শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৭-ডিসেম্বর, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৭ই ডিসেম্বর, ২০১৮ইং লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় হযরত উবায়দ বিন যায়েদ আনসারী (রা.), হযরত যাহের বিন হারাম আল্ আশজায়ী (রা.), হযরত যায়েদ বিন খাত্তাব (রা.), হযরত উবাদা বিন খিশখাশ (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন জাদ (রা.), হযরত হারেস বিন অওস বিন মুআয (রা.), হযরত কা’ব বনি আশরাফ (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর (আই.) বলেন, আজ যেসব সাহাবীর স্মৃতিচারণ করব তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম রয়েছেন, হযরত উবায়দ বিন যায়েদ আনসারী (রা.)। তিনি বনু আজলান গোত্রভুক্ত ছিলেন। তিনি বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

হযরত যাহের বিন হারাম আল্ আশজায়ী (রা.)-ও একজন বদরী সাহাবী ছিলেন। তিনি একজন আরব বেদুঈন ছিলেন এবং গ্রাম থেকে বিভিন্ন উপহার সামগ্রী অর্থাৎ তরিতরকারি নিয়ে মহানবী (সা.)-এর সমীপে উপস্থিত হতেন, আর ফেরত যাবার সময় মহানবী (সা.)-ও তাকে অনেক উপহার-উপঢৌকন দিয়ে দিতেন। মহানবী (সা.) বলতেন, “যাহের আমার গ্রামের বন্ধু আর আমি তার শহুরে বন্ধু”। হযরত যাহের (রা.) বাহ্যত দেখতে কিছুটা কদাকার ছিলেন। একদিন বাজারে হযরত যাহের কাজ করছিলেন, তার শরীর ছিল ঘর্মাক্ত ও ধূলো-বালিতে নোংরা। মহানবী (সা.) পেছন থেকে চুপিচুপি গিয়ে তার চোখ চেপে ধরেন। হযরত যাহের (রা.) যখন বুঝতে পারেন এটি মহানবী (সা.), তখন তিনিও দুষ্টুমি করে তার ময়লা শরীর মহানবী (সা.)-এর শরীরের সাথে ঘষতে থাকেন। মহানবী (সা.) ঠাট্টা করে বলেন, “আমার কাছে একটি ক্রীতদাস আছে, কেউ একে কিনবে কি?” হযরত যাহের দুঃখ করে বলেন, “হে আল্লাহ্‌র রসূল! আমাকে বিক্রি করলে তো আপনি ভাল দাম পাবেন না; আমাকে কে কিনবে?” মহানবী (সা.) বলেন, “এভাবে বলো না! আল্লাহ্‌র কাছে তুমি অনেক মূল্যবান”। হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.)-ও মহানবী (সা.)-এর এই মনস্তুষ্টির ঘটনাটি তাঁর একটি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। মোটকথা, সাহাবীগণ মহানবী (সা.)-এর কাছ থেকে বিষ্ময়কর ভালোবাসার কল্যাণ লাভ করে ধন্য হয়েছেন। হযরত যাহের বিন হারাম আল্ আশজায়ী (রা.) জীবন সায়াহ্নে কুফায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন বলে জানা যায়।

পরবর্তী সাহাবী হলেন, হযরত যায়েদ বিন খাত্তাব (রা.)। তিনি ছিলেন হযরত উমর (রা.)-এর বড় ভাই এবং তার পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। বদর, উহুদ, খন্দক, হুদাইবিয়াসহ সকল যুদ্ধাভিযানে মহানবী (সা.)-এর সহযোদ্ধা ছিলেন। মহানবী (সা.) মা’আন বিন আদি ও তার মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন রচনা করিয়েছিলেন। তারা উভয়েই ইয়ামামার যুদ্ধে শহীদ হন। বদরের যুদ্ধের দিন হযরত উমর (রা.) আল্লাহ্‌র কসম দিয়ে হযরত যায়েদ (রা.)-কে নিজের বর্ম পরিধান করতে অনুরোধ করেন। যায়েদ (রা.) কিছুক্ষণের জন্য তা পরিধান করলেও পরে তা খুলে ফেলেন। হযরত উমর (রা.) খুলে ফেলার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমিও তোমার মতই শাহাদাতের পিয়াসী”। বিদায় হজ্জ্বের দিন মহানবী (সা.) ক্রিতদাসদের সম্পর্কে যে উপদেশাবলী দিয়েছিলেন, হযরত যায়েদ (রা.) ছিলেন সেটির একজন বর্ণনাকারী। ইয়ামামার যুদ্ধে যখন মুসলমানরা সাময়িকভাবে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিল, তখন তিনি উচ্চস্বরে দোয়া করেন, “হে আল্লাহ্! আমি আমার সাথীদের পিছু হটার কারণে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি এবং মুসায়লামা ও মুহাকামা যে কাজ করেছে তা থেকে নিজেকে দায়মুক্ত ঘোষণা করছি”। একথা বলে তিনি মুসলমানদের পতাকা শক্তভাবে ধরে শত্রুব্যুহে প্রবল আক্রমণ চালান আর লড়াই করতে করতে শাহাদতের অমীয় সূধা পান করেন। তার শাহাদাতের পর হযরত উমর (রা.) বলেন, “আল্লাহ্ তার প্রতি কৃপা করুন; আমার ভাই দু’দিক থেকে আমার চেয়ে অগ্রগামী হয়েছেন- প্রথমত ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রে আর দ্বিতীয়ত শাহাদাত বরণের বেলায়”। মুসায়লমার সাথীদের মাঝ থেকে রাজ্জাল বিন উনফাওয়া হযরত যায়েদ (রা.)-এর হাতে নিহত হয়। এককালে সে মুসলমান ছিল, একাধারে মুহাজির এবং ক্বারীও ছিল, কিন্তু পরে মুসায়লামার দলে গিয়ে ভিড়ে। সে মুসায়লামাকে গিয়ে বলেছিল, আমি রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কাছে শুনেছি, “তিনি তোমাকে তার নবুওয়তের অংশীদার বানিয়েছেন”। তার একথা বনু হুনায়ফার জন্য অনেক বড় পরীক্ষা বা নৈরাজ্যের কারণ হয়েছিল।

আরেকজন সাহাবী হযরত উবাদা বিন খিশখাশ (রা.)। তিনি হযরত মুজাযের বিন যিয়াদের চাচাতো ভাই ছিলেন। তিনি বদরের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। উহুদের যুদ্ধে তিনি শাহাদত বরণ করেন।

আরেকজন বদরী সাহাবী হলেন, হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন জাদ (রা.)। তার পিতার নাম ছিল, জাদ বিন কায়েস, সে আবু ওয়াহাব নামেও পরিচিত ছিল। মুআয বিন জাবাল মায়ের দিক থেকে হযরত আব্দুল্লাহ্‌র ভাই ছিলেন। তাবূকের যুদ্ধের সময় মহানবী (সা.) তার বাবা আবু ওয়াহাবকে যুদ্ধে যেতে বললে সে মিথ্যা অজুহাত দেখায় এবং যুদ্ধে না যাওয়ার অনুমতি চায়। কিন্তু হযরত আব্দুল্লাহ্ (রা.) যখন ঘরে গিয়ে এ বিষয়ে তার পিতাকে প্রশ্ন করেন, তখন সে আরেক অজুহাত দাঁড় করায়। এতে হযরত আব্দুল্লাহ্ (রা.) নিজ পিতাকে এই বলে সতর্ক করেন যে, তার মাঝে কপটতা রয়েছে আর নিশ্চয়ই আল্লাহ্ও তার ব্যাপারে কুরআনে উল্লেখ করে দিবেন; আর তখন সবাই তার অবস্থা জেনে যাবে। একথা শুনে তার পিতা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে নিজের জুতা খুলে ছেলের মুখে ছুঁড়ে মারে, তখন আব্দুল্লাহ্ (রা.) কোন কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। আবু ওয়াহাব সম্পর্কে জানা যায়, পরবর্তীতে তিনি তওবা করেছিলেন।

পরবর্তী বদরী সাহাবী হলেন, হযরত হারেস বিন অওস বিন মুআয (রা.)। তিনি হযরত সা’দ বিন মুআয (রা.)-এর ভাতিজা ছিলেন। তিনি বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নেন। কারও কারও মতে তিনি উহুদের যুদ্ধে শহীদ হন। তবে অন্যান্য বর্ণনানুসারে তিনি উহুদের যুদ্ধে শহীদ হন নি। কা’ব বিন আশরাফের মৃত্যুদন্ড কার্যকরকারী সাহাবীদের মধ্যে তিনিও একজন ছিলেন। কা’বকে হত্যার সময় দুর্ঘটনাবশতঃ সাহাবীদের কারও তলোয়ারের ফলা লেগে তিনি আহত হন। সাহাবীরা তাকে দ্রুত মহানবী (সা.)-এর কাছে নিয়ে আসেন। মহানবী (সা.) তার ক্ষতস্থানে নিজের মুখের লালা লাগিয়ে দেন এবং এতে তার কষ্ট দূরীভূত হয়।

এরপর হুযূর আনোয়ার (আই.) কা’ব বিন আশরাফকে হত্যার কারণ কি ছিল সে সম্পর্কিত ঘটনাটি স্ববিস্তারে তুলে ধরেন যা নিয়ে পাশ্চাত্বের ইতিহাসবিদরা বিভিন্ন সময়ে আপত্তি তুলে থাকে। হুযূর (আই.) কা’ব বিন আশরাফের ব্যাপারে বলেন, সে যদিও জন্মগতভাবে ইহুদি ছিল না বরং আরব ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও বেশ কিছু কারণে আরবে সে ইহুদিদের সবচেয়ে বড় নেতা বলে গণ্য হতো। জাগতিকভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী, সম্পদশালী, সুদর্শন ও সুকবি ছিল, কিন্তু চারিত্রিকভাবে অত্যন্ত নোংরা প্রকৃতির লোক ছিল। সে গোপন ষড়যন্ত্র ও ধূর্ততায় অত্যন্ত পারদর্শী ছিল। বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় সে একেবারেই মেনে নিতে পারে নি। সে ইসলামকে ধ্বংস ও নিঃশেষ করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা ও ষড়যন্ত্র করতে থাকে। সে মক্কায় গিয়ে সংগোপনে কুরাইশদেরকে যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করতো, অন্যান্য গোত্রগুলিকেও প্ররোচিত করতো; মুসলমান মহিলাদের নামে অত্যন্ত মন্দ ও অশালীন বাক্য সে তার কবিতায় লিখতো। এমনকি সে মহানবী (সা.)-কে কারো বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে এনে কতিপয় ইহুদি যুবক দ্বারা হত্যা করানোর ষড়যন্ত্রও করেছিল, এ বিষয়ে আগেই আল্লাহ্ তা’লা মহানবী (সা.)-কে অবহিত করায় তার এই দুরভিসন্ধি সফল হয় নি। যেহেতু সে মদীনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহমূলক আচরণ ও ষড়যন্ত্র করে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছিল, এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, রাষ্ট্রদ্রোহ, যুদ্ধের উস্কানিদাতা, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারা, অশ্লীলতা ছড়ানো এবং হত্যাচেষ্টার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রামাণিকভাবে সাব্যস্ত হয়েছিল, সেহেতু মহানবী (সা.) যৌক্তিকভাবেই মদীনা রাষ্ট্রের স্বার্থে মদীনার প্রধান বা শাসকের অবস্থান থেকে এই সিদ্ধান্ত দেন যে কা’ব বিন আশরাফ হত্যাযোগ্য অপরাধী। কিন্তু যেহেতু কা’ব তখন মদীনায় নিজের এমন একটি অবস্থান বা ভাবমূর্তি সৃষ্টি করেছিল যে, যদি তাকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হতো বা হত্যার নির্দেশ দেওয়া হতো, তবে মদীনাতে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আশংকা ছিল এবং ভয়াবহ রক্তপাত শুরু হয়ে যেতো, তাই শান্তির খাতিরেই মহানবী (সা.) তাকে সুযোগমত হত্যার জন্য কয়েকজন সাহাবীকে দায়িত্ব প্রদান করেন, যার নেতৃত্বে ছিলেন আওস গোত্রের নিষ্ঠাবান সাহাবী হযরত মুহাম্মদ বিন মাসলামা। যাহোক, তারা পরিকল্পনা করে এই কাজ সমাধা করেন। পরের দিন এই বিষয়টি নিয়ে ইহুদিদের একটি প্রতিনিধিদল মহানবী (সা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসে এবং বলে, আমাদের নেতা কা’ব বিন আশরাফকে এভাবে গোপনে হত্যা করা হয়েছে। তখন মহানবী (সা.) তার প্রমাণিত অপরাধগুলোর কথা তাদের স্মরণ করিয়ে দেন; এতে তারা নীরব হয়ে যায়। মহানবী (সা.) তখন তাদেরকে ভবিষ্যতে মদীনার শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে নতুন করে শান্তিচুক্তির কথা বলেন এবং তাদের সম্মতিতে নতুন চুক্তি সম্পাদিত হয়। মহানবী (সা.) হত্যার দায় অস্বীকার করেন নি, বরং কা’বের অপরাধগুলো স্মরণ করিয়ে দিয়ে তার স্বাভাবিক শাস্তির কথা তাদেরকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন; আর ইহুদিরাও তাতে দ্বিমত পোষণ করে নি, নতুবা তারা নতুন করে চুক্তি-ই বা কেন করল যাতে এমন ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে? তাদের এমন আচরণ এটা প্রমাণ করে যে, তখনকার প্রচলিত ব্যবস্থায় এমনটি করা একেবারেই সঠিক এবং যুক্তিযুক্ত ছিল। বর্তমান যুগের আপত্তিকারীরা একথা মনে রাখে না যে, সে যুগের ইহুদিরা কোন আপত্তি করে নি, শত শত বছর ধরে এটি নিয়ে কোন আপত্তিও উঠে নি। কারণ সে যুগের প্রেক্ষাপটে কাজটি সম্পূর্ণ সঠিক ও যথার্থ ছিল। কাজেই পুরো বিষয় না জেনেই আজ পাশ্চাত্ব্যের ইতিহাসবেত্তাগণ আপত্তি করার সুযোগ খুঁজছে।

খুতবার শেষ দিকে হুযূর (আই.) দোয়া করে বলেন, আল্লাহ্ তা’লা সর্বদা ইসলামকে এসব বিপদ থেকে রক্ষা করুন। এখনকার মুসলমানরা এসব ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়ার পরিবর্তে উল্টো নিজেরাই এসব বিশৃঙ্খলায় নিপতিত ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মূল হোতা। আল্লাহ্ তা’লা মুসলমানদেরকে সৎবুদ্ধি দিন যাতে তারা এ যুগে ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য প্রেরিত পথ-প্রদর্শককে মানার তৌফিক লাভ করে ধন্য হয়, আমীন।