মজলিসে শূরার গুরুত্ব ও শূরার প্রতিনিধিদের দায়-দায়িত্ব

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১২-মে, ২০২৩

মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌, আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১২ই মে, ২০২৩ ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় মজলিসে শূরার গুরুত্ব ও শূরার প্রতিনিধিদের দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করেন।
তাশাহ্‌হুদ, তাআ’ঊয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত পাঠ করেন,

فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللَّهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ

(এই) আয়াতের অনুবাদ হলো, “অতএব আল্লাহ্‌র পরম কৃপায় তুমি তাদের প্রতি কোমলচিত্ত হয়েছ, আর তুমি যদি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতে তাহলে নিশ্চয় তারা তোমার আশপাশ হতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতো। অতএব (তুমি) তাদের মার্জনা করো এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ করো। এরপর তুমি যখন (কোনো বিষয়ে) সংকল্পবদ্ধ হও তখন আল্লাহ্‌রই ওপর ভরসা করো। নিশ্চয় আল্লাহ্ ভরসাকারীদের ভালোবাসেন”। (সূরা আলে ইমরান : ১৬০)

এরপর হুযূর (আই.) বলেন, বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জামাতের মজলিসে শূরা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, কতক দেশে অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে আবার কোনো কোনো দেশে আগামী এক দুই সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে। মজলিসে শূরার গুরুত্ব ও প্রতিনিধিদের দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে আমি পূর্বেও কোনো কোনো খুতবায় দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি, কিন্তু যেহেতু এর কয়েক বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে তাই আমি আজ পুনরায় এ বিষয়ে আল্লাহ্ তা’লার নির্দেশ এবং মহানবী (সা.)-এর আদর্শ ও জামাতের রীতি-নীতি স্মরণ করিয়ে দেয়া যথার্থ মনে করছি। যেসব স্থানে ইতঃমধ্যে শূরা অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে সেখানকার শূরার প্রতিনিধিরাও যেন এসব নির্দেশনা থেকে উপকৃত হতে পারেন, কেননা শূরার সদস্যদের অধিকাংশ দায়-দায়িত্ব যুগ-খলীফা কর্তৃক শূরার প্রস্তাবাবলী অনুমোদনের পরই আরম্ভ হয়। অনুমোদন অনুযায়ী আমল করা এবং নিজেদের দায়-দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা শূরার প্রত্যেক সদস্যের জন্য একান্ত আবশ্যক।
হুযূর (আই.) বলেন, উপরোক্ত আয়াতে মহানবী (সা.) আল্লাহ্ তা’লার পরম দয়ার কারণে স্বীয় উম্মতের সদস্যদের প্রতি অত্যন্ত সদয়চিত্ত ছিলেন- এ বিষয়টি সত্যায়ন করার পাশাপাশি এদিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে যে, যাদের ওপর মহানবী (সা.)-এর মিশনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তাদেরও সবার সাথে ভালোবাসা, স্নেহ ও নম্রতাপূর্ণ আচরণ করতে হবে। আল্লাহ্ তা’লা বলেন, যদি নম্রতা প্রদর্শন না করে কঠোর আচরণ করো এবং ক্রোধ প্রদর্শন করো তাহলে মানুষ তোমার নিকট থেকে দূরে সরে যাবে। এছাড়া এ আয়াতের পরবর্তী অংশে আল্লাহ্ তা’লা পরামর্শ গ্রহণেরও নির্দেশ প্রদান করেছেন। কাজেই, এ নীতি ও শিক্ষার আলোকেই মজলিসে শূরার আয়োজন করা উচিত।
হুযূর (আই.) মজলিসে শূরার গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, মজলিসে শূরা মূলত পরামর্শ প্রদানের সভা, সিদ্ধান্ত প্রদানের নয়। তাই যখন সিদ্ধান্ত প্রদান করা হবে তখন তা সানন্দে মেনে নিয়ে পালন করতে হবে। মহানবী (সা.) বিভিন্ন বিষয়ে আল্লাহ্ তা’লার পক্ষ থেকে নির্দেশনা লাভ করতেন। কিন্তু যেসব বিষয়ে আল্লাহ্ তা’লার স্পষ্ট নির্দেশনা থাকত না সেসব বিষয়ে তিনি (সা.) পরামর্শ গ্রহণ করতেন। আমাদের প্রতি আল্লাহ্ তা’লার অশেষ অনুগ্রহ হলো, আমাদের জামাতে শূরার প্রচলন আছে আর আমাদের মাঝে আল্লাহ্ তা’লার পক্ষ থেকে মনোনীত খলীফা আছেন, যিনি পৃথিবীর সকল দেশ থেকে সেখানকার অবস্থানুসারে পরামর্শ গ্রহণ করেন।
হুযূর (আই.) বলেন, ‘শাভিরহুম বিল’ আমর মানে হলো, যদিও আল্লাহ্ হিদায়াত দেন তথাপি নিজেদের কল্যাণের জন্য পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। মহানবী (সা.) পরামর্শের জন্য মুখাপেক্ষী ছিলেন না, কিন্তু তারপরও উম্মতকে শেখানোর উদ্দেশ্যে একাজ করেছেন এবং পরামর্শ গ্রহণ করাকে উম্মতের জন্য কল্যাণকর জ্ঞান করতেন। অতএব যে পরামর্শ গ্রহণ করবে সে কৃপা লাভ করবে, কিন্তু যে পরমার্শ গ্রহণ করবে না সে লাঞ্ছিত হবে। মহানবী (সা.) এবং তাঁর সাহাবীদের জীবনী থেকে সাধারণত পরামর্শ নেয়ার তিনটি পদ্ধতি দেখা যায়। প্রথমত, যখন পরামর্শের প্রয়োজন হতো তখন ঘোষণা দেওয়া হলে লোকেরা একস্থানে সমবেত হয়ে পরামর্শ প্রদান করতেন, এরপর মহানবী (সা.) কিংবা তাঁর খলীফাগণ সে অনুসারে সিদ্ধান্ত প্রদান করতেন। সে যুগে গোত্র-প্রধানের প্রচলন ছিল তাই গোত্রের পক্ষ থেকে তাদের নেতা প্রস্তাবনা পেশ করত আর এতে সাধারণ সদস্যদের সম্মতি থাকত। দ্বিতীয়ত, যাদেরকে মহানবী (সা.) পরমার্শের যোগ্য মনে করতেন তাদেরকে ডাকতেন, এরপর তাদের কাছ থেকে প্রস্তাব বা পরামর্শ গ্রহণ করতেন। তৃতীয়ত, মহানবী (সা.) পৃথক পৃথকভাবে একেকজনকে ডেকেও পরামর্শ গ্রহণ করতেন। খলীফারাও উপরোক্ত তিনটি পদ্ধতিতে পরামর্শ গ্রহণ করেছেন।
এরপর হুযূর (আই.) পরামর্শ গ্রহণ সম্পর্কিত কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করেন। হযরত আবু হুরায়রাহ্ (রা.) বর্ণনা করেন, আমি মহানবী (সা.)-এর চেয়ে অধিক পরমার্শগ্রহণকারী আর কাউকে দেখিনি। অতএব আল্লাহ্‌র নবীই যদি এত বেশি পরমার্শ গ্রহণ করে থাকেন তাহলে তোমাদের জন্য এ রীতি অবলম্বন করা কতটা জরুরী! হযরত মুআয বিন জাবাল (রা.) বর্ণনা করেন, আমাকে ইয়েমেনে প্রেরণ করার সময় মহানবী (সা.) হযরত আবু বকর (রা.), হযরত উমর (রা.), হযরত উসমান (রা.), হযরত তালহা (রা.) সহ বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শ করেন। হযরত আবু বকর (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) তাদের জিজ্ঞেস না করলে তারা কিছুই বলতেন না, কিন্তু মহানবী (সা.) কিছু জিজ্ঞেস করলে তখন তাঁরা পরামর্শ দিতেন। তিনি (সা.) এ ব্যাপারে হযরত মুআয (রা.)’র মতামতও জানতে, চেয়েছিলেন। কাজেই, এ ঘটনাটি মহানবী (সা.)-এর বিনয় এবং পরামর্শ গ্রহণের গুরুত্ব প্রকাশ করে। বদরের যুদ্ধের পূর্বে মহানবী (সা.) আনসার ও মুহাজির উভয়দলের পরামর্শ গ্রহণ করে যুদ্ধের জন্য যাত্রা করেছিলেন। আমরা দেখেছি, এই পরামর্শের আলোকে সাহাবীগণ কিরূপ অতুলনীয় কুরবানীর দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন, কীভাবে জীবন বাজি রেখে তাঁরা লড়াই করেছেন। অতএব পরামর্শ দেয়ার অর্থ হলো, এ বিষয় পালনে আমি সর্বপ্রথম অঙ্গীকার করছি। এভাবে যদি আমাদের পক্ষ থেকে ব্যবহারিক দৃষ্টান্ত প্রদর্শিত হয় তাহলে জামাতের সদস্যগণ সানন্দে সেগুলো পালন করতে চাইবে।
পরামর্শদাতাদের উদ্দেশ্যে হুযূর (আই.) বলেন, সর্বদা স্মরণ রাখবেন! যেভাবে খলীফার জন্য এ নির্দেশ রয়েছে যে, ধর্মীয় কাজে পরামর্শ গ্রহণ করো, অনুরূপভাবে যাদের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করা হবে তাদেরকে সৎ-সংকল্প নিয়ে এবং তাকওয়ার উন্নত মানে অধিষ্ঠিত হয়ে পরামর্শ প্রদান করতে হবে। মহানবী (সা.) বলেন, বিবেকবান এবং সৎলোকদের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করো। তাই বিভিন্ন জামাতে যারা শূরার প্রতিনিধি নির্বাচন করে থাকেন তাদেরকেও এ বিষয়টি দৃষ্টিপটে রাখতে হবে। একইসাথে পরামর্শ দেয়ার সময় এবং মত প্রকাশের সময় শূরার প্রতিনিধিদের অন্য কারো বক্তৃতায় প্রভাবান্বিত হয়ে বা আত্মীয়তার কথা চিন্তা করে বা কারো ভয়ে ভীত হয়ে নিজস্ব মতামত পরিবর্তন করা উচিত নয়, বরং ধার্মিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে মতামত প্রদান করা উচিত। তাদের মনে রাখা উচিত, তাদের অন্তরে কী আছে এবং তারা কি করছে তা আল্লাহ্ সবচেয়ে ভালো জানেন। হুযূর (আই.) আরো বলেন, যুগ-খলীফার নির্দেশে এই শূরার আয়োজন করা হয়। শূরার প্রতিনিধিরা এক বছরের জন্য প্রতিনিধি এবং তারা খিলাফতের সাহায্যকারী হয়ে থাকেন। প্রত্যেক সদস্যকে এ বিষয়টি ভালোভাবে মনে রাখা উচিত যে, এর বিশেষ গুরুত্ব আছে। অনুমোদন বা সিদ্ধান্ত যাই হোক না কেন শূরার সদস্যের প্রতিটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার আপ্রাণ চেষ্টা করা উচিত।
পঠিত আয়াতের পরবর্তী অংশের ব্যাখ্যায় হুযূর (আই.) বলেন, কর্মকর্তাদের কখনো কঠোর ব্যবহার করা উচিত নয়। জামাতের সদস্যদের মধ্যে হতে কেউ যদি কঠোর আচরণ করেও ফেলে তবুও তাকে নম্রতার সাথে বুঝানো উচিত। অনেক সময় ব্যক্তিগত প্রভাব খাটানো শুরু হয়ে যায় বা কারো ভয়ে ভীত হয়ে মানুষ নিশ্চুপ হয়ে যায়। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের দায়িত্ব হলো, ন্যায়সঙ্গতভাবে সবাইকে সমঅধিকার প্রদান করা। আবেগকে প্রাধান্য না দিয়ে প্রত্যেকেরই শান্ত থাকা উচিত এবং পরষ্পরের পরামর্শ শোনা উচিত। অনেক প্রতিনিধি তাকওয়ার নিরিখে কাজ করেন না। এরূপ হলে প্রথমত যারা মনোনীত করেছে তারা ভুল করেছে, তাই তাদের এস্তেগফার করা উচিত। তবে যারা মনোনীত হয়েছেন অথচ প্রত্যাশিত আধ্যাত্মিক মানে উপনীত নন তাদের এস্তেগফার করে নিজেদেরকে যোগ্য বানানোর চেষ্টা করে যেতে হবে এবং নিজেদের আধ্যাত্মিক ও ব্যবহারিক অবস্থাকে উন্নত করতে সচেষ্ট হতে হবে।
শূরার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে হুযূর (আই.) বলেন, কখনো কখনো পদাধিকারীদের পক্ষ থেকে শৈথিল্যের কারণে সিদ্ধান্তগুলি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয় না। এমন পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র শূরার প্রতিনিধিদের সাধারণ সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই যথেষ্ট নয়, বরং তাদের উচিত পদাধিকারীদেরকেও স্মরণ করিয়ে দেওয়া। এরপরও যদি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে শূরার প্রতিনিধিকে কেন্দ্রে অবগত করা উচিত। হুযূর (আই.) বলেন, যদি সিদ্ধান্তের ওপর আমল করা না হয় এটি কি তাকওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার এবং খিলাফতের প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বস্ততা রক্ষা করার লক্ষণ? এভাবে কর্মকর্তারা অপরাধী সাব্যস্ত হয় এবং যুগ-খলীফার আস্থার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে। কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কাজ না করলে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং লজ্জিত হয়ে এটি লিখা উচিত যে, আমরা এ বছর করতে পারি নি, আগামী বছর করবো বা করতে পারব না। স্থানীয় জামাতগুলোরও এরূপ আত্মবিশ্লেষণ করা উচিত ।
পরিশেষে হুযূর (আই.) বলেন, আমরা শুধু কথা দিয়ে পৃথিবীতে পরিবর্তন আনতে পারব না, বরং আমাদের আমল করে দেখাতে হবে। শূরার প্রতিনিধিরা যদি তাদের ইবাদতের মান উন্নয়নে এবং মসজিদে উপস্থিত হওয়ার বিষয়ে মনোনিবেশ করে, তাহলে মসজিদের সামগ্রীক উপস্থিতি তিনগুণ বৃদ্ধি পেতে পারে। শূরার প্রতিনিধিরা যদি অন্যদের প্রতি সদয় ও সহানুভূতিশীল আচরণ করে এবং তাদের জন্য দোয়া করে এবং যুগ-খলীফার প্রতি তাদের আনুগত্যের মান বৃদ্ধি করে তবে জামাতের মধ্যে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসতে পারে। আল্লাহ্ তা’লা আমাদের সবাইকে তাকওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে ন্যায়ের মান সমুন্নত রেখে আমাদের দায়িত্ব পালন করার তৌফিক দিন। আল্লাহ্ তা’লা আমাদের সকল দুর্বলতা ও ত্রুটি ঢেকে রাখুন এবং ক্রমাগত তাঁর কৃপাবারি আমাদের ওপর বর্ষণ করুন, আমীন।