কতিপয় গুরুত্বপুর্ণ দোয়া

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৫-জুন, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১৫ জুন, ২০১৮ইং লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় একাধারে কুরআনে বর্ণিত বিভিন্ন দোয়া এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-কৃত অনেক দোয়া করেন এবং সবাইকে দোয়ায় অংশ নিতে বলেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, মহানবী (সা.) জুমুআর গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে একবার বলেন, সেদিন এমন একটি মুহূর্ত আসে যদি তখন একজন মুসলমান নামাযরত থাকে আর তখন সে যে দোয়াই করে তা গ্রহণ করা হয়, কিংবা তখন সে যে কল্যাণ ও মঙ্গলই কামনা করে আল্লাহ্ তাকে তা দান করেন। অনেকে এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, জুমুআর খুতবাও নামাযের অংশ, তাই এটিও সেই বিশেষ সময়ের অন্তর্ভুক্ত যার সম্পর্কে মহানবী (সা.) এই মন্তব্য করেছেন। মোটকথা, জুমুআর দিনের একটি বিশেষ গুরুত্ব বা তাৎপর্য রয়েছে, আর একান্ত অপারগতা ছাড়া প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ-সবল মুসলমানের জন্য জুমুআর নামায পড়া আবশ্যক।

হুযূর (আই.) বলেন, নামাযে প্রত্যেকে নিজ নিজ চিন্তানুসারে ও প্রয়োজন অনুসারে দোয়া করে থাকে; আবার কতক এমনও আছে যারা নামায পড়ে ঠিকই কিন্তু দোয়ার জন্য বিশেষ ভাবাবেগ তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় না। বাহ্যত নামায পড়ে আর মনে করে, বুলিসর্বস্ব নামায পড়াই যথেষ্ট; এর ফলে দোয়ার গুরুত্ব কী তা তারা বুঝতে পারে না। তাই আজ রমযানের এই শেষ জুমুআয় আমি ভাবলাম কিছু দোয়া পড়ব যেন যাদের এদিকে মনোযোগ কম তারা বুঝতে পারে দোয়া কী; আর সমবেতভাবে আমরা নিজেদের দোয়া ও প্রার্থনা আল্লাহ্‌র দরবারে উপস্থাপন করি, আর এরপর নামাযেও সমবেতভাবে এসব দোয়া কবুল হওয়ার জন্য দোয়া করি।

হুযূর বলেন, এসব দোয়ার কতেক আমি কুরআন বর্ণিত বিভিন্ন দোয়া থেকে নিয়েছি, মহানবী (সা.)-এর কিছু দোয়া রয়েছে, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর কতিপয় দোয়াও এর মধ্যে রয়েছে আর কিছু সাধারণ দোয়াও রয়েছে। হুযূর বলেন, কুরআনের ও মসনূন যে দোয়াগুলো পড়ব, আপনারা পারলে আমার সাথে মনে মনে সেগুলো পড়বেন, আর মনে মনে প্রত্যেক দোয়ার পর আমীনও বলতে থাকবেন। আল্লাহ্ তা’লা আমাদের সকল দোয়া কবুল করুন (আমীন)। এরপর হুযূর (আই.) আল্লাহ্ তা’লার প্রশংসা ও দরূদ পাঠের পর একনাগাড়ে বিভিন্ন কুরআনী দোয়া পড়তে থাকেন, অতঃপর হুযূর হাদীস থেকে মহানবী (সা.) কয়েকটি মসনূন দোয়া পড়েন, তারপর হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর কতিপয় দোয়াও পড়েন যা তিনি বিভিন্ন সময় তাঁর সাহাবীদের উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন। আর সবশেষে কয়েকটি সাধারণ দোয়াও পাঠ করে। হুযুরের সাথে সাথে মসজিদে উপবিষ্ট মুসল্লীগণ আমীন বলতে থাকেন।

হুযূর আনোয়ার (আই.) যেসব দোয়া করেন তারমধ্যে আল্লাহ্‌র কাছে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ যাচনা। আগুনের শাস্তি থেকে মুক্তি প্রার্থনা। জ্ঞানে সমৃদ্ধি। সত্য ও মিথ্যার মাঝে সুস্পষ্ট পার্থক্য নির্ণয়, শত্রুদের অনিষ্ট থেকে নিরাপত্তা লাভ, নিজেদের অন্যায়-অপরাধ স্বীকার করে খোদার দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা আর নিজেদের অযোগ্যতা ও দুবর্লতা স্বীকার করে খোদার রহমত লাভ, মুসলমানদের বিবেক-বুদ্ধি লাভ ও চৈতন্যদয় আর মুসলিম বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য বিশেষভাবে দোয়া করেন।

হুযূর বলেন, সাধারণভাবে ইসলামী বিশ্বকে আমাদের দোয়ায় স্মরণ রাখা উচিত, আল্লাহ্ তা’লা তাদের মাঝে ঐক্য সৃষ্টি করুন, তাদের মধ্যে যে মনোমালিন্য ও বিভক্তি রয়েছে তা দূরীভূত হোক, তাদের পারষ্পরিক শত্রুতার অবসান ঘটুক, আর তাদের আভ্যন্তরীণ শত্রুতার সুযোগে অমুসলমান শক্তি নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করছে, আল্লাহ্ তা’লা তাদের হাতকে প্রতিহত করুন এবং তারা ইসলামের কোনরূপ ক্ষতিসাধন করা থেকে নিবৃত্ত হোক। আল্লাহ্ তা’লা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল আহমদীর মাঝে স্বল্পে-তুষ্টি সৃষ্টি করুন, তাদেরকে সর্বপ্রকার অকল্যাণ থেকে রক্ষা করুন, তাদেরকে দৃঢ়চিত্ততা দান করুন, তারা সর্বদা জামাতের ব্যবস্থাপনা ও খিলাফতের রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে রাখুক। আল্লাহ্ তা’লা জামাতের ব্যবস্থাপনাকেও মানুষের প্রাপ্য অধিকার প্রদানের তৌফিক দান করুন, কর্মকর্তাদেরকে নিজ নিজ দায়িত্ব অনুধাবনের তৌফিক দান করুন। ওয়াক্‌ফে যিন্দেগীদেরকে ওয়াক্ফের প্রকৃত স্পৃহার সাথে ধর্মের সেবা করার তৌফিক দান করুন। আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে দাজ্জালের নৈরাজ্য ও অনিষ্ট থেকে নিরাপদ রাখুন। আল্লাহ্ তা’লা সেসব শক্তি যারা মুসলমানদের দুর্বল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তাদের হাতকে প্রতিহত করুন এবং মুসলমানদেরকে তাদের ক্ষতি থেকে রক্ষা করুন। আসলে তাদের কর্মকান্ডে কেবল মুসলিম বিশ্বেই নয়, বরং সমগ্র বিশ্বে এক মহা ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি হতে পারে; আল্লাহ্ তা’লা সেই ধ্বংস থেকে বিশ্ববাসীকে রক্ষা করুন। আল্লাহ্ তা’লা আহমদী শহীদদের পদমর্যাদা উন্নত করুন আর তাঁদের উত্তরসূরীদের স্বয়ং নিরাপত্তা বিধান করুন, আল্লাহ্‌র পথে বন্দীদের দ্রুত মুক্তির উপায় সৃষ্টি করুন। যারা কোন না কোনভাবে বিপদে জর্জরিত আল্লাহ্ তা’লা তাদের বিপদমুক্ত করুন, অসুস্থদের পূর্ণ আরোগ্য দান করুন। যারা রাজনৈতিকভাবে বা ধর্মীয় কারণে কোন বিপদে নিপতিত আছেন, বিশেষভাবে জামাতের সদস্যরা যারা বিভিন্ন দেশে এমন বিপদ কবলিত, তাদের বিপদ দূর করুন এবং শত্রুদের হাতকে রুখে দিন। কাদিয়ানের দরবেশগণ, কাদিয়ানে বসবাসরত অন্যান্য বিপদগ্রস্তগণ, পাকিস্তানের বাসিন্দাগণ ও বিশেষভাবে রাবওয়া নিবাসীগণ- যাদের জীবন চলার পথ সরকারের পক্ষ থেকে সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর করা হচ্ছে, আল্লাহ্ তা’লা তাদেরকে অত্যাচারীদের হাত থেকে মুক্তি দিন এবং পরিস্থিতি অনুকূল করে দিন; একইভাবে ভারতেও বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ স্থানে আহমদীদের ওপর অত্যাচার চালানো হচ্ছে, আল্লাহ্ তা’লা অত্যাচারীদেরকে নিবৃত্ত করুন; অনুরূপভাবে ইন্দোনেশিয়াতেও যেখানেই তারা সুযোগ পায় আহমদীদের ওপর নির্যাতন চালায়, কয়েকদিন পূর্বে এমনই একটি স্থানে যেখানে অল্প কিছু আহমদী ছিলেন, তাদেরকে তাদের বাড়ীঘর থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে আর তারা গৃহহীন অবস্থায় দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে, আল্লাহ্ তা’লা তাদেরকে নিজ নিরাপত্তা বেষ্টনীতে আবদ্ধ রাখুন এবং শত্রুদের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করুন। মুসলমানরা যারা নিজেদের মাঝে মতবিরোধ ও ভেদাভেদের কারণে প্রাণঘাতি যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে তাদেরকে আল্লাহ্ তা’লা সুবুদ্ধি দিন, তারা যে নবীর (সা.) উম্মত সেই নবীর প্রকৃত আদর্শ ও শিক্ষা তাদেরকে মানার তৌফিক দিন, আর আল্লাহ্‌র প্রেরিত মসীহ্ ও মাহ্‌দীকে মানার সৌভাগ্য দিন যেন তারা তাঁকে মেনে ভুল পথে পরিচালিত হওয়া থেকে রক্ষা পায়। আল্লাহ্ তা’লা সেসব ব্যক্তির ধন-সম্পদ ও জনবলে অশেষ বরকত দিন যারা ধর্মসেবার মানসে বিভিন্ন খাতে আর্থিক কুরবানী করছেন। তেমনিভাবে যেসব কর্মী তবলীগের কাজ করছে, বিশেষভাবে এমটিএ তবলীগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, এমটিএ’র সকল কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদেরকে আল্লাহ্ তা’লা উত্তম প্রতিদান দিন আর আগের চেয়ে আরো বেশি তাদেরকে সেবা করার তৌফিক দান করুন। এমটিএ আফ্রিকাও তবলীগের ক্ষেত্রে খুব ভালো কাজ করছে; স্থানীয় পর্যায়েই সব কাজ করা হচ্ছে; আল্লাহ্ তা’লা তাদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ করুন যাতে তারা আরও উন্নত অনুষ্ঠান তৈরির মাধ্যমে নিজ জাতি ও বিশ্বের দরবারে আহমদীয়াতের সংবাদ পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়। আমীন।