সালানা জলসা যুক্তরাজ্য – ২০১৮ এর পর্যালোচনা

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১০-আগস্ট, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১০ই আগস্ট, ২০১৮ইং লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদ থেকে সালানা জলসা যুক্তরজ্য – ২০১৮ এর পর্যালোচনা করেন এবং জলসার জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে ও অ-আহমদী অতিথিদের কিছু অভিব্যক্তি উল্লেখ করে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, গত রবিবার যুক্তরাজ্যের জলসা সালানা নিজ কল্যাণরাজি ছড়িয়ে দিয়ে সমাপ্ত হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ্। জলসা সালানার প্রস্তুতি তো সারা বছর ধরেই চলে, কিন্তু শেষ তিন-চার মাস জলসার ব্যবস্থাপনা ও স্বেচ্ছাসেবীরা বিশেষভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। হাদীকাতুল মাহদী, যা এক প্রকার জঙ্গলই বলা চলে, এখানে আধুনিক শহরের যাবতীয় সুবিধাদি সৃষ্টির জন্য বিপুল সংখ্যক কর্মী নিরলসভাবে কাজ করে থাকে, যাদের একটি বিরাট অংশই তরুণ স্বেচ্ছাসেবী খোদ্দাম। এ কাজটি কোন সহজ কাজ নয়, তার উপর কর্মীরাও পেশাদার কর্মী নয়; যা-ই ফলাফল আমরা লাভ করছি তা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্ তা’লার কৃপাতেই হচ্ছে, যিনি আমাদের চেষ্টাগুলোকে অসাধারণভাবে সাফল্যমন্ডিত করেন। আর যেসব অতিথি আসেন, তারাও কর্মীদের স্পৃহা দেখে আশ্চর্য হন; বিশেষভাবে অ-আহমদী অতিথিবর্গ, যারা নারী-পুরুষ-শিশু সকল কর্মীদের এভাবে মগ্ন হয়ে কাজ করতে আগে কোথাও দেখে নি, তারা এ দৃশ্য দেখে অত্যন্ত প্রভাবিত হয়। আর তারা একথা তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেও থাকেন; সেইসাথে তারা এটিও বলেন, জলসা তাদের উপর এক বিশেষ প্রভাব সৃষ্টি করেছে ও তাদের জীবন বদলে দিয়েছে, মুসলমান না হলেও তাদের উপর ইসলামী শিক্ষার এক প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে, ইসলাম ও আহমদীয়া জামাত সম্পর্কে নতুন জ্ঞান অর্জন হয়েছে এবং ইসলামের প্রতি নেতিবাচক মনোভাবের পরিবর্তে ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। তাই জলসা একদিকে যেমন আমাদের নিজেদের ঈমান ও ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির মাধ্যম, তেমনি তা অন্যদেরকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা সম্পর্কে জানানোরও একটি মাধ্যম। হুযূর (আই.) বলেন, জলসার দ্বিতীয় দিনের বক্তৃতায় বছরজুড়ে আল্লাহ্ তা’লার বর্ষণকৃত কৃপারাজির সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয় এবং আল্লাহ্ তা’লার অশেষ দয়ার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়; আর এর ফলশ্রুতিতে আল্লাহ্ তা’লার কৃপারাজি আরও বেশি মাত্রায় আমরা লাভ করতে থাকি, যা জলসা চলাকালীনই শুরু হয়ে যায় এবং অ-আহমদী অতিথিদের ব্যক্ত করা অনুভূতি তার একটি উপমা। অতঃপর হুযূর সংক্ষেপে কয়েকজনের অভিব্যক্তি তুলে ধরেন, যা থেকে এটি বোঝা যায় যে অন্যদের উপরও জলসার কল্যাণরাজির কী প্রভাব পড়ে।

আট বছর ধরে বেনিনে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী একজন অতিথি ভ্যালেন্টিন সাহেব বলেন, “জলসায় আমি যা পেয়েছি, তা অঢেল টাকা খরচ করেও আমি পেতাম না। এক শান্তিপূর্ণ আধ্যাত্মিক পরিবেশে থাকার আমি সুযোগ পেয়েছি। … আমি ভাবছিলাম, এই যুগে এমন নিঃস্বার্থভাবে এত কাজ করা কিভাবে সম্ভব হতে পারে? শেষ পর্যন্ত আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম, এগুলো সব খিলাফতের নেতৃত্বের ফলেই সম্ভব হয়েছে, যিনি জামাতের সকল সদস্যকে এভাবে প্রশিক্ষিত করেছেন।… আমি নিশ্চিত, জামাতে আহমদীয়া যেভাবে ইসলামকে উপস্থাপন করে ও নিজ সদস্যদের তরবিয়ত করে, তাতে শীঘ্রই বিশ্ব ইসলাম আহমদীয়াতে প্রবেশ করবে”। আইভরি কোস্টের সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি তুগরেলি সাহেব, তিনি বলেন, “আমি নিজেই মুসলিম, আর বিশ বছর ধরে মুসলমানদের বিভিন্ন ফিরকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিতে অংশ নিচ্ছি। কিন্তু গত বিশ বছরে ইসলাম সম্পর্কে আমি ততটা জানতে পারি নি যা গত তিনদিনে জেনেছি। এই তিনদিনে যতটা আধ্যাত্মিকতা আমি অর্জন করেছি, তা বিশ বছরেও লাভ করতে পারি নি। অ-আহমদী আলেমদের কাছে কিছুই নেই, যদি কেউ ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা জানতে চায় তবে সে যেন আহমদী জামাতের কাছে যায়”।

ইটালির এক অধ্যাপক ইউস্তুলা গোনসা, যিনি একজন ক্যাথলিক পাদ্রীও বটে, তিনি বলেন, “আমি জলসায় তিনটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছি। এক, বিভিন্ন জাতি-বর্ণের লোকেদের এরকম অকৃত্রিমভাবে একত্রিত হওয়া যা অভূতপূর্ব; দুই, একেবারে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ; তিন, খলীফার ভাষণসমূহে অত্যন্ত স্পষ্ট বাণী ছিল যাতে আমাদের জন্য বাস্তবসম্মত শিক্ষা ছিল”। জাপান থেকে আগত প্রতিনিধিদলের সদস্য এক ভদ্রমহিলা মহিলাদের উদ্দেশ্যে হুযূরের ভাষণ সম্পর্কে বলেন, “খলীফার উপদেশসমূহ হল সেই সুরক্ষা, যার ছায়াতলে আহদমীয়াত উন্নতি লাভ করছে। পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করা ও যান্ত্রিকতা থেকে বের হওয়া বাস্তবিক অত্যন্ত জরুরী”। তিনি বলেন, “বর্তমান পৃথিবী ধর্ম থেকে দূরে, তাহলে আহমদীয়া জামাত কিভাবে তার তরুণ-যুবকদের ধর্মসেবার স্পৃহায় উজ্জীবিত করছে- এই প্রশ্ন আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল; কিন্তু জলসার উদ্বোধনী ভাষণ ও খলীফার দোয়া শুনেই বুঝতে পারলাম, আসলে এই দোয়াই জামাতকে সারা পৃথিবীর বিপরীতে এই অনন্য বৈশিষ্ট্য দান করছে”। তিনি নিজেও দোয়ায় অংশ নিয়ে মন হালকা করেছেন; জলসার স্বেচ্ছাসেবীদের জন্য তিনি নিজেই দোয়া করেছেন যেন আল্লাহ্ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হন। এরকম আরও অজস্র অভিব্যক্তি রয়েছে।

হুযূর বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে জলসার যে প্রচার হয়েছে তার উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, আল-ইসলাম ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ৮ লক্ষ ৩২ হাজার বার দেখা হয়েছে, ২ লক্ষ ১৮ হাজার ব্যক্তি ভিডিও দেখেছেন; অনলাইন সংবাদ, সংবাদপত্র ও টিভি ইত্যাদির সংবাদের মাধ্যমে ২৬ মিলিয়ন লোকের কাছে আহমদীয়াতের সংবাদ পৌঁছেছে। সারা পৃথিবী থেকে সাংবাদিকেরা এসেছিলেন, তারা ফিরে গিয়ে যেসব রিপোর্ট করবেন সেগুলোর মাধ্যমেও অনেক মানুষ আহমদীয়াত সম্পর্কে জানবেন। এছাড়া আফ্রিকাতেও বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে জলসার কার্যক্রম সম্প্রচারিত হয়েছে যা ৫০ মিলিয়নের অধিক লোক দেখেছেন, এ সংক্রান্ত অসংখ্য মন্তব্যও পাওয়া গিয়েছে।

হুযূর বলেন, জলসার যাবতীয় কর্মকান্ড স্বেচ্ছাসেবীরাই সম্পাদন করেছেন, তাই সকল অংশগ্রহণকারীর আল্লাহ্ তা’লার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার পাশাপাশি এসব কর্মীদেরও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত, আর তাদের জন্য দোয়াও করা উচিত, আল্লাহ্ যেন ভবিষ্যতেও তাদেরকে সেবা করার সুযোগ দেন। হুযূর বলেন, আমি নিজেও সকল কর্মীবৃন্দের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি, আল্লাহ্ তা’লা তাদেরকে প্রতিদান দিন এবং ভবিষ্যতে আরও বেশি সেবা করার সুযোগ দিন এবং তারা সর্বদা খিলাফতে আহমদীয়ার সাহায্যকারী হোক। (আমীন)। হুযূর বলেন, সকল কর্মীও আল্লাহ্ তা’লার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করুন, কারণ তিনি তাদেরকে সেবা করার সুযোগ দিয়েছেন, আর আল্লাহ্‌র দয়া ছাড়া সেবার সুযোগ লাভ সম্ভবপর নয়। আল্লাহ্ তা’লা সকলকে আরও বিনয়ী হবার সৌভাগ্য দিন, এসকল সেবা করার ও প্রশংসার ফলে তাদের মাঝে যেন কোন প্রকার অহংকার সৃষ্টি না হয়। (আমীন)