প্রবাসে অভিবাসী আহমদী মুসলমানদের দায়িত্ব ও কর্তব্য

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৪-এপ্রিল, ২০১৮

বাইতুর রহমান মসজিদ, ভ্যালেন্সিয়া, স্পেন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৬ই এপ্রিল, ২০১৮ইং স্পেনের ভ্যালেন্সিয়ায় অবস্থিত বাইতুর রহমান মসজিদে অভিবাসী আহমদীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য একটি গুরুত্বপূর্ণ জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

হুযূর (আই.) বলেন, স্পেন পাশ্চাত্বের দেশসমূহের অন্তর্ভুক্ত হলেও অর্থনৈতিকভাবে ইউরোপের অসচ্ছল দেশগুলোর মাঝে পরিগণিত হয়। কর্মসংস্থানের সুযোগ, মাথাপিছু আয় ও জীবনযাত্রার মানের দিক থেকে এটি ইউরোপের অন্যান্য দেশ যেমন ফ্রান্স, জার্মানি, হল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও পাকিস্তান থেকে আগতদের কাছে এখানকার অর্থনৈতিক অবস্থা পাকিস্তানের তুলনায় শ্রেয়; এজন্যই অনেক পাকিস্তানি ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বা চাকরির সুবাদে এখানে আসে। আর আহমদীরা মূলতঃ দু’টো কারণে পাকিস্তান থেকে হিজরত করেন, এর মধ্যে প্রধান কারণটি হল, আহমদী হবার কারণে পাকিস্তানে ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হওয়া ও ধর্মীয় স্বাধীনতা না থাকা। আর দ্বিতীয়টি হল, অর্থনৈতিক উন্নতি।

এখানে যারা আসেন তারা এ কারণ দেখিয়েই এসাইলাম বা স্থায়ীভাবে বসবাসের আবেদন করে থাকেন, পাকিস্তানে এমন পরিবেশ নেই যে, আমরা স্বাধীনভাবে সেখানে নিজেদের বিশ্বাস অনুসারে নিজেদেরকে মুসলমান ঘোষণা করতে পারি বা ধর্মকর্ম পালন করতে পারি। কেউ কেউ কেস করার সময় সঠিকভাবে নিজেদের চিত্র তুলে ধরে, তবে কেউ কেউ অতিরঞ্জনও করে থাকে; অথচ এর কোন প্রয়োজনই নেই।

হুযূর বলেন, আমি কয়েকবার বলেছি, যদি প্রকৃত ও সত্য ঘটনা তুলে ধরা হয় এবং পাকিস্তানে আমাদের ওপর অন্যায়-অবিচার করা হচ্ছে তা-ই বর্ণনা করে বলা হয় যে, এটি আমাদের জন্য তীব্র মানসিক চাপ ও নিরন্তর অত্যাচারের শামিল, তাহলে এখানকার কর্তৃপক্ষ ও আদালতের বিচারকরা বুঝতে সক্ষম হন আর তারা সাহায্য ও সহমর্মিতার মনোভাবও রাখেন।

কাজেই উকিল বা অন্য কারও কথায় প্রভাবিত হয়ে অযথা অতিরঞ্জণের আশ্রয় নেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। একইভাবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই বক্তব্য থাকা উচিত, কেননা বার বার কথা পরিবর্তন করলে কর্তৃপক্ষ এটিকে মিথ্যা বলে সন্দেহ করতে পারে।

এছাড়া একজন আহমদীর তো এমনিতেই মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকা উচিত, কারণ আল্লাহ্ তা’লা মিথ্যাকে শিরক্ বা অংশীবাদীতার সমতুল্য আখ্যা দিয়েছেন। একজন আহমদীর কাছ থেকে এটি কখনোই মেনে নেয়া যায় না যে, একদিকে সে এই দাবী করবে যে, আমি সবচেয়ে বেশি আল্লাহ্ তা’লার একত্ববাদে বিশ্বাস করি, মহানবী (সা.)-এর আনুগত্যকারী ও যুগের ইমাম ও মসীহ্‌র অনুসারী; অপরদিকে এই মৌলিক পাপ যা থেকে আত্মরক্ষা করা একজন একত্ববাদীর অন্যতম দায়িত্ব, তা থেকে বিরত থাকবে না।

তাই এদিক থেকে প্রত্যেক আহমদীর আত্মবিশ্লেষণ করা প্রয়োজন, জাগতিক কোন লাভের জন্য আমরা এমন কিছু করছি না তো যা আল্লাহ্‌র কাছে আমাদেরকে চরম পাপী সাব্যস্ত করছে? যেহেতু আমরা নিজেদের ঈমানের সুরক্ষার জন্য, নিজ ধর্মে প্রতিষ্ঠিত থাকার জন্য স্বদেশ থেকে বিতাড়িত, সেহেতু আল্লাহ্ তা’লার নির্দেশকে আমাদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত। আমাদের দেখতে হবে, আহমদীয়াত গ্রহণের পর আমাদের কাছে কোন বিষয়গুলো বেশি গুরুত্ব পায়; যদি তা খোদা তা’লার নির্দেশমত না হয় তবে আমাদের হিজরতের প্রকৃত উদ্দেশ্য পূর্ণ হয় নি, আর যদি তা হয় তবে আমরা হিজরতের প্রকৃত উদ্দেশ্য লাভ করতে সক্ষম হবো আর তখন আল্লাহ্‌র সাহায্যও আমাদের সাথে থাকবে।

হুযূর (আই.) বলেন, যারা নিজেদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য অনুধাবন করতে পেরেছে, তাদের জীবনের প্রথম উদ্দেশ্যই থাকে আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জন। আমাদের মনে রাখতে হবে, জগৎ অর্জন ও এর চাকচিক্যে নিমগ্ন হওয়া আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য নয়। যদি আমরা আল্লাহ্‌কে সন্তুষ্ট করার মানসে তাঁর বর্ণিত জীবনের উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য চেষ্টা করি, কেবল তখনই আমরা প্রকৃত সফলতা অর্জন করতে পারব। পৃথিবী ও এর কল্যাণ তো আমরা পেয়েই যাব, কারণ যারা আল্লাহ্‌র পানে যায় তাদেরকে তিনি এগুলো থেকে বঞ্চিত রাখেন না। বরং তিনি আমাদেরকে তাঁর কাছে পৃথিবী ও পরকালের কল্যাণ লাভের জন্য এই দোয়াও শিখিয়েছেন- “রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাঁও ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতাঁও ওয়াকিনা আযাবান্ নার”। অর্থাৎ, হে আমাদের প্রভু-প্রতিপালক! আমাদেরকে ইহকালেও কল্যাণ দান করো আর পরকালেও কল্যাণ দান কর, আর আগুনের শাস্তি হতে আমাদের রক্ষা করো।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) এ প্রসঙ্গে বলেন, মানুষ তার আত্মার মঙ্গলের জন্য দু’টি জিনিসের মুখাপেক্ষী- প্রথমত পৃথিবীর সংক্ষিপ্ত জীবনে যেসব সমস্যা ও বিপদ রয়েছে সেগুলো থেকে নিরাপত্তা, দ্বিতীয়ত পাপ ও সীমালঙ্ঘন এবং আধ্যাত্মিক ব্যাধি, যা তাকে খোদা থেকে দূরে ঠেলে দেয়, সেগুলো থেকে মুক্তি লাভ। পার্থিব কল্যাণ হল, আধ্যাত্মিক বা দৈহিকভাবে সর্বপ্রকার বিপদ, নোংরামি ও লাঞ্ছনা থেকে নিরাপদ থাকা।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, প্রকৃতপক্ষে ‘রাব্বানা’ শব্দটিতে তওবার প্রতি এক সূক্ষ্ম ইঙ্গিত রয়েছে। রাব্বানা শব্দটি দাবী করে, সে যেন অসন্তুষ্ট হয়ে ঐসব বস্তুকে পরিত্যাগ করে তার প্রকৃত রব বা প্রভুর পানে প্রত্যাবর্তন করে, যেগুলোকে সে ইতোপূর্বে প্রভু বানিয়ে রেখেছিল; আর এই শব্দটি সত্যিকার বেদনা ও বিগলণ ছাড়া সে বলতেই পারে না। আসলে মানুষ অনেক রকম মনগড়া প্রভু বানিয়ে রাখে; কেউ কেউ নিজের বুদ্ধি ও চালাকির ওপর ভরসা করে- আর মনে করে এটিই তার রব, কেউ তার জ্ঞান বা শক্তির কারণে গর্ব করে- আর মনে করে এটিই তার রব, যদি কেউ সৌন্দর্য বা সম্পদের কারণে অহংকার করে তবে সেটিই তার রব; এরকম হাজারো রব বা খোদা রয়েছে।

যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ এসবকিছু থেকে মুক্ত হয়ে প্রকৃত বেদনার সাথে এবং বিগলিতচিত্তে ‘রাব্বানা’ বলে আল্লাহ্‌র দরবারে বিনত না হয়, ততক্ষণ সে তার রবকে চিনতে পারে না। যখন এভাবে সে খোদার দরবারে নিজের পাপ স্বীকার করে নিয়ে তওবা করে বলে ‘রাব্বানা’, তখন এর অর্থ দাঁড়ায়- প্রকৃত রব তো তুমিই ছিলে, কিন্তু আমি মুর্খতাবশত দিশেহারা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, এখন আমি সেসব মিথ্যা খোদাকে পরিত্যাগ করছি এবং হৃদয় থেকে তোমার রবুবিয়্যতের ঘোষণা দিচ্ছি ও তোমার দরবারে প্রণত হচ্ছি। এটি হল সেই চিত্র যা নিষ্ঠার সাথে আল্লাহ্‌র প্রতি সমর্পিত হবার, তাঁর ইবাদত করার ও নিজের সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য অনুধাবন করার ক্ষেত্রে মসীহ্ মওউদ (আ.) আমাদের মাঝে দেখতে চেয়েছেন। যখন আমরা এভাবে আমাদের প্রভু-প্রতিপালককে ডাকার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করব, তখন পার্থিব কল্যাণও লাভ করব আর পরকালের কল্যাণও লাভ করতে পারব। আর প্রকৃতপক্ষে পার্থিব কল্যাণও একজন মু’মিন পরকালের কল্যাণ লাভের জন্যই কামনা করে থাকে। তাই এই অত্যাবশ্যক বিষয়টি সর্বদা আমাদের দৃষ্টিপটে রাখা প্রয়োজন।

আল্লাহ্ তা’লা বলেন, “ওয়ামা খালাকতুল জিন্না ওয়াল ইনসা ইল্লা লিইয়া’বুদুন”- অর্থাৎ, আমি জিন্ন ও মানুষকে কেবল আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি। আল্লাহ্ তা’লার যাবতীয় নির্দেশাবলীকে দেখলে বোধগম্য হয় যে, এগুলোর মর্মকথা হল- কক্ষনো আল্লাহ্‌কে ভুলে যেও না, সর্বদা তাঁকে স্মরণ রাখো। তোমাদের পার্থিব চেষ্টা-প্রচেষ্টা যেন তোমাদেরকে আল্লাহ্‌র স্মরণ ভুলিয়ে না দেয়, আর পার্থিব কোন উদ্দেশ্য পূরণ করাও যেন কেবলমাত্র পার্থিবতার খাতিরে না হয় বরং আল্লাহ্‌র খাতিরে হয়।

খুতবার শেষদিকে হুযূর (আই.) বলেন, আমাদের প্রত্যেকের আবশ্যক দায়িত্ব হল, আমরা যেন প্রকৃত মুসলমান হবার চেষ্টা করি; পার্থিব কল্যাণ দ্বারা যেন এজন্য উপকৃত হওয়ার চেষ্টা করি যাতে তা পরকালের কল্যাণ লাভের কারণ হয়; আমরা যেন নিজেদের ইবাদতের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনকারী হই; শুধুমাত্র ধর্মের খাতিরে বাধ্য হয়ে যেহেতু আমাদেরকে স্বদেশ ত্যাগ করতে হয়েছে, সেহেতু এখানে এসে যেন আমরা স্বাধিনভাবে আমাদের ধর্মীয় শিক্ষা পালনের সম্ভাব্য সকল চেষ্টা করি। আল্লাহ্ তা’লা আমাদের সবাইকে সেই তৌফিক দান করুন। (আমীন)।