শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৭-জুলাই, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২৭ জুলাই, ২০১৮ইং লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত মুনযির বিন মুহাম্মদ আনসারী (রা.), হযরত হাতেব বিন আবি বালতা’হ্ (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহুদ, তা’উয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর মহানবী (সা.)-এর নিবেদিত প্রাণ দু’জন সাহাবীর স্মৃতিচারণ করেন। প্রথমজন হচ্ছেন, হযরত মুনযির বিন মুহাম্মদ আনসারী (রা.)। মুনযির বিন মুহাম্মদ (রা.)-এর সম্পর্ক বনু জাজেবা গোত্রের সঙ্গে ছিল। মদিনায় আগমণের পর মহানবী (সা.) মুনযির বিন মুহাম্মদ ও তোফায়েল বিন হারেস (রা.)-এর মাঝে ভাতৃত্বের বন্ধন প্রতিষ্ঠা করান। হযরত মুনযির (রা.) বদর এবং উহুদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

এই সাহাবীর শাহাদাতের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে হুযূর (আই.) বি’রে মাউনায় তিনি কীভাবে শহীদ হয়েছিলেন তা বর্ণনা করেন। মহানবী (সা.) ধর্ম শেখানোর উদ্দেশ্যে আনসারদের মধ্য হতে সাহাবীদের একটি দল প্রেরণ করেন। তাদের সংখ্যা ছিল ৭০ জন। তাঁরা সবাই হাফেযে কুরআন ছিলেন। তাঁরা সবাই দিনের বেলা জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ করতেন এবং তা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আর রাতের অধিকাংশ সময় ইবাদত-বন্দেগীতে কাটিয়ে দিতেন। ৭০ জনের এই কাফেলাটি এমন এক স্থানে পৌঁছায় যা কিনা একটি কূপের কারণে বি’রে মাউনা নামে প্রসিদ্ধ ছিল। হারাম বিন মিলহান আমের গোত্রের রঈস আবু বারা’আ এর ভাতিজা আমের বিন তোফায়েল ও তাঁর সঙ্গীদের কাছে মহানবী (সা.)-এর দূত হিসেবে ইসলামের বাণী প্রচার করতে শুরু করেন। তাঁরা শুরুতেই কপটতার আশ্রয় নিয়ে তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানায়। আলোচনার এক পর্যায়ে তারা হারাম বিন মিলহানকে পেছন থেকে আক্রমন করে শহীদ করে। শাহাদতের সময় তাঁর মুখে যে বাক্য ছিল তা হল, ‘আল্লাহু আকবার, ফুযতু ওয়া রাব্বিল কা’বা”। অর্থাৎ, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, আমি আমার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে গিয়েছি। আমের বিন তোফায়েল মহানবী (সা.)-এর দূতকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয় নি, বরং বনু আমের গোত্রকে উত্তেজিত করে মুসলমানদের এই নিরস্ত্র ও ছোট্ট দলের ওপর আক্রমণ করে তাদের সবাইকে শহীদ করে। সাহাবীদের মধ্য হতে দু’জন হযরত আমের বিন উমায়ের বিন যাময়ি এবং মুনযির বিন মুহাম্মদ উট বা ঘোড়া চড়ানোর জন্য সেই দল থেকে কিছুটা দূরে ছিলেন। মরুভূমিতে পাখির দল আকাশে উড়তে দেখে তারা বুঝতে পারেন যে, নিশ্চয় সেখানে লড়াই হয়েছে এবং তাৎক্ষণিকভাবে তারা সেখানে ফিরে আসেন এবং কাফিরদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ দেখে নিজেরা পরামর্শ করেন যে, এখন আমাদের কি করা উচিত। একজন পরামর্শ দিলেন আমাদের এখান থেকে মদিনায় ফিরে গিয়ে মহানবী (সা.)-কে সংবাদ দেয়া উচিত। মুনযির (রা.) সেই মতামত গ্রহণ না করে বলেন, আমি এখান থেকে পালিয়ে যাব না। এরপর তিনি সেখানে যান এবং লড়াই করে শাহাদাত বরণ করেন।

দ্বিতীয় সাহাবী হলেন, বনু আসাদ গোত্রের হাতেম বিন আবি বালতাহ। তাঁর বংশ পরিচয় ছিল আবু আব্দুল্লাহ। মহানবী (সা.) হাতেম বিন আবি বালতাহ ও উখায়লা (রা.)-এর মধ্যে ভাতৃত্বের বন্ধন রচনা করেন। হযরত হাতেম বিন আবি বালতাহ (রা.) বদর, উহুদ ও খন্দকের যুদ্ধসহ সকল যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি (রা.) মহানবী (সা.)-এর একজন দক্ষ তীরন্দাজ এবং সর্বোত্তম অশ্বারোহী ছিলেন। উহুদের যুদ্ধে যে ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর মুখে আঘাত করেছিল তাকে হযরত হাতেম (রা.) পরাভূত করে শিরচ্ছেদ করেন এবং তার জিনিসপত্র ও ঘোড়া নিয়ে মহানবী (সা.)-এর সকাশে উপস্থিত হন। মহানবী (সা.) হাতেম (রা.)-কে সেই জিনিসপত্র দিয়ে দেন এবং তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আল্লাহ্‌ তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হোন, আল্লাহ্ তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হোন” মোট দু’বার হুযূরে পাক (সা.) একথা বলেন।

হযরত হাতেম বিন আবি বালতাহ ৩০ হিজরীতে ৬৫ বছর বয়সে মদিনায় ইন্তেকাল করেন। হযরত উসমান (রা.) তাঁর জানাযার নামায পড়ান। মহানবী (সা.) হযরত হাতেম বিন আবি বালতাহ্ (রা.)-এর হাতে মিশরের বাদশাহ্ মকুকাসের নিকট ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত পত্র প্রেরণ করেন। পত্রে তিনি (সা.) লিখেন, “আমি আল্লাহ্‌র নামে আরম্ভ করছি, যিনি অযাচিত-অসীম দাতা ও কর্মের উত্তম প্রতিদানকারী। খোদার বান্দা ও রসূল মোহাম্মদ এর পক্ষ থেকে কিবতিদের নেতা মকুকাসের নামে এই পত্র প্রেরণ করা হচ্ছে। সেই ব্যক্তির ওপর শান্তি বর্ষিত হোক যে সৎপথ গ্রহণ করে। হে মিশরের অধিপতি! আমি আপনাকে সত্যপথ ইসলামের পানে আহ্বান জানাচ্ছি, মুসলমান হয়ে খোদার নিরাপত্তার চাদরে আবৃত হোন, এখন এটিই একমাত্র মুক্তির পথ। আল্লাহ্ তা’লা আপনাকে দ্বিগুণ পুরস্কার দিবেন। কিন্তু যদি আপনি মুখ ফিরিয়ে নেন তাহলে আপনার নিজের ছাড়া কিবতিদের অপরাধও আপনার স্কন্ধে বর্তাবে। হে আহলে কিতাব! সেই বাণীর প্রতি আসুন যা আপনাদের ও আমাদের মাঝে সমান, অর্থাৎ আমরা খোদাকে বাদ দিয়ে অন্য কারো ইবাদত করবো না আর কোনভাবে খোদার সাথে কাউকে শরীক সাব্যস্ত করবো না আর খোদাকে বাদ দিয়ে নিজেদের মধ্য হতে কাউকে গ্রহণ করার মত অন্যায় করবেন না। এরপরও যদি আপনারা মুখ ফিরিয়ে নেন তাহলে স্বাক্ষী থাকুন যে, আমরা তো অবশ্যই এক খোদার প্রতি বিশ্বস্ত ও অনুগত।”

বাদশাহ্ মকুকাস এই পত্র পাঠ করেন এবং মহানবী (সা.)-এর উল্লেখ করে বলেন, “এই ভদ্রলোক যদি সত্যিই আল্লাহ্‌র নবী হয়ে থাকেন তাহলে এই পত্র প্রেরণের পূর্বে আল্লাহ্‌র কাছে এই দোয়া কেন করলেন না, আল্লাহ্ যেন আমার ওপর তাকে প্রাধান্য দান করেন”। হাতেম (রা.) এর উত্তরে বলেন, ‘আপনি যে আপত্তি করছেন তা যদি সঠিক হয় তাহলে এই আপত্তি ঈসা (আ.)-এর ওপরও বর্তায়। তিনিও বিরোধীদের জন্য এ দোয়া করেন নি।’ হাতেম (রা.) মকুকাসকে নসিহত করতে গিয়ে বলেন, আপনি এ পত্রটি নিয়ে আন্তরিকভাবে চিন্তা করুন। এরপর হাতেম (রা.) বাদশাহ্‌র আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর প্রদান করেন। উত্তর শুনে বাদশাহ্ প্রভাবিত হন এবং তাকে সম্বোধন করে বলেন, তুমি নিঃসন্দেহে একজন বুদ্ধিমান মানুষ। এরপর একথা বলে মহানবী (সা.)-এর সত্যায়ন করেন যে, ‘তিনি মন্দ কাজের শিক্ষা দেন নি, আর ভালো কাজ করতে বারণ করেন নি’। এরপর তিনি সেই পত্রটি সম্মানের সাথে একটি বাক্সে রেখে দেন এবং আরবী লিপিকারকে দিয়ে মহানবী (সা.)-এর নিকট উত্তর পত্র প্রেরণ করেন। তাতে তিনি লিখেন, “খোদার নামে আরম্ভ করছি যিনি রহমান ও রহীম। কিবতীদের নেতা মকুকাসের পক্ষ থেকে মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ্ (সা.)-এর নামে এই পত্র প্রেরণ করা হচ্ছে। আপনার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। আমি আপনার পত্র এবং এর মর্ম অনুধাবন করেছি এবং আপনার দাওয়াতের প্রতি অভিনিবেশ করেছি। আমি জানতাম যে, অবশ্যই একজন নবী আবির্ভুত হতে যাচ্ছে্‌ কিন্তু আমি মনে করতাম, তিনি আরবে নয় বরং সিরিয়ায় জন্ম গ্রহণ করবেন। আমি আপনার দূতকে সম্মান করেছি আর আমি তার সাথে উপহার স্বরূপ, দু’জন মেয়ে প্রেরণ করছি, যারা কিবতি জাতীতে খুবই সম্মানিতা। এরা অনেক উচ্চ বংশীয়া এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। এছাড়া আমি কিছু কাপড়ও পাঠাচ্ছি এবং আপনার বাহন হিসেবে খচ্চরও পাঠাচ্ছি। ওয়াসসালাম।”

এ পত্র দ্বারা বুঝা যায় যে, বাদশাহ্ মহানবী (সা.)-এর দাবীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলেও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন নি। হযরত হাতেম (রা.)-এর সঙ্গে উপহারস্বরূপ বাদশাহ্ কিবতি জাতিতে খুবই সম্মানিতা ও উচ্চ বংশীয়া যে দু’জন মেয়ে প্রেরণ করেন তাদের একজনের নাম মারিয়া আর অপরজনের নাম সিরিন। তারা উভয়ে বোন ছিলেন। সে যুগে মিশরে এই রীতি প্রচলিত ছিল। কোন গোত্রের সাথে তারা সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য নিজ গোত্রের সম্ভ্রান্ত মেয়েদের প্রেরণ করতো যাতে তাদের বিয়ে করার কারণে আত্মীয়তা ও মিত্রতার সম্পর্ক গড়ে উঠে। মদিনায় পৌঁছার পর মারিয়া কিবতিয়াকে মহানবী (সা.) বিয়ে করেন এবং তার বোনকে আরবের প্রখ্যাত কবি হাসান বিন সাবেত (রা.)-এর সঙ্গে বিয়ে দেন। নবুয়তের পর একমাত্র এই মহিয়ষী নারী অর্থাৎ, হযরত মারিয়া কিবতিয়া (রা.)-এর গর্ভেই মহানবী (সা.)-এর পুত্র সন্তান ইব্রাহীম জন্য গ্রহণ করেছিলেন।

প্রকাশ থাকে যে, হযরত হাতেম বিন আবি বালতাহ্ (রা.)-এর তবলীগে মদিনায় পৌঁছার পূর্বেই এই দু’জন মহিলা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। আর মকুকাস মহানবী (সা.)-কে যে সাদা রঙের খচ্চরটি প্রেরণ করেছিল তাতে অধিকাংশ সময় তিনি আরোহণ করতেন এমনটি হুনায়নের যুদ্ধেও তিনি এই খচ্চরে চড়েই গিয়েছিলেন।

হুযূর বলেন, হযরত হাতেম (রা.) সম্পর্কে হাদিসে বর্ণিত আছে যে, হাতেম একজন সুদর্শন ব্যক্তি ছিলেন, হালকা শ্মশ্রূ ছিল আর তার হাতের আঙ্গুল ছিল মোটা মোটা। হযরত হাতেম বিন আবি বালতাহ (রা.) মৃত্যুর দিন ৪ হাজার দিরহাম রেখে গিয়েছিলেন। তিনি খাদ্যশস্যের ব্যবসা করতেন। তিনি মহানবী (সা.) প্রিয়ভাজনদের একজন ছিলেন বলে ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়।

কুরায়শদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করতে গিয়ে তিনি মহানবী (সা.)-এর মক্কা অভিযানের সংবাদ প্রেরণ করেছিলেন এক মহিলার হাতে কিন্তু মহানবী (সা.)-কে আল্লাহ্ তা’লা তা পূর্বেই জানিয়ে দেন তাই সেই চিঠি আর মক্কাবাসীদের কাছে পৌঁছেনি। দয়ার সাগর মহানবী (সা.) হযরত হাতেম এর সরল স্বীকারোক্তি এবং মহৎ উদ্দেশ্য অনুধাবন করে তার এই অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন বলে ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়।

খুতবার শেষাংশে হুযূর আনোয়ার (আই.) এই সাহাবীদের পদ-মর্যাদা উন্নীত হওয়ার জন্য আল্লাহ্‌র দরবারে দোয়া করেন। (আমীন)।