প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ ও ইমাম মাহদী (আ.)

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৪-মার্চ, ২০২৩

মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌, আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২৪শে মার্চ, ২০২৩ তারিখে ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় মসীহ্ মওউদ দিবসের প্রেক্ষাপটে শেষ যুগে আগত প্রতিশ্রুত হযরত মসীহ্ ও ইমাম মাহদী (আ.)-এর সত্যতার কিছু দিক তুলে ধরেন। খুতবার শেষাংশে হুযূর (আই.) পাকিস্তান, বুরকিনা ফাঁসো এবং বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে দোয়া করার আবেদন করেন।

তাশাহ্হুদ, তাআউয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযুর (আই.) সূরা জুমুআর ৩-৪নং আয়াত পাঠ করে এর অর্থ উপস্থাপন করেন। উক্ত আয়াতগুলোর ব্যাখ্যায় প্রতিশ্রুত হযরত আকদাস মসীহ্ (আ.) বলেন, খোদা তা’লা হলেন সেই খোদা যিনি এমন সময়ে রসূল প্রেরণ করেছেন যখন মানুষ জ্ঞান ও প্রজ্ঞা থেকে বঞ্চিত হয়ে গিয়েছিল আর ধর্মীয় প্রজ্ঞাপূর্ণ জ্ঞান সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে গিয়েছিল। আত্মার সংশোধনের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল আর মানুষ ভ্রষ্টতায় নিপতিত ছিল। তখন খোদা তা’লা স্বীয় নিরক্ষর রসূলকে প্রেরণ করেন আর সেই রসূল তাদের আত্মাকে পবিত্র করেন আর কিতাবের জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় তাদেরকে সমৃদ্ধ করেন। এরপর আল্লাহ্ তা’লা বলেন, আরও একটি দল রয়েছে যারা শেষ যুগে আত্মপ্রকাশ করবে। সহীহ্ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, মহানবী (সা.) এই আয়াতের তফসীর করার সময় সালমান ফার্সীর কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন, ঈমান যদি সপ্তর্ষিমন্ডলে তথা আকাশেও উঠে যায়, তবুও পারস্যবংশীয় এক বা একাধিক ব্যক্তি তা ফিরিয়ে আনবেন। সেই যুগটিই প্রতিশ্রুত মসীহ্’র যুগ আর এই পারস্যবংশীয় ব্যক্তিই তিনি যার পবিত্র নাম হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.)।
তিনি (আ.) বলেন, যেমনটি হাদীসের বর্ণিত হয়েছে ঠিক সেভাবেই নির্ধারিত সময়ে চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ সংঘটিত হয়েছে। (আর এগুলো) এমন সময়ে (সংঘটিত হয়েছে) যখন মাহদী হবার দাবিকারক বিদ্যমান ছিল এবং এরূপ ঘটনা পৃথিবী ও আকাশমন্ডলী সৃষ্টি হবার পর আর কখনো ঘটে নি। কেননা এখন পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি ইতিহাস থেকে এই ঘটনার কোনো দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে পারে নি। অতএব এটি মহানবী (সা.)-এর একটি মু’জিযা ছিল যা মানুষ স্বচক্ষে দেখেছে। এরপর মাহদী ও প্রতিশ্রুত মসীহ্‌র যুগে ‘যুস সিনীন’ তথা পুচ্ছবিশিষ্ট তারকা উদিত হবার কথা বর্ণনা করা হয়েছিল, যা উদিত হতে সহস্র সহস্র মানুষ দেখেছে। একইভাবে জাভা’র অগ্নুৎপাতও লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। একইভাবে প্লেগের প্রাদুর্ভাব এবং হজ্জ বন্ধ হওয়াও সবাই স্বচক্ষে দেখেছে। দেশে রেলগাড়ির প্রচলন হওয়া এবং উষ্ট্র বেকার হওয়া- এসবকিছু মহানবী (সা.)-এর মু’জিযা ছিল যা বর্তমান যুগে ঠিক সেভাবেই দেখা হয়েছে যেভাবে সাহাবা রাযিআল্লাহ্ আনহুম মহানবীর যুগে বিভিন্ন মু’জিযা দেখেছিলেন।
তিনি (আ.) আরো বলেন, অন্য কোনো ফিরকা নেই যা মহানবী (সা.)-এর সাহাবীদের মতো সাদৃশ্যপূর্ণ। প্রাথমিক যুগের সাহাবীগণ যে নিদর্শনগুলো প্রত্যক্ষ করেছিলেন আজ তা প্রত্যক্ষ করা হচ্ছে। সাহাবীগণ যে কষ্ট ও অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিলেন; আজ প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.)-এর জামাতও তার সম্মুখীন হচ্ছে। যেভাবে সাহাবীগণ নামাযে কাঁদতেন এবং বিভিন্ন ঐশী নিদর্শন ও সত্যস্বপ্ন দেখতেন, আজও তা দেখা যাচ্ছে। যেভাবে সাহাবীগণ তাঁদের ধন-সম্পদ একমাত্র আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য কুরবানী করেছিলেন, আজও মানুষ তাই করে। সাহাবীগণ যেমন আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য মৃত্যুকে ভয় করতেন না, কোমল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন এবং ন্যায়ের পথে চলতেন, তেমনি আজ এই জামাতের লোকেরাও করছেন। অতএব সাহাবীগণের মধ্যে যেসব গুণাগুণ পাওয়া যেত আজ তা প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.)-এর জামাতের মধ্যেও প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।
শেষ যুগের মসীহ্ (আ.) দু’টি সাদৃশ্য বহন করবেন; প্রথমত, ঈসা (আ.)-এর সাথে সাদৃশ্য যার কারণে তাঁকে মসীহ্ বলা হবে। দ্বিতীয়ত, মহানবী (সা.)-এর সাথে সাদৃশ্য যার কারণে তাঁকে মাহদী বলা হবে। তিনি (আ.) একস্থানে বলেন, পবিত্র কুরআন এবং মহানবী (সা.)-এর বাণী দ্বারা প্রমাণিত যে, মহানবী (সা.)-এর পরে অন্য কোনো শরীয়তবাহী নবীর আগমনের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, খোদা তা’লার সাথে কথোপকথনের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। এতো সবের পরও সুনিশ্চিত কুরআনের আয়াত দ্বারা হযরত ঈসা (আ.)-এর মৃত্যু প্রমাণিত, তাই পুনরায় পৃথিবীতে তার ফিরে আসার প্রত্যাশা করা বৃথা আশা মাত্র। কাজেই, শেষ যুগে হযরত ঈসা (আ.)-এর রঙে রঙিন হয়ে যিনি আসবেন তিনি নবীও হবেন বটে। তবে শরীয়তবাহী নয়, উম্মতি নবী। কেননা সহীহ্ হাদীস থেকে প্রমাণিত যে, মুহাদ্দিসরাও নবী ও রসূলদের মতো আল্লাহ্‌র প্রেরিতদের অন্তর্ভুক্ত। একই সাথে অন্য একটি হাদীসে আছে, علماء أمتی کأنبیاء بنی اسرائیل (অর্থাৎ, আমার উম্মতের আলেমরা বনী ইস্রাঈলের নবীসদৃশ হবেন)। একথাও স্মরণ রাখতে হবে যে, মুসলিম শরীফে প্রতিশ্রুত মসীহ্‌র সম্পর্কে বারবার ‘নবী উল্লাহ্’ শব্দটিও এসেছে।
প্রতিশ্রুত হযরত মসীহ্ (আ.) বলেন, বিশ্বের বর্তমান অবস্থা দেখে, সত্য প্রচারের জন্য খোদা তা’লা প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.)-কে প্রেরণ করেছেন। এভাবেই প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.) প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন যে, বিশ্ববাসীর সংশোধনের উদ্দেশ্যে শতাব্দীর শিরোভাগে যাকে পাঠানোর কথা ছিল তিনিই প্রকৃতপক্ষে সেই ব্যক্তি। তিনি (আ.) আরো বলেন, যখন বিশ্ববাসী খোদা থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল এবং কুফরের দিকে ধাবিত হচ্ছিল, তখন খোদা তা’লার আত্মাভিমান তাঁর সত্তাকে আবারও বিশ্বের সামনে প্রকাশ করার সংকল্প করেন। একারণেই প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.) এই সময়ে এবং এই যুগে পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছেন।
মানুষ কীভাবে বুঝবে যে, তিনিই সত্য প্রতিশ্রুত মসীহ্? এর উত্তরে হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.) বলেছেন, প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.)-এর আবির্ভাবের সাথে যেসব লক্ষণ পূর্বশর্ত ছিল তা তাঁর মাধ্যমে, তাঁর সময় এবং তাঁর দেশে পূর্ণ হয়েছে। অতএব, চন্দ্রগ্রহণ-সূর্যগ্রহণ, প্লেগ, ভূমিকম্প এবং অন্যান্য অগণিত নিদর্শন স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে, কেবল এটিই শেষ যুগের মসীহ্‌র আবির্ভাবের সময় ছিল না, বরং তিনিই প্রকৃতপক্ষে সেই প্রতিশ্রুত মসীহ্। একইভাবে তাঁর দোয়া কবুলিয়্যতের নিদর্শনসমূহ দেখে যে কোন বিবেকবান ব্যক্তি এটি স্বীকার করতে বাধ্য হবে যে, তিনিই সত্য মসীহ্ ও ইমাম মাহদী।
হুযূর (আই.) খুতবার শেষাংশে বলেন, রমযান মাসে প্রত্যেক আহমদী নিজের জন্য দোয়া করার পাশাপাশি প্রত্যেক প্রকার বিশৃঙ্খলা থেকে যেন জামা’ত সুরক্ষিত থাকে- সেজন্যও দোয়া করুন। একই সাথে মুসলিম উম্মাহ্‌র জন্যও দোয়া করুন, আল্লাহ্ তা’লা যেন তাদের চোখ খুলে দেন ও অন্ধকার থেকে তাদের মুক্তি দিন। আর তারা যেন এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারে যে, মহানবী (সা.)-এর খতমে নবুওয়্যতের মর্যাদাকে প্রকৃতঅর্থে উপলব্ধিকারী হলেন হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী, প্রতিশ্রুত মসীহ্ ও মাহদী (আ.) এবং তাঁর জামা’ত।
হুযূর (আই.) আরো বলেন, পাকিস্তানের আহমদীদের বিশেষভাবে নিজের দেশের জন্যও দোয়া করা উচিত। পাকিস্তানী আহমদীদের জন্যও দোয়া করা উচিত। আল্লাহ্ তা’লা নৈরাজ্যবাদী এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী আর স্বার্থপর লোক ও নেতাদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করুন। একইভাবে বুর্কিনা ফাঁসোর আহমদীদের জন্যও দোয়া করুন, আল্লাহ্ তা’লা তাদেরকে সকল অনিষ্ট থেকে রক্ষা করুন। বাংলাদেশের আহমদীদের বিশেষভাবে দোয়ায় স্মরণ রাখবেন। সেখানে প্রত্যেক জুমু’আতে কোনো না কোনো শংকা থাকে। পৃথিবীর সকল আহমদীদের জন্যও দোয়া করুন। আল্লাহ্ তা’লা সকল অনিষ্ট থেকে প্রত্যেক আহমদীকে সুরক্ষিত রাখুন আর প্রত্যেক আহমদীকে দৃঢ়তা দান করুন এবং ঈমান ও বিশ্বাসে প্রবৃদ্ধি দান করুন।