প্রতিশ্রুত সংস্কারক: ভবিষ্যদ্বাণী ও প্রতিশ্রুত পুরুষ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৯-ফেব্রুয়ারি, ২০২১

মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১৯শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১ইং ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় প্রতিশ্রুত সংস্কারক: ভবিষ্যদ্বাণী ও প্রতিশ্রুত পুরুষ সম্পর্কে খুতবা প্রদান করেন। খুতবায় তাঁর সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’লার ভবিষ্যদ্বাণী ‘তাকে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানে পরিপূর্ণ করা হবে’-এর পূর্ণতা সম্পর্কে আলোকপাত করেন।

তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, ২০শে ফেব্রুয়ারি দিনটি আহমদীয়া জামাতে মুসলেহ্ মওউদ সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণীর প্রেক্ষাপটে পালন করা হয়; আগামীকাল ২০ফেব্রুয়ারি, তাই আজ এ প্রসঙ্গে কিছু বলব। এটি একটি দীর্ঘ ভবিষ্যদ্বাণী এবং এতে অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে, যা আল্লাহ্ তা’লা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে ইলহাম মারফত তাঁর প্রতিশ্রুত পুত্র সম্পর্কে জানিয়েছিলেন। হুযূর (আই.) ইলহামের মধ্য থেকে একটি বাক্য ‘তাঁকে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানে পরিপূর্ণ করা হবে’- এ বিষয়টির পূর্ণতা সম্পর্কে হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.)’র রচনাসমগ্র ও বক্তৃতাদির আলোকে কিছুটা ব্যাখ্যা করেন, যার সাথে ইলহামের আরও একটি ভবিষ্যদ্বাণী ‘সে প্রখর মেধাবী ও ধীমান হবে’-এটিরও সম্পর্ক রয়েছে। যদিও তাঁর জাগতিক শিক্ষা মূলতঃ প্রাথমিক পর্যন্তই সীমিত ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও আল্লাহ্ তা’লা আপন প্রতিশ্রুতি অনুসারে তাঁকে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানে যে পরিপূর্ণ করেছেন, তা তাঁর বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা বা রচনাবলীতে বিবৃত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়াদি থেকে অনুমান করা যায়।

হুযূর (আই.) বলেন, একটি খুতবাতে সেগুলো বর্ণনা করা তো দূরে থাক, সেগুলোর পরিচিতি বর্ণনা করাও অসম্ভব; কেবল হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.)’র শৈশব থেকে যৌবনের মধ্যবর্তী সময়ের নির্বাচিত কয়েকটি বক্তৃতা ও রচনার পরিচিতি হুযূর তুলে ধরেন এবং এগুলোর সামান্য একটু ঝলক হিসেবে কয়েকটি পয়েন্ট উল্লেখ করেন। এসব প্রবন্ধ, বক্তৃতা ও রচনাসমগ্রে আল্লাহ্ তা’লার একত্ববাদ, ফিরিশতার প্রকৃত মর্ম ও তাৎপর্য, নবীদের অবস্থান ও মর্যাদা, খাতামান্ নবীঈন হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অবস্থান ও মর্যাদা এবং অন্যান্য আধ্যাত্মিক বিষয়াদি, সেইসাথে মুসলমানদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পথপ্রদর্শন, ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, ইসলামের ইতিহাসসহ আরও বিভিন্ন বিষয়ে তিনি (রা.) তাঁর গবেষণালব্ধ তথ্য ও উপাত্ত এবং সুগভীর মতামত ব্যক্ত করেছেন, যেগুলো আজও মুসলমানদের বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয়ের সমাধান প্রদানে সচেষ্ট। মাত্র ষোল-সতের বছর বয়সে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর জীবদ্দশায় জলসা সালানায় তিনি আল্লাহ্ তা’লার একত্ববাদের মত গভীর বিষয়ে যে বক্তৃতা করেন,
স্বয়ং হযরত খলীফাতুল মসীহ্ আউয়াল (রা.) তা শুনে ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং বলেন, “এতে সম্পূর্ণ নতুন নতুন কিছু বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে”।

১৯০৭ সনের মার্চ মাসে মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি (রা.) ‘মহব্বতে এলাহী’ বা ‘ঐশীপ্রেম’ নামে একটি আশ্চর্য প্রবন্ধ প্রকাশ করেন, যা পরবর্তীতে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। এত্থেকে প্রতীয়মান হয়, শৈশব থেকেই আল্লাহ্ তাঁকে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানে পূর্ণ করতে আরম্ভ করেন। এতে তিনি লিখেন, “খোদা তা’লা মানুষকে সৃষ্টিই করেছেন তাঁকে ভালোবাসার জন্য; ঐশীপ্রেমের ফলেই মানুষ পাপ থেকে মুক্তিলাভ করে এবং আধ্যাত্মিকতার পরম মার্গে উন্নতি করতে থাকে, আর এটিই মানুষকে খোদার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়”। এর
উপসংহারে গিয়ে তিনি (রা.) উল্লেখ করেন, “প্রকৃতপক্ষে ইসলামই জগদ্বাসীকে ঐশীপ্রেমের সন্ধান দিয়েছে এবং এটি লাভের সঠিক পথও বাতলে দিয়েছে”। ২৮শে ডিসেম্বর, ১৯০৮ তারিখে জলসা সালানায় তিনি ‘আমরা কীভাবে সফলতা অর্জন করতে পারি’- এই বিষয়ে অত্যন্ত গভীর ও প্রজ্ঞাপূর্ণ বক্তৃতা প্রদান করেন; সূরা তওবার ১১১-১১২নং আয়াতের আলোকে তিনি (রা.) বলেন, “প্রত্যেকের নিজের জন্মের
উদ্দেশ্য ও মৃত্যু-পরবর্তী জীবন সম্পর্কে প্রণিধান করা উচিত; মানুষ যেখানে গুটিকয়েক দিনের এই জীবনের জন্য এত চেষ্টা ও পরিকল্পনা করে, সেখানে পরকালের অনন্ত জীবনের জন্য কতটা প্রস্তুতি নেয়া দরকার! পার্থিব সম্পদ তো তার উত্তরাধিকারীদের ধ্বংসও করে দিতে পারে; কিন্তু মানুষ যদি কুরআন-বর্ণিত ব্যবসা করে, তবে তার মৃত্যুর পরও কেউ সেটিকে ধ্বংস করতে পারবে না, বরং মৃত্যুর পরও তা তার উপকারে বা কল্যাণে আসবে। যারা কার্যতঃ নিজেদেরকে খোদার হাতে সঁপে দেয়, আল্লাহ্ স্বয়ং তাদের অভিভাবক হয়ে যান ও তাদেরকে বিজয় ও সাফল্য দান করেন। তবে এই ব্যবসার জন্য কিছু শর্তও রয়েছে; প্রথমটি হল, মানুষ যেন সর্বদা নিজের পাপসমূহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে; দ্বিতীয়তঃ খোদা তা’লার ইবাদতের প্রতি মনোযোগী হয়; তৃতীয়তঃ খোদা তা’লার গুণকীর্তন ও কৃতজ্ঞতা-জ্ঞাপন করে; চতুর্থতঃ সৎকর্মের নির্দেশ প্রদান করে আর পঞ্চম, খোদা তা’লার নির্ধারিত সীমাসমূহ রক্ষা করে। এসব বিষয় নিষ্ঠার সাথে পালন করলে একজন মু’মিন সার্থক ও সাফল্যমণ্ডিত হয়, এমনকি খোদা তা’লার পক্ষ থেকে
সুসংবাদও লাভ করে”।

খিলাফতের আসনে সমাসীন হবার দ্বিতীয় বছরে অর্থাৎ ১৯১৬ সালের জলসায় তিনি (রা.) ‘যিকরে এলাহী’ বিষয়ে বক্তৃতা করেন, যার মাঝে তিনি (রা.) অত্যন্ত অতুলনীয় ও হৃদয়গ্রাহীভাবে যিকরে এলাহীর সংজ্ঞা, এর আবশ্যকতা, প্রকারভেদ ও উপকারিতা সম্পর্কে আলোকপাত করেন। তিনি (রা.) স্পষ্ট করেন যে, “যিক্‌র মূলত চার প্রকার; প্রথম যিক্‌র হল নামায, দ্বিতীয় কুরআন শরীফ পাঠ, তৃতীয় আল্লাহ্ তা’লার গুণাবলী বর্ণনা করা, চতুর্থ একাকী-নিভৃতেও খোদা তা’লার গুণাবলী স্মরণ করা ও এগুলোতে অভিনিবেশ করা, আর মানুষের মাঝেও সেগুলো বর্ণনা করা। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি (রা.) যিক্‌রে এলাহী কবুল হওয়ার পদ্ধতি, বিশেষ যিক্‌রে এলাহী তথা নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামায পড়ার আবশ্যকতা ও এর উপায়, কুরআন ও হাদীসের আলোকে নামাযে মনোযোগ নিবদ্ধ রাখার বাইশটি পদ্ধতি বর্ণনা করেন; আর সবশেষে যিক্‌রে এলাহীর বারটি মহান উপকারিতাও বর্ণনা করেন। এই বক্তৃতা চলাকালেই একটি মজার ঘটনা ঘটে; জলসায় উপস্থিত একজন শ্রোতা ছিলেন এক অ-আহমদী সূফী সাহেব; যিনি বক্তৃতার মাঝেই হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.)-কে চিরকুট পাঠান যে, “এ আপনি কী সর্বনাশ করছেন! এরকম একটা রহস্য সূফীগণ কমপক্ষে দশবছর সেবা গ্রহণের পর একজন মুরীদকে জানায়, আর আপনি কি-না একবারেই সব রহস্যের পর্দা উন্মোচন করে দিলেন!” ৯ই অক্টোবর ১৯১৭ তারিখে পাটিয়ালায় তিনি ‘আল্লাহ্ তা’লার রবুবিয়্যত মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে’- এ বিষয়ে বক্তব্য রাখেন; এতে আল্লাহ্ তা’লার
অস্তিত্ব, ইসলাম ও পবিত্র কুরআনের সত্যতা এবং হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর সত্যতা আল্লাহ্ তা’লার ‘রবুবিয়্যত’ গুণের আলোকে প্রমাণ করেন। ১৯১৯ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি লাহোরের ইসলামিয়া কলেজে অনুষ্ঠিত মডার্ন হিস্টরিকাল সোসাইটির এক সভায় তিনি ইসলাম ধর্মে বিভেদের সূচনা বিষয়ে এক ঐতিহাসিক বক্তব্য রাখেন, যা পরে ‘ইসলাম মেঁ এখতেলাফাত কা আগায’ নামে পুস্তকাকারে
প্রকাশিত হয়। বক্তৃতায় তিনি (রা.) প্রমাণ করেন, এই বিভেদের জন্য কখনোই সাহাবীরা দায়ী ছিলেন না, বরং তা পরবর্তীকালের মুসলমানদের সঠিক প্রশিক্ষণের অভাব এবং কুচক্রী, ষড়যন্ত্রী আব্দুল্লাহ্ বিন সাবা’র চক্রান্তের ফলে সৃষ্টি হয়েছিল। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল কাদের সাহেব, যিনি অ-আহমদী ছিলেন, তিনি মন্তব্য করেন, “হযরত মির্যা সাহেব যেভাবে এই বিষয়ের মূল পর্যন্ত গিয়েছেন এবং বিশৃঙ্খলার প্রকৃত কারণ অনুধাবন করেছেন, মুসলমান-অমুসলমান মিলিয়ে খুব অল্প ইতিহাসবিদই এমনটি করতে পেরেছেন”। ১৯১৯ সালের জলসায় হুযূর (রা.) ‘তকদীরে এলাহী’ বিষয়ে বক্তব্য রাখেন, যা অত্যন্ত জটিল ও সূক্ষ্ম একটি বিষয়। এতে তিনি অত্যন্ত সূক্ষ্ম সব বিষয়াদির অবতারণা করেন এবং কুরআন-হাদীসের ভিত্তিতে প্রামাণিক ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। হুযূর (আই.) যাদের মনে তকদীরে এলাহী বা ঐশী-নিয়তি বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে, তাদের এই বইটি পড়ার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক পরাজিত হয় এবং খিলাফত অবলুপ্ত করা হয়, যার ফলে ভারতে খিলাফত আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল।
২রা জুন, ১৯২০ সালে এলাহাবাদে খিলাফত কমিটির একটি সম্মেলন হয় এবং সেখানে হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.)-কেও পরামর্শ প্রদানের জন্য আহ্বান জানানো হলে তিনি কালক্ষেপণ না করে ত্বরিৎ ‘তুরস্ক চুক্তি ও মুসলমানদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা’ শীর্ষক প্রবন্ধ রচনা করে তা ছাপিয়ে পাঠান। এতে তিনি (রা.) মুসলমানদের হারানো সম্মান পুনরুদ্ধার ও তাদের ঐক্যবদ্ধ করার দূরদর্শী পরিকল্পনা তুলে ধরেন; বর্তমান ওআইসির স্বপ্নদ্রষ্টা যে হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.)-ই ছিলেন, তা-ও এত্থেকে সুস্পষ্ট, বরং তিনি আরও শক্তিশালী সংগঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ১৯২০ সালের জলসায় তিনি (রা.) ‘মালাইকাতুল্লাহ্’ বা ‘ফিরিশ্তার অস্তিত্ব’-এর মত অত্যন্ত সূক্ষ্ম একটি বিষয়ে নিতান্ত প্রাঞ্জল বক্তব্য উপস্থাপন করেন। বক্তৃতার শেষদিকে তিনি (রা.) ফিরিশ্তাদের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টির আটটি উপায়ও বর্ণনা; এগুলো হল- নবীগণ, যাদের ওপর জীব্রাঈল (আ.) অবতীর্ণ হন, তাঁদের সাহচর্য অবলম্বন; মহানবী (সা.)-এর প্রতি দরূদ পাঠ, হৃদয়ে অপরকে ক্ষমা করার চেতনা সৃষ্টি, আল্লাহ্ তা’লার গুণকীর্তন, গভীর মনোযোগের সাথে কুরআন পাঠ, এমন ব্যক্তির বই পড়া যার প্রতি ফিরিশ্তা অবতীর্ণ হয়, সেসব পবিত্র স্থানে পরিদর্শন যেখানে ফিরিশ্তাদের বিশেষ অবতরণ হয়েছে এবং যুগ-খলীফার সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন।

১৯২১ সালের মার্চে লাহোরে কয়েকজন কলেজ ছাত্রের পক্ষ থেকে উত্থাপিত তিনটি প্রশ্নের তিনি (রা.) খুব সাবলীল ও সহজবোধ্য ভাষায় উত্তর রচনা করেন, যা ‘ধর্মের আবশ্যকতা’ নামে পুস্তকাকারে
সংকলিত হয়। তাদের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে তিনি (রা.) আটটি অকাট্য যুক্তির ভিত্তিতে আল্লাহ্ তা’লার অস্তিত্ব প্রমাণ করেন; এছাড়া নবীদের ভবিষ্যদ্বাণীর মাহাত্ম্য এবং মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর জামাতের উন্নতি কীভাবে তাঁর সত্যতার প্রমাণ বহণ করে- সে বিষয়েও প্রাঞ্জল উত্তর প্রদান করেন।

১৯২১ সালে প্রিন্স অব ওয়েলসের ভারত আগমন উপলক্ষ্যে হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) তাঁর জন্য উপহারস্বরূপ একটি পুস্তক রচনা করেন এবং সেটি তাকে পৌঁছানো হয়, রাজপুত্র উপহার গ্রহণ করে কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন। এই পুস্তকে তিনি (রা.) মহানবী (সা.)-এর সুন্নত অনুসারে রাজপুত্রকে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহীভাবে ইসলামের তবলীগ করেন এবং ইসলাম গ্রহণ করার আহ্বান জানান। জানা যায়, রাজপুত্র এটি পড়েছিলেন এবং প্রবলভাবে আন্দোলিতও হয়েছিলেন। বিশ্ব রাজপুত্রকে ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড নামে চেনে, যিনি ১৯৩৬ সালে চার্চ অব ইংল্যান্ডের সাথে মতবিরোধের কারণে সিংহাসন পরিত্যাগ করেছিলেন।

১৯২৪ সালে ওয়েম্বলী সম্মেলন উপলক্ষ্যে তিনি (রা.) ‘আহমদীয়াত তথা প্রকৃত ইসলাম’ শীর্ষক প্রবন্ধ রচনা করেন, যা উক্ত সম্মেলনে তাঁর উপস্থিতিতে হযরত চৌধুরী মুহাম্মদ জাফরুল্লাহ্ খান সাহেব (রা.) পাঠ করেন। এতে তিনি এক অনন্য আঙ্গিকে ইসলামের সত্যতার প্রমাণ উপস্থাপন করেন এবং এসব শিক্ষামালার ওপর আমলকারীদের দৃষ্টান্তও দেন। আর তারা কীভাবে নিজেদের জীবনে বিপ্লব সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের ওপর হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর শিক্ষা কতটা প্রভাব ফেলেছে যে, তাদের মধ্য হতে কেউ কেউ নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন বটে কিন্তু মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর শিক্ষা পরিত্যাগ করা পছন্দ করেন নি। অবশেষে হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) সমগ্র বিশ্বে বসবাসকারীদের আহমদীয়াত গ্রহণের প্রতি আমন্ত্রণ জানিয়ে সুসংবাদ দিয়েছেন, বিপদাপদ দূর হওয়ার সময় এসে গেছে; তারা যদি এ যুগের মনোনীত (ব্যক্তির) হাতে সমবেত হয় তাহলে তারা ঐহিক ও পারত্রিক (জগতে) সাফল্য লাভ করবে।

এই বক্তৃতার অনন্যতা ও গভীরতার ভূয়সী প্রশংসা করে বিভিন্ন ধর্মের পণ্ডিতরা যেসব মন্তব্য করেছিলেন, তারও কিছু হুযূর (আই.) খুতবায় উদ্ধৃত করেন। যেমন, প্রবন্ধ পাঠ শেষ হওয়ার পর সভাপতি মহোদয় সংক্ষিপ্ত বাক্যে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, আমার বেশি কথা বলার প্রয়োজন নেই, প্রবন্ধের বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য সম্পর্কে স্বয়ং প্রবন্ধই ধারণা পাইয়ে দিয়েছে। আমি শুধুমাত্র আমার ও উপস্থিত সূধিবৃন্দের পক্ষ থেকে প্রবন্ধের বিন্যাসের বৈশিষ্ট্য, ধ্যাণ-ধারণার অনুপমত্ব আর ক্ষুরধার যুক্তি-প্রমাণের রীতির জন্য হযরত খলীফাতুল মসীহ্‌র প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

একজন জার্মান অধ্যাপক, সম্মেলন থেকে ফেরত যাবার সময় হযরত সাহেবকে মোবারকবাদ জানিয়ে বলেন, আমার পাশে কয়েকজন বিশিষ্ট ইংরেজ উপবিষ্ট ছিলেন আমি দেখেছি, কেউ কেউ উরু চাপড়াতে চাপড়াতে বলতেন, Rare ideas. One can not hear such ideas everyday! এটি খুবই দুর্লভ চিন্তা-ধারা, এরূপ চিন্তা-ধারার (কথা) প্রতিদিন শোনা যায় না। সেই জার্মান অধ্যাপক আরো বর্ণনা করেন, (প্রবন্ধ পাঠের সময়) অনেক ক্ষেত্রে লোকেরা অবলীলায় বলে উঠতো, What a beautiful and true principle! কতইনা মনোরম ও যথার্থ নীতি।

হুযূর (আই.) বলেন, হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.)’র ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সের মধ্যেকার ১৭ বছরের হাতে গোনা কয়েকটি রচনার সামান্য পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে। এই সময়কালের মধ্যে রচিত তার তফসীর ও খুতবাগুলো বাদ দিয়ে কেবল অন্যান্য বক্তৃতা ও রচনার যদি হিসেব করা হয়, তবুও আজকের খুতবায় তার এক শতাংশও বর্ণনা করা সম্ভব হয় নি। যে ব্যক্তির জাগতিক কোন শিক্ষা-দীক্ষা ছিল না, তাঁর দ্বারা এই যে জ্ঞানের এক মহা স্রোতস্বিনী আল্লাহ্ বইয়ে দিয়েছেন- তা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে আল্লাহ্ তা’লা ‘মুসলেহ্ মওউদ’-এর যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার প্রতিটি বর্ণই সত্য। মুসলেহ্ মওউদ (রা.)’র রচনাবলীর মাধ্যমে যে ধনভাণ্ডার আমরা পেয়েছি, তা-ও আমাদের অধ্যয়ন করা উচিত। হুযূর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.)’র পদমর্যাদা ক্রমশ উন্নতকরতে থাকুন। (আমীন)। খুতবার শেষাংশে হুযূর (আই.) পুনরায় পাকিস্তানের আহমদীদের সার্বিক পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য দোয়া করার বিষয়ে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেন।