শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ
হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.)
০১-জুন, ২০১৮
মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য
ডাউনলোড
জুমুআর খুতবার সারমর্ম
এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।
আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১লা জুন, ২০১৮ইং লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত উকাশা বিন মিহসান (রা.), হযরত খারেজা বিন যায়েদ (রা.), হযরত মুয়াত্তেব বিন উবায়েদ (রা.), হযরত খালেদ বিন বুকায়ের (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।
হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, মহানবী (সা.)-এর একজন সাহাবীর নাম উকাশা বিন মিহসান (রা.), তিনি বিশেষ সাহাবীদের মধ্যে গণ্য হতেন। তিনি বদরের যুদ্ধে ঘোড়ায় চড়ে অংশ নিয়েছিলেন। যুদ্ধে তার তরবারী ভেঙে গেলে মহানবী (সা.) তাকে একটি কাঠের তরাবারী দেন, আর এটিই যেন তার হাতে ক্ষুরধার তরবারীতে পরিণত হয়। তিনি পরবর্তীতে মহানবী (সা.)-এর সাথে সকল যুদ্ধে এটি নিয়েই অংশ নেন, আমৃত্যু এটি তার কাছে ছিল; এই কাঠের তরবারীর নাম ছিল ‘আওন’। মহানবী (সা.) তাকে বিনা হিসেবে জান্নাত লাভের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। বদরের যুদ্ধের দিন মহানবী (সা.) সাহাবীদের বলেছিলেন, আরবের শ্রেষ্ঠ ঘোড়সওয়ার আমাদের সাথে আছে। সাহাবীরা যখন জানতে চান সে কে, তখন রসূলুল্লাহ্ (সা.) উকাশার নাম বলেন।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, একবার মহানবী (সা.) বলেছেন, আমার উম্মতের ৭০ হাজার লোকের একটি দল বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে, তাদের চেহারা পূর্ণিমার চাঁদের মত উজ্জ্বল হবে। তখন উকাশা (রা.) দাঁড়িয়ে নিবেদন করেন, ‘হে আল্লাহ্র রসূল! আল্লাহ্র কাছে দোয়া করুন যেন তিনি আমাকেও তাদের অন্তর্ভুক্ত বানিয়ে দেন।’ মহানবী (সা.) দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ্! একে তাদের অন্তর্ভুক্ত করে নাও।’ তখন আরেক আনসারী সাহাবী দাঁড়ান এবং নিবেদন করেন, ‘হে আল্লাহ্র রসূল! আমার জন্যও দোয়া করুন যেন আল্লাহ্ আমাকেও তাদের অন্তর্ভুক্ত করে দেন।’ তখন মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমার আগেই উকাশা বলে ফেলেছে।’ এই ঘটনার উল্লেখ করে সাহেবযাদা মির্যা বশির আহমদ সাহেব লিখেন, বাহ্যত ছোট্ট এই ঘটনাটি মহানবী (সা.)-এর বৈঠক ও তাঁর উম্মতের মহান আধ্যাত্মিক মর্যাদার প্রতি ইঙ্গিত করে। প্রথমতঃ এত্থেকে সাব্যস্ত হয়, মহানবী (সা.)-এর উম্মত এত উন্নত পদমর্যাদার অধিকারী যে তাতে ৭০ হাজার বা অসংখ্য এমন লোক থাকবে যারা তাদের আধ্যাত্মিক মর্যাদা ও আল্লাহ্র কৃপার কারণে কিয়ামত দিবসে হিসাব-নিকাশের ঊর্ধ্বে গণ্য হবেন। দ্বিতীয়তঃ আল্লাহ্র দরবারে মহানবী (সা.)-এর এমন নৈকট্য রয়েছে যে, তাঁকে (সা.) আল্লাহ্ তা’লা সাথে সাথেই দিব্যদর্শনের মাধ্যমে সংবাদ দিয়ে দিলেন যে, উকাশাও সেই দলে অন্তর্ভুক্ত; এ-ও হতে পারে যে পূর্বে উকাশা সেই দলে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না, কিন্তু মহানবী (সা.)-এর দোয়ার ফলে তৎক্ষণাৎ তাকে সেই দলে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়। তৃতীয়তঃ এত্থেকে মহানবী (সা.) আল্লাহ্ তা’লার সম্মানের প্রতি কতটা খেয়াল রাখতেন এবং নিজ উম্মতকে পুণ্যে কতটুকু সচেষ্ট রাখতে চাইতেন, তা-ও জানা যায়। যখন উকাশার পর আরেকজন সাহাবী একই আবেদন জানান, তখন তিনি তার আবেদন নাকচ করে দিয়ে বোঝান, তাদের ঈমান, তাকওয়া ও পুণ্যকর্মে অগ্রসর হয়ে এই মর্যাদা অর্জন করতে হবে। চতুর্থতঃ এত্থেকে মহানবী (সা.)-এর অনুপম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যেরও পরিচয় পাওয়া যায়, কেননা তিনি (সা.) সেই আনসার সাহাবীর আবেদন এমনভাবে নাকচ করেছেন যেন সে মনে কষ্ট না পায়।
হুযূর বলেন, সূরা নাসর অবতীর্ণ হওয়ার পর নামায শেষে মহানবী (সা.) একটি বিশেষ খুতবা দেন, যাতে তাঁর (সা.) মৃত্যুর প্রতি ইঙ্গিত ছিল, তা শুনে সবাই অনেক কেঁদেছিল। সেদিন রসূল (সা.) বারবার আল্লাহ্র কসম দিয়ে সবাইকে আহ্বান করেন, যদি আমার পক্ষ থেকে কারও প্রতি কোন অন্যায়-অত্যাচার হয়ে থাকে তবে কিয়ামতের পূর্বে আজই তার প্রতিশোধ নিয়ে নাও। তখন হযরত উকাশা দাঁড়িয়ে বলেন, কোন এক যুদ্ধ থেকে ফেরার সময় মহানবী (সা.)-এর চাবুকের আঘাত তার গায়ে লেগেছিল। মহানবী (সা.) হযরত বেলাল (রা.)-কে দিয়ে হযরত ফাতেমার কাছ থেকে সেই চাবুক আনিয়ে উকাশার হাতে তুলে দিয়ে আঘাত করতে বলেন বা বদলা নিতে বলেন। সাহাবীরা সবাই অত্যন্ত বিচলিত ছিলেন যে উকাশা কেন এমনটি করছে। হযরত আবু বকর, হযরত উমর, হযরত আলী এবং হযরত হাসান -হোসাইন বলেন, মহানবীর পরিবর্তে তুমি আমাদের কাছ বদলা নাও। কিন্তু মহানবী বলেন যে, না আমার কাছ থেকেই তুমি প্রতিশোধ নাও। তখন উকাশা নিবেদন করেন, সেসময় আমার পেটের ওপরে কাপড় ছিল না যখন আপনি আঘাত করেছিলেন, তাই রসূল (সা.)-ও নিজের চাদর সরিয়ে শরীর উন্মুক্ত করে দেন। তখন উকাশা পাগলের মত তাঁর (সা.) কাছে গিয়ে তাঁর শরীরে চুমু দিতে থাকেন ও বলেন, আপনার কাছ থেকে প্রতিশোধ নেবে এমন মন কার আছে? মহানবী (সা.) বলেন, হও প্রতিশোধ নাও না হয় ক্ষমা করে দাও। মহানবী (সা.) সাহাবীদের বলেন, ‘যারা জান্নাতে আমার সঙ্গীকে দেখতে চাও, তারা এই বুড়োকে দেখে নাও!’ দ্বাদশ হিজরীতে হযরত আবু বকর (রা.)-এর যুগে ভন্ড নবী তুলায়হার বিরুদ্ধে প্রেরিত বাহিনীতে উকাশাও ছিলেন, যুদ্ধ শুরুর আগে শত্রুদের গতিবিধি জানার জন্য উকাশাকে পাঠানো হয় এবং একাজ করতে গিয়ে তিনি তুলায়হার হাতে শহীদ হন।
হুযূর বলেন, আরেকজন সাহাবী ছিলেন খারজাহ বিন যায়েদ (রা.), তিনি হযরত আবু বকর (রা.)-এর শ্বশুরও ছিলেন। তিনি বদরের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, উহুদের যুদ্ধে অত্যন্ত বীরত্বের সাথে লড়াই করে শহীদ হন। বদরের যুদ্ধে তার হাতে উমাইয়া বিন খালফ নিহত হয়েছিল, তারই পুত্র সাফওয়ান উহুদের ময়দানে তাকে আহত অবস্থায় পেয়ে হত্যা করে। হযরত খারজাহকে তার চাচাতো ভাই সাদ বিন রবীর সাথে একই কবরে দাফন করা হয়। তিনি সেদিন আরেক সাহাবীর কথার প্রেক্ষিতে বলছিলেন, আমরা থাকা সত্ত্বেও রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর যদি কোন ক্ষতি হয় তবে আল্লাহ্র কাছে দেয়ার মত আমাদের কোন জবাব বা অজুহাত থাকবে না। এটি বলেই তিনি পূর্ণোদ্যমে শত্রুদের সাথে লড়াই করতে করতে শহীদ হয়ে যান, তার দেহে ১৩টির অধিক প্রাণঘাতী আঘাত ছিল।
হুযূর বলেন, আরেকজন সাহাবী ছিলেন যিয়াদ বিন লবীদ (রা.), তিনি মদীনার বাসিন্দা ছিলেন। তিনি উকবার দ্বিতীয় বয়আতের সময় ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি মদীনা থেকে মক্কায় মহানবী (সা.)-এর কাছে চলে যান এবং মহানবীর মদীনায় হিজরতের পর তিনিও হিজরত করেন। এ কারণে তিনি একাধারে মুহাজির ও আনসার দু’টোই ছিলেন। তিনি বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধেই মহানবী (সা.)-এর সঙ্গী হয়েছিলেন। মহানবী (সা.) তাকে ৯ম হিজরীতে হাযারমওত এলাকায় সদকা ও যাকাত সংগ্রহের দায়িত্ব প্রদান করেন, হযরত উমরের যুগ পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। কুফায় তিনি জীবনের শেষ সময় কাটান ও সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।
হুযূর আরও দু’জন সাহাবী মু’আত্তব বিন উবায়দ (রা.) ও খালেদ বিন বুকায়র (রা.)-এর স্মৃতিচারণ করেন, তারা উভয়েই আযল্ কারা ও বনু লিহইয়ান গোত্রের বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনায় রজী’ নামক স্থানে শহীদ হন। তারা বদর এবং উহুদের যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন। খালেদ বিন বুকায়র (রা.) দ্বারে আরকামে সর্বপ্রথম বয়আত গ্রহণকারী ছিলেন। তারা এমন লোক ছিলেন যারা ঈমান ও ধর্মের খাতিরে জীবন উৎসর্গকারী ছিলেন। তারা ছিলেন নির্ভিক ও শির্কমুক্ত। মহানবীর ভালোবাসায় তারা সদা জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিলেন।
হুযূর বলেন, মহানবী (সা.)-এর সাহাবীগণ ধর্ম ও ঈমানের সুরক্ষার জন্য সর্বপ্রকার ত্যাগ স্বীকার করেছেন আর খোদার সন্তোষভাজন হয়েছেন। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) একস্থানে বলেন, সেই রসূলের খোদার প্রতি কৃতজ্ঞতা, যিনি অনুগ্রহশীল ও দুঃখ-বেদনা লাঘবকারী আর সেই রসূলের প্রতি দরূদ ও সালাম যিনি জিন্ন ও ইনসানের নেতা এবং পবিত্র হৃদয়ের অধিকারী ও বেহেশতের পানে আকৃষ্টকারী। আর তাঁর সাহাবীদের প্রতিও সালাম যারা ঈমানের ঝর্নার পানে তৃষ্ণার্তের মত ছুটেছে এবং ভ্রষ্টতার অমানিষার রাতে জ্ঞান ও আমলের পূর্ণতার মাধ্যমে আলোকিত হয়েছে।
আরেকস্থানে সাহাবীদের সম্পর্কে তিনি (আ.) বলেছেন, যারা দিনেরবেলা কর্মক্ষেত্রে নির্ভিক এবং রাতের বেলার সন্যাসী আর ধর্মজগতের নক্ষত্র ছিলেন। রাতের সন্যাসীর অর্থ হল, রাতেরবেলা ইবাদতকারী আর ধর্মজগতের নক্ষত্ররাজি, খোদার সন্তুষ্টি ছিল তাদের সবার সঙ্গে।
হুযূর বলেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকেও নিজেদের জ্ঞানগত ও ব্যবহারিক অবস্থাকে উন্নত করার আর রাতের ইবাদতের মানকে উন্নত করার তৌফিক দান করুন।
হুযূর খুতবার শেষদিকে উগান্ডানিবাসী জামাতের একজন নিষ্ঠাবান সেবক মোকাররম ইসমাঈল মালাগালা সাহেবের স্মৃতিচারণ করেন, যিনি গত ২৫ মে জুমআর পূর্বে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মাত্র ৬৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তিনি উগান্ডায় মুবাল্লিগ হিসেবে সেবারত ছিলেন। জন্মগত খ্রীস্টান এই ভাই একজন আহমদীর দীর্ঘ তবলীগের মাধ্যমে ১৯৭৮ সালে ইসলাম-আহমদীয়াত গ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকে তার শখ ছিল পাদ্রী হয়ে ধর্মের সেবা করার, আহমদী হওয়ার পর ১৯৮০-তে তিনি ওয়াক্ফে যিন্দেগী হিসেবে রাবওয়ায় জামেয়া আহমদীয়াতে ভর্তি হন এবং ১৯৮৮-তে পাস করে জামাতের সেবায় নিয়োজিত হন। তবলীগ-পাগল, নম্র, বিনয়ী, মিশুক আর খিলাফতের প্রতি বিশ্বস্ত ও নিষ্ঠাবান একজন সেবক ছিলেন। তিনি সাইকেলে করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তবলীগ করতেন। এভাবেই একবার তবলীগে যার আর ফিরে এসে জানতে পারেন যে, তাঁর স্ত্রী ইন্তেকাল করেছেন এবং তার দাফন-কাফনও হয়ে গেছে। তার তবলীগের অনেক মানুষ আহমদীয়াত গ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করেছেন। হুযূর মরহুমের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন আর তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করে তার মর্যাদা উন্নীত হওয়ার জন্য দোয়া করেন। প্রয়াত ইসমাঈল মালাগালা সাহেব মৃত্যুকালে ২জন স্ত্রী এবং ৯জন সন্তান স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখে গেছেন। হুযূর মরহুমের পরিবারবর্গের জন্যও দোয়া করেন যেন তারাও জামাত ও খিলাফতের সাথে সর্বদা সম্পৃক্ত থাকে। আমীন।