শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৭-ডিসেম্বর, ২০১৯

মসজিদ মুবারক, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২৭শে ডিসেম্বর, ২০১৯ লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত সা’দ ঊবাদাহ্ (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, বিগত খুতবায় হযরত সা’দ বিন উবাদাহ্ (রা.)’র স্মৃতিচারণ করা হচ্ছিল, তার সম্পর্কে আজ আরও কিছু বর্ণনা করব। হযরত সা’দ বিন উবাদাহ্ (রা.) আকাবার দ্বিতীয় বয়আতের সময় নিযুক্তকৃত ১২জন নেতার একজন ছিলেন। তার পরিচয় দিতে গিয়ে হযরত মির্যা বশীর আহমদ সাহেব (রা.) ‘সীরাত খাতামান্নবীঈন’ পুস্তকে লিখেছেন, তিনি শীর্ষস্থানীয় আনসারদের একজন ছিলেন, মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর পর আনসারদের পক্ষ থেকে তার নাম খলীফা হিসেবেও প্রস্তাব করা হয়েছিল; তিনি হযরত উমর (রা.)-এর যুগে ইন্তেকাল করেন। হযরত সা’দ বিন উবাদাহ্ এবং হযরত মুনযের বিন আমর ও হযরত আবু দজানা (রা.) যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন তারা তিনজন মিলে বনু সায়েদার প্রতিমাগুলো ভেঙ্গেছিলেন। হিজরতের পর মহানবী (সা.) মদীনায় তার থাকার স্থান নির্বাচনের জন্য তার উটটিকে স্বাধীনভাবে চলতে দেন। উট যখন বনু সায়েদার এলাকা অতিক্রম করছিল তখন এই তিনজন সাহাবী রসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে একথা বলে তাদের বাড়িতে থাকার জন্য অনুরোধ করেন- হে আল্লাহ্‌র রসূল, আপনি আমাদের কাছে থাকুন; আমরা সম্মান, সম্পদ, প্রতিপত্তি ও শক্তির অধিকারী। রসূলুল্লাহ্ (সা.) তাকে বলেন, হে আবু সাবেত, এই উটকে ছেড়ে দাও, এটি আজ আদিষ্ট হয়েছে; এটি তার ইচ্ছেমতো কোনস্থানে যাবে। মহানবী (সা.) তার ও হযরত তুলায়েব বিন উমায়ের (রা.)’র মাঝে ভ্রাতৃত্ববন্ধন স্থাপন করেন, যিনি একজন মুহাজির সাহাবী ছিলেন। ইবনে ইসহাকের মতে তার ও হযরত আবু যর গিফ্‌ফারির মাঝে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল, যদিও এ বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে। কারণ ভ্রাতৃত্ব স্থাপনের ঘটনাটি বদরের যুদ্ধের পূর্বে সংঘটিত হয়েছিল এবং হযরত আবু যর তখন মদীনায় ছিলেন না। কথিত আছে, অওস ও খাযরাজ গোত্রে এমন কোন পরিবার ছিল না যাতে একটানা চার প্রজন্ম খুব দানশীল ছিল; একমাত্র ব্যতিক্রম হযরত সা’দের পরিবার। তার দাদা দুলায়ম, পিতা উবাদাহ্, তিনি নিজে ও তার পুত্র কায়েস- চারজনই অত্যন্ত দানশীল ছিলেন। মহানবী (সা.)-এর হিজরতের পর হযরত সা’দ বিন উবাদাহ্ প্রতিদিনই তাঁর (সা.) কাছে বড় বাটিতে করে বিভিন্ন উপাদেয় ও সুস্বাদু খাবার পাঠাতেন, অধিকাংশ সময়ই তা মাংসের কোন পদ হতো। সেই খাবার মহানবী (সা.)-এর সাথে পালাক্রমে তার পবিত্র সহধর্মিনীদের বাড়িতে যেত।

হুযূর (আই.) বলেন, ইতিহাস থেকে এটিও জানা যায় যে, মহানবী (সা.) এমন দিনও পার করতেন, যেদিন তার বাড়িতে কোন খাবারই থাকতো না। হুযূর এই উভয় বর্ণনার এভাবে সামঞ্জস্য বিধান করেন যে, সম্ভবতঃ সা’দ বিন উবাদাহ্ প্রতিদিন নয় বরং প্রায়শঃ খাবার পাঠাতেন, কিংবা রসূলুল্লাহ্ (সা.) হয়তো তার পাঠানো খাবার কখনো কখনো গরীব ও অতিথিদের জন্য দিয়ে দিতেন ও নিজে অভুক্ত থাকতেন। এ প্রসঙ্গে হযরত যায়েদ বিন সাবেতের একটি বর্ণনাও হুযূর উপস্থাপন করেন, উক্ত বর্ণনানুসারে হিজরতের পর প্রথমদিকে মহানবী (সা.) সাত মাস পর্যন্ত হযরত আবু আইয়ূব আনসারী (রা.)’র বাড়িতে অবস্থান করেন, তখন প্রতিদিনই তাঁর (সা.) কাছে সা’দ বিন উবাদাহ্’র পক্ষ থেকে খাবার আসতো; পরবর্তীতে হয়তো আর এতটা নিয়মিত আসতো না। হযরত উম্মে আইয়ূবকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, মহানবী (সা.)-এর প্রিয় খাবার কোনটি? উত্তরে তিনি বলেন, আমি কখনোই তাঁকে (সা.) কোন বিশেষ খাবার প্রস্তুত করার জন্য বলতে শুনি নি, আর কখনো এমনটিও দেখি নি যে, তাঁর (সা.) সামনে কোন খাবার উপস্থাপন করা হয়েছে এবং তিনি সেই খাবারের খুঁত ধরেছেন। অর্থাৎ খাবারের ব্যাপারে তিনি (সা.) খুবই অনাড়ম্বর ও সাদাসিধে ছিলেন। বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, তিনি মহানবী (সা.)-কে নিজের বাড়িতেও নিমন্ত্রণ করতেন এবং বাড়িতে নিয়ে খুব আপ্যায়নও করতেন।

একদিন মহানবী (সা.) সা’দের সাথে দেখা করতে তার বাড়িতে যান, গিয়ে বাইরে থেকে সালাম দেন, কিন্তু সা’দ নিচু শব্দে তাঁর সালামের জবাব দেন। সা’দের পুত্র কায়েস বিন সা’দ বলেন, আপনি রসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে ভেতরে আসতে বলবেন না? সা’দ তার পুত্রকে বলেন, আগে রসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে আমাদের প্রতি আরও বেশি সালাম করে নিতে দাও, যেন আমাদের বাড়ির ওপর আরও বেশি শান্তি বর্ষিত হয়। রসূলুল্লাহ্ (সা.) তিনবার সালাম দেন ও কোন জবাব শুনতে না পেয়ে ফেরার জন্য পা বাড়ান। তখন সা’দ ছুটে গিয়ে তাঁকে (সা.) ফিরিয়ে আনেন এবং পুরো ঘটনা খুলে বলেন। এরপর তিনি মহানবী (সা.)-এর জন্য গোসলের ব্যবস্থা করেন, তিনি (সা.) গোসল করার পর সা’দ তাঁকে নতুন একটি লেপ উপহার দেন যা তিনি ভালোভাবে নিজের শরীরে জড়িয়ে রাখেন। অতঃপর তিনি (সা.) হযরত সা’দ ও তার বংশধরদের প্রতি কল্যাণ ও আশিস বর্ষণের জন্য আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করেন। মহানবী (সা.)-এর পাশাপাশি অন্য সাহাবীদেরও, বিশেষভাবে সুফফা বাসীদেরও হযরত সা’দ আপ্যায়ন করতেন। বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, কোন কোন দিন তিনি আশিজন আসহাবে সুফফাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আপ্যায়ন করতেন।

মদীনায় হিজরতের এক বছর পর মহানবী (সা.) আবওয়া নামক স্থানে এক অভিযানে যাওয়ার সময় সা’দ বিন উবাদাহ্ (রা.)-কে মদীনার আমীর নিযুক্ত করে যান, এটি ইতিহাসে গাযওয়া আবওয়া নামে পরিচিত। প্রাসঙ্গিকভাবে হুযূর ইসলামী ইতিহাসের দু’টি পরিভাষা ‘গাযওয়া’ ও ‘সারিয়্যা’ সম্পর্কেও ব্যাখ্যা করেন। যেসব অভিযানে মহানবী (সা.) স্বয়ং যোগদান থাকতেন সেগুলোকে ঐতিহাসিকরা ‘গাযওয়া’ নামে অভিহিত করেছেন, আর যেগুলোতে তিনি (সা.) অন্য কাউকে নেতৃত্ব দিয়ে প্রেরণ করেন সেগুলো হল, ‘সারিয়্যা’। দ্বিতীয় হিজরির সফর মাসে অস্ত্রের জিহাদের নির্দেশাবলী অবতীর্ণ হয়, আর সেই মাসেই মহানবী (সা.) আবওয়ার অভিযানে গমন করেন। এই অভিযানে তিনি (সা.) বনু যামরার সাথে মৈত্রীচুক্তি করেন, যারা কুরাইশদের আত্মীয় একটি গোত্র ছিল। দ্বিপাক্ষিক এই চুক্তিতে উভয় পক্ষই পরস্পরের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার এবং প্রয়োজনে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একে অপরকে সাহায্য করার প্রতিজ্ঞা করে এবং লিখিত চুক্তি সম্পাদিত হয়।

হযরত সা’দ বিন উবাদাহ্ (রা.)’র বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণের ব্যাপারে দু’রকম অভিমত পাওয়া যায়। ইবনে ইসহাক প্রমুখের মতে তিনি বদরের যুদ্ধে যেতে পারেন নি, তবে ওয়াকদি প্রমুখের মতে তিনি বদরে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাবাকাতুল কুবরায় তার বদরে অংশ না নিতে পারার বিষয়ে লিখিত আছে, তিনি যখন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন একদিন তাকে কুকুর কামড়ায়; কিন্তু যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য তার ঐকান্তিক ইচ্ছার কারণে মহানবী (সা.) তাকে বদরের যোদ্ধাদের মধ্যে গণ্য করেন এবং তার জন্য যুদ্ধলদ্ধ সম্পদের অংশ নির্ধারণ করেন। তিনি উহুদ, খন্দকসহ পরবর্তী যুদ্ধগুলোতে রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সহযোদ্ধা হিসেবে যোগদানের সৌভাগ্য লাভ করেন। তবে একাধিক বর্ণনায় তার বদরের যুদ্ধে অংশ নেয়ার কথাও জানা যায়; মুস্তাদরেক এ বর্ণিত হয়েছে, বদরের যুদ্ধে আনসারদের পতাকা সা’দ বিন উবাদাহ্’র কাছেই ছিল। এছাড়া বদরের যুদ্ধের পূর্বে মহানবী (সা.) সাহাবীদের কাছ থেকে যখন পরামর্শ চান, তখন সা’দ বিন উবাদাহ্-ই আনসারদের পক্ষ থেকে বলেছিলেন, আপনি আমাদের যেখানে নিয়ে যেতে চান আমরা সেখানে যেতে প্রস্তুত, এমনকি আপনি বললে ঘোড়াসহ সমুদ্রে ঝাঁপ দিতেও প্রস্তুত। বদরের যুদ্ধের যাত্রা শুরুর প্রাক্কালে হযরত সা’দ মহানবী (সা.)-কে একটি তরবারি উপহার দেন, যা দিয়ে তিনি (সা.) যুদ্ধ করেছিলেন। এছাড়া বদরের যুদ্ধের দিন তিনি (সা.) যে গাধায় চড়েছিলেন সেটিও সা’দ বিন উবাদাহ্ (রা.)’র দেয়া উপহার ছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, সা’দ রসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে একটি দীর্ঘ বর্মও উপহার দিয়েছিলেন।

মহানবী (সা.) বদরের যুদ্ধের পূর্বে একদিন সা’দ বিন উবাদাহ্-কে দেখতে যান, যখন সা’দ অসুস্থ ছিলেন; পথিমধ্যে একদল লোকের সাথে তাঁর (সা.) দেখা হয় যেখানে আব্দুল্লাহ্ বিন উবাই বিন সলুল মদীনার কতেক মুসলমান, ইহুদী ও মুশরিকসহ বসে ছিল। মহানবী (সা.) তাদেরকে তবলীগ করেন, কিন্তু আব্দুল্লাহ্ বিন উবাই চরম অসৌজন্যমূলক ব্যবহার করে এবং তাঁকে (সা.) তাদের সভায় এসে তবলীগ করতে নিষেধ করে। কিন্তু সেখানে থাকা মুসলমানরা বলেন, হে আল্লাহ্‌র রসূল, আপনি অবশ্যই আমাদের সভায় আসবেন ও তবলীগ করবেন। এ নিয়ে সেখানে প্রায় লড়াইয়ের উপক্রম হয়, মহানবী (সা.) তাদের শান্ত করেন। পরে তিনি (সা.) সা’দ বিন উবাদাহ্ (রা.)-কে গিয়ে এ ঘটনা বলেন। সা’দ আব্দুল্লাহ্ বিন উবাই বিন সলুলকে ক্ষমা করে দিতে বলেন, কারণ মহানবী (সা.)-এর মদীনায় আগমন আব্দুল্লাহ্‌র জন্য মদীনার একচ্ছত্র নেতা হওয়ায় পথে প্রতিবন্ধক হওয়ায় সে তাঁর (সা.) প্রতি ঈর্ষান্বিত, তাই সে এমনটি করেছে। মহানবী (সা.) আব্দুল্লাহ্‌কে ক্ষমা করে দেন। তাদের এই বিদ্বেষের বিষয়ে আল্লাহ্ তা’লা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আয়াত অবতীর্ণ করেন। পরবর্তীতে বদরের যুদ্ধে কুরাইশদের শোচনীয় পরাজয় দেখে আব্দুল্লাহ্ বিন উবাই বিন সলুল ও তার সমমনা মুনাফিকরা ইসলাম গ্রহণ করে।

উহুদের যুদ্ধের দিন মুসলমানরা যখন আক্রান্ত হয়, তখন যে স্বল্পসংখ্যক সাহাবী মহানবী (সা.)-এর পাশে দৃঢ়-অবিচল ছিলেন, তাদের মধ্যে সা’দ বিন উবাদাহ্ও একজন। উহুদের পর হামরাউল আসাদের অভিযানেও তিনি যোগদান করেন, তখন সা’দ বিন উবাদাহ্ মুসলিম বাহিনীর খাবারের জন্য ত্রিশটি উট ও খেজুর প্রদান করেছিলেন। হযরত সা’দের মায়ের মৃত্যুর সময় মহানবী (সা.) মদীনায় অনুপস্থিত ছিলেন। প্রায় মাসখানেক পর মদীনায় ফিরে তিনি (সা.) তার মায়ের জানাযা পড়েন। হযরত সা’দ তার মায়ের মৃত্যুর সময় মায়ের নিকটে ছিলেন না, তাই তিনি মহানবী (সা.)-এর কাছে জানতে চান, তিনি তার মায়ের পক্ষ থেকে কোন সদকা করলে তা গৃহীত হবে কি-না? মহানবী (সা.) অনুমতি দিলে তিনি একটি বাগান সদকা করেন। তিনি বরাবরই অত্যন্ত দানশীল ছিলেন। তিনি তার মায়ের পক্ষ থেকে একটি কূপও খনন করিয়ে সবার জন্য পানির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। হুযূর বলেন, তার সম্পর্কে আরও কিছু বর্ণনা পরবর্তীতে করা হবে, ইনশাআল্লাহ্।