শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৩-সেপ্টেম্বর, ২০১৯

কিংসলে কান্ট্রি মার্কেট, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১৩ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ কিংসলের কান্ট্রি মার্কেটে আবস্থিত মজলিস আনসারুল্লাহ্, যুক্তরাজ্যের বার্ষিক ইজতেমা গাহ্ থেকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি “হযরত নু’মান বিন আমর (রা.), হযরত খুবায়ব বিন ইসাফ (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, আজ বদরী সাহাবীদের স্মৃতিচারণ করার পূর্বে আনসারুল্লাহ্‌র ইজতেমা প্রসঙ্গে একথা বলে দিতে চাই যে, সাহাবীরা, যাদের মধ্যে আনসারও ছিলেন আর মুহাজিরও ছিলেন, তারা ইসলাম গ্রহণের পর নিজেদের মাঝে পবিত্র পরিবর্তন সাধন করেছিলেন আর আত্মত্যাগ, তাক্বওয়া, বিশ্বস্ততা আর নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার উন্নত আদর্শও প্রদর্শন করেছিলেন। আপনারা এখানে যারা আনসারুল্লাহ্‌র বয়সের উপস্থিত আছেন- আপনারা একাধারে আনসারও এবং মুহাজিরও। তাই এই দৃষ্টিকোণ থেকে আত্মবিশ্লেষণ করতে থাকুন, আমাদের সামনে পূর্ববর্তীরা যে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে গিয়েছেন আমরা তা কতটুকু অনুসরণ করছি।

এই ভূমিকার পর হুযূর খুতবার মূল বিষয়ে ফিরে আসেন। আজ প্রথম যে সাহাবীর স্মৃতিচারণ করব তিনি হলেন, হযরত নু’মান বিন আমর (রা.), বিভিন্ন বর্ণনায় তার নাম নু’য়েমানও পাওয়া যায়। তার পিতার নাম ছিল আমর বিন রিফা ও মাতার নাম ফাতিমা বিনতে আমর। ইবনে ইসহাকের মতে তিনি আকাবার দ্বিতীয় বয়আতের সময় ৭০ জন আনসারের দলভুক্ত ছিলেন। তিনি বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর সহযোদ্ধা হিসেবে অংশ নেন। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, মহানবী (সা.) বলেন, নু’য়েমান সম্বন্ধে ভালো ছাড়া কিছু বলো না, কেননা সে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলকে ভালোবাসে। তিনি ৬০ হিজরিতে আমীর মুয়াবিয়ার যুগে মৃত্যুবরণ করেন। মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর বছরখানেক পূর্বে হযরত আবু বকর (রা.) সিরিয়ার বসরায় বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন, সে সময় তার সাথে নু’মান ও সুয়াইবাত বিন হারমালাও গিয়েছিলেন। তারা দু’জনই বদরী সাহাবী ছিলেন এবং উভয়েই খুবই রসিক মানুষ ছিলেন। এই সফরেই হযরত সুয়াইবাত হযরত নু’মানকে ঠাট্টাচ্ছলে অন্য জাতির একদল লোকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন, যা হুযূর ইতোপূর্বে হযরত সুয়াইবাতের স্মৃতিচারণের সময় উল্লেখ করেছিলেন। পরবর্তীতে হযরত আবু বকর ফেরত এসে নু’মানকে মুক্ত করেছিলেন। মহানবী (সা.) ও সাহাবীরা যখন এই ঘটনা শুনেন তখন খুব হাসাহাসি করেন। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, সাহাবীরা রসকষহীন ও কাঠখোট্টা স্বভাবের ছিলেন না, বরং তাদের মধ্যেও অদ্ভুত অদ্ভুত রসিকতার ঘটনা ঘটতো। হযরত নু’মানের বিভিন্ন রসিকতায় মহানবী (সা.) ও সাহাবীরা বিনোদন লাভ করতেন এবং হাসতেন। হযরত নু’মান সম্বন্ধে জানা যায়, মদীনায় যখনই কোন ফেরিওয়ালা আসত, তিনি অবশ্যই তার কাছ থেকে কিছু না কিছু মহানবী (সা.)-এর জন্য ক্রয় করতেন এবং তাঁকে (সা.) দিয়ে বলতেন, হে আল্লাহ্‌র রসূল! ‘এটা আমার পক্ষ থেকে আপনার জন্য উপহার।’ কিন্তু যখন সেই ফেরিওয়ালা জিনিসের দাম নিতে আসত, তখন নু’মান (রা.) তাকে মহানবী (সা.)-এর কাছে নিয়ে গিয়ে বলতেন, ‘একে এর জিনিসের দাম দিয়ে দিন’। মহানবী (সা.) প্রশ্ন করতেন, ‘তুমি না আমাকে এটা উপহার দিয়েছ?’ নু’মান (রা.) জবাব দিতেন, ‘হে আল্লাহ্‌র রসূল! আল্লাহ্‌র কসম, আমার কাছে এই জিনিষের মূল্য দেওয়ার মত টাকা নেই। কিন্তু আমি চাই এটা (খাবার জিনিস হলে) আপনি খান বা এটা (রাখার মত জিনিস হলে) আপনি রাখুন।’ তখন মহানবী হাসতেন এবং মূল্য পরিশোধ করার নির্দেশ দিতেন। মহানবী (সা.)-এর প্রতি সাহাবীদের এরূপ ঐকান্তিক ভালোবাসা ছিল।

দ্বিতীয় সাহাবী হলেন, হযরত খুবায়ব বিন ইসাফ (রা.), তিনি আনসারদের খাযরাজ গোত্রের বনু জুশাম শাখার লোক ছিলেন। তার পিতার নাম ছিল ইসাফ আর মায়ের নাম সালামা বিনতে মাসউদ। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর ইন্তেকালের পর হযরত খুবায়ব তার বিধবা স্ত্রী হুবায়বা বিনতে খারজাকে বিয়ে করেছিলেন। মহানবী (সা.)-এর হিজরতের সময় যদিও খুবায়ব মুসলমান ছিলেন না, তবুও মুহাজিরদের আতিথেয়তা বা আপ্যায়ন করার সৌভাগ্য লাভ করেন; হযরত তালহা বিন আব্দুল্লাহ্ ও সুহায়ব বিন সিনান তার বাড়িতে থেকেছিলেন বলে বর্ণিত আছে। হযরত খুবায়ব বদর ছাড়াও উহুদ, খন্দক ও অন্যান্য যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর সাথে অংশ নেন। মদীনায় ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলেও তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন নি, বরং বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণের সময় তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। সহীহ্ মুসলিমে হযরত আয়েশা (রা.)-এর বরাতে তার ইসলাম গ্রহণের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। মহানবী (সা.) বদরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলে পথিমধ্যে খুবায়ব এসে যুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুমতি চান। মহানবী (সা.) তাকে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান এনেছেন কি-না? তিনি (রা.) ‘না’ সূচক উত্তর দিলে মহানবী (সা.) তাকে ফিরিয়ে দেন। মুসলিম বাহিনী কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর খুবায়ব আবারও আসেন, সেবারও মহানবী (সা.) তাকে ফিরিয়ে দেন। তৃতীয়বার এসে খুবায়ব পুনরায় যুদ্ধে যাবার অনুমতি চান এবং ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন, ফলে মহানবী (সা.) তাকে অনুমতি দান করেন। খুবায়ব (রা.) নিজেও তার ইসলাম গ্রহণের ঘটনা বর্ণনা করেছেন যা মুসনাদ আহমদ বিন হাম্বলে বর্ণিত হয়েছে। খুবায়ব (রা.) বলেন, “আমি ও আমার জাতির আরেক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর সমীপে এমন সময় উপস্থিত হই যখন তিনি (সা.) যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমরা তখনও ইসলাম গ্রহণ করি নি; আমরা নিবেদন করলাম, আমাদের জন্য এটি খুবই লজ্জার বিষয় যে, আমাদের জাতি যুদ্ধে যাচ্ছে অথচ আমরা যাচ্ছি না। মহানবী (সা.) আমাদের বলেন, ‘তোমরা দু’জন কি ইসলাম গ্রহণ করেছ?’ আমরা বললাম, না। তখন মহানবী (সা.) বলেন, ‘আমরা মুশরিকদের বিরুদ্ধে মুশরিকদের সাহায্য চাই না।’ তখন আমরা ইসলাম গ্রহণ করি এবং তাঁর (সা.) সাথে যুদ্ধে অংশ নিই। এই যুদ্ধে আমি একজনকে হত্যা করি এবং সে-ও আমাকে আহত করে।” বদরের যুদ্ধে তিনি কুরায়শ নেতা উমাইয়া বিন খাল্ফকে হত্যা করেছিলেন। প্রাসঙ্গিকভাবে হুযূর উমাইয়া বিন খাল্‌ফের নিহত হওয়ার ঘটনাটিও এখানে স্ববিস্তারে তুলে ধরেন। হযরত খুবায়বের মৃত্যুর ব্যাপারে একাধিক মত রয়েছে। কারো কারো মতে তিনি হযরত উমর (রা.)’র খিলাফতকালে ইন্তেকাল করেন, আবার কারো মতে তিনি হযরত উসমান (রা.)’র খিলাফতকালে মৃত্যুবরণ করেন।

হুযূর দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা এই সাহাবীদ্বয়ের মর্যাদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করতে থাকুন।

খুতবার শেষদিকে হুযূর (আই.) তিনটি গায়েবানা জানাযা পড়ানোর ঘোষণা দেন এবং মরহুমদের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন। প্রথম জানাযা রাবওয়ার শ্রদ্ধেয়া রশিদা বেগম সাহেবার, যিনি মোকাররম সৈয়দ মুহাম্মদ সারোয়ার সাহেবের স্ত্রী ছিলেন; গত ২৪শে আগস্ট ৭৪ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার পরিবারের আদিনিবাস হল কাশ্মির। মরহুমার পরিবারে আহমদীয়াতের সূচনা তার পিতামহ মোকাররম ফতেহ মুহাম্মদ সাহেবের মাধ্যমে হয়। মরহুমার পাঁচ পুত্র জামাতের জীবন-উৎসর্গকারী; মুহাম্মদ মুহসিন তাবাসসুম সাহেব ও মুহাম্মদ মুমিন সাহেব মুয়াল্লিম, দাউদ জাফর সাহেব ও যাকারিয়া সাহেব মুরব্বী এবং আরেক ছেলে আসিফ সাহেব খিলাফত লাইব্রেরির কম্পিউটার বিভাগে কর্মরত আছেন। মুহাম্মদ যাকারিয়া সাহেব লাইবেরিয়ায় কর্মরত রয়েছেন, তিনি মায়ের জানাযায় যোগ দিতে পারেন নি।

দ্বিতীয় জানাযা ফিজির শ্রদ্ধেয় মোহাম্মদ শমশীর খান সাহেবের, যিনি ফিজির নানদি জামাতের প্রেসিডেন্ট ছিলেন; গত ৫ই সেপ্টেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার জন্ম ১৯৫২ সালে, ১৯৬২ সালে তিনি তার পিতার সাথে লাহোরী জামাত ত্যাগ করে বয়আত করে খিলাফতের ছায়াতলে আসেন। তিনি নিষ্ঠার সাথে জামাতের অনেক সেবা করেছেন।

তৃতীয় জানাযা শ্রদ্ধেয়া ফাতেমা মুহাম্মদ মুস্তফা সাহেবার, যিনি গত ১৩ই জুন ৮৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তিনি ইরাকের কুর্দিস্তানের বাসিন্দা ছিলেন, বর্তমানে মেয়ের সাথে নরওয়েতে বসবাস করছিলেন। তার ৩ মেয়ে ও ৫ ছেলের মধ্যে এক মেয়ে আহমদী, যিনি নরওয়েতে থাকেন, মেয়ের তবলীগেই ২০১৪ সালে অনেক দোয়া ও চিন্তা-ভাবনার পর তিনি বয়আত করেন। তার বাকি সন্তানরা আহমদীয়াতের অনেক বিরোধিতা করছেন। মরহুমা অনেক গুণের অধিকারীণি ছিলেন।

হুযূর সকল মরহুমের জন্য মাগফিরাত কামনা করেন আর তাদের পদমর্যাদা উন্নীত হওয়ার জন্য দোয়া করেন এবং তাদের সন্তানদেরও তাদের আদর্শের ওপর পরিচালিত হওয়ার এবং সন্তানদের অনুকূলে কৃত তাদের সকল দোয়া কবুল হওয়ার জন্য দোয়া করেন, আমীন।