সালানা জলসা জার্মানী – ২০১৮

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৭-সেপ্টেম্বর, ২০১৮

কার্লস্‌রূহ, জার্মানী

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৭ই সেপ্টেম্বর ২০১৮ ইং তারিখে সালানা জলসা জার্মানী ২০১৮-এর জলসাগাহ্ থেকে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন এবং তিনি উক্ত জলসার উদ্বোধন করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, আজ থেকে আহমদীয়া জামা’ত জার্মানির বার্ষিক জলসা শুরু হতে যাচ্ছে এবং আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে আরও একটি জলসায় অংশগ্রহণের সুযোগ দান করছেন, আলহামদুলিল্লাহ্। জলসা সালানা কী?- এ বিষয়ে সোয়াশ’ বছর আগে প্রথম জলসার প্রাক্কালেই হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেছিলেন, “জলসা কোন জাগতিক মেলা নয়, আর এখানে একত্রিত হওয়ার উদ্দেশ্য কোন পার্থিব অর্জন বা সংখ্যা প্রদর্শন নয়; বরঞ্চ এখানে আগমনকারীদের কেবলমাত্র আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে একত্রিত হওয়া উচিত যেন নিজের জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারে এবং আল্লাহ্‌র বান্দাদের অধিকার প্রদানের জ্ঞান অর্জনকারী ও তা প্রদানকারী হতে পারে”। হুযূর (আই.) বলেন, কিন্তু আমি দুঃখের সাথে বলছি, কিছু লোক তো জলসায় অংশ নিতে আসে, কিন্তু কোন কিছু অর্জন করে না; খালি কিছু বন্ধুর সাথে দেখা হয় আর কিছু কাজের কথা সেরে নেয়। এমন লোকেরা আবার সমস্যাও সৃষ্টি করে, আর কিছু তরুণ ও শিশুদের জন্য হোঁচট খাওয়ার কারণে পরিণত হয়। এরা এমন কিছু কাজ করে বসে আর ভাবে, কেউ আমাদের দেখছে না। সবসময় মনে রাখা উচিত, আল্লাহ্ সর্বদা সবকিছু দেখছেন। তাই আজ সর্বপ্রথম যে কথাটি আমি বলতে চাই, আর তা সকলের মাথায় গেঁথে নেয়া দরকার তা হল, এই জলসা কেবলমাত্র একটি আধ্যাত্মিক জলসা, এটি অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য হল আমাদের মাঝে তাকওয়া বৃদ্ধি ও খোদা তা’লার সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি। আজকে আমার বলার প্রথম বিষয় হল জলসার উদ্দেশ্য, আর তা হল তাকওয়া সৃষ্টি। জলসার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশ্যে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, “তাদের ভিতরে যেন খোদাভীতি সৃষ্টি হয়; পরহেযগারি, চিত্তের নম্রতা ও পারস্পরিক ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্বের ক্ষেত্রে যেন দর্শনীয় নমুনা হয়; বিনয়, নম্রতা ও ন্যায়পরায়ণতা সৃষ্টি হয়”। আরেক স্থানে তিনি (আ.) বলেন, “তাকওয়া অবলম্বন কর, তা প্রত্যেক পুণ্যের মূল। তাকওয়ার অর্থ হল প্রত্যেক সূক্ষাতিসূক্ষ্ম পাপ থেকে আত্মরক্ষা করা, যেই বিষয়ে সন্দেহ হয় যে এর ফলে পাপ হতে পারে- সেটি থেকেও বিরত থাকা”। হুযূর (আই.) বলেন, এখন আমরা প্রত্যেকে যদি আত্মবিশ্লেষণ করি যে আমরা প্রকৃতই এমনটি করছি কি-না, আর যদি এমনটিই করে করি, তবে গিয়ে আমরা ভাবতে পারি যে আমরা জলসায় আগমনের উদ্দেশ্য পূর্ণ করছি বা করার চেষ্টা করছি। নতুবা জলসায় এসে বক্তৃতা শোনা বা সাময়িক আবেগ দেখানো বা শ্লোগান দেয়া ইত্যাদি অর্থহীন। অনেকের তো চেহারা দেখেই বুঝা যায়, তারা কেবল অন্যদের দেখাদেখি শ্লোগান দিচ্ছে, প্রকৃত স্পৃহা নিয়ে নয়। তাকওয়ার ব্যাপারে মসীহ্ মওউদ (আ.) আরেকটি মানদন্ড উল্লেখ করেছেন। তিনি (আ.) বলেন, “তাকওয়ার প্রভাব এই পৃথিবীতেই মুত্তাকীর উপর কার্যকর হয়। এটি হতেই পারে না, মানুষ তাকওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও তার দ্বারা পাপ সংঘটিত হবে। এদিক থেকেও প্রত্যেকে আত্মবিশ্লেষণ করতে পারে”। মসীহ্ মওউদ (আ.) আরও বলেন, “খোদা তা’লার এই জামা’ত সৃষ্টির আসল উদ্দেশ্য হল, প্রকৃত মারেফত, তাকওয়া ও পবিত্রতা, যা পৃথিবী থেকে হারিয়ে গিয়েছে, তা পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা”। তাই যারা আল্লাহ্‌র ইচ্ছা মোতাবেক তাকওয়া ও পবিত্রতা প্রতিষ্ঠা করবে, তারাই সফল এবং মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর দৃষ্টিতে প্রকৃত আহমদী ও জলসায় অংশগ্রহণের উদ্দেশ্য পূর্ণকারী।

হুযূর (আই.) এরপর জলসায় আগত প্রত্যেক ব্যক্তির উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। হুযূর (আই.) বলেন, জলসায় আগতদের দু’টি ভাগ রয়েছে। একদল হলেন কর্মকর্তা ও কর্মীবৃন্দ, যারা জলসার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করছেন; দ্বিতীয় দলটি হল জলসায় অংশগ্রহণকারীদের। আর এই উভয় ধরনের লোকদেরই এই মানদন্ডে নিজেদের যাচাই করতে হবে। এরপর হুযূর (আই.) উভয় পক্ষকেই এ বিষয়ে আলাদাভাবে নসীহত করেন।

হুযূর (আই.) প্রথমে কর্মীদেরকে উপদেশ প্রদান করেন, তাদেরকে সর্বাবস্থায় নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখার উপদেশ দেন, অতিথিদের খেয়াল রাখতে বলেন; বিনয় প্রদর্শন, নম্র ভাষা ব্যবহারের ব্যাপারে নির্দেশনা দেন। হুযূর (আই.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লা কুরআন শরীফে বলেছেন, কুলু লিন্নাসি হুসনা, অর্থাৎ মানুষের সাথে নম্রভাবে কথা বল। মহানবী (সা.) বলেছেন, যাকে নম্রতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, তাকে সবরকম কল্যাণ থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে। এরপর হুযূর (আই.) আগত অতিথিদেরও উপদেশ প্রদান করে বলেন, “অতিথিদের মনে রাখতে হবে, তাদের আগমনের উদ্দেশ্য হল আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জন, আর সেটি তাকওয়ার মাধ্যমে লাভ করা সম্ভব। কর্মীরা যদিও সেবার জন্যই কাজ করছে ও তারা অবশ্যই ধৈর্য প্রদর্শন করবে, কিন্তু অতিথিদের তাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নেয়া ঠিক নয়। কোন কর্মী উষ্মা প্রদর্শন করলে অতিথিরও ধৈর্য ধরা উচিত, তাকওয়া অবলম্বন ও বিনয় প্রদর্শন করা উচিত। কর্মীদের কাজে সহায়তা করা ও তাদের নির্দেশনা মেনে নেয়া উচিত। সদ্ব্যবহার ও নম্রভাবে কথা বলা তাদেরও কর্তব্য। নিজেদেরকে সেই মানে উন্নীত করতে হবে যা আপনাদেরকে মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর অতিথি হওয়ার যোগ্য করবে। নতুবা কার্যত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর শিক্ষা যদি পালন না করেন, তাঁর জলসার উদ্দেশ্য পূর্ণ না করেন, তবে মুখে হাজার বার দাবী করুন না কেন, আপনারা মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর অতিথি নন! সুতরাং কর্মী ও অংশগ্রহণকারী- প্রত্যেকেরই তাকওয়া ও সদ্ব্যবহারের ফলে জলসার প্রকৃত উদ্দেশ্য পূরণ হতে পারে”। হুযূর (আই.) সকলকে অনেক বেশি বেশি দরূদ পড়ার, যিকরে ইলাহীতে রত থাকার ব্যাপারেও নির্দেশনা প্রদান করেন। সকলকে দোয়া করতে বলেন যেন আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে এই জলসার উদ্দেশ্য পূর্ণকারী ও এর কল্যাণ লাভকারী বানান, আমাদের বংশধরদের মাঝেও যেন তাকওয়া সৃষ্টি হয়, আল্লাহ্ তা’লার অপছন্দের প্রত্যেক বিষয় থেকে আমরা ও আমাদের বংশধরেরাও আত্মরক্ষা করতে পারি, আমাদের সম্পদে যেন সমৃদ্ধি হয় এবং আমরা বা আমাদের বংশধরেরা যেন আল্লাহ্‌র দৃষ্টিতে অপছন্দীয় বা হারাম কোন সম্পদ বা জীবিকা অর্জন না করি, আমাদের পরিবার-পরিজন যেন সর্বদা ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে।

হুযূর (আই.) আরও দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা প্রত্যেককে তাঁর সন্তুষ্টি মোতাবেক জীবনযাপনের তৌফিক দান করুন, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর জামাতে অন্তর্ভুক্ত হবার গুঢ়তত্ত্ব বুঝে এর হক আদায় করার তৌফিক দিন। আল্লাহ্ করুন, আমরা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর আকাক্সক্ষা অনুযায়ী জীবন যাপনকারী হই, জলসার আশিস থেকে কল্যাণমন্ডিত হই, মসীহ্ মওউদ (আ.) জলসায় অংশগ্রহণকারীদের জন্য যে দোয়া করেছেন তা লাভকারী হই- জলসার দিনগুলোতেও এবং পরেও; আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে সর্বদা পুণ্য অর্জন করার তৌফিক দিন। আমীন।