শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৬-জুলাই, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৬ জুলাই, ২০১৮ইং লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত সুবাই বিন কায়েস বিন আয়শা (রা.), হযরত উনায়স বিন কাতাদা (রা.), হযরত মুলায়ল বিন ওয়াবারা (রা.), হযরত নওফেল বিন আব্দুল্লাহ্ বিন নাযলাহ (রা.), হযরত ওয়াদিয়া বিন আমর (রা.), হযরত ইয়াযিদ বিন মুনযের (রা.), হযরত খারজাহ বিন হুমাইয়ার (রা.), হযরত সুরাকা বিন আমর (রা.), হযরত আব্বাদ বিন কায়েস (রা.), হযরত আবু যাইয়াহ বিন সাবেত বিন নুমান (রা.), হযরত আবু কাবশা সুলায়ম (রা.), হযরত মারসাদ বিন আবু মারসাদ (রা.), হযরত আবু মারসাদ (রা.), হযরত সালিত বিন কায়েস বিন আমর (রা.), হযরত মুজাযের বিন যিয়াদ (রা.), হযরত উবাব বিন মুনযের (রা.), হযরত হুবাব বিন মুনযের (রা.), হযরত রিফাআ বিন রাফে বিন মালেক (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, ইদানিং আমি বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীদের স্মৃতিচারণ করছি। ইতিহাস ও বর্ণনাসমূহে কতক সাহাবীর বিবরণ ও জীবনালেখ্য বেশ বিস্তারিত পাওয়া যায়, কিন্তু এমন অনেক সাহাবীও রয়েছেন যাদের অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাওয়া যায়। বদরের যুদ্ধে অংশ নেয়ার কারণে তাদের এই মর্যাদা রয়েছে যে যদি কয়েক লাইনের বর্ণনাও থাকে তবে তা-ই যেন উল্লেখ করা হয়। আজকে যাদের বর্ণনা করা হবে তাদের মধ্যে অনেকেই এমন যাদের সম্পর্কে খুব অল্প বর্ণনা পাওয়া যায়। অতঃপর হুযূর (আই.) স্মৃতিচারণ শুরু করেন। হুযূর আজ প্রথম যে সাহাবীর স্মৃতিচারণ করেন তার নাম সুবাই বিন কায়েস বিন আয়শা (রা.), তিনি আনসারী সাহাবী ছিলেন এবং খাযরাজ বংশের লোক ছিলেন। বদর ও উহুদের যুদ্ধে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। উবাদা বিন কায়েস ও যায়েদ বিন কায়েস তার ভাই ছিলেন। দ্বিতীয় সাহাবীর নাম উনায়স বিন কাতাদা (রা.), উহুদের যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। তার তখন পর্যন্ত কোন সন্তানাদি হয় নি। এরপর হুযূর হযরত মুলায়ল বিন ওয়াবারা (রা.)-এর উল্লেখ করেন, খাযরাজ বংশের বনু আজলান গোত্রের লোক ছিলেন। বদর ও উহুদের যুদ্ধে তিনি অংশ নেন, আরেকটি বর্ণনানুসারে তিনি মহানবী (সা.)-এর সাথে সকল যুদ্ধেই অংশ নিয়েছিলেন। পরবর্তী সাহাবী হলেন হযরত নওফেল বিন আব্দুল্লাহ্ বিন নাযলাহ (রা.), তিনি বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, উহুদের যুদ্ধে শহীদ হন। এরপর হুযূর হযরত ওয়াদিয়া বিন আমর (রা.)-এর উল্লেখ করেন, তিনি বনু জুনাইহার সদস্য ছিলেন, যা বনু নাজ্জার গোত্রের মিত্র ছিল। তিনি বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নেন। এরপরে হুযূর হযরত ইয়াযিদ বিন মুনযের (রা.)-এর উল্লেখ করেন, যিনি খাযরাজ বংশের লোক ছিলেন এবং উকবার বয়আতে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এরপর হুযূর হযরত খারজাহ বিন হুমাইয়ার (রা.)-এর উল্লেখ করেন, তিনি আশজাহ গোত্রের সদস্য ছিলেন। তার ভাইয়ের নাম আব্দুল্লাহ্ বিন হুমাইয়ার (রা.) তার সাথেই বদরের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। পরের সাহাবী হলেন হযরত সুরাকা বিন আমর (রা.), তিনি ৮ম হিজরিতে মূতার যুদ্ধে শহীদ হন। তিনি সম্ভ্রান্ত বনু নাজ্জার গোত্রের সদস্য ছিলেন। তিনি বদর, উহুদ, খন্দক ও খায়বারের যুদ্ধে অংশ নেন, হুদাইবিয়াতে বয়আতে রিযওয়ানে অংশ নেয়ার সৌভাগ্যও হয়েছিল। আরেকজন সাহাবী হলেন হযরত আব্বাদ বিন কায়েস (রা.), তিনি হযরত আবু দারদা (রা.)-এর চাচা ছিলেন, তিনিও বদর, উহুদ, খন্দক ও খায়বারের যুদ্ধে ও হুদাইবিয়ার সন্ধিতে মহানবী (সা.)-এর সঙ্গী ছিলেন, তিনি মূতার যুদ্ধে শহীদ হন। আরেকজন সাহাবী হযরত আবু যাইয়াহ বিন সাবেত বিন নুমান (রা.), তিনি বদর, উহুদ ও খন্দকের যুদ্ধে অংশ নেন এবং খায়বারের যুদ্ধে শহীদ হন। আরেকজন সাহাবী হযরত আনাসা (রা.); তিনি বদরের যুদ্ধে শহীদ হন, তবে কারও কারও মতে তিনি হযরত আবু বকরের যুগ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। ইসলামের প্রথম যুগেই মুসলমান হন, মদীনায় হিজরত করেন এবং সর্বদা মহানবী (সা.)-এর সেবায় উৎসর্গীকৃত ছিলেন; তিনিও বদরের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। পরবর্তী সাহাবী হলেন হযরত আবু কাবশা সুলায়ম (রা.), মহানবী (সা.)-এর স্বাধীনকৃত ফার্সী দাস ছিলেন, প্রথম যুগের মুসলমান ছিলেন। তিনি বদরের যুদ্ধসহ সকল যুদ্ধেই মহানবী (সা.)-এর সঙ্গী ছিলেন। তিনি হযরত উমর (রা.) খলীফা হবার প্রথম দিনই মৃত্যুবরণ করেন। এরপর হলেন হযরত মারসাদ বিন আবু মারসাদ (রা.), হযরত হামযা (রা.)-এর মিত্র ছিলেন, বদরের যুদ্ধে নিজ পিতার সাথে অংশ নিয়েছিলেন। ৩য় হিজরিতে রাজঈ’ নামক স্থানে বনু আযল ও কারা গোত্রের বিশ্বাসঘাতকতার যে কুখ্যাত ঘটনা ঘটেছিল, সেই ঘটনায় তিনি শহীদ হন। এরপর হুযূর তার পিতা হযরত আবু মারসাদ (রা.)-এর স্মৃতিচারণ করেন। তিনি ও তার পুত্র উভয়েই প্রথম দিকের মুসলমান ছিলেন। পিতা-পুত্র একসাথে মদীনায় হিজরত করেছিলেন। হযরত আবু বকর (রা.)-এর খেলাফতকালে মৃত্যুবরণ করেন। আরেকজন সাহাবী ছিলেন হযরত সালিত বিন কায়েস বিন আমর (রা.)। তিনি এবং হযরত আবু সালমা (রা.) ইসলাম গ্রহণের পর বনু আদী বিন নাজ্জারের দেবতার মূর্তি ভেঙে দিয়েছিলেন। তিনি বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর সাথে ছিলেন; হযরত উমর (রা.)-এর খেলাফতকালে জিসরের যুদ্ধে শহীদ হন। আরেকজন সাহাবী হযরত মুজাযের বিন যিয়াদ (রা.), বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নেন এবং উহুদের যুদ্ধে শহীদ হন। এরপর হুযূর হযরত হুবাব বিন মুনযের (রা.)-এর স্মৃতিচারণ করেন, তিনি বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর সঙ্গী ছিলেন। হযরত হুবাব (রা.) সেই সাহাবী যিনি বদরের যুদ্ধের সময় মহানবী (সা.)-কে শিবির স্থাপনের ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছিলেন যেন আরও এগিয়ে গিয়ে কুরায়শ শিবিরের নিকটতম ঝর্ণার কাছে গিয়ে শিবির স্থাপন করা হয়; মহানবী (সা.) সেই পরামর্শ সানন্দে গ্রহণ করেন, হযরত জিব্রাঈলও এসে বলেন যে হুবাবের সিদ্ধান্ত সঠিক। তিনি বদরের যুদ্ধে খাযরাজ গোত্রের পতাকাবাহী ছিলেন। হযরত জিব্রাঈল (আ.) যখন রসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে আরও কিছুদিন পৃথিবীতে থাকা বা আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জান্নাতে যাওয়া- এ দু’টোর মধ্যে একটি বেছে নেয়ার কথা জানান তখন রসূলুল্লাহ্ (সা.) সব সাহাবীর কাছ থেকে পরামর্শ চান। সবাই তাঁকে (সা.) প্রথমটি বেছে নেয়ার জন্য বলেন। তখন রসূলুল্লাহ্ (সা.) নিরবে বসে থাকা হুবাবের কাছে পরামর্শ চান; হুবাব বলেন, ‘হে আল্লাহ্‌র রসূল! আপনার প্রভু-প্রতিপালক আপনার জন্য যা পছন্দ করেছেন তা-ই গ্রহণ করুন।’ মহানবী (সা.) এই পরামর্শ পছন্দ করলেন। হযরত হুবাব হযরত উমর (রা.)-এর যুগে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর হুযূর হযরত রিফাআ বিন রাফে বিন মালেক (রা.)-এর উল্লেখ করেন। তিনি আনসারী ছিলেন, উকবার বয়আতে শামিল ছিলেন। বদর, উহুদ, খন্দক, বয়আতে রিযওয়ানসহ সকল যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর সাথী ছিলেন। জামাল ও সিফফীনের যুদ্ধে হযরত আলী (রা.)-এর সঙ্গী ছিলেন, আমীর মুয়াবিয়ার যুগের শুরুর দিকে মৃত্যুবরণ করেন।

হুযূর বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ফেরেশতাদের সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে মালাইকাতুল্লাহ্ বা ফেরেশতাদের যুদ্ধের পন্থা ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন, যার সারসংক্ষেপ হল- ফেরেশতাদের যুদ্ধ মানুষের মত ঢাল-তলোয়ার দ্বারা নয়, বরং যুদ্ধের ফলাফল ইত্যাদি সবকিছু মুসলমানদের পক্ষে ঘটানো হল ফেরেশতাদের কর্মকাণ্ড। খুতবার শেষদিকে হুযূর (আই.) বিগত খুতবার আলোকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্পষ্ট করেন। হযরত আম্মার (রা.)-এর মৃত্যুতে হযরত আমর বিন আস (রা.) বিচলিত হয়েছিলেন যে রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে বিদ্রোহীরা তার হত্যাকারী হবে। এত্থেকে বোঝা যায় হযরত আমর বিন আস বিদ্রোহীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, আবার আমীর মুয়াবিয়াও বিদ্রোহী ছিলেন। এতদসত্ত্বেও তাদেরকে কেন সম্মানের সাথে স্মরণ করা হয়? এর জবাবে হুযূর বলেন, প্রথম কথা হল, সাহাবীদের যে পদমর্যাদা রয়েছে, তাতে এই মন্তব্য করা সম্ভব নয় যে অমুক ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে আর অমুক হবে না। তাদের মধ্যে যে মতবিরোধ বা ভুল বোঝাবুঝি ছিল, তার হিসাব আল্লাহ্‌র কাছে। সেই যুগের মুসলমানদের মধ্যেও এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা ছিল, রসূল (সা.)-এর সাহাবীদের মাঝে কেন এই মতবিরোধ; আর এজন্য তারা দোয়াও করতেন। সেরকম একটি বর্ণনা পাওয়া যায়, আব্দুল্লাহ্ বিন মাসউদের এক শিষ্য স্বপ্নে হযরত আম্মার ও আরও কয়েকজন সাহাবীকে একইসাথে জান্নাতে দেখে আশ্চর্য হন যে এরা তো পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন। তাকে জবাব দেয়া হয়, তারা আল্লাহ্‌কে মহাক্ষমার অধিকারী পেয়েছেন, তাই তারা একত্রে জান্নাতে রয়েছেন। মোটকথা, আমাদের এসব ঘটনা থেকে ঐক্যবদ্ধ থাকার শিক্ষা নিতে হবে এবং নিজেদের মাঝে অনৈক্য সৃষ্টি হতে দেয়া যাবে না। আমীর মুয়াবিয়া সম্পর্কে এটিও জানা যায়, হযরত আলী ও মুয়াবিয়ার মতবিরোধের সুযোগে খ্রিস্টান সম্রাট হামলা করার পরিকল্পনা করলে মুয়াবিয়া তাকে খবর পাঠান, যদি এরকম কিছু সে করে তবে মুয়াবিয়া স্বয়ং আলীর পতাকাতলে লড়াইকারী প্রথম সেনাপতি হবেন। হুযূর দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে সর্বদা ঐক্যবদ্ধ থাকার ও পুণ্যে অগ্রসরমান হবার তৌফিক দান করুন। আমীন।