পবিত্র কুরআনের আশিস, কল্যাণরাজি, মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১০-ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১০ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ইং ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় বিগত খুতবার ধারাবাহিকতায় হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর রচনাবলী হতে পবিত্র কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করেন।
তাশাহ্‌হুদ, তা’ঊয এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, পবিত্র কুরআনের অলৌকিক সৌন্দর্য ও গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) রানী ভিক্টোরিয়ার হীরক জয়ন্তী উপলক্ষ্যে তোহফায়ে কায়সারিয়া নামক যে পুস্তিক রচনা করেছিলেন, তাতে তিনি রানীকে ইসলামের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং তাকে ইসলামের তবলীগ করেছিলেন। তিনি লিখেন, “পবিত্র কুরআন গভীর প্রজ্ঞায় পরিপূর্ণ এবং প্রতিটি শিক্ষার ক্ষেত্রে ইঞ্জিলের তুলনায় প্রকৃত পুণ্য শেখানোর ব্যাপারে অগ্রসর। বিশেষতঃ প্রকৃত ও সত্য খোদাকে দর্শনের প্রদীপ কুরআনের হাতেই রয়েছে। যদি এটি পৃথিবীতে না আসতো তবে আল্লাহ্ই জানেন, পৃথিবীতে সৃষ্টিপূজার সংখ্যা কোন্ পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হতো? তাই (এটি) কৃতজ্ঞতা প্রকাশের বিষয়, খোদার একত্ববাদ যা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল তা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।”
হুযূর (আই.) বলেন, অ-আহমদীরা আমাদের প্রতি কুরআন অবমাননার অপবাদ আরোপ করে। অথচ কে আছে যে বৃটিশ রানীকে এভাবে কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে ইসলামের বাণী পৌঁছে দিতে পারে?
ইসলাম খোদাপ্রদত্ত ধর্ম। যদি কেউ কুরআনে বর্ণিত শিক্ষা অনুযায়ী আমল করে তাহলে সে এ পৃথিবীতেই খোদা তা’লাকে দর্শন করতে পারবে। এতে এমন এক শক্তি রয়েছে যা মানুষকে সত্য ও জ্যোতির দিকে আকৃষ্ট করে এবং খোদা তা’লার একত্ববাদ তার হৃদয়ে প্রোথিত হয়ে যায়।
হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, “পবিত্র কুরআন সেই পরিপূর্ণ গ্রন্থ যা সঠিক পথ তথা পুরস্কারপ্রাপ্তদের পথ প্রদর্শন করে। পবিত্র কুরআন এমন এক হিদায়াত যার ওপর আমল করার ফলে মানুষ আধ্যাত্মিকতার উন্নত মার্গে পৌঁছতে পারে এবং খোদা তা’লার নৈকট্যভাজন হতে পারে। পৃথিবীতে সব ধরনের অনৈতিকতা ও বিশৃংক্সক্ষলা ছড়িয়ে পড়ার পর আল্লাহ্ তা’লা সমস্ত অপকর্ম দূরীভূত করার জন্য আর ধর্মীয় ও বিশ্বাসগত ভ্রান্তি দূর করার উদ্দেশ্যে পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ করেছেন।”
তিনি (আ.) আরো বলেন, “কুরআন এক মু’জিযা যা সমগ্র আরববাসীর সামনে উপস্থাপন করা হয়েছিল, কিন্তু কেউ এর কোনো উপমা উপস্থাপন করতে পারেনি। বাহ্যত তাদের কাছে এটি মানবীয় বাণীর ন্যায়ই মনে হয়েছিল, কিন্তু এর বিপরীতে কোনো বিরোধী দাঁড়াতে পারেনি। এভাবে কুরআন সত্য মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করে দেখিয়েছে এবং খোদার অস্তিত্বের জ্বলন্ত প্রমাণ দিয়েছে। যে ধর্ম কেবল এ কথা বলে যে, খোদা থাকা উচিত কিংবা বিবেকপ্রসূত দলীল দেয়- তা সত্য প্রমাণের জন্য যথেষ্ট নয়, কিন্তু পবিত্র কুরআন ব্যক্তিগত নিদর্শনাবলী এবং অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের আলোকে এমন খোদা পর্যন্ত পৌছে দেয় যার সম্পর্কে মানুষের হাক্কুল ইয়াকীন বা অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান অর্জিত হয়। আর এটি ইসলামের সত্যতা প্রমাণের অনেক বড় একটি দলীল। আল্লাহ্ তা’লার কৃপায় আহমদীয়া জামা’তে এমন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে যারা হাক্কুল ইয়াকীনের সাথে আল্লাহ্ তা’লাকে দর্শন করে।”
তিনি (আ.) একস্থানে বলেন, “পবিত্র কুরআন দাবি করে যে, এটি মুত্তাকীদের জন্য হিদায়াতস্বরূপ। এটি সেই মহাগ্রন্থ যা খোদা তা’লার জ্ঞান থেকে প্রকাশিত হয়েছে; যেহেতু এর জ্ঞান- সকল প্রকার অজ্ঞতা ও ভুলত্রুটি থেকে পবিত্র তাই এটি সবরকম সন্দেহ ও ত্রুটির ঊর্ধ্বে। আর এটি মানুষকে সেই স্তরে নিয়ে যায় যা মানবীয় উন্নতির পরম শিখর। পবিত্র কুরআন ধর্মকে পরিপূর্ণতা দান করেছে। যেভাবে কুরআনেই বর্ণিত হয়েছে, “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং আমার অনুগ্রহকে সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম।” কাজেই পবিত্র কুরআনের পর আর কোনো কিতাব আসতে পারে না। অন্য সব গ্রন্থের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব হলো, কুরআন বলে এখনও আল্লাহ্‌র সাথে বাক্যালাপের পথ খোলা আছে। তবে শর্ত হলো, কুরআনের অনুশাসন ষোলোআনা মেনে এবং মুহাম্মদ (সা.)-এর পরিপূর্ণ অনুসরণের মাধ্যমেই এটি লাভ করা সম্ভব। পরিতাপের বিষয় হলো, এরপরও বিরোধীরা আমাদেরকে কুরআন অবমাননাকারী বলে!
তিনি (আ.) বলেন, “পবিত্র কুরআন আধ্যাত্মিক নিরাময়ের উৎস। এ গ্রন্থ শত-সহস্রর তত্ত্বজ্ঞান ও সূক্ষ্ম রহস্যের জট খুলতে পারে। এটি প্রজ্ঞায় পূর্ণ যা নিখুঁত ধর্মের রূপরেখা বর্ণনা করেছে এবং আধ্যাত্মিক নিরাময়কে দৈহিক নিরাময়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করেছে। আল্লাহ্‌র সাথে সংযোগ স্থাপনের প্রকৃত মাধ্যম হলো পবিত্র কুরআন। কেউ আল্লাহ্‌র সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তাঁর নিদর্শনাবলীর সাথে পরিচিত হয় এবং যতক্ষণ না খোদার জ্যোতি তাদের হৃদয়ে প্রবেশ করে। প্রবৃত্তির দুর্বলতা ততক্ষণ পর্যন্ত দূর হতে পারে না যতক্ষণ না আল্লাহ্ তা’লা তা দূর করেন।” তিনি (আ.) বলেন, “আমাদের এবং পূর্ববর্তী পুণ্যবানদের অভিজ্ঞতা হলো, মুহাম্মদ (সা.) ও কুরআনের শক্তি মানবাত্মাকে এমন এক শক্তি দান করে যার মাধ্যমে মানুষের আধ্যাত্মিক চোখ উন্মুক্ত হয়; আর সেই চোখ দিয়ে সে আল্লাহ্ তা’লাকে দেখতে পায়।”
হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “সমস্ত উল্লেখযোগ্য নিদর্শন যা একটি ঐশী গ্রন্থে বিদ্যমান থাকা উচিত সেগুলো পবিত্র কুরআন ছাড়া অন্য কোনো গ্রন্থে নেই। পবিত্র কুরআনের মহান স্বতন্ত্র গুণাবলীর মধ্যে একটি হলো, এটি একজন মানুষকে ‘ঈশ্বর থাকা উচিত’ পর্যায় থেকে ‘আল্লাহ্ অবশ্যই আছেন’ পর্যায়ে নিয়ে যায়। যারা পবিত্র কুরআন অনুসরণ করে তাদের জন্য পবিত্র কুরআনের প্রতিশ্রুতি হলো- ১. যারা কুরআনের প্রতি ঈমান আনবে তাদেরকে সুসংবাদ প্রদান করা হবে (সূরা আয্ যুমার: ১৮)। ২. কুরআনের ওপর আমলকারীকে রূহুল কুদুসের পক্ষ থেকে সাহায্য করা হবে (সূরা আল্ মুজাদিলা: ২৩)। ৩. অন্যদের সাথে তার পার্থক্য সৃষ্টি করা হবে এবং তার মন্দসমূহ তার কাছ থেকে দূর করা হবে (সূরা আল্ আনফাল: ৩০)।” হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, “আমি নিজেই এ প্রতিশ্রুতিগুলোর সাক্ষী এবং আমাকে এ কারণেই প্রেরণ করা হয়েছে।”
তিনি (আ.) অন্যত্র বলেন, “পবিত্র কুরআনের ঘটনাপ্রবাহ কেবল কল্পকাহিনী নয়, বরং এগুলো ভবিষ্যদ্বাণীস্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের দু’টি অংশ রয়েছে। একটি হলো আদেশবালী ও অন্যটি হলো ঘটনাপ্রবাহ। যারা এ দু’টির মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না তারা কুরআন থেকে উপকৃত হতে পারে না। কুরআন স্বয়ং বলছে, لَوْ كَانَ مِنْ عِندِ غَيْرِ اللَّهِ لَوَجَدُوا فِيهِ اخْتِلَافًا كَثِيرًا । এটি পবিত্র কুরআন আল্লাহ্ তা’লার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হওয়ার এবং এর সত্যতার একটি শক্তিশালী প্রমাণ। কিন্তু যারা আদেশ ও ঘটনার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না, তাদের কাছে কুরআনে বিভিন্ন ধরণের স্ববিরোধ দৃষ্টিগোচর হয়। তাই এই দু’য়ের মাঝে পার্থক্য করতে পারাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) পবিত্র কুরআনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেন, “এর শিক্ষামালা অনেক উন্নত। তওরাত কেবলমাত্র অতিরিক্ত কঠোরতা শেখায় আর ইঞ্জিলে অতিরিক্ত নমনীয়তার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এ ধরনের শিক্ষা সার্বজনীনও নয় বা সর্বকালের জন্যও যথার্থ নয়। কেননা মানুষের প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। এ কারণে পবিত্র কুরআনে এমন এক ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষা বর্ণনা করা হয়েছে যা সর্বকালীন এবং সার্বজনীন।”
হুযূর (আই.) বলেন, পবিত্র কুরআন সম্পর্কিত বিষয়াদি হযরত মসীহ মওউদ (আ.)-এর রচনাসমগ্রের আলোকে আগামীতেও বর্ণনা করা হবে, ইনশাআল্লাহ্। আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে পবিত্র কুরআনের শিক্ষার ওপর সত্যিকার অর্থে আমল করার তৌফিক দিন। (আমীন)