শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২০-জুলাই, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২০ জুলাই, ২০১৮ইং লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত খাল্লাদ বিন রাফে (রা.), হযরত হারসা বিন সুরাকা (রা.), হযরত আব্বাদ বিন বিশর (রা.), হযরত কা’ব বিন আশরাফ (রা.), হযরত সাওয়াদ বিন ওয়াযিয়া আনসারী (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, মহানবী (সা.)-এর একজন নিবেদিতপ্রাণ আনসারী সাহাবী ছিলেন হযরত খাল্লাদ বিন রাফে (রা.)। তিনি সেসব সৌভাগ্যবান সাহাবীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যারা বদর ও উহুদ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। বদরের যুদ্ধের সময় তিনি ও তার ভাই রাফে একটি শীর্ণকায় ও দুর্বল উটে আরোহন করে যুদ্ধক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। পথিমধ্যে একস্থানে গিয়ে তাদের উটটি বসে পড়ে এবং দুর্বলতার কারণে আর এগোতে পারছিল না। হযরত রাফে মানত করে দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ্! যদি তুমি এই উটে চড়িয়ে আমাদের মদীনা ফিরিয়ে আন তবে আমরা এটিকে তোমার উদ্দেশ্যে কুরবানী করে দেব।’ সে সময় মহানবী (সা.) তাদের কাছে এসে কী হয়েছে জানতে চাইলে তারা পুরো ঘটনা খুলে বলেন। মহানবী (সা.) ওযু করেন এবং ওযু শেষে বেঁচে যাওয়া পানিতে নিজের মুখের পবিত্র লালা মেশান এবং সেই পানি উটের মুখ, মাথা, ঘাড়, কুঁজ, পিঠ, শরীর এবং লেজ পর্যন্ত ঢেলে দেন, এরপর দোয়া করেন যেন উট তাদেরকে বয়ে নিয়ে যেতে পারে। এর ফলে উট তাদের দু’ভাইকে নিয়ে পুনরায় চলতে আরম্ভ করে আর একস্থানে গিয়ে মহানবী (সা.)-এর সাথে তাদের আবার সাক্ষাত হয়, তখন তাদের উট কাফেলার সবচেয়ে অগ্রভাগে চলছিল। বদরের যুদ্ধ শেষে ফেরার পথে মুসাল্লা নামক স্থানে গিয়ে উটটি আবার বসে পড়ে, তখন খাল্লাদ (রা.) সেটি জবাই করে এর মাংস বিতরণ করে দেন এবং এভাবে তারা নিজেদের মানত পূর্ণ করেন।

আরেকজন সাহাবী হলেন, হযরত হারসা বিন সুরাকা (রা.)। দ্বিতীয় হিজরীতে হাব্বান বিন আরেকার হাতে তিনি বদরের যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন। তার মা রুবাইয়া বিনতে নযর হযরত আনাস বিন মালেকের ফুফু ছিলেন। হযরত হারসা হিজরতের পূর্বেই তাঁর মায়ের সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি মায়ের প্রতি অত্যন্ত সদয় ও সদ্ব্যবহারকারী ছিলেন; স্বয়ং মহানবী (সা.) তার ব্যাপারে বলেছিলেন, ‘আমি জান্নাতে প্রবেশ করে হারসাকে সেখানে দেখতে পেয়েছি।’ তিনি (রা.) যখন কূপ থেকে পানি পান করছিলেন তখন হাব্বান বিন আরেকা তাকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করে যা তার ঘাড়ে এসে বিঁধে এবং এতেই তিনি শহীদ হন।

হযরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, বদরের যুদ্ধে যাবার পথে হারসা মহানবী (সা.)-এর কাছে আসলে তিনি (সা.) তার অবস্থা জানতে চান। জবাবে হারসা আল্লাহ্ তা’লার প্রতি তার দৃঢ় বিশ্বাস থাকার কথা বলেন; তিনি বলেন, ‘আমার মন পৃথিবী থেকে উঠে গেছে। আমি রাত জেগে ইবাদত করি এবং দিনভর রোযা থাকি; আমি যেন খালি চোখেই আল্লাহ্‌র আরশ দেখতে পাচ্ছি, খালি চোখেই জান্নাতবাসীদের ও জাহান্নামীদের দেখতে পাচ্ছি।’ মহানবী (সা.) তাকে ঈমানের এরূপ অবস্থা ধরে রাখতে বলেন ও তার প্রশংসা করেন। হযরত হারসা তখন রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কাছে শাহাদাতের সৌভাগ্য লাভের জন্য দোয়ার আবেদন করেন। মহানবী (সা.) দোয়া করেন এবং তা গৃহীত হয়। তার শাহাদাতের পর তার মমতাময়ী মা মহানবী (সা.)-এর কাছে এসে নিবেদন করেন, ‘আপনি তো জানেন হারসাকে আমি কতটা ভালোবাসতাম, কারণ সে আমার অনেক সেবাযত্ন করত। যদি সে জান্নাত লাভ করে থাকে তবে আমি ধৈর্য ধরতে পারব, যদি তা না হয় তবে আল্লাহ্ই জানেন আমি কী করব!’ মহানবী (সা.) বলেন, ‘জান্নাত তো একটি নয়, অনেকগুলো জান্নাত। কিন্তু হারসা তো জান্নাতের সর্বোচ্চ স্তর ফেরদৌসে রয়েছে!’ একথা শুনে তার মা হাসি মুখে ফিরে যান আর বলেন, হে হারসা কতইনা আনন্দের কথা, ‘আমি অবশ্যই ধৈর্য ধরব।’

আরেকজন আনসারী সাহাবী হলেন, হযরত আব্বাদ বিন বিশর (রা.)। ১১শ হিজরীতে ইয়ামামার যুদ্ধে তিনি মাত্র ৪৫ বছর বয়সে শাহাদত বরণ করেন। তিনি বনু আব্দুল আশয়াল গোত্রের লোক ছিলেন। মদীনাতে হযরত মুসআব বিন উমায়েরের কাছে ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত আব্বাদ বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর সঙ্গী ছিলেন। তিনি সেই বিশেষ সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যারা ইহুদী নেতা কা’ব বিন আশরাফকে হত্যার দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

এরপর হুযূর (আই.) ইতিহাসের আলোকে কা’ব বিন আশরাফের ব্যাপারে বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন। সে যদিও জন্মগতভাবে ইহুদী ছিল না বরং আরব ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও বিভিন্ন কারণে সে ইহুদীদের সবচেয়ে বড় নেতা বলে গণ্য হতো। জাগতিকভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী, সম্পদশালী, সুদর্শন ও সুকবি ছিল, কিন্তু চারিত্রিকভাবে অত্যন্ত নোংরা স্বভাবের ছিল। সে গোপন ষড়যন্ত্র ও কূটচালে অভ্যস্ত ছিল। বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় সে একেবারেই মেনে নিতে পারে নি। সে ইসলামকে ধ্বংস ও বিনাশ করার জন্য ষড়যন্ত্র করতে থাকে এবং উঠেপড়ে লাগে। সে সংগোপনে কুরাইশদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ বা প্ররোচিত করতো, এছাড়া আরবের অন্যান্য গোত্রকেও উস্কানি দিতো; মুসলমান নারীদের নামে অত্যন্ত মন্দ ও চরম অশালীন অপলাপ করতো সে তার কবিতায়। এমনকি সে মহানবী (সা.)-কে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে কতিপয় ইহুদী যুবক দ্বারা হত্যা করানোর ষড়যন্ত্রও করেছিল, যদিও তার এই ষড়যন্ত্রে সফল হয় নি। যেহেতু সে মদীনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী আচরণ ও ষড়যন্ত্র করে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছিল, এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, রাষ্ট্রদ্রোহ, যুদ্ধের উস্কানি, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, অশ্লীলতা ছড়ানো এবং হত্যাচেষ্টার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছিল, সেহেতু মহানবী (সা.) যৌক্তিকভাবে মদীনা রাষ্ট্রের স্বার্থে রাষ্ট্রপ্রধাণের অবস্থান থেকে এই সিদ্ধান্ত দেন যে, কা’ব বিন আশরাফ একজন হত্যাযোগ্য অপরাধী। কিন্তু যেহেতু কা’ব তখন মদীনার ভেতর এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল যে, যদি তাকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হতো বা হত্যার নির্দেশ দেওয়া হতো, তাহলে মদীনাতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যেতো এবং ভয়াবহ রক্তপাত ঘটার আশংকা ছিল, তাই শান্তির খাতিরেই মহানবী (সা.) তাকে সুযোগমত হত্যার জন্য কয়েকজন সাহাবীকে দায়িত্ব প্রদান করেন, যাদের নেতৃত্বে ছিলেন আওস গোত্রের নিষ্ঠাবান সাহাবী মুহাম্মদ বিন মাসলামা। যাহোক, তারা পরিকল্পনা করে এই কাজ সমাধা করেন। পরের দিন এই বিষয়টি নিয়ে ইহুদীদের একটি প্রতিনিধিদল মহানবী (সা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসে এবং বলে, আমাদের নেতা কা’ব বিন আশরাফকে গোপনে হত্যা করা হয়েছে। তখন মহানবী (সা.) তার বিরুদ্ধে প্রমাণিত অপরাধগুলোর কথা তাদের স্মরণ করিয়ে দিলে তারা নিরব হয়ে যায়। মহানবী (সা.) তখন তাদেরকে ভবিষ্যতে মদীনার শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে নতুন করে শান্তি চুক্তির কথা বলেন এবং নতুন চুক্তিপত্র সম্পাদিত হয়। মহানবী (সা.) হত্যার দায় অস্বীকার করেন নি, বরং কা’বের অপরাধগুলো স্মরণ করিয়ে দিয়ে তার স্বাভাবিক শাস্তির কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন; আর ইহুদিরাও তাতে দ্বিমত করতে পারে নি, নতুবা তারা নতুন করে চুক্তি-ই বা কেন করল-যাতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে? তাদের আচরণ একথা প্রমাণ করে যে, তখনকার প্রচলিত ব্যবস্থায় এমনটি করাই স্বাভাবিক ও যুক্তিযুক্ত ছিল।

হুযূর (আই.) বলেন, বর্তমান সময়ের চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো এবং কোন কোন সরকারও এই ঘটনাকে দলিল হিসেবে মনে করে এবং এ যুগেও এসব কর্মকাণ্ডকে সঠিক বলে সাব্যস্ত করতে চায়। প্রথম কথা হল, কা’ব বিন আশরাফের মত এমন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা এ যুগে সম্ভব নয়; দ্বিতীয়ত সেখানে কেবল অপরাধীকেই শাস্তি দেয়া হয়েছিল, তার পরিবারসহ অন্যদেরকে নয়, যেমনটি এ যুগের চরমপন্থীরা করে থাকে।

হযরত আব্বাদের ধার্মিকতার অনেক ঘটনা রয়েছে। হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় যখন মহানবী (সা.) ওমরা করার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন, তখন পথে আব্বাদ (রা.)-এর নেতৃত্বে একটি অগ্রগামী দল পাঠিয়েছিলেন যেন কুরায়েশদের গতিবিধি আগাম জানা যায়। তিনি মহানবী (সা.)-এর নিকট অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত একজন সাহাবী ছিলেন। মহানবী (সা.) তাকে বিভিন্ন স্থানে সদকা আদায়ের জন্য প্রেরণ করতেন এমনকি ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, হুনায়েনের যুদ্ধলব্ধ সম্পদের আমেল বা নিগরাণও তাকে নিযুক্ত করেছিলেন। এমনকি তাবুকের যুদ্ধেও মহানবী (সা.) তার ওপর নিজের পাহাড়ার দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন।

হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন, হযরত আব্বাদ বিন বিশর (রা.) আমাকে বলেন, হে আবু সাঈদ! আমি রাতে স্বপ্নে দেখেছি, আকাশ আমার জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে এরপর আবার ঢেকে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, এর অর্থ হল, আমি শাহাদতের সৌভাগ্য লাভ করবো। ইয়ামামার যুদ্ধে তিনি চারশ’ জন আনসারী সাহাবীকে নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং সম্মুখে সমরে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন এবং শাহাদতের অমীয় সূধা পান করে অমরত্ব লাভ করেন।

এরপর হুযূর বনু আদি বিন নাজ্জার গোত্রের আরেকজন আনসারী সাহাবী হযরত সাওয়াদ বিন ওয়াযিয়া (রা.)-এর স্মৃতিচারণ করেন। তিনিও বদর, উহুদ, খন্দকসহ অন্যান্য যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। বদরের যুদ্ধের দিনের একটি ঘটনা থেকে রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর প্রতি তার পরম ভালোবাসার পরিচয় পাওয়া যায়। মহানবী (সা.) ভোরবেলা যখন যুদ্ধের জন্য সাহাবীদের সারিবদ্ধ করছিলেন, তখন একটি তীর দিয়ে ইশারায় নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। হযরত সাওয়াদ লাইন থেকে কিছুটা এগিয়ে ছিলেন, মহানবী (সা.) তাকে এক লাইনে থাকার জন্য ইশারা করতে গেলে তীরের ফলা তার শরীরে লাগে। আশ্চর্যজনকভাবে সাওয়াদ (রা.) তখন খুব দুঃসাহসের বলে বসেন, তিনি মহানবী (সা.)-এর কাছ থেকে এখনি এর প্রতিশোধ নিতে চান। সাহাবীরা তার এহেন আচরণে খুবই আশ্চর্য হন, কিন্তু মহানবী (সা.) নম্রভাবে তার দাবী পূরণ করেন ও নিজের বুক থেকে কাপড় সরিয়ে তাকে তীর দ্বারা আঘাত করতে বলেন। তখন সাওয়াদ এগিয়ে গিয়ে তাঁর বুকে চুম্বন করেন এবং কান্নাজড়ানো কন্ঠে বলেন, শত্রু সামনে দাঁড়িয়ে, জানি না বেঁচে ফিরব কি-না; তাই আমি চাচ্ছিলাম এর আগেই একবার আপনার শরীর স্পর্শ করে নিজেকে আপনার পরশধন্য করি। এই ছিল মহানবী (সা.)-এর প্রতি সাহাবীদের ভালোবাসা এবং গভীর অনুরাগ।

সবশেষে হুযূর (আই.) দোয়া করে বলেন, আল্লাহ্ তা’লা এসব উজ্জ্বল তারকার মর্যাদা ক্রমাগত বৃদ্ধি করতে থাকুন, আর আমাদেরকেও রসূলপ্রেমের মাহাত্ম্য অনুধাবনের সৌভাগ্য দান করুন, আমীন।