শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১২-এপ্রিল, ২০১৯

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১২ই এপ্রিল, ২০১৯ লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত হুসায়ন বিন হারেস (রা.), হযরত সাফওয়ান (রা.), হযরত মুবাশ্বের বিন আবদুল মুনযের (রা.), হযরত ওয়ারকা বিন আইয়াস (রা.), হযরত মুহরেয বিন নাযলা (রা.), হযরত সুয়ায়বাত বিন সা’দ (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর (আই.) বলেন, আজ আমি যেসব বদরী সাহাবীর স্মৃতিচারণ করব তাদের মধ্যে প্রথমে রয়েছেন হযরত হুসায়ন বিন হারেস (রা.)। তার মায়ের নাম ছিল সুখাইলা বিনতে খাযাঈ। তিনি বনু মুত্তালিব বিন আবদে মানাফের সদস্য ছিলেন; তিনি তার দু’ভাই হযরত তোফায়েল ও উবাইদার সাথে মদীনায় হিজরত করেন, তাদের সাথে হযরত মিসতাহ্ ও আব্বাদ বিন মুত্তালিবও ছিলেন। মহানবী (সা.) আব্দুল্লাহ্ বিন জুবায়েরকে তার ধর্মভাই বানিয়েছিলেন। তিনি বদর, উহুদসহ সকল যুদ্ধেই মহানবী (সা.)-এর সহযোদ্ধা ছিলেন; তার দু’ভাইও বদরী সাহাবী ছিলেন। ৩২ হিজরিতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

পরবর্তী সাহাবী হলেন, হযরত সাফওয়ান (রা.)। তার পিতার নাম ছিল ওয়াহাব বিন রবীআ। তিনি বনু হারেস বিন ফাহর গোত্রের সদস্য ছিলেন। তার দু’ভাইয়ের নাম হযরত সাহল ও সুহায়েল, তবে তারা সেই দুই সহোদর নন যাদের কাছ থেকে মহানবী (সা.) মসজিদে নববীর জমি ক্রয় করেছিলেন। মহানবী (সা.) রাফে বিন মুআল্লাকে তার ধর্মভাই বানান; অন্য এক বর্ণনায় রাফে বিন আজলানের নাম এসেছে। তার মৃত্যুর ব্যাপারেও একাধিক মত রয়েছে। কারও মতে তিনি বদরের যুদ্ধে শহীদ হন এবং তোয়াইমা বিন আদী তাকে শহীদ করে; তবে অপর কতক বর্ণনামতে তিনি বদর, উহুদসহ সকল যুদ্ধেই অংশ নেন এবং ১৮ হিজরি বা ৩০ হিজরি অথবা মতান্তরে ৩৮ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।

এরপর হুযূর স্মৃতিচারণ করেন হযরত মুবাশ্বের বিন আবদুল মুনযের (রা.)-এর, তার পিতা ছিলেন, আব্দুল মুনযের ও মাতা নাসিবা বিনতে যায়েদ। তিনি অওস গোত্রের লোক ছিলেন। আকিল বিন আবু বুকায়র তার ধর্মভাই ছিলেন। তিনি বদরের যুদ্ধে অংশ নিয়ে শাহাদাতবরণ করেন, তার দু’ভাই হযরত আবু লুবাবা ও রিফাআও বদরের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন আমর বর্ণনা করেন, ‘উহুদের যুদ্ধের আগে আমি স্বপ্নে দেখি যে, মুবাশ্বের বিন আব্দুল মুনযের আমাকে বলছেন, তুমি কয়েকদিন পরেই আমাদের কাছে চলে আসবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কোথায় আছেন? তিনি বলেন, আমি জান্নাতে আছি, এখানে আমরা যেখানে খুশি যাই, পানাহার করি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি না বদরের যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন? তিনি বলেন, হ্যাঁ, অবশ্যই; কিন্তু আমাকে আবারও জীবিত করে দেয়া হয়েছে।’

পরবর্তী সাহাবী হযরত ওয়ারকা বিন আইয়াস (রা.)। তার পিতার নাম হল, আইয়াস বিন আমর। তিনি আনসারদের খাযরাজ গোত্রের লোক ছিলেন। তিনি তার দুই ভাই হযরত রবী ও আমর-এর সাথে বদরের যুদ্ধে অংশ নেন। তিনি অন্যান্য যুদ্ধেও মহানবী (সা.)-এর সাথে অংশগ্রহণ করেন। ইয়ামামার যুদ্ধে একাদশ হিজরিতে তিনি শহীদ হন।

পরবর্তী সাহাবী হযরত মুহরেয বিন নাযলা (রা.)। তার পিতার নাম নাযলা বিন আব্দুল্লাহ্। তিনি খুব ফর্সা ও সুদর্শন ছিলেন। তিনি আখরাম নামেও সুপরিচিত ছিলেন। তিনি মক্কার বনু গানাম বিন দুদান গোত্রের লোক ছিলেন; এই গোত্রটি মুসলমান হয়ে গিয়েছিল। এই গোত্রের নারী-পুরুষরা প্রায় সবাই মদীনায় হিজরত করেন, যাদের মধ্যে হযরত মুহরেযও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি বদর, উহুদ ও খন্দকের যুদ্ধে অংশ নেন। হযরত মুহরেয একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন, যা শুনে হযরত আবু বকর (রা.) তাকে শাহাদতের সুসংবাদ শুনিয়েছিলেন। অতঃপর ৬ষ্ঠ হিজরিতে সংঘটিত গাবার যুদ্ধ বা যি কারাদের যুদ্ধে তিনি শাহাদতবরণ করেন। হুদাইবিয়ার সন্ধির পর মুসলমানরা মদীনায় ফেরত যাচ্ছিল, পথিমধ্যে একস্থানে যাত্রাবিরতি নেয়া হয়। সেই স্থান ও বনু লহইয়ানের এলাকা পাশাপাশি ছিল, মাঝখানে ছিল একটি পাহাড়। মহানবী (সা.) নিজের উটগুলো রাবাহ নামক এক দাসের সাথে মদীনা অভিমুখে পাঠিয়ে দেন, হযরত সালামা বিন আকওয়া (রা.)-ও হযরত তালহার ঘোড়ায় চড়ে তার সাথে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে আব্দুর রহমান নামক এক মুশরিক তার কিছু সঙ্গীসহ মহানবী (সা.)-এর উষ্ট্রপালের ওপর আক্রমন করে ও উটের রাখালকে হত্যা করে সবগুলো উট ছিনিয়ে নিয়ে যায়। হযরত সালামা রাবাহকে হযরত তালহার ঘোড়া দিয়ে মহানবী (সা.)-এর কাছে দ্রুত পাঠিয়ে দেন এবং সবকিছু তাঁকে (সা.) অবহিত করতে বলেন। আর নিজে একাই মুশরিকদেরকে উচ্চস্বরে যুদ্ধের আহ্বান জানিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করেন এবং কখনো তীর দিয়ে, কখনো পাথর দিয়ে তাদের আক্রমণ করে আহত করতে থাকেন। হযরত সালামা একা হওয়া সত্ত্বেও মুশরিকরা তার সাথে পেরে ওঠেনি, কারণ তার রণকৌশল ছিল অত্যন্ত সুনিপুণ। পরবর্তীতে মহানবী (সা.)-এর কতিপয় সাহাবী ঘোড়ায় চেপে সেখানে এসে পৌঁছেন, যাদের মধ্যে হযরত মুহরেয বিন নাযলাও ছিলেন। তারা শত্রুদের সাথে লড়াইয়ে জন্য অগ্রসর হলে হযরত সালামা হযরত মুহরেযের ঘোড়ার লাগাম ধরে ঘুরিয়ে দেন ও তাকে বাধা দিয়ে মহানবী (সা.) ও বাকি সাহাবীদের আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেন। কিন্তু হযরত মুহরেয তাকে বলেন, ‘হে সালামা, যদি তুমি আল্লাহ্ ও আখিরাত এবং জান্নাত-জাহান্নামকে সত্য বলে বিশ্বাস কর, তবে আমার ও শাহাদাতের মধ্যে আড়াল হয়ে দাঁড়িও না।’ তখন সালামা তাকে ছেড়ে দেন, আর তিনি আব্দুর রহমানের ওপর আক্রমণ করে তাকে ও তার ঘোড়াকে আহত করেন। কিন্তু সেই মুশরিক আব্দুর রহমান বর্শা দিয়ে আঘাত করে তাকে শহীদ করে দেয়, আর তার ঘোড়া নিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু হযরত আবু কাতাদা তার পিছু ধাওয়া করে তাকে হত্যা করেন। হযরত সালামা সেদিন আরও বীরত্ব প্রদর্শন করেন এবং একাই গিয়ে মুশরিকদের কয়েকজনকে হত্যা করে মহানবী (সা.) সবগুলো উট ফিরিয়ে আনেন, এমনকি মুশরিকদেরও কয়েকটি উট ও ঘোড়া দখল করেন। পরে তিনি মহানবী (সা.)-এর কাছে ফিরে এসে তার সাথে একদল সাহাবীকে পাঠাতে বলেন যেন লুটেরা মুশরিকদের পিছু ধাওয়া করে তাদের সবাইকে হত্যা করেন। কিন্তু মহানবী (সা.) তাকে নিরস্ত করেন ও বলেন, হে ইবনে আকওয়া! তুমি তো জয়ী হয়েছ, এখন তাদের ছেড়ে দাও। অর্থাৎ তারা যা ছিনিয়ে নিয়েছিল তা তো ফেরত পেয়ে গেছ, যথেষ্ট শাস্তিও তাদের হয়েছে; এবার আর তাদের তাড়া করার কোন দরকার নেই।

এরপর হুযূর স্মৃতিচারণ করেন হযরত সুয়ায়বাত বিন সা’দ (রা.)-এর। তাকে সুয়ায়বাত বিন হারমালাও ডাকা হতো। তিনি বনু আবদে দার গোত্রের লোক ছিলেন। অধিকাংশ ইতিহাসবিদ তাকে ইথিওপিয়ায় হিজরতকারীদের মধ্যে গণ্য করেছেন। পরবর্তীতে তিনি মদীনায় হিজরত করেন। মহানবী (সা.) তার ও হযরত আয়েস বিন মায়েস-এর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

সাহাবীদের স্মৃতিচারণের পর হুযূর (আই.) হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর প্রতি হওয়া একটি ইলহাম ‘ওয়াসসে মাকানাকা’ অর্থাৎ ‘তোমার গৃহকে প্রশস্ত কর’ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলেন। এই ইলহামটি সেই সময় তাঁর প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল যখন মাত্র দু’তিনজন লোক তাঁর কাছে আসতো, পরবর্তীতে যখন জামাত প্রতিষ্ঠিত হয় তখনও একাধিক বার এই ইলহাম হয়েছে, যার সাথে সাথে আল্লাহ্ তা’লার ফযল ও কৃপারাজি বর্ষিত হবার ইলহামও হয়েছে। এই ইলহামটি নির্দেশ করে যে, আল্লাহ্ তা’লা স্বয়ং হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর গৃহকে প্রশস্ত করার উপকরণ সৃষ্টি করবেন এবং তাঁর পর তাঁর খলীফাগণ আর জামাতও এই দৃশ্যাবলী দেখতে থাকবেন। আল্লাহ্ তা’লার কৃপায় জামাত এমনটিই ঘটতে দেখেছে এবং দেখছে। হযরত খলীফাতুল মসীহ্ রাবে (রাহে.)-এর যুক্তরাজ্যে হিজরতের পর যেমন সারা বিশ্বে আহমদীয়াত বিস্তৃত হয়েছে, তেমনই বিশ্বজুড়ে জামাতের স্থাপনাও ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে। ব্রিটেনে খলীফা রাবের হিজরতের পরপরই আল্লাহ্ তা’লা জামাতকে ইসলামাবাদে ২৫ একর জমি ক্রয় করার সৌভাগ্য দান করেন, পরবর্তীতে তাতে আরও ৬ একর যুক্ত হয়। এছাড়া ফার্নহামের দ্বিতল বিল্ডিং, খোদ্দামুল আহমদীয়ার বিল্ডিং, অল্টনের ২শ একরের বেশি জলসা গাহ্ এবং ৩০ একরের জামেয়া কমপ্লেক্স এগুলো সবই ইসলামাবাদ থেকে মাত্র দশ-বিশ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত। ইসলামাদে খলীফার জন্য বাসভবন, নতুন একটি মসজিদ, কয়েকটি অফিস এবং জামাতের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য বিভিন্ন কোয়ার্টার নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে।

হুযূর বলেন, পরিকল্পনা অনুসারে আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই আমি লন্ডন থেকে ইসলামাবাদে স্থানান্তরিত হবো। জুমুআর নামায আমি সাধারণত এখানে অর্থাৎ বাইতুল ফুতুহ্‌তে এসেই পড়াবো। ইসলামাবাদের আশেপাশে বসবাসকারী জামাতের সদস্যরা সেখানে গিয়ে নামায পড়তে পারবেন। এ ক্ষেত্রে জামাতের করণীয় সম্পর্কে আমীর সাহেব আপনাদেরকে অচিরেই অবহিত করবেন। মসজিদ ফযলের পাশ্ববর্তী প্রতিবেশিরা বিভিন্ন সময় আমাদের লোকদের ব্যাপারে অভিযোগ করতো, ইসলামাদের আশেপাশের লোকেরা যেন কোন অভিযোগ-অনুযোগের সুযোগ না পায় সেদিকে আপনারা খেয়াল রাখবেন।

হুযূর জামাতের সবাইকে দোয়া করতে বলেন যেন আল্লাহ্ তা’লা ইসলামাবাদে তার স্থানান্তর এবং অবস্থানকে সবদিক থেকে কল্যাণমন্ডিত করেন ও কৃপারাজি বর্ষণ করতে থাকেন; আল্লাহ্ তা’লা যেন ইসলামাবাদ থেকে ইসলামের প্রচার কাজকে পূর্বের চেয়ে অধিক বিস্তৃতি দান করেন, আর আল্লাহ্ তা’লার ইলহাম ‘তোমার গৃহকে প্রশস্ত কর’ যেন কেবল জামাতের স্থাপনার বিস্তৃতিরই কারণ না হয় বরং আল্লাহ্ তা’লার মহা-পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রশস্ততারও কারণ হয়। (আল্লাহুম্মা আমীন)