প্রিয় মুহাম্মদ ওসমান চৌ (চিনি সাহেব)

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৭-এপ্রিল, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২৭শে এপ্রিল, ২০১৮ইং লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় সদ্য প্রয়াত প্রবীণ, নিষ্ঠাবান জামাতের সেবক ও আলেম জনাব মুহাম্মদ ওসমান চৌ (চিনি সাহেব)-এর পুণ্যময় জীবণ চরিত ও বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, কয়েকদিন আগে জামাতের একজন বুযূর্গ ও আলেম জনাব ওসমান চীনি সাহেব মৃত্যুবরণ করেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন। আল্লাহ্ তা’লা তাকে চীনের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে পাকিস্তানে আসার ও আহমদীয়াত গ্রহণ করার সৌভাগ্য দান করেন। আল্লাহ্ তা’লা স্বয়ং কীভাবে তাঁকে আহমদীয়াত গ্রহণের ও জীবন উৎসর্গ করার প্রতি পথনির্দেশনা দিয়েছেন সে সংক্রান্ত তাঁর নিজের লেখা আত্মজীবনী রয়েছে; এছাড়া বিভিন্ন জনকে তিনি তাঁর জীবনের অনেক ঘটনা বর্ণনা করেছেন-সেগুলোরও অনেক বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে; এসব ঈমানবর্ধক ঘটনা, তাঁর জীবনী ও জামাতের সেবা নিয়ে যত তথ্য-উপাত্ত রয়েছে তা নিয়ে বই রচিত হতে পারে এবং খোদ্দামুল আহমদীয়া পাকিস্তান একাজ উত্তমরূপে সম্পাদন করতে পারে।

হুযূর (আই.) বলেন, এখন আমি এই দরবেশতুল্য ব্যক্তির, যিনি জামাতের একজন প্রবীণ, ওয়াক্‌ফে যিন্দেগী, মুবাল্লিগ, আদর্শ স্থানীয় একজন আলেম ও ওলীউল্লাহ্ ছিলেন, সংক্ষেপে তাঁর কিছু স্মৃতিচারণ করব, যা বিশেষভাবে ওয়াক্‌ফে যিন্দেগীদের জন্য এবং জামাতের সাধারণ সদস্যদের জন্যও অনুকরণীয় আদর্শ। তিনি সাধারণভাবে ওসমান চীনি সাহেব নামেই আহমদীয়া জামাতে সুপরিচিত ছিলেন, তাঁর আসল নাম ছিল মুহাম্মদ ওসমান চৌ চাং শি (Mohammad Osman Chung Sai Chou) । ১৩ এপ্রিল, ২০১৮ তারিখে তিনি ইন্তেকাল করেন। তিনি ১৩ ডিসেম্বর, ১৯২৫ সনে চীনের আন খুই প্রদেশে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনা চীনেই করেন, পরবর্তীতে দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনা করেন। তাঁর আগ্রহ ছিল তুরষ্কে গিয়ে পড়াশোনা করার, পরবর্তীতে ১৯৪৯-এ তিনি পাকিস্তানে চলে আসেন। নিজে পড়াশোনা ও গবেষণা করে আহমদীয়াত গ্রহণ করেন। এরপর জামেয়াতে পড়াশোনা আরম্ভ করেন। ১৯৫৭ সনের এপ্রিলে জামেয়াতে শর্টকোর্স পাস করেন ও আগস্ট, ১৯৫৯ সনে তিনি জীবন উৎসর্গ করেন। ১৯৬০ সনের জানুয়ারিতে প্রথম তিনি কর্মক্ষেত্রে যোগদান করেন। পরে ১৯৬১ সনের এপ্রিলে মুবাল্লিগ কোর্সের জন্য পুনরায় জামেয়াতে ভর্তি হন এবং ১৯৬৪ সনে শাহেদ পাস করেন। পাকিস্তানে ওকালত তসনীফ এবং রাবওয়া ও করাচিতে মুরব্বী হিসেবে জামাতের সেবা করার সুযোগ পেয়েছেন।

১৯৬৬ সনে সিঙ্গাপুর ও মালেশিয়াতে তিনি প্রায় সাড়ে তিনবছর জামাতের সেবা করার সুযোগ পান। ১৯৭০ সনে পাকিস্তানে ফেরত আসেন এবং বিভিন্ন জামাতে মুরব্বী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ওমরা ও হজ্জ্ব করারও সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। খলীফাতুল মসীহ্ রাবে (রাহে.)-এর হিজরতের পর কাজের পরিধি বেড়ে যাওয়ার দরুন লন্ডনে অন্যান্য ভাষার মত চীনা ভাষারও পৃথক ডেস্ক খোলা হয় এবং তাকে এর পরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হয়। সে সময় তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে চীনা ভাষায় বিভিন্ন বই-পুস্তক অনুবাদের কাজ করেন, যার মধ্যে চীনা ভাষায় পবিত্র কুরআনের অনুবাদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও ইসলাম ও আহমদীয়াতের ধর্মীয় বিশ্বাস ও শিক্ষা সম্বলিত বিষয়েও তিনি বেশ কিছু বই চীনা ভাষায় রচনা করেন। তিনি চীনা ভাষায় কুরআন অনুবাদের কাজ ১৯৮৬ সালে শুরু করেন এবং মাত্র চার বছরে একাজ সম্পন্ন করেন; যদিও এর জন্য আরও অনেক দীর্ঘ সময় প্রয়োজন ছিল, কিন্তু তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে অতি স্বল্প সময়ের মধ্যেই তা সম্পন্ন করেন। জামাতের শতবর্ষ পূর্তি উদযাপনের আগেই এই অনুবাদকর্ম সম্পন্ন করার বিষয়ে হযরত খলীফাতুল মসীহ্ রাবে (রাহে.)-এর বিশেষ তাগিদ ছিল। যদিও ইতোপূর্বেও চীনা ভাষায় কুরআনের বিভিন্ন অনুবাদ ছিল এবং এর পরে আরও অনুবাদ হয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত চীনা ভাষায় সবচেয়ে উৎকৃষ্ট অনুবাদ ওসমান চীনি সাহেবেরটিকেই গণ্য করা হয়। এ সম্পর্কে চীনের অনেক অ-আহমদী আলেম-ওলামা, লেখক ও সাধারণ পাঠকদের বিভিন্ন মন্তব্য রয়েছে। যার মধ্য হতে হুযূর কিছু উল্লেখও করেন।

মরহুম শোকসন্তপ্ত পরিবারে স্ত্রী ছাড়াও একজন পুত্র ও দু’জন কন্যা সন্তান রেখে গেছেন স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে। স্ত্রীর সাথে মরহুমের বয়সের পার্থক্য ছিল প্রায় ত্রিশ বছর। এই বিয়ে কীভাবে আল্লাহ্‌র কৃপায় অসাধারণভাবে সংঘটিত হয় হুযূর তা মরহুমের স্ত্রীর বরাতে বর্ণনা করেন। তাঁর স্ত্রী বলেন, ওসমান সাহেব অত্যন্ত দয়ার্দ্র স্বামী ছিলেন, স্ত্রীকে নামায পড়া ও কুরআন পড়া শিখিয়েছেন, কুরআনের অনুবাদও শিখিয়েছেন। সন্তানদের তরবীয়তের ব্যাপারে গভীর আগ্রহ রাখতেন। তিনি তাঁর মাকে চীন থেকে পাকিস্তানে আনিয়েছেন এবং আমৃত্যু তার অনেক সেবাযত্ন করেছেন।

মরহুমের বড় কন্যা ডা. কুররাতুল আঈন লিখেছেন, অত্যন্ত স্নেহের সাথে আমাদের তরবীয়ত করেছেন, কখনো আমাদের প্রতি কঠোর আচরণ করতেন না; কেবলমাত্র নিয়মিত ও সময়মত নামায পড়ার বিষয়ে আমাদের প্রতি কঠোর হতেন। সন্তানদের বলতেন, তোমাদের প্রধান উদ্দেশ্য হল, তবলীগ করা, বিশেষভাবে চীনা লোকদেরকে তবলীগ কর। সন্তানদেরকে আধ্যাত্মিকতা, জ্ঞান ও চরিত্র উন্নত করার জন্য সর্বদা নসীহত করতেন; প্রায়শঃ একথা বলতেন- তোমাদের ব্যক্তিত্ব, কর্ম ও আচরণ দেখে লোকেরা যেন একথা বুঝতে পারে যে, আল্লাহ্ আছেন। কিশতিয়ে নূহ পড়ার জন্য অনেক উপদেশ দিতেন আর বলতেন, আমি জামেয়ার ভর্তি হওয়ার পর প্রথম মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর যে বইটি পড়েছিলাম তা হল, কিশতিয়ে নুহ্।

সবসময় বলতেন, যে কাজই কর না কেন তা আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য কর। মরহুমের ছেলে ডা. দাউদ সাহেব বলেন, তিনি আমাদেরকে বারবার চীনাদের তবলীগ করার জন্য বলতেন। আল্লাহ্ তা’লার গুণবাচক নামসমূহ মুখস্ত করতে বলতেন আর সেগুলোর পরীক্ষা নেওয়ার জন্য আমাদের ভাইবোনদের মাঝে প্রতিযোগিতা করাতেন ও পুরস্কার দিতেন। তিনি নিজে চীনা ভাষায় আল্লাহ্‌র গুণবাচক নামসমূহ নিয়ে একটি নযম লিখেছিলেন, তিনি প্রতি রাতে স্বরচিত এই নযমটি গভীর বেদনার সাথে পড়তেন।

হুযূর (আই.) বলেন, কয়েক মাস পূর্বে তাঁর জামাতাকে সাথে নিয়ে তিনি আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন। অসুস্থতার কারণে তাঁর জন্য কথা বলা কষ্টকর ছিল তাই আমার কাছে তিনটি বিষয়ে অনুমতি প্রার্থনা করে লিখেন, প্রথমটি হল তিনি অসুস্থ বিধায় হুইলচেয়ারে বসে আছেন, দাঁড়াতে পারছেন না- এজন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন; এটি তাঁর খিলাফতের প্রতি অগাধ সম্মান ও শ্রদ্ধার পরিচায়ক। দ্বিতীয়ত, জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত যেন তবলীগ করতে পারেন সেজন্য দোয়া ও অনুমতি প্রার্থনা করেন; তৃতীয়ত, তিনি যেহেতু অফিসে যেতে পারছেন না তাই ঘরে বসেই যেন হুযূর তাঁকে কাজ করার অনুমতি প্রদান করেন। হুযূর বলেন, কাজের নেশা ছিল তাঁর, এমন না যে অসুস্থ, ঘরে রয়েছি তাই কাজ করার দরকার নেই; ঘরে বসেও কাজ করার আগ্রহ ছিল।

নিজ জাতি অর্থাৎ চীনাদের সত্য ইসলামের হিদায়েত লাভের ব্যাপারে তাঁর উদগ্র বাসনা ছিল; হজ্জ্বে গিয়ে অত্যন্ত আবেগের সাথে চীনা ভাষায় এজন্য দোয়া করছিলেন যা দেখে অপর কতিপয় লোক অত্যন্ত আশ্চর্য হন। তাঁর দোয়ার ব্যাপারে অনেকেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন, কীভাবে তিনি দোয়া করতেন ও আল্লাহ্ তাঁর দোয়া কবুল করতেন। বাজামাত নামায ও তাহাজ্জুদ নামাযে অত্যন্ত নিয়মিত ছিলেন। খলীফাতুল মসীহ্ সানী, মির্যা বশীর আহমদ সাহেব, মৌলভী গোলাম রসূল রাজেকী সাহেবসহ জামাতের আরো অনেক সাহাবী ও বুযূর্গের তিনি সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন, আর তাদের পুণ্যের ছাপ তাঁর মাঝে অত্যন্ত স্পষ্ট ছিল। অগণিত পুণ্যস্বভাবের অধিকারী ছিলেন তিনি। কেউ দোয়ার জন্য বললে, তৎক্ষণাৎ হাত তুলে দোয়া করতেন এবং দীর্ঘক্ষণ দোয়া করতেন। আর তাঁর দোয়ার ফলে মানুষের বাহ্যত অসম্ভব অনেক কাজ সম্ভব হয়েছে বলেও লোকেরা জানিয়েছেন।

হুযূর এরপর বিভিন্ন জনের লেখা হতে মরহুম চীনি সাহেবের বিভিন্ন গুণ ও অনুপম বৈশিষ্ট্যের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন এবং যৌবনে হুযূর নিজেও তাকে কীরূপে দেখেছেন তার স্বাক্ষ্য প্রদান করেন। যে কোন মূল্যে তিনি মসজিদে এসে বাজামাত নামায পড়তেন আর যতদিন তিনি হাঁটতে পারতেন মসজিদে আসতেন তাতে যত সময়ই লাগুগ না কেন। ঝর-বৃষ্টি আর বরফ তাঁর মসজিদে আসার ক্ষেত্রে কোনরূপ অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারতো না।

হুযূর দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা মরহুম ওসমান চীনি সাহেবের পদমর্যাদা উন্নীত করুন এবং তাঁনে নিজ প্রিয়দের চরনে ঠাই দিন। আল্লাহ্ তাঁর স্ত্রী-সন্তানদেরকে ধৈর্য ও দৃঢ় মনোবল দান করুন এবং তাদের হাফেয ও নাসের হোন, মরহুমের সন্তানদেরকেও তাঁর দোয়া ও পুণ্যসমূহের উত্তরাধিকারী বানান এবং পিতার আদর্শ অনুসরণ ও অবলম্বনের তৌফিক দিন। আমীন।