ফাতহে আযীম মসজিদ, যায়োন (Zion), ইলিনিয়স, যুক্তরাষ্ট্র

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

৩০-সেপ্টেম্বর, ২০২২

ফাতহে আযীম মসজিদ, যায়োন, ইলিনিয়স, যুক্তরাষ্ট্র

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌, আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৩০শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ইং আমেরিকার ইলিনিয়স অঙ্গরাজ্যের যায়োন (Zion) শহরে অবস্থিত ফাতহে আযীম মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় এই শহরে মসজিদ নির্মাণের প্রেক্ষাপট এবং আল্লাহ্ তা’লার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে আমাদের করণীয় সম্পর্কে আলোকপাত করেন।
তাশাহ্‌হুদ, তা’ঊয এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, আজ আপনারা এখানে যায়োনের মসজিদের উদ্বোধন উপলক্ষ্যে সমবেত হয়েছেন। আল্লাহ্ তা’লা আমেরিকা জামাতকে এই মসজিদ সেই শহরে নির্মাণের তৌফিক দান করেছেন যা জামাতের ইতিহাসে এক বিশেষ গুরুত্ব বহন করে, কারণ এই শহরের গোড়াপত্তন করেছিল এক চরম ইসলাম-বিদ্বেষী ড. আলেকজান্ডার ডুই। সেই ইতিহাস তুলে ধরার জন্য জামাত একটি প্রদর্শনীরও আয়োজন করেছে। এই শহরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব, জনৈক নামসর্বস্ব দাবিকারক এবং মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বিরুদ্ধে তার নোংরা ভাষা ব্যবহার আর তার নিদর্শনমূলকভাবে ধ্বংস হওয়া এবং এই শহরে জামাত প্রতিষ্ঠিত হওয়া- এগুলো প্রত্যেক আহমদীকে আল্লাহ্ তা’লার প্রতি কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করে এবং করা উচিতও বটে। হুযূর শহরবাসীদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন; কারণ শহরের কাউন্সিল প্রথমে এখানে আমাদের মসজিদ নির্মাণের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছিল, কিন্তু শহরবাসী আমাদের পক্ষে দ-ায়মান হয় এবং কাউন্সিলকে অনুমতি প্রদানে বাধ্য করে। মহানবী (সা.) আমাদের শিখিয়েছেন, আল্লাহ্ তা’লার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য মানুষের প্রতিও কৃতজ্ঞ হওয়া আবশ্যক। সেই সাথে আল্লাহ্ তা’লার প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ হওয়ার প্রতিও হুযূর (আই.) জামাতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন; কারণ আমরা যতই কৃতজ্ঞ হব এবং আল্লাহ্‌র প্রাপ্য প্রদানকারী হব, তিনি ততই আমাদেরকে সেসব নিদর্শনের পূর্ণতা দেখাবেন যেগুলোর প্রতিশ্রুতি তিনি হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে আজ থেকে ১২০ বছর পূর্বে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী এই শহরের প্রতিষ্ঠাতা জন আলেকজান্ডার ডুই-এর ধ্বংস হওয়া এক মহান বিজয় ছিল, এবং সেই শহরেই আজ মুসলমানদের মসজিদ নির্মিত হওয়াও এক মহান বিজয়, কিন্তু এটিই কি আমাদের চূড়ান্ত বিজয়? আমেরিকার ছোট্ট একটি শহরে মসজিদ নির্মাণই কি যথেষ্ট? আমাদেরকে তো ছোট-বড় সব শহর এবং সকল দেশকে মহানবী (সা.)-এর চরণতলে সমবেত করতে হবে। আমাদের সঙ্গতির তুলনায় এটি অনেক বড় কাজ হলেও আল্লাহ্ তা’লা এই কাজ আমাদের স্কন্ধেই অর্পণ করেছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেছেন; আমাদের সকল কর্মকাণ্ড তুচ্ছ প্রচেষ্টা মাত্র; প্রকৃত কাজ সম্পাদিত হবে আল্লাহ্‌র সাহায্যে যার জন্য অনেক বেশি দোয়া করা প্রয়োজন। আমাদেরকে দোয়ার প্রতি এবং মসজিদ নির্মাণের মূল উদ্দেশ্যের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। পাঁচবেলার নামাযে নিয়মিত উপস্থিত হওয়া, নিয়মিত জুমু’আর নামাযে আসা একান্ত আবশ্যক। যদি তা না হয় তবে এই মসজিদ নির্মাণ এক অবকাঠামো তৈরী করা ছাড়া আর কিছুই নয়; প্রকৃত উদ্দেশ্য পূর্ণ না হলে আমাদের এই নির্মাণ কাজ আল্লাহ্ তা’লার সন্নিধানে গৃহীত হবে না। তাই আমাদের আত্মবিশ্লেষণ করা উচিত। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে প্রদত্ত খোদার সকল প্রতিশ্রুতি অবশ্যই পূর্ণ হবে, কিন্তু আমরা এর অংশীদার থাকতে পারবো কিনা তা আমাদের ভেবে দেখতে হবে।
হুযূর (আই.) বদরের যুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরেন যে, কীভাবে মহানবী (সা.) বিজয়ের সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও সেদিন আল্লাহ্‌র সাহায্য চেয়ে অঝোরে কেঁদে কেঁদে দোয়া করছিলেন; কারণ ঐশী প্রতিশ্রুতির সাথে কোন গোপন শর্ত রয়েছে কি-না তা আমাদের জানা নেই। এরূপ বিগলিত চিত্তের দোয়ার কল্যাণেই মুসলমানরা এমন মহান বিজয় বদরের প্রান্তরে লাভ করেছিলেন যার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে আর নেই; উপরন্তু ইসলাম এত বড় বড় বিজয় লাভ করে যে, চরম শত্রুরাও এমন আন্তরিক মুসলমানে পরিণত হয় যে, তাঁর (সা.) জন্য নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করতেও তারা দ্বিধা করে নি। আজ মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বেলায়ও নিশ্চয় তা ঘটবে, তবে তার জন্য প্রচুর হৃদয়-নিংড়ানো আন্তরিক দোয়ার প্রয়োজন।
হুযূর (আই.) বলেন, এই মসজিদের নাম মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর প্রতি অবতীর্ণ একটি এলহামের ভিত্তিতে ‘ফাতহে আযীম’ বা মহান বিজয় রাখা হয়েছে; ঐশী কোপগ্রস্ত হয়ে ডুই-এর দৃষ্টান্তমূলক মৃত্যুকে তিনি (আ.) ফাতহে আযীম বা মহান বিজয় আখ্যা দিয়েছিলেন। তৎকালীন জাগতিক পত্রপত্রিকাতেও মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী এবং ডুই-এর করুণ মৃত্যুর ঘটনা প্রকাশিত হয়েছিল। হুযূর ২৩শে জুন, ১৯০৭ সালের সানডে হেরাল্ড বোস্টনে প্রকাশিত নিবন্ধের অংশবিশেষ তুলে ধরেন। নিজেকে এলিয়া নবীর বিকাশ বলে দাবি করা আলেকজান্ডার ডুই ইসলাম এবং মহানবী (সা.) সম্পর্কে বিভিন্ন জঘন্য মন্তব্য করায় হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) তাকে মুবাহালার চ্যালেঞ্জ দেন। ডুই প্রথমে এর কোন উত্তর না দিলেও এক পর্যায়ে সে নিজের পত্রিকায় নিতান্ত অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যেভরে মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর উল্লেখ করে। মসীহ্ মওউদ (আ.) মুবাহালার চ্যালেঞ্জ জোরের সাথে পুনর্ব্যক্ত করেন এবং তাঁর জীবদ্দশাতেই ডুইয়ের শাস্তিমূলক মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী করেন। অতঃপর কিছুদিনের মধ্যেই পাগল এবং পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে ডুইয়ের করুণ মৃত্যু হয়। এটি নিঃসন্দেহে এক মহান বিজয় ছিল; কিন্তু এটি তাঁর (আ.) বিশাল কর্মক্ষেত্রের ক্ষুদ্র একটি অংশ ছিল মাত্র। আমাদের প্রকৃত বিজয় তো তখন হবে, যখন সারা পৃথিবীকে আমরা মহানবী (সা.)-এর পতাকাতলে সমবেত করতে সক্ষম হব। মক্কা-বিজয় তো ইসলামের সবচেয়ে বড় বিজয় ছিল, কিন্তু মুসলমানরা কি এরপর ধর্মপ্রচার করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন? নতুন নতুন বিজয় কি সূচিত হয় নি? অতএব, এই বিজয়ের পর আমাদের আরও নতুন নতুন বিজয় অর্জনের জন্য অগ্রসর হতে হবে।
হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর মাধ্যমে ইসলামের পুনর্জাগরণের যে বীজ আল্লাহ্ তা’লা বপন করেছিলেন, সেটিকে তিনি বিশাল মহীরূহে পরিণত করেছেন এবং ক্রমাগত বর্ধিত করছেন, ফুলে ফলে সুশোভিত করছেন। আজ ১৩৩ বছর ধরে জামাত ক্রমাগত উন্নতি লাভ করে চলেছে এবং ২২০টি দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেহেতু আমরা ঘোষণা করছি যে, মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.)ই সেই প্রতিশ্রুত মসীহ্ ও মাহদী, যাঁর সুসংবাদ এবং ভবিষ্যদ্বাণী মহানবী (সা.) করে গিয়েছেন, আমাদেরকে তাই তাঁর (আ.) প্রকৃত সাহায্যকারী হতে হবে, তাঁর সমর্থনে সেই আদর্শ প্রদর্শন করতে হবে যা মহানবী (সা.)-এর সাহাবীরা দেখিয়েছিলেন; নতুবা আমাদের বয়’আতের দাবি অন্তঃসারশূন্য সাব্যস্ত হবে। আর এটি তখনই সম্ভব যখন আমরা নিজেদের জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য অনুধাবন করতে সক্ষম হব।
মানবজীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী- সে বিষয়ে হুযূর (আই.) হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর ভাষ্য তুলে ধরেন। মানবসৃষ্টির প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো, মানুষ যেন তার প্রভু-প্রতিপালক আল্লাহ্‌কে চেনে, তাঁর ইবাদত করে। অথচ দুঃখের বিষয় হলো, প্রাপ্তবয়স্ক হবার পর অধিকাংশ মানুষ সেটি থেকেই দূরে সরে যায় এবং জগৎপূজায় লিপ্ত হয়। তাই মসজিদ নির্মাণের পাশাপাশি আমাদেরকে নিজেদের ইবাদতের প্রতিও মনোযোগী হতে হবে। মুরগির ঠোকর মারার মত দায়সারাভাবে নামায পড়লে চলবে না, নিজেদের নামায সুন্দরভাবে আদায় করতে হবে। অন্যের অধিকার খর্ব বা গ্রাস করা চলবে না। আল্লাহ্ তা’লার প্রতিটি নির্দেশ পালন করতে হবে; আল্লাহ্‌র প্রাপ্য এবং বান্দার প্রাপ্য অধিকার তথা হুকুকুল্লাহ্ ও হুকুকুল ইবাদ- উভয়টিই যথাযথভাবে প্রদান করতে হবে। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেছেন, তাঁর আগমনের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো খাঁটি মুত্তাকীদের একটি জামাত গঠন করা এবং নিজ অনুসারীদেরকে সর্বপ্রকার ঘৃণা-বিদ্বেষ এবং শিরক ও জগৎপূজা থেকে মুক্ত করা। আর যখন আমাদের মাঝে তাকওয়া সৃষ্টি হয়ে যাবে, তখন একের পর এক নিদর্শন আল্লাহ্ তা’লা প্রদর্শন করতে থাকবেন এবং নতুন নতুন বিজয়ের দ্বার উন্মোচন করতে থাকবেন, ইনশাআল্লাহ্। তাই হুযূর (আই.) জামাতকে সম্বোধন করে বলেন, হে মুহাম্মদী মসীহ্‌র সেবকগণ! বিজয়ের প্রতিটি নিদর্শন আমাদের মাঝে এক বিপ্লব সৃষ্টিকারী হওয়া উচিত। কাজেই, অঙ্গীকার করুন- আজকের এ দিন যেন আমাদের মাঝে এক আধ্যাত্মিক বিপ্লব আনয়নের দিন হয়, আমাদের সন্তানদের এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্যও আধ্যাত্মিক বিপ্লব আনয়নের দিন হয়। নতুবা ডুইয়ের ধ্বংসের মাধ্যমে ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হবার কথা সবাইকে জানিয়ে লাভ কী? লাভ তো তখনই হবে, যখন এই মহান বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হবার মাধ্যমে আমাদের মাঝেও এক মহান বিপ্লব সাধিত হবে, আমাদের দেশবাসী এবং সমগ্র বিশ্ববাসী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দাসত্বের জোয়াল নিজেদের কাঁধে তুলে নেবে, আল্লাহ্ তা’লার একত্ববাদ স্বীকার করবে এবং এর জন্য সর্বপ্রকার ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত হয়ে যাবে। হুযূর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে এবং আমাদের বংশধরদেরকে এই মানে অধিষ্ঠিত হবার তৌফিক দান করুন।