শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

৩০-মার্চ, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৩০শে মার্চ, ২০১৮ইং লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ্ (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন আমর বিন হারাম (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, মহানবী (সা.)-এর একজন সাহাবী ছিলেন হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ্ এবং তিনি হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন আমর বিন হারামের পুত্র ছিলেন। হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন আমর হলেন সেই সাহাবী যার শাহাদাতের পরের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে মহানবী (সা.) বলেছিলেন, আল্লাহ্ তা’লা তাকে যা ইচ্ছা চাইবার সুযোগ দিলে তিনি পুনরায় পৃথিবীতে এসে আবারও শাহাদত বরণের সুযোগ চান। যেহেতু এটি আল্লাহ্‌র বিধান পরিপন্থী একটি বিষয়, অর্থাৎ, মানুষ মৃত্যুর পর পুনরায় এ পৃথিবীতে আর আসতে পারেন না। তাই আল্লাহ্ তা’লা তাকে সেটির পরিবর্তে এর অনুরূপ পুণ্য দান করেন। মোটকথা এ ঘটনা থেকে হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন আমরের কুরবানীর উন্নত মান ও তাঁর সাথে আল্লাহ্ তা’লার স্নেহসূলভ আচরণের বিষয়ে জানা যায়।

হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ্ (রা.) তার মহান পিতার সুযোগ্য পুত্র ছিলেন এবং শিশুকালেই আকাবার দ্বিতীয় বয়আতের সময় ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন আমরের ব্যাপারে একথা বর্ণিত আছে যে, তিনি হযরত জাবেরকে নিজের শাহাদাতের পর এক ইহুদীর কাছ থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং এটি তার খেজুর বাগানের আয় থেকে পরিশোধ করতে বলেছিলেন। হযরত জাবের (রা.) পিতার নির্দেশ অনুযায়ী সেই ঋণ পরিশোধও করেছিলেন।

হুযূর বলেন, হাদীস থেকে জানা যায় হযরত জাবের নিজেও সেই যুগের রীতি অনুযায়ী নিজের প্রয়োজনে ঋণ নিতেন যা খেজুর বাগানের ফল দ্বারা পরিশোধ করা হতো। এভাবে একবার তিনি এক ইহুদীর কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করেন, সে বছর ফলন আশানুরূপ না হওয়ায় তিনি সেই ইহুদীকে অনুরোধ করেন যেন তাকে ঋণ পরিশোধের জন্য একবছর বর্ধিত সুযোগ দেয়া হয় যাতে দু’বছরে অর্ধেক অর্ধেক করে ঋণ পরিশোধ করতে পারেন। কিন্তু ইহুদী তাকে সেই সুযোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ইহুদীর দূরভিসন্ধি ছিল যে এভাবে সে পুরো বাগানের মালিকানা দাবী করে বসতে পারবে। মহানবী (সা.)-এর কাছে এই সংবাদ পৌঁছলে তিনি হযরত জাবেরের পক্ষে সুপারিশ করার জন্য কয়েকজন সাহাবীকে সাথে নিয়ে সেই বাগানে এসে হাজির হন এবং ইহুদীর সাথে আলাপ করেন, কিন্তু ইহুদী তাঁকে (সা.) সোজা বলে দেয়, ‘হে আবুল কাসেম, আমি তাকে কোন ছাড় দেব না!’ ইহুদীর এই হাবভাব দেখে মহানবী (সা.) বাগানের চতুষ্পার্শ্বে একপাক ঘুরে আসেন এবং আবারও ইহুদীর সাথে আলাপ করেন, এবারও সে অস্বীকৃতি জানায়। ইতোমধ্যে হযরত জাবের গাছ থেকে কিছু খেজুর পেড়ে মহানবী (সা.)-এর সমীপে পেশ করেন, তিনি (সা.) কিছুটা খান এবং হযরত জাবের (রা.)-কে বাগানের মধ্যে যে ছাপড়া ঘর ছিল সেখানে তাঁর (সা.) বিশ্রামের জন্য ব্যবস্থা করতে বলেন। জাবের (রা.) আদেশ পালন করেন ও সেখানে চাটাই বিছিয়ে দেন। মহানবী (সা.) সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করেন, এরপর জাবের (রা.) আবারও কিছু খেজুর এনে মহানবীর সমীপে পেশ করেন, তিনি (সা.) কয়েকটা খেজুর খান, তারপর উঠে গিয়ে আবারও সেই ইহুদীকে একবছর সময় দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। সে পুনরায় অস্বীকৃতি জানালে মহানবী (সা.) পুনরায় বাগানের চারপাশে একপাক ঘুরে আসেন এবং বলেন, ‘জাবের, গাছ থেকে খেজুর পাড়তে আরম্ভ কর এবং ইহুদীর ঋণ পরিশোধ কর’। হযরত জাবের (রা.) খেজুর পাড়তে শুরু করেন, যতক্ষণ খেজুর পাড়া হচ্ছিল ততক্ষণ মহানবী (সা.) বাগানে গাছগুলোর মাঝে দাঁড়িয়ে ছিলেন। খেজুর পাড়তে পাড়তে ইহুদীর সম্পূর্ণ ঋণ পরিশোধ হয়ে যায় এমনকি কিছু খেজুর উদ্বৃত্ত থেকে যায়। হযরত জাবের (রা.) যখন এই সুসংবাদ মহানবী (সা.)-কে জানান তখন তিনি (সা.) বলেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই আমি আল্লাহ্‌র রসূল, যে অসাধারণ ঘটনাটি ঘটেছে তার কারণ হল, আমি এর জন্য দোয়া করেছি এবং আল্লাহ্ আমার দোয়া শ্রবণ করেন।

হুযূর (আই.) বলেন, এ ঘটনায় একদিকে যেমন সাহাবীদের প্রতি মহানবী (সা.)-এর গভীর স্নেহ এবং তাঁর দোয়ার কারণে গাছের ফলে বরকত হবার বিষয়টি দেখতে পাই, অন্যদিকে ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে সাহাবীদের মাঝে যে ব্যাকুলতা ছিল সেটিও আমরা জানতে পারি।

হুযূর (আই.) বলেন, একজন খাঁটি মুমিনের মাঝে এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার। আজকাল কখনো-সখনো দেখা যায়, কোন কোন আহমদী ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে গড়িমসি করতে থাকে; বছরের পর বছর পার হয়ে যায়, মামলা-মোকদ্দমা চলতে থাকে, তবুও ঋণ পরিশোধ করে না। তাই এ ব্যাপারে আমাদের আরো সচেতন হতে হবে। আর হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর এই বাণীকে স্মরণ রাখতে হবে- ‘আমার হাতে বয়আত করার পর সাহাবীদের আদর্শ নিজেদের মাঝে সৃষ্টি কর, তবেই তোমরা সেই সুন্দর সমাজ গড়তে পারবে যা মসীহ্ মওউদের আসার পর প্রতিষ্ঠিত হবার কথা’।

হাদীস থেকে জানা যায়, মহানবী (সা.) কোন একজন ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির জানাযা পড়াতে অস্বীকৃতি জানান যতক্ষণ না আরেকজন সেই ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব নেন, এবং তিনি সেই সাহাবীর কাছে পরবর্তীতে জানতেও চান যে, সে ঋণ পরিশোধ করেছে কি-না।

আবার আরেকটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, মহানবী (সা.) বলেন, মৃত ব্যক্তির সহায়-সম্পত্তির মালিক হবে তার উত্তরাধিকারীরা, আর যদি তার কোন ঋণ থাকে বা অসহায় এতিম সন্তান থাকে এবং কোন সম্পদ না থাকে, তবে সেই ঋণ পরিশোধের ও এতিমদের দেখভালের দায়িত্ব সেই রাষ্ট্রের বা সমাজের। এদ্বারা তিনি (সা.) দু’টি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে সতর্ক করেছেন ও আমাদের দায়িত্বের প্রতি নির্দেশ করেছেন। অর্থাৎ একদিকে যারা অযথা ঋণ নেয় ও তা পরিশোধে উদাসীনতা প্রদর্শন করে তাদেরকে কড়াভাবে সতর্ক করেছেন, অন্যদিকে অসমর্থদের ঋণ পরিশোধ ও এতিমদের যথাযথ প্রতিপালনের ব্যাপারে রাষ্ট্রকে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। অথচ আজকাল দেখা যায় মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতেই জনগণের অধিকার সবচেয়ে বেশি পদদলিত করা হয়।

হুযূর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা এই সাহাবীদের পদমর্যাদা উন্নীত করুন এবং যেসব ঘটনা আমি বিভিন্ন সময়ে বর্ণনা করে থাকি, সেসব আদর্শ যেন আমরা নিজেরাও অবলম্বন করতে পারি, সেই তৌফিক আমাদেরকে দান করুন। আমীন।

হুযূর (আই.) আজকের খুতবা সংক্ষিপ্ত আকারে প্রদান করেন এবং এরপর জামাতের দু’জন বিশেষ নিষ্ঠাবান সেবকের মৃত্যুতে যিকরে খায়ের করেন। প্রথম জন হলেন, জনাব বেলাল আদনভী সাহেব, যিনি সিরিয়ার বাসিন্দা ছিলেন। কয়েকদিন পূর্বে গাড়ি দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৭ই মার্চ, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

দ্বিতীয় জানাযা শ্রদ্ধেয়া সালমা মীর সাহেবার, যিনি আব্দুল খালেক ডার সাহেবের স্ত্রী ছিলেন, এবং হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর সাহাবী হযরত মীর এলাহী বক্স সাহেবের কন্যা ছিলেন। গত ১৭ই মার্চ ৯০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। এই মহিয়সী নারী দীর্ঘদিন জামাতের সেবা করেছেন এবং দীর্ঘকাল তিনি লাজনা ইমাইল্লাহ্ করাচির সদর ছিলেন।

হুযূর উভয়ের স্মৃতিচারণ করেন ও তাদের উন্নত গুণাবলী ও জামাতের সেবার উল্লেখ করেন। বিশেষভাবে সালমা মীর সাহেবার অসাধারণ কুরবানী ও সেবার বিভিন্ন ঘটনাবলী হুযূর তুলে ধরেন। হুযূর উভয়ের পদমর্যাদা উন্নীত হবার জন্য দোয়া করেন, একইসাথে তাদের সন্তানরাও যেন তাদের পুণ্যসমূহকে চলমান রাখেন সেজন্য দোয়া করেন। হুযূর নামাযের পর তাদের গায়েবানা জানাযা পড়ান।