শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০১-ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ইং লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত আবু হুযায়ফা বিন উতবা (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর বলেন, আজ যে বদরী সাহাবীর স্মৃতিচারণ করছি তার নাম হল, হযরত আবু হুযায়ফা বিন উতবা (রা.)। আবু হুযায়ফা ছিল তার ডাক নাম। তিনি লম্বা-চওড়া ও সুদর্শন ছিলেন। দ্বারে আরকাম যুগের পূর্বেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি বনী উমাইয়া গোত্রের সদস্য ছিলেন। তার পিতা উতবা বিন রবীআ কুরাইশের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা এবং ইসলামের চরম বিদ্বেষী একজন শত্রু ছিল। হযরত আবু হুযায়ফা হযরত আবু বকর (রা.)-এর খিলাফতকালে মুসায়লামা কাযযাবের বিরুদ্ধে ইয়ামামার যুদ্ধে শহীদ হন। তিনি আবিসিনিয়ার উভয় হিজরতেই অংশ নিয়েছিলেন, তার স্ত্রী হযরত সাহলা বিনতে সুহায়লও তার সাথে হিজরত করেন।

এরপর হুযূর সংক্ষেপে আবিসিনিয়া বা ইথিওপিয়ায় হিজরতের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন। মহানবী (সা.)-এর নির্দেশনা অনুসারে মক্কার কুরাইশদের অত্যাচার-নিপীড়নের মুখে নবুওয়তের ৫ম বছর রজব মাসে ১১জন পুরুষ ও ৪জন নারী আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন; এদের মধ্যে হযরত উসমান বিন আফফান ও তার স্ত্রী মহানবী (সা.)-এর কন্যা হযরত রুকাইয়া (রা.), আব্দুর রহমান বিন আওফ, যুবায়ের ইবনুল আওয়াম, আবু হুযায়ফা, উসমান বিন মাযউন, মুসআব বিন উমায়ের, আবু সালামা বিন আব্দুল আসাদ ও তার স্ত্রী উম্মে সালামা। এদের অধিকাংশই কুরাইশের প্রভাবশালী গোত্রের লোক ছিলেন। এত্থেকে দু’টি বিষয় স্পষ্ট হয়; প্রথমত, প্রভাবশালী গোত্রের লোকেরাও কুরাইশের অত্যাচারের ঊর্ধ্বে ছিলেন না; দ্বিতীয়ত, দুর্বল ও গরীব মুসলমানদের অবস্থা তখন এতটাই করুণ ছিল যে, হিজরত করার মত অবস্থা বা সাধ্যও তাদের ছিল না। কুরাইশরা আবিসিনিয়ার বাদশাহ্ নাজ্জাশী যার আসল নাম ছিল ‘আসহামা’ তাকে উল্টো-পাল্টা বুঝিয়ে মুসলমানদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে, যেন তারা তাদের ওপর আরো অত্যাচার চালাতে পারে, কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়। কেননা নাজ্জাশী একজন খিস্ট্রান বাদশাহ্ হলেও তিনি ছিলেন পরম ন্যায়পরায়ণ।

এরপর আবিসিয়ায় হিজরতকারী মুসলমানদের মধ্যে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, মক্কার কুরাইশরা মুসলমান হয়ে গেছে। মির্যা বশীর আহমদ সাহেব ‘সীরাত খাতামান্নাবীঈন’ পুস্তকেও লিখেছেন, যদিও বলা হয় যে, কুরাইশরা এই গুজব ছড়িয়েছিল, কিন্তু তা সম্পূর্ণ সঠিক বলে মনে হয় না। বরং এরূপ হওয়ার কারণ খুব সম্ভব আরেকটি ঘটনা; মহানবী (সা.)-এর ওপর যখন সূরা নজম অবতীর্ণ হয় এবং তিনি (সা.) কাবার চত্বরে সেই সূরা উচ্চস্বরে ও সুললিত কণ্ঠে তিলাওয়াত করেন, তখন তা উপস্থিত কাফিরদের ওপরও যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। এ সূরায় কুরাইশদেরকে সতর্ক করা হয়েছিল, যদি তারা তাদের অত্যাচার ও অপকর্ম থেকে বিরত না হয়, তবে তাদের অবস্থাও পূর্ববর্তী অস্বীকারকারীদের মত হবে। এই সূরা পাঠ করার পর যখন মহানবী (সা.) সিজদা করেন, তখন সেই পরিস্থিতির যাদুকরী প্রভাবে অন্যান্য মুসলমানদের সাথে সাথে কাফিররাও সিজদায় প্রণত হয়। কিন্তু তাদের ওপর সেই ঘটনার প্রভাব ছিল সাময়িক, পরে তারা আবার তাদের স্বরূপে ফিরে যায়। কিন্তু কুরাইশরা, যারা আবিসিনিয়ার মুহাজিরদেরকে পুনরায় ফিরিয়ে এনে অত্যাচার করার বাসনা রাখতো, তারা খুব সম্ভব এই ঘটনাটির উল্লেখ করেই এ গুজব রটনা করে যে, মক্কার সবাই মুসলমান হয়ে গেছে, যেন মুহাজিররা মক্কায় ফিরে আসে। যাহোক, হয়তো কিছু মুহাজির একথায় বিশ্বাস করে মক্কায় ফিরে এসেছিলেন, কিন্তু যখন সত্যটা জানতে পারেন, তখন অধিকাংশই আবার আবিসিনিয়ায় ফিরে যান; আর মক্কার অন্য মুসলমানরাও ধীরে ধীরে হিজরত করতে থাকেন। এমনকি আবিসিনিয়ায় হিজরতকারীর সংখ্যা প্রায় একশ’র কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছে। আর ইসলামের ইতিহাসে এটিই আবিসিনিয়ার দ্বিতীয় হিজরত নামে পরিচিত। পরবর্তীতে মদীনায় হিজরতের নির্দেশনা জানার পর হযরত আবু হুযায়ফা মদীনায় হিজরত করেন ও হযরত আব্বাদ বিন বিশরের বাড়িতে আশ্রয় নেন। মহানবী (সা.) তাদের দু’জনের মাঝে ভ্রাতৃত্ব-বন্ধন প্রতিষ্ঠা করেন।

হযরত আবু হুযায়ফা আব্দুল্লাহ্ বিন জাহশের অভিযানেও অংশ নিয়েছিলেন, যা প্রথম বদর নামেও অভিহিত হয়। মক্কার এক নেতা কুরয বিন জাবের বিন ফেহরী কুরায়শদের একটি দল নিয়ে মদীনা থেকে মাত্র তিন মাইল দূরে অবস্থিত চারণভূমিতে আক্রমণ করে মুসলমানদের উট ইত্যাদি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। মহানবী (সা.) একথা শোনার সাথে সাথে যায়েদ বিন হারসাকে তাঁর অবর্তমানে আমীর নিযুক্ত করেন এবং মুহাজিরদের একটি দল নিয়ে বদর প্রান্তরের কাছাকাছি সাফওয়ান নামক স্থান পর্যন্ত লুটেরাদের পিছু ধাওয়া করেন, তবে কাফিররা পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। কুরয বিন জাবেরের এই আক্রমণের মূল উদ্দেশ্য ছিল অতর্কিত হামলা চালিয়ে মহানবী (সা.)-কে হত্যা করা; কিন্তু যখন তারা মুসলমানদেরকে সতর্ক দেখতে পায়, তখন উট ছিনতাই করে পালায়। এ ঘটনা থেকে স্পষ্ট হয় যে, কুরাইশরা অতর্কিত ও চোরগোপ্তা হামলা চালিয়ে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন‎‎‎‎‎ করার পরিকল্পনা করেছিল, এ কারণে মহানবী (সা.) কুরাইশদের গতিবিধি সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নেন। এ উদ্দেশ্যেই মহানবী (সা.) আব্দুল্লাহ্ বিন জাহশের নেতৃত্বে এক অভিযাত্রী দল নাখলা উপত্যকায় প্রেরণ করেন, যাদের সাথে পরবর্তীতে কুরাইশদের একটি দলের যুদ্ধ হয়। সেই অভিযাত্রী দলে হযরত আবু হুযায়ফাও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

হুযূর (আই.) সেই পরিস্থিতিও তুলে ধরেন, যার প্রেক্ষিতে অভিযাত্রী দল কাফিরদের সাথে নিষিদ্ধ মাসেই যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু আসল বিষয় হল, মহানবী (সা.) যখন এই ঘটনা জানতে পারেন তখন অভিযাত্রী দলের ওপর খুবই অসন্তুষ্ট হন। তিনি (সা.) কোনভাবেই তাদের এই কাজকে সমর্থন করেন নি, এমনটি করার নির্দেশ দেয়া তো দূরে থাক। কিন্তু যেহেতু বিষয়টি নিয়ে অনেক বেশি কথাবার্তা ও আলোচনা হচ্ছিল, তাই আল্লাহ্ তা’লা স্বয়ং পবিত্র কুরআনে এই ঘটনার উল্লেখ করে সাহাবীদের সেই আক্রমণকে যৌক্তিক সাব্যস্ত করেন, যার উল্লেখ সূরা বাকারার ২১৮নং আয়াতে রয়েছে। এ অভিযানে একজন সম্ভ্রান্ত কাফির নিহত হয়, দু’জন বন্দী হয় এবং একজন পালিয়ে যায়। কাফিররা তাদের দু’জনকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য মদীনায় আসে। যেহেতু তখনও দু’জন মুসলমান নিখোঁজ ছিলেন, তাই মহানবী (সা.) সেই দু’জন মুসলমানের ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। তারা ফিরে এলে কাফির দু’জনকে মুক্তিপণ নিয়ে মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু তাদের একজন ইতোমধ্যে ইসলামের সৌন্দর্য ও মহানবী (সা.)-এর মহানুভবতায় অভিভূত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন, যিনি পরবর্তীতে বি’রে মউনার ঘটনায় শহীদও হন।

হযরত হুযায়ফা সম্পর্কে এই বর্ণনাও পাওয়া যায় যে, বদরের যুদ্ধের দিন তিনি তার পিতার সাথে, যে কাফিরদের অন্যতম নেতা ছিল, লড়াই করতে যান। কিন্তু মহানবী (সা.) তাকে নিবৃত্ত করে বলেন, তোমাকে তার সাথে যুদ্ধ করতে হবে না, অন্য কেউ তার সাথে লড়বে। সেদিন তার পিতা, চাচা, ভাই ও ভাতিজা মুসলমানদের হাতে নিহত হয়। তিনি (রা.) সেদিন অসাধারণ ধৈর্য প্রদর্শন করেছেন এবং আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট থেকে ইসলামের বিজয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। বদরের যুদ্ধে নিহত কাফিরদেরকে মহানবী (সা.) একটি বড় গর্ত করে তাতে মাটিচাপা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। যখন আবু হুযায়ফার পিতাকে সেখানে ফেলা হচ্ছিল, তখন তার চেহায়ায় অসন্তুষ্টি ও কষ্ট প্রকাশ পাচ্ছিল। এটি দেখে মহানবী (সা.) তাকে বলেন, হে আবু হুযায়ফা! আল্লাহ্‌র কসম! আমার মনে হচ্ছে তোমার পিতার এই পরিণাম দেখে তোমার খারাপ লাগছে। তিনি (রা.) জবাব দেন, হে আল্লাহ্‌র রসূল! আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের সিদ্ধান্তে আমার কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার পিতা সহিষ্ণু, সত্যবাদী ও ধীমান ছিলেন। [হুযূর বলেন, এটি আবু হুযায়ফার ধারণা ছিল নিজ পিতা সম্বন্ধে।] আর তার মৃত্যুর পূর্বেই আল্লাহ্ তাকে হিদায়েত দিবেন বলে আমার বিশ্বাস ছিল। কিন্তু এখন যখন দেখলাম তা আর সম্ভব নয়, আর তার পরিণতি তা-ই হল যা হওয়ার ছিল, তাই এটি আমাকে খুবই ব্যথিত করছে। তখন মহানবী (সা.) হুযায়ফার মঙ্গল কামনা করে আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করেন। হযরত আবু হুযায়ফা সকল যুদ্ধেই মহানবী (সা.)-এর সহযোদ্ধা ছিলেন, হযরত আবু বকর (রা.)-এর খিলাফতকালে ৫৩ বা ৫৪ বছর বয়সে ইয়ামামার যুদ্ধে তিনি শহীদ হন।

খুতবার শেষদিকে হুযূর জামাতের একজন নিষ্ঠাবান সেবক অধ্যাপক সউদ আহমদ খান দেহলভি সাহেবের গায়েবানা জানাযার ঘোষণা দেন, যিনি গত ২১ জানুয়ারি ইন্তেকাল করেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার পিতা হযরত মুহাম্মদ হাসান আহসান দেহলভি হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর সাহাবী ছিলেন; তার দাদা হযরত মাহমুদ হাসান খান সাহেবও মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর সাহাবী ছিলেন এবং তার নাম মসীহ্ মওউদ (আ.) নিজের ৩১৩ সাহাবীর মধ্যে ৩০১ নম্বরে উল্লেখ করেছেন। মরহুমের পিতা মুহাম্মদ হাসান আহসান সাহেব মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর খুতবা ইলহামিয়ার কল্যাণমন্ডিত নিদর্শন স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য লাভ করেন, যখন তার বয়স ছিল মাত্র ১০/১২ বছর। অধ্যাপক সউদ খান সাহেব ১৯৪৫ সালের এপ্রিলে জীবন উৎসর্গ করেন। তিনি আলীগড় থেকে ফার্সিতে বিএ অনার্স ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। হুযূর মরহুমের অসাধারণ গুণাবলী, পাণ্ডিত্য, সেবা ও কর্মময় জীবন এবং খিলাফতের প্রতি অগাধ ভালবাসা ও বিশ্বস্ততার স্মৃতিচারণ করেন। হুযূর দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা তার মর্যাদা ক্রমাগত উন্নত করুন, তার সন্তান ও বংশধরদেরও সর্বদা জামাতের সাথে সম্পৃক্ত রাখুন। (আমীন)