থ করা হবে। অতএব, অনেকগুলো স্থান যাচাই বাছাইয়ের পর খোদা তা’লার নির্দেশের আলোকে মহানবী (সা.) বাকীউল গারকাদের করবস্থানটিকে মুসলমানদের জন্য নির্ধারণ করেন, যার নাম পরবর্তীতে জান্নাতুল বাকী রাখা হয়। আরবীতে বাকী শব্দের অর্থ এমন স্থান যেখানে গাছের প্রাচুর্যতা রয়েছে আর জান্নাত অর্থ বাগান। এ কবরস্থানে সর্বপ্রথম হযরত উসমান বিন মাযঊন (রা.)-কে দাফন করা হয়েছিল। মহানবী (সা.) তার কবরের মাথার দিকে একটি প্রস্তরফলক রেখেছিলেন আর মাঝে মাঝে সেই কবরের পাশে গিয়ে দোয়া পড়তেন। এরপর কোনো মুসলমান মারা গেলে মহানবী (সা.) বলতেন, আমাদের পথপ্রদর্শক উসমানকে যেখানে সমাহিত করা হয়েছে, তাকে যেখানে কবরস্থ কর।
গযওয়ায়ে বনু গাতফান সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, মহানবী (সা.) যখন জানতে পারেন যে, বনু গাতফানের দুটি শাখা গোত্র বনু সালবা এবং বনু মুহারেব- যি আমর নামক স্থানে একত্রিত হচ্ছে তখন তিনি ৪৫০জন সাহাবীকে নিয়ে সেদিকে যাত্রা করেন। এটি তৃতীয় হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসের ঘটনা। মহানবী (সা.) হযরত উসমান বিন আফফান (রা.)-কে মদীনায় আমীর নিযুক্ত করে যান। পথিমধ্যে সাহাবীরা এক লোককে পেয়ে আটক করে মহানবী (সা.)-এর কাছে নিয়ে আসেন। তাঁর (সা.) সাথে কথা বলার পর সে ইসলাম গ্রহণ করে এবং তার গোত্রের অবস্থান ও দূরভিসন্ধি সম্পর্কে মহানবী (সা.)-কে অবগত করে। অতঃপর সে বলে, বনু সালবা যদি জানতে পারে যে, আপনারা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন তাহলে তারা কখনো আপনাদের সাথে লড়াই করবে না, বরং পাহাড়ে পালিয়ে যাবে। পরবর্তীতে এমনই হয়েছে অর্থাৎ মুসলমানদেরকে দেখে তারা পালিয়ে পাহাড়ে চলে যায়।
গযওয়ায়ে বনু গাতফানের সময় একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে। একবার মহানবী (সা.) একটি গাছের নিচে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন আর সাহাবীরা অদূরে নিজেদের কাজে মগ্ন ছিলেন। এদিকে এক দুষ্ট লোক যার নাম ছিল দসুর সে মহানবী (সা.)-কে পাহাড়ের ওপর থেকে দেখে তার কাছে আসে এবং তরবারী ধরে বলে, হে মুহাম্মদ (সা.)! তোমাকে আমার হাত থেকে এখন কে রক্ষা করবে? মহানবী (সা.) বলেন, আল্লাহ্ বাঁচাবেন। একথা শোনার সাথে সাথে দসুরের হাত থেকে তরবারী পড়ে যায়। অতঃপর মহানবী (সা.) সেই তরবারী হাতে নিয়ে তার সামনে ধরে বলেন, এবার তোমাকে কে আমার হাত থেকে বাঁচাবে? সে বলে, কেউ নয়। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ্ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহ্র রসূল। এছাড়া আমি আর কখনো আপনার বিরুদ্ধে দন্ডায়মান হবো না। মহানবী (সা.) তাকে ক্ষমা করে দেন। সে যখন তার গোত্রের কাছে ফিরে যায় তখন গোত্রের লোকেরা তাকে এ ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। সে বলে, আমি দেখেছি যে, এক দীর্ঘকায় ব্যক্তি আমাকে পেছনে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। আমার মনে হলো, এ ব্যক্তি কোনো মানুষ নয়, বরং ফিরিশ্তা। কতিপয় আলেম এ ঘটনাকে গযওয়াতুর রিকার ঘটনা বলে উল্লেখ করেছে। কিন্তু অধিকাংশ বর্ণনামতে এটি বনু গাতফানের ঘটনা। সে তৎক্ষণাৎ ইসলাম গ্রহণ করেছিল কিনা এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে, তবে এটি সত্য যে, সে পরবর্তীতে আর কখনো মহানবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে দন্ডায়মান হয়নি। যাহোক, এ ছিল বনু গাতফানের অভিযান- যেখানে মহানবী (সা.) মতান্তরে ১১দিন কিংবা ১৫দিন বা এক মাস অবস্থান করেছিলেন।
এরপর হযরত রুকাইয়্যা (রা.)’র মৃত্যু এবং হযরত উম্মে কুলসুমের বিয়ের ঘটনা। মহানবী (সা.) বদরের যুদ্ধে যাওয়ার সময় হযরত উসমান বিন আফফান (রা.)-কে তাঁর কন্যা রুকাইয়্যার সেবার উদ্দেশ্যে মদীনায় রেখে গিয়েছিলেন। হযরত যায়েদ (রা.) যখন বদরের যুদ্ধ বিজয়ের সুসংবাদ নিয়ে মদীনায় আসেন সেদিন রুকাইয়্যা (রা.) মৃত্যুবরণ করেছিলেন। মহানবী (সা.) রুকাইয়্যার মৃত্যুর পর নিজের অপর কন্যা উম্মে কুলসুম (রা.)-কে তার সাথে বিয়ে দেন। এ সময় তিনি (সা.) হযরত হযরত উসমান (রা.)-কে বলেন, আল্লাহ্ তা’লা তোমার সাথে উম্মে কুলসুমের বিয়ে রুকাইয়্যার সমপরিমাণ দেন মোহরানা এবং উত্তম চরিত্রের শর্তে নির্ধারণ করেছেন। এটি তৃতীয় হিজরী সনের রবিউল আউয়াল মাসের ঘটনা আর এটি উম্মে কুলসুমের দ্বিতীয় বিয়ে ছিল। হযরত আয়েশা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে, মহানবী (সা.) বিয়ের সময় উম্মে আইমানকে বলেন, উম্মে কুলসুমকে প্রস্তুত করে উসমানের বাড়িতে দিয়ে আসো। তিনদিন পর মহানবী (সা.) তার বাড়িতে গিযে তাকে তার স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, হযরত উসমান (রা.) সর্বোত্তম স্বামী। নবম হিজরী সনে হযরত উম্মে কুলসুম (রা.)ও ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুতে মহানবী (সা.) অনেক কষ্ট পান। একটি বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে, মহানবী (সা.) বলেন, যদি আমার তৃতীয় কোনো কন্যা থাকত তাহলে আমি তাকেও উসমানের সাথে বিয়ে দিতাম। এমনকি এটিও বর্ণিত হয়েছে, তিনি (সা.) বলেন, আমার যদি একশটিও কন্যা থাকত তাহলে আমি তাদেরকে হযরত উসমানের সাথে বিয়ে দিতাম।
এছাড়া এ সময়কালে গযওয়ায়ে বনু সুলাইমের কথাও উল্লেখ রয়েছে। তৃতীয় হিজরী সনে মহানবী (সা.) জানতে পারেন, বনু সুলাইমের একটি বিশাল সংখ্যা মদীনায় আক্রমণের উদ্দেশ্যে সমবেত হয়েছে আর কুরাইশদের একটি দল তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে। অতঃপর তিনি (সা.) আব্দুল্লাহ্ বিন উম্মে মাকতুম (রা.)-কে, আরেক বর্ণনানুযায়ী হযরত উমর (রা.)-কে মদীনায় নিজের স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করে ৩০০ সাহাবীকে নিয়ে সেদিকে যাত্রা করেন, কিন্তু সেখানে পৌছার পূর্বেই এক লোকের কাছ থেকে জানতে পারেন যে, তারা সবাই বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। অতঃপর মহানবী (সা.) তাদেরকে না পেয়ে সেখান থেকে ফিরে আসেন, অতএব সেখানে কোনো যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি।
আরেকটি ঘটনা হলো, সারিয়া যায়েদ বিন হারেসা বা যায়েদ বিন হারেসার অভিযান। বদরের যুদ্ধের পর মক্কার কুরাইশরা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে মদীনার নিকটবর্তী সমুদ্রপথে সিরিয়ায় যেতে পারছিল না। তাই তারা নতুন কোনো পথ খুঁজছিল। একজন তাদেরকে ইরাক হয়ে সিরিয়া যাওয়ার পরামর্শ দেয়। তার পরামর্শ অনুযায়ী তৃতীয় হিজরী সনে সাফওয়ান অনেক সম্পদ নিয়ে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে আর আবু সুফিয়ান এবং আরো কিছু ব্যবসায়ী তার পিছু পিছু রওয়ানা হয়। তাদের চেষ্টা ছিল কোনোভাবেই যেন মদীনাবাসী এ পথের খবর না পায়। কিন্তু মক্কার নুয়ায়েম নামক এক ব্যক্তি এ সময়ে মদীনায় গিয়েছিল। সে মদ্যপান অবস্থায় এ যাত্রার কথা উল্লেখ করে যা একজন সাহাবী শুনে মহানবী (সা.)-কে অবগত করেন। অতঃপর মহানবী (সা.) হযরত যায়েদ বিন হারেসা (রা.)-কে দলনেতা মনোনীত করে ১০০জন অশ্বারোহীকে সেদিকে প্রেরণ করেন। তিনি সেখানে পৌঁছে পুরো দলকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে নেন আর সাফওয়ান ও আবু সুফিয়ান পালিয়ে প্রাণে বেঁচে যেতে সক্ষম হয়। হুযূর (আই.) বলেন, এই গোত্রগুলোকে আটক করার উদ্দেশ্য এটি ছিল যে, তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রমণের উদ্দেশ্যে অস্ত্র ধারণ করছিল যেরূপভাবে বর্তমান যুগেও বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। তারপরও তারা ইসলামের বিষয়ে আপত্তি করে থাকে!
খুতবার শেষ দিকে হুযূর (আই.) ফিলিস্তিনের নির্যাতিত ও নিপীড়িত মুসলমানদের জন্য পুনরায় দোয়ার তাহরীক করেন। হুযূর (আই.) বলেন, এখন কতিপয় অমুসলমান তাদের পক্ষে কথা বলছে। অনেকে বলছে, কমপক্ষে প্রতিদিন চার ঘন্টা যুদ্ধবিরতি দেয়া উচিত। আল্লাহ্ তা’লাই ভালো জানেন তারা কতটুকু এর ওপর আমল করবে। তবে বিশ্ববাসীর অনুধাবন করা উচিত, আল্লাহ্ তা’লা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবকাশ দিয়ে থাকেন। এ পৃথিবীই শেষ জগত নয়, আরেকটি জগত আছে। আল্লাহ্ তা’লা চাইলে এ জগতেও যালেমদের ধৃত করতে পারেন, পরজগতেও তারা ধৃত হবে। তাই আমাদের অনেক বেশি দোয়া করা উচিত, যাতে আল্লাহ্ তা’লা ফিলিস্তিনের নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত মুসলমানদের উদ্ধারের ব্যবস্থা করেন।
পরিশেষে হুযূর (আই.) ফয়সালাবাদ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রেজিষ্ট্রারার প্রয়াত চৌধুরী রশীদ আহমদ সাহেবের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন এবং নামাযের পর তার গায়েবানা জানাযা পড়ানোর ঘোষণা দেন। মরহুম পুণ্যবান, ঈমানদার, আহমদীয়াতের প্রতি আত্মাভিমানী, আর্থিক কুরবানীর ক্ষেত্রে অগ্রগামী এবং স্বল্পেতুষ্ট মানুষ ছিলেন। আল্লাহ্ তা’লা তার প্রতি দয়া ও ক্ষমাসুলভ আচরণ করুন এবং তাকে সুউচ্চ মর্যাদা দান করুন।