শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ: হযরত আবু বকর (রা.)

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৫-নভেম্বর, ২০২২

মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌, আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২৫শে নভেম্বর, ২০২২ইং ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় সাম্প্রতিক ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় হযরত আবু বকর (রা.)’র ধারাবাহিক স্মৃতিচারণের ধারা অব্যাহত রাখেন রাখেন
তাশাহ্‌হুদ, তা’ঊয এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)’র জীবনাদর্শের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা চলছিল। হযরত আবু বকর (রা.)’র সৃষ্টির সেবা এবং অসহায়-দুস্থদের প্রতি তাঁর দয়ার্দ্র আচরণ সংক্রান্ত কতিপয় ঘটনা হুযূর তুলে ধরেন। হযরত আবু বকর (রা.) ইসলাম গ্রহণের পূর্বেও কুরাইশদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের মধ্যে গণ্য হতেন। মানুষজন বিভিন্ন সমস্যায় পড়লে তাঁর কাছেই সাহায্যের আশায় ছুটে যেত। মক্কায় তিনি বড় আকারের নিমন্ত্রণের আয়োজন করে মানুষজনকে খাবার খাওয়াতেন। আতিথেয়তার ক্ষেত্রে আরবদের সুখ্যাতি সুবিদিত, কিন্তু হযরত আবু বকর (রা.) তাদের মধ্যেও এই ক্ষেত্রে এক অনন্য অবস্থান রাখতেন। তিনি অসহায় ও দুস্থদের প্রতি সীমাহীন দয়া প্রদর্শন করতেন। শীতের সময় তিনি কম্বল ইত্যাদি কিনে দুস্থদের মাঝে বিতরণ করতেন। একবার তিনি গ্রাম থেকে উন্নত মানের পশমী কম্বল কিনে বিধবাদের মধ্যে বিতরণ করেন বলে জানা যায়। একটি বর্ণনা থেকে জানা যায়, হযরত আবু বকর (রা.) খিলাফতের আসনে সমাসীন হবার পূর্বে দুস্থ একটি পরিবারের জন্য ছাগলের দুধ দুইয়ে দিতেন। যখন তিনি খলীফা নির্বাচিত হন তখন সেই বাড়ির ছোট্ট একটি মেয়ে তাঁকে বলে, এখন তো আর আপনি আমাদের ছাগলের দুধ দুইয়ে দেবেন না! একথা শুনে আবু বকর (রা.) বলেন, কেন দেব না? অবশ্যই দেব! বস্তুতঃ তিনি খলীফা হবার পরও ছ’মাস পর্যন্ত একাজ করেন, যতদিন না তিনি খিলাফতের দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে মদীনায় স্থানান্তরিত হন। তিনি দুধ দুইয়ে দেবার সময় সেই মেয়েটিকে আনন্দ দেয়ার জন্য বলতেন, দুধে ফেনা তুলবেন নাকি তুলবেন না; মেয়েটি যেভাবে চাইতো তিনি সেভাবেই করতেন। এটি ছিল ছোট্ট এক শিশুর প্রতি তাঁর স্নেহের অতুলনীয় বহিঃপ্রকাশ।
মহানবী (সা.)-এর যুগে সুফ্ফার অধিবাসীরা দরিদ্র ছিলেন। একদিন মহানবী (সা.) সাহাবীদের বলেন, যাদের বাড়িতে তিনজন বা চারজনের খাবার রয়েছে, তারা যেন সাথে করে দু’একজনকে নিয়ে যান এবং খাবার খাওয়ান। হযরত আবু বকর (রা.) নিজের সাথে তিনজনকে সাথে করে নিয়ে যান, মহানবী (সা.) নিজেও সাথে করে দশজনকে নিয়ে যান। এরপর তিনি নামাযের জন্য আবার মসজিদে আসেন এবং রাতের খাবার মহানবী (সা.)-এর বাড়িতে খান এবং এশার নামাযের পর বাড়ি ফেরেন। বাড়ি গিয়ে জানতে পারেন, তাঁর স্ত্রী অতিথিদের সময়মতো খাবার পরিবেশন করে বারংবার তাদেরকে খাবার খেয়ে নিতে অনুরোধ করার পরও অতিথিরা খাবার খান নি, আবু বকর (রা.)’র জন্য অপেক্ষা করেছেন। এতে তিনি (রা.) খুবই বিব্রত হন এবং অতিথিদের দ্রুত খেতে বসতে বলেন; অতিথিরা খেতে বসলে দেখা যায়, তারা পাত থেকে একটি গ্রাস তোলার সাথে সাথেই পুনরায় তা ভরে যাচ্ছে। এটি আল্লাহ্ তা’লার পক্ষ থেকে কৃপার এক অলৌকিক নিদর্শন ছিল। তিনি (রা.) নিজেও সেই আশিসমণ্ডিত খাবার খান এবং মহানবী (সা.)-এর জন্যও নিয়ে যান।
হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) একস্থানে বলেন, হযরত আবু বকর (রা.) কখনোই খলীফা হিসেবে কোন ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করেন নি, বরং যথাসাধ্য সৃষ্টির সেবা করার চেষ্টা করেছেন এবং একেই নিজের পরম সম্মান জ্ঞান করেছেন। সূফীদের মধ্যে প্রচলিত একটি ঘটনা হুযূর (রা.) বর্ণনা করেন; হযরত উমর (রা.) খিলাফতের আসনে সমাসীন হবার পর একবার হযরত আবু বকর (রা.)’র জনৈক কর্মচারীর কাছে জানতে চান, তিনি কী কী করতেন? সেই কর্মচারী যেসব কাজের বিবরণ দেন তার মধ্যে একটি ছিল, তিনি (রা.) প্রতিদিন খাবার নিয়ে একস্থানে যেতেন এবং কর্মচারীকে দাঁড় করিয়ে রেখে একটি গুহায় প্রবেশ করতেন। হযরত উমর (রা.) সেই কর্মচারীকে সাথে নিয়ে ঐ স্থানে যান এবং কিছুদূর এগিয়ে একটি গুহার মধ্যে একজন অন্ধ এবং চলাফেরায় অক্ষম লোককে দেখতে পান। তিনি তখন সেই ব্যক্তির মুখে খাবারের লোকমা তুলে দেন। ঐ অন্ধ লোকটি খাবার মুখে দিয়েই বলেন, ‘আল্লাহ্ আবু বকরের প্রতি কৃপা করুন, তিনি অত্যন্ত পুণ্যবান মানুষ ছিলেন।’ উমর (রা.) আশ্চর্য হয়ে বলেন, ‘বাবাজী, আবু বকর (রা.) যে মারা গিয়েছেন, তা আপনি কীভাবে বুঝলেন?’ সেই ব্যক্তি বলেন, ‘আমার তো দাঁত নেই, তাই আবু বকর নিজেই চিবিয়ে আমার মুখে খাবারের গ্রাস তুলে দিতেন। আজ আমার মুখে খাবার শক্ত লাগছে বিধায় আমি বুঝতে পেরেছি- তিনি আর নেই!’
হযরত আবু বকর (রা.)’র আরেকটি অসাধারণ গুণ ছিল তিনি অন্যের দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখার ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তিনি বলতেন, যদি আমার হাতে কোন চোর ধরা পড়তো, তবে আমার সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা এটিই হতো যেন আল্লাহ্ তার অপরাধ গোপন রাখেন। হযরত আবু বকর (রা.) সাহসিকতা ও বীরত্বের মূর্ত প্রতীক ছিলেন। তিনি ইসলামের স্বার্থে ভয়ংকর সব বিপদের মুখেও নিজেকে ঠেলে দিতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। মহানবী (সা.)-এর প্রতি তাঁর ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা এত গভীর ছিল যে, যখনই তিনি তাঁর (সা.) বিন্দুমাত্র কষ্ট বা ক্ষতির আশংকা করতেন, সাথে সাথে তাঁর (সা.) সুরক্ষা ও সাহায্যার্থে ছুটে আসতেন এবং তাঁর সামনে নিজের বুক পেতে দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে যেতেন। শে’ব-এ আবি তালিবেও অসীম ধৈর্য নিয়ে তিনি মহানবী (সা.)-এর সাথে থেকেছেন এবং হিজরতের সময়ও মহানবী (সা.)-এর সঙ্গী হয়েছেন; প্রতিটি যুদ্ধে তিনি কেবল অংশগ্রহণই করেন নি, বরং মহানবী (সা.)-এর নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বও পালন করেছেন। হযরত আলী (রা.) এই বিষয়টিকেই দৃষ্টিপটে রেখে একবার মন্তব্য করেছিলেন, “মুসলমানদের মাঝে সবচেয়ে সাহসী হলেন হযরত আবু বকর (রা.)”। এর যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, বদরের যুদ্ধের দিন মহানবী (সা.) ছিলেন কুরাইশদের প্রধান লক্ষ্যস্থল এবং তাঁর (সা.) নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়ার অর্থই ছিল নিজেকে সবচেয়ে বড় ঝুঁকির মধ্যে নিক্ষেপ করা। হযরত আলী (রা.)’র মতে, অন্য সবাই যখন আলাপ করছিল যে, এই দায়িত্ব কে নেবে; তখন হযরত আবু বকর (রা.) সবার আগে নিঃসঙ্কোচে তরবারি হাতে এই দায়িত্ব পালনার্থে এগিয়ে আসেন। উহুদের যুদ্ধের দিনও যখন মহানবী (সা.) সম্পূর্ণরূপে শত্রুদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েছিলেন, তখন যে গুটিকয়েক সাহাবী তাঁর (সা.) পাশে অবিচলতার সাথে থেকেছেন, তাঁদের মধ্যে আবু বকর (রা.) অন্যতম। পরিখার যুদ্ধ, হুদাইবিয়ার সন্ধি, তায়েফের যুদ্ধ- ইত্যাদি প্রতিটি বিশেষ ক্ষেত্রেই হযরত আবু বকর (রা.)’র আত্মনিবেদন ছিল সবার চেয়ে বেশি। তিনি কোমল হৃদয়ের অধিকারী হওয়ায় মহানবী (সা.) তাঁকে বড় কোন যুদ্ধের সেনাপতির দায়িত্ব দেন নি কিন্তু ছোট-খাট কিছু যুদ্ধাভিযানের নেতৃত্ব তাঁকে প্রদান করতেন। হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) সূরা বনী ইস্রাইলের দ্বিতীয় আয়াতের তফসীর প্রসঙ্গে লেখেন, যেভাবে স্বপ্নযোগে মহানবী (সা.)-এর বায়তুল মুকাদ্দাস সফরের সময় হযরত জিব্রাইল (আ.) তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন, সেভাবেই হিজরতের সময় হযরত আবু বকর (রা.) তাঁর সঙ্গী ছিলেন। যেভাবে জিব্রাইল, আল্লাহ্ তা’লার নির্দেশের প্রতি অনুগত, হযরত আবু বকর (রা.) সেভাবেই মহানবী (সা.)-এর অনুগত এবং যেভাবে জিব্রাইল শব্দের অর্থ আল্লাহ্র পাহলোয়ান, তেমনিভাবে হযরত আবু বকর (রা.)ও আল্লাহ্‌র বিশেষ বান্দা এবং ধর্মের ক্ষেত্রে এক বীর পাহলোয়ানের মর্যাদা রাখেন।
হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) এই বিষয়টিও বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে, যদিও হযরত আবু বকর (রা.) অত্যন্ত নরম ও কোমল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন, কিন্তু যথাসময়ে আল্লাহ্ তা’লা তাঁকে খিলাফতের উপযুক্ত যোগ্যতাও প্রদান করেন। মহানবী (সা.)-এর তিরোধানের পর যখন খিলাফত নির্বাচন সম্পর্কে আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়, হযরত উমর (রা.) সেখানে গিয়ে বক্তব্য রাখতে চেয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, আবু বকর (রা.) খুব নরম হৃদয়ের মানুষ, কিন্তু এখানে জোর দিয়ে কথা বলতে হবে। অথচ যখন তিনি বক্তব্য দিতে যাবেন, ঠিক তখনই আবু বকর (রা.) তাঁকে বসিয়ে দিয়ে স্বয়ং অত্যন্ত জোরালো ও প্রতাপান্বিত বক্তব্য রাখেন, যার ফলে আনসার স্বীকার করে নেয় যে, খলীফা মুহাজিরদের মধ্যে থেকেই হবেন। হযরত উমর (রা.) বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না, ইনিই সেই আবু বকর, যাঁকে একবার তিনি কোন এক তর্কের সময় আক্রমণ করতে উদ্যত হলেও তিনি কিছু বলেন নি। আর যখন চতুর্মুখী বিদ্রোহের মুখে হযরত উমর (রা.)’র মতো প্রতাপশালী ব্যক্তিও যাকাতের ব্যাপারে কিছুটা ছাড় দিতে আবু বকর (রা.)-কে অনুরোধ করেন, তখন সেই নরম আবু বকর (রা.)ই দৃঢ়তার সাথে বলেন, কুরআনের নির্দেশের ব্যাপারে তিনি বিন্দুমাত্রও আপোস করতে রাজি নন, যদি বিদ্রোহীদের সাথে তাঁকে একাকী লড়তে হয় তবে তাতেও তিনি প্রস্তুত। যারা বলতো, সূরা তওবার ১০৩নং আয়াতে মহানবী (সা.)-কে যাকাত নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, এখন আর সেই নির্দেশ বলবৎ নেই, তাদের এই ভ্রান্তিও তিনি অপনোদন করেন এবং বলেন, মহানবী (সা.)-এর পর খলীফাই তাঁর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে এই দায়িত্ব পালন করবেন।
হযরত আবু বকর (রা.)’র বিভিন্ন আর্থিক কুরবানীর ইতিহাসও হুযূর (আই.) তুলে ধরেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, তিনি (রা.) যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তিনি দশ লক্ষ দিরহামের মালিক ছিলেন, কিন্তু তিনি দুস্থ ও অসহায়দেরকে তা এত ব্যাপকহারে দান করেন যে, হিজরতের সময় তাঁর কাছে মাত্র পাঁচ হাজার দিরহাম ছিল আর তাও তিনি মহানবী (সা.)-এর প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে জমা করেছিলেন। স্বয়ং মহানবী (সা.) বলেন, হযরত আবু বকর (রা.)’র সম্পদ দ্বারা তিনি যতটা উপকৃত হয়েছেন, অন্য কারো সম্পদ দিয়ে তিনি এতটা উপকৃত হন নি। এক যুদ্ধের প্রাক্কালে হযরত উমর (রা.) ভাবেন, সবসময় আবু বকর (রা.) আর্থিক কুরবানীর ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকেন, এবার আমি তাঁর চেয়ে এগিয়ে যাব। এই ভেবে তিনি নিজের যাবতীয় সম্পদের অর্ধেক নিয়ে উপস্থিত হন। একটু পরে যখন আবু বকর (রা.) আসেন তখন দেখা যায়, তিনি বাড়িতে যা কিছু ছিল তার সবই নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। হযরত উমর (রা.) বুঝতে পারেন, আবু বকর (রা.)-কে পেছনে ফেলা তাঁর সাধ্যাতীত। হুযূর (আই.) বলেন, এই স্মৃতিচারণের ধারা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে, ইনশাআল্লাহ্।