একনিষ্ঠ দোয়ার প্রভাব

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৬-ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১৬শে ফেব্রুয়ারী, ২০১৮ইং লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় একনিষ্ঠ দোয়ার শক্তি প্রসঙ্গে আলোকপাত করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, একজন মুমিনের, যে এই দাবী করে যে ‘আমি খোদা তা’লার উপর বিশ্বাস রাখি’, তার সর্বদা আল্লাহ্‌র এই নির্দেশকে দৃষ্টিপটে রাখা উচিত যে তিনি আমাদেরকে তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। এরপর আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে ইবাদতের পদ্ধতিও শিখিয়েছেন, যার মধ্যে আমলসংক্রান্ত বিষয়ও রয়েছে অর্থাৎ বাহ্যিক কর্মমূলক, আবার দোয়া বা প্রার্থনামূলক শব্দও রয়েছে যাকে যিকরও বলা হয়। নামাযে এর উভয়টিই অর্থাৎ বাহ্যিক কর্ম আর দোয়া বা যিকর- দুটোই রয়েছে। কিন্তু নামায ছাড়াও যিকর ও দোয়া এবং আল্লাহ্‌কে স্মরণ রাখা একজন মুমিনের দায়িত্ব। কুরআন শরীফেই আল্লাহ্ তা’লা বিভিন্ন নবীদের ঘটনা প্রসঙ্গে বিভিন্ন দোয়ার উল্লেখ করে দিয়েছেন যেগুলো আমরা নামাযেও পড়তে পারি, আবার দৈনন্দিন কাজের ফাঁকেও যিকর হিসেবে পড়ি বা পড়তে পারি। লোকজন আমাকে চিঠিতে তাদের সমস্যাদির কথা লিখে এবং প্রশ্ন করে, ‘আমাদেরকে কোন দোয়া বা যিকর শিখিয়ে দিন যা পড়ে আমাদের বিপদ দূর হবে’। সাধারণত আমি তাদেরকে একথাই লিখে দিই যে নামাযে মনোযোগ দিন, নামাযে ও সিজদায় দোয়া করুন এবং আল্লাহ্‌র কাছে সাহায্য চান। কিন্তু আজ আমি এমন এক যিকর সম্বন্ধে বলতে চাই যা মহানবী (সা.)-এরও সুন্নত এবং আল্লাহ্ তা’লার নাযিলকৃত দোয়াও বটে; আর এগুলোর অর্থের প্রতি মনোনিবেশ করে পড়লে মানুষ একদিকে যেমন আল্লাহ্ তা’লার তওহীদ বা একত্ববাদের তত্ত্বজ্ঞান লাভ করতে পারে, সেইসাথে আল্লাহ্‌র নিরাপত্তায়ও আশ্রয় লাভ করতে পারে এবং সর্বপ্রকার অমঙ্গল থেকেও নিরাপদ থাকতে পারে। মহানবী (সা.) কেবল নিজেই প্রতিরাতে শোবার পূর্বে এই আয়াত ও দোয়াগুলো পড়তেন না, বরং সাহাবীদেরও পড়ার নির্দেশ দিতেন; আর এই আয়াত ও দোয়াগুলোর গুরুত্ব ও উপকারিতা তিনি (সা.) বিভিন্ন সময়ে বর্ণনাও করেছেন।

মহানবী (সা.)-এর নিজের নিয়মিত আমল এটি ছিল যে তিনি (সা.) সর্বদা ঘুমানোর পূর্বে আয়াতুল কুরসী, সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পড়ে নিজের হাতে ফুঁ দিতেন এবং তারপর হাতদুটিকে মাথা থেকে শুরু করে যতদূর হাত যায়, নিজের শরীরে বোলাতেন। যে কাজটি তিনি (সা.) নিয়মিতভাবে করেছেন, তা-ই তো তাঁর (সা.) সুন্নত, সুতরাং সেটি প্রত্যেক মুসলমানের পালন করা উচিত। আর আমরা যারা আহমদী, যাদেরকে মসীহ্ মওউদ (আ.) এ যুগে মহানবী (সা.)-এর সুন্নত পালনের ব্যাপারে অধিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, তাদের এ বিষয়ে বিশেষভাবে সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন; বিশেষভাবে বর্তমানে আমরা যে পরিস্থিতি পার করছি, তার প্রেক্ষিতে কেবল ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক ও পার্থিব বিষয়াদির জন্যই নয়, বরং জামাতের বিরুদ্ধেও ফিতনা-ফাসাদ ও এর শত্রুদের হিংসা-বিদ্বেষ থেকে নিরাপদ থাকার জন্য এক নিতান্ত আবশ্যক দায়িত্ব হিসেবে এর প্রতি মনোযোগ দেয়া দরকার।

হুযূর বলেন, এই যিকর ও দোয়া সম্বন্ধে অন্যান্য হাদীসেও বর্ণনা দেখা যায়। আয়াতুল কুরসী সম্পর্কে তো আমি দু’সপ্তাহ আগের খুতবায় আমি বলেছি, আজকে কুরআন শরীফের শেষ তিনটি সূরা সম্পর্কে হাদীসের আলোকে বলব যে কিভাবে বারবার তিনি (সা.) সাহাবীদেরকে এই সূরাগুলো পড়ার ব্যাপারে তাগাদা দিয়েছেন।

একটি বর্ণনায় হযরত আয়েশা (রা.)-এর বরাতে এই সূরাগুলো পড়ে হাতে ফুঁ দিয়ে শরীরে হাত বোলানোর বর্ণনা এসেছে, আর তিনি (রা.) বলেন যে তিনি (সা.) যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন তখনও তিনি একাজ করতেন, আর যখন অসুস্থতা খুব বেড়ে যায় তখন আমি নিজে এ সূরাগুলো পড়ে তাঁর (সা.) হাতে ফুঁ দিয়ে সেই হাত তাঁর (সা.) শরীরে বুলিয়ে দিতাম। এত্থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে মহানবী (সা.) নিজে একাজে কতটা নিয়মিত ছিলেন এবং এর গুরুত্ব হযরত আয়েশাকে বুঝিয়েছিলেন। হযরত উকবা বিন আমের (রা.) বলেন, “একবার রসূলুল্লাহ্ (সা.) আমার হাত ধরে আমাকে বলেন, ‘হে উকবা, আমি কি তোমাকে তওরাত, যবূর, ইঞ্জিল ও কুরআনে যত সূরা নাযিল হয়েছে তার মধ্য থেকে সর্বোত্তম তিনটির কথা বলব?’ তিনি (রা.) বলেন, ‘অবশ্যই’। তখন মহানবী (সা.) সূরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পড়ে শোনান এবং বলেন, ‘হে উকবা, তুমি এগুলো কখনও ভুলো না আর এগুলো না পড়ে কখনও ঘুমিয়ো না’। উকবা বলেন, ‘তিনি (সা.) এটি বলার পর আমি কখনও এগুলো ভুলি নি এবং এগুলো না পড়ে ঘুমাই নি’।” হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) কর্তৃক একাধিক রেওয়ায়েত রয়েছে, এছাড়াও বিভিন্ন রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে মহানবী (সা.) বলেছেন- সূরা ইখলাস কুরআনের এক-তৃতীয়াংশ। এর মর্মার্থ হল, আল্লাহ্ তা’লা কুরআন শরীফ নাযিল করেছেন তওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্য, আর সূরা ইখলাসে অত্যন্ত স্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গভাবে তওহীদের বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে; এই সূরায় মনোনিবেশ করলে ও তা পালন করলে মানুষ প্রকৃত তওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে ও প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। অতএব এটি শুধু আউড়ে নিলেই চলবে না, বরং এতে মনোনিবেশ করতে হবে ও তা পালন করে তওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। এটি-ই একে কুরআনের এক-তৃতীয়াংশ বলার প্রকৃত মর্ম। এক সাহাবী প্রত্যেক রাকআতের কিরাআত শেষ করতেন সূরা ইখলাস দিয়ে, এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি (রা.) বলেন, যেহেতু এটি রহমান খোদার গুণগান তাই এমনটি করতে ভালবাসি; মহানবী (সা.) বলেন, তাকে বলে দাও আল্লাহ্ও তাকে ভালবাসেন। আরেকজন আনসারী সাহাবী, যিনি মসজিদে কুবায় নামাযে ইমামতি করতেন, তিনি নামাযের প্রত্যেক রাকআতে অন্য সূরা পড়ার আগে সূরা ইখলাস পড়তেন। সাহাবীরা এটি মহানবী (সা.)-কে জানালে তিনি কারণ জানতে চান, সাহাবী জবাব দেন- এই সূরা আমার খুবই প্রিয়। মহানবী (সা.) বলেন, তোমার এই ভালবাসা তোমাকে জান্নাতে প্রবিষ্ট করে দিয়েছে। সেই যুগেও কিছু লোক নাস্তিক মনোভাবাপন্ন ছিল ও প্রশ্ন করত, সবকিছু আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন, তাহলে আল্লাহ্‌কে সৃষ্টি করল কে? মহানবী (সা.) এর জবাব শেখান, তোমরা সূরা ইখলাস সম্পূর্ণ পড়বে এবং শয়তানের থেকে আল্লাহ্‌র আশ্রয় চাইবে। এক দরিদ্র সাহাবী তার দারিদ্র দূর করার জন্য পরামর্শ চাইলে নবীজী (সা.) তাকে বলেন, ঘরে ঢুকেই সালাম দেবে- তা ঘরে কেউ থাকুক আর না থাকুক, আর সূরা ইখলাস পড়বে; অর্থাৎ আল্লাহ্‌র তওহীদের উপর পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাস স্থাপন করবে, তাঁরই কাছে সাহায্য চাইবে। এর পরিণতিতে সেই হতদরিদ্র সাহাবীর অবস্থা রাতারাতি পাল্টে যায়। অনুরূপভাবে সূরা ইখলাস, ফালাক ও নাসের ব্যাপারে অনেক বর্ণনা রয়েছে যে এগুলো আল্লাহ্‌র আশ্রয় লাভের সর্বোত্তম উপায়। বিভিন্ন রেওয়ায়েতে সূরা ফালাক ও নাসের ফযিলত বর্ণিত হয়েছে। মহানবী (সা.) এই দু’টি সূরা দিয়ে ফজরের নামায পড়িয়েছেন এবং নামাযে এ সূরা দু’টি পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। উকবা বিন আমের (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) বলেন, যখনই তুমি ঘুমাবে ও উঠবে, এই সূরা দু’টি পড়বে।

এসব বর্ণনা শেষে হুযূর বলেন, বর্তমান যুগে তো এই সূরাগুলো পড়া আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ- ব্যক্তিগতভাবে আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি ও শয়তানের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য, আর জামাতীভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে যেসব ষড়যন্ত্র হচ্ছে সেগুলো থেকে বাঁচার জন্য। একদিকে ইসলামবিরোধীদের ষড়যন্ত্র, আরেকদিকে তথাকথিত আলেম বা মোল্লাদের কর্মকান্ড ও আহমদীয়াতের শত্রুতা, তার সাথে নাস্তিক্যবাদের প্রসার ও আক্রমণ- এই সবকিছুকে দৃষ্টিতে রেখে আমাদের এসব দোয়ার প্রতি মনোযোগী হতে হবে। হুযূর দোয়া করেন, আল্লাহ্ করুন আমাদের প্রত্যেকেই যেন এই সূরাগুলোর মর্মার্থ উপলদ্ধি করে মহানবী (সা.)-এর সুন্নত পালনকারী হয়, আল্লাহ্‌র একত্ববাদের তত্ত্ব আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়, তিনি ছাড়া আর কারও কাছে আমরা যেন অবনত না হই, তাঁকেই যেন আমরা সর্বশক্তির আধার জ্ঞান করি- কেবল হৃদয়ে নয়, বরং আমাদের সব কর্মের মাধ্যমেও যেন এর প্রতিফলন হয়, আল্লাহ্ই সব আলো ও কল্যাণের উৎস; সৃষ্টির অমঙ্গল থেকে বাঁচার জন্য সৃষ্টিরই উপর ভরসা করার বদলে যেন আমরা আল্লাহ্‌র প্রতি বিনত হই। (আমীন)।