আল্লাহ্ তা’লার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে আহমদীদের করণীয়

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৪-অক্টোবর, ২০২২

বায়তুর রহমান মসজিদ, সিলভার স্প্রিং, মেরিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌, আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ১৪ই অক্টোবর, ২০২২ইং উত্তর আমেরিকার মেরিল্যান্ডে অঙ্গরাজ্যের সিলভার স্প্রিংয়ে অবস্থিত বায়তুর রহমান মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় আল্লাহ্ তা’লার অনুগ্রহরাজির প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে আহমদীদের করণীয় সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেন।
তাশাহ্‌হুদ, তা’ঊয এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, আপনাদের প্রতি, আহমদীয়া জামাতের প্রতি এবং হিজরতকারী আহমদীদের প্রতি আল্লাহ্ তা’লার অপার অনুগ্রহ হলো, তিনি আপনাদেরকে এই উন্নত দেশে আসার সৌভাগ্য প্রদান করেছেন; বিশেষভাবে বিগত কয়েক বছরে পাকিস্তান থেকে এখানে অনেক আহমদী এসেছেন, এখনও আসছেন। পাকিস্তান থেকে তাদের হিজরত করে এখানে আসার কারণ হলো, সেখানে আহমদীদের বসবাস ক্রমেই কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আহমদীদের এখানকার সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত, যারা অনেক নির্যাতিত আহমদীকে এখানে থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ যা আল্লাহ্ তা’লা আমাদের আহমদীদের প্রতি করেছেন তা হলো, তিনি আমাদেরকে যুগ-ইমাম ও মহানবী (সা.)-এর নিষ্ঠাবান প্রেমিক হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে মানার সৌভাগ্য দান করেছেন। এই অনুগ্রহের কারণে আমরা তাঁর প্রতি যতই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি না কেন তা হবে অপ্রতুল। আর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সর্বোত্তম উপায় হলো, আল্লাহ্ তা’লার নির্দেশাবলী মান্য করা; আল্লাহ্‌র ইবাদতের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন এবং সৃষ্টজীবের প্রাপ্য অধিকার প্রদান করা। আর এটি তখনই সম্ভব যখন আমরা মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর হাতে বয়’আতের অঙ্গীকার পুরোপুরি পালন করতে সক্ষম হব, কেননা তিনিই এই যুগে মহানবী (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে আমাদেরকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার ওপর পরিচালিত করেছেন। তিনিই সেই ব্যক্তি, যাঁকে আল্লাহ্ তা’লা এই যুগে পবিত্র কুরআনের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করেছেন। তাই আমাদের প্রকৃত মুসলমান হতে হলে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর নির্দেশানুসারেই নিজেদের জীবন পরিচালিত করতে হবে।
হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) তাঁর হাতে বয়’আতকারীদের পূর্ণ ঈমান ও একীন প্রতিষ্ঠা এবং ক্রমশ এতে উন্নতি করার বিষয়ে জোরালো উপদেশ প্রদান করেছেন এবং কুধারণা থেকে আত্মরক্ষা করতে বলেছেন। আল্লাহ্ তা’লা বলেছেন –إِنَّ ٱلظَّنَّ لَا يُغۡنِى مِنَ ٱلۡحَقِّ شَيۡـًٔا‌ – অর্থাৎ অনুমান কখনোই সত্যের বিকল্প হতে পারে না; একীন বা সুনিশ্চিত বিশ্বাসই কেবল মানুষকে সাফল্যমণ্ডিত করতে পারে। মানুষ যদি কুধারণা করতে আরম্ভ করে তবে এক দণ্ডও পৃথিবীতে টিকতে পারবে না। পানি পান করতে গেলেও সে ভাববে, কেউ হয়তো এতে বিষ মিশিয়েছে; বাজারের জিনিস খেতে গেলেও এমন সন্দেহ করবে। এমনটি হলে সে বাঁচবে কীভাবে? আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রেও এই নীতি অবলম্বন করে উপকৃত হওয়া সম্ভব। আমরা মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর হাতে বয়’আত করেছি এবং তাঁকে হাকাম ও আদল তথা ন্যায়বিচারক এবং মীমাংসাকারী বলে মেনেছি, তারপরও যদি তাঁর কোন সিদ্ধান্ত বা কাজে আমাদের মনে কোন বিরক্তি বা ক্ষোভ সৃষ্টি হয় তবে নিজেদের ঈমান সম্পর্কে আমাদের চিন্তিত হওয়া উচিত, কারণ সংশয় ও সন্দেহপূর্ণ ঈমান কোন সুফল বয়ে আনে না। স্বয়ং মহানবী (সা.) যেখানে বলে গিয়েছেন, মসীহ্ মওউদ হাকাম ও আদল হবেন, সেই কথায় বিশ্বাস না করলে আর কী করবে? যারা মসীহ্ মওউদ (রা.)-কে অস্বীকার করেছে, তারা না হয় তাঁকে চিনতে পারে নি; কিন্তু যে তাঁকে গ্রহণ করার পরও তাঁর দেয়া সিদ্ধান্তের বিষয়ে আপত্তি করে- সে তো আরো বড় দুর্ভাগা, কারণ সে দেখার পরও অন্ধ হয়েছে! আর মসীহ্ মওউদ (আ.) নিজেই তাঁর পর খিলাফত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকার সুসংবাদ প্রদান করেছেন; স্বয়ং মহানবী (সা.)ও মসীহ্ ও মাহদীর আগমনের পর কিয়ামত পর্যন্ত খিলাফতের ধারা অব্যাহত থাকার সুসংবাদ প্রদান করেছেন। আর আহমদীয়া খিলাফত হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর মিশনকেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। আর বয়’আতের সময়ও প্রত্যেক আহমদী খিলাফতের সাথে সম্পৃক্ত এবং এর প্রতি অনুগত থাকার অঙ্গীকার করে থাকে। কাজেই, এই খিলাফতের সাথে সম্পৃক্ততা এবং আনুগত্যের অঙ্গীকার রক্ষা করাও আমাদের জন্য অপরিহার্য, নতুবা আমাদের বয়’আত অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) জামাতকে পবিত্র কুরআন অভিনিবেশ সহকারে পাঠ করার এবং তা অনুধাবন করার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন, কারণ এটি ছাড়া ব্যবহারিক জীবনে কোন আলো বা জ্যোতি সৃষ্টি হতে পারে না। পবিত্র কুরআন নিছক কল্প-কাহিনী বা ঘটনার সমাহার মনে করে পাঠ করলে চলবে না, একে এক গভীর দর্শন জ্ঞান করে অধ্যয়ন করতে হবে; এর অর্থের প্রতিও অভিনিবেশ করতে হবে, তফসীরও মনোযোগের সাথে অধ্যয়ন করতে হবে। হুযূর (আই.) বলেন, প্রত্যেকের আত্মবিশ্লেষণ করা উচিত, জাগতিক কর্মব্যস্ততায় নিমগ্ন হয়ে পাছে আমরা নিজেদের বয়’আতের উদ্দেশ্যকে ভুলে যাই নি তো! যদি অবস্থা তা-ই হয়, তবে আমরা নিজেদের সন্তান-সন্ততি এবং পরবর্তী প্রজন্মের ধর্ম থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণ হব এবং কার্যত আল্লাহ্ তা’লার অনুগ্রহরাজির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পরিবর্তে অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শনকারী গণ্য হব। মসীহ্ মওউদ (আ.) বয়’আত সম্পর্কে বলেন, এটি হলো প্রাণসঞ্চারী প্রস্রবণের কাছে আসা, কিন্তু সেই প্রস্রবণ থেকে পানি পান করে আধ্যাত্মিকভাবে জীবিত হওয়া এখনো বাকি। আর সেই পানি পান করার উপায় কী? উপায় হলো হুকুকুল্লাহ্ ও হুকুকুল ইবাদ তথা আল্লাহ্‌র ও সৃষ্টজীবের প্রাপ্য অধিকার যথাযথভাবে প্রদান করা।
হুকুকুল্লাহ্ বা আল্লাহ্‌র অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে যে, বান্দা প্রকৃত অর্থেই আল্লাহ্‌কে এক-অদ্বিতীয় ও একমাত্র উপাস্য জ্ঞান করে, যেমনটি কলেমা পাঠের সময় সে ঘোষণা দিয়ে থাকে। কলেমা কেবল মুখে বুলি আওড়ানোর নাম নয়, বরং হৃদয়ে তা অনুধাবন করতে হবে এবং কার্যত তা পালন করতে হবে। তাই আমাদের আত্মবিশ্লেষণ করতে হবে, যেভাবে আমরা কলেমা পাঠের সময় ঘোষণা করি, সেভাবেই কি আল্লাহ্ তা’লা আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয়? যদি নামাযের সময় আমাদের মনোযোগ এতে নিবদ্ধ না হয়, নামাযে সেই আকর্ষণ অনুভব না করি, তবে মুখে কলেমা পাঠকারী হলেও আমরা কার্যত এক গোপন এবং সূক্ষ্ম শির্‌ককের শিকার হব। মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর হাতে তওবামূলক বয়’আতের মাধ্যমে আমাদের জীবনে আমূল পরিবর্তন সাধন আবশ্যক, নতুবা মৌখিক বয়’আতের কোন মূল্য নেই।
হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, পুণ্য সেটিই যা সময়ের পূর্বে করা হয়, একবার বিপদ উপস্থিত হলে আর পুণ্য গৃহীত হয় না। জাগতিক কাজ বাদ দিয়ে নামাযে উপস্থিত হওয়া খুবই কঠিন, তাহাজ্জুদ পড়া তো আরো কঠিন; কিন্তু এখন চেষ্টা করলে আল্লাহ্ তা সহজ করে দেবেন। যে দোয়া করে, সে বঞ্চিত থাকে না। হুযূর (আই.) বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আল্লাহ্‌র সাথে সম্পর্ক স্থাপনের এটিই মোক্ষম সময়, কারণ এখনো যুদ্ধ এবং বিপদাপদ এড়ানো সম্ভব। জগতের প্রতি সহমর্মিতা নিয়ে দোয়া করতে হবে, কারণ আজ শুধুমাত্র আহমদীদের ঈমান, আল্লাহ্ তা’লার সাথে সম্পর্ক বন্ধন এবং দোয়াই জগদ্বাসীকে রক্ষা করতে পারে।
হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) জামাতকে উন্নত চরিত্র প্রদর্শনের জন্যও বিশেষভাবে উপদেশ দিয়েছেন, কারণ আল্লাহ্ তা’লাও এই নির্দেশ প্রদান করেছেন। আর এটি অত্যন্ত কঠিন কাজ; মানুষ যতক্ষণ গভীরভাবে আত্মবিশ্লেষণ না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত সংশোধিত হতে পারে না। নিজের জিহ্বাকে সর্বদা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। কেউ এমন ব্যক্তির প্রতি শত্রুতা পোষণ করতে পারে না, যার সম্পর্কে সে নিশ্চিত জানে যে; সে প্রকৃতই তার শুভাকাঙ্ক্ষী। তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ে যদি অসদাচরণ প্রদর্শন করা হয়, তবে নিজেই নিজেকে কষ্টে নিপতিত করা হবে। হুযূর (আই.) বলেন, নিঃসন্দেহে ইসলাম ব্যক্তিগত বিষয়াদিতে ধৈর্য, সংযম, সহনশীলতা ও উন্নত নৈতিক গুণাবলী প্রদর্শন করার এবং ঝগড়া বিবাদ থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ দেয়, তবে একইসাথে আইনের গণ্ডির মধ্যে থেকে ধর্মের প্রতি আত্মাভিমান প্রদর্শন করারও নির্দেশ দেয়। যারা ইসলাম, আল্লাহ্ তা’লার সত্তা, মহানবী (সা.)-এর প্রতি শত্রুতা রাখে এবং ভালোভাবে বোঝানো সত্ত্বেও গালিগালাজ এবং নোংরা ভাষা থেকে বিরত হয় না, এমন ব্যক্তির সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করা উচিত এবং ধর্মীয় আত্মাভিমান প্রদর্শন করা উচিত; অনুরূপভাবে মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর ক্ষেত্রেও আত্মাভিমান প্রদর্শন করা উচিত। তবে কখনো আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া যাবে না, আইনের গণ্ডিতে থেকেই তা করতে হবে। জামাতের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা, সৌহার্দ্য এবং ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টির বিষয়েও মসীহ্ মওউদ (আ.) বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন আর বলেছেন, যতক্ষণ না প্রকৃত সহমর্মিতা নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত জামাতের মাঝে প্রকৃত সতেজতা সৃষ্টি হবে না। আপন ভাইয়ের মত জামাতের ভাইদের দুর্বলতা ঢেকে রাখা, তাদের সুন্দরভাবে বোঝানো এবং সংশোধনের চেষ্টা করা আমাদের অন্যতম দায়িত্ব।
খুতবার শেষাংশে হুযূর (আই.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদের তৌফিক দিন, আমরা যেন হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী নিজেদের জীবন গড়ে তুলতে পারি, ধর্মকে জাগতিকতার ওপর প্রাধান্য দানকারী হই, আমাদের হৃদয়ে যেন আল্লাহ্ তা’লার ভীতি সৃষ্টি হয় এবং আমরা যেন প্রকৃত অর্থেই ‘আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ কলেমায় প্রদত্ত স্বীকারোক্তি পালনকারী হই; আমরা যেন আখারীনদের সেই জামাতের অন্তর্ভুক্ত হতে পারি যার সুসংবাদ আল্লাহ্ তা’লা মহানবী (সা.)-কে প্রদান করেছিলেন; আল্লাহ্ তা’লা আমাদের সেই তৌফিক দান করুন। হুযূর এ-ও উল্লেখ করেন, বায়তুর রহমান মসজিদটি আজ থেকে ২৮ বছর পূর্বে এই দিনেই উদ্বোধন করা হয়েছিল; তাই সংশ্লিষ্ট আহমদীদের আত্মবিশ্লেষণ করা উচিত- তারা বিগত ২৮ বছর ধরে কতটা এই মসজিদের প্রাপ্য অধিকার প্রদান করেছেন। সেইসাথে হুযূর (আই.) অদূর ভবিষ্যতেও আহমদীরা যেন এই মসজিদের প্রাপ্য প্রদানে সমর্থ হন সেই দোয়া করেন।