প্রতিশ্রুত সংস্কারক (মুসলেহ মওউদ) সম্পর্কিত ভবিষ্যতবাণী

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৩-ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২৩শে ফেব্রুয়ারী, ২০১৮ইং লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় মুসলেহ মওউদ (প্রতিশ্রুত সংস্কারক)-এর ভবিষ্যদ্বাণী প্রসঙ্গে আলোকপাত করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, সাম্প্রতিক দিনগুলোতে বিশ্বের যেখানেই জামাত প্রতিষ্ঠিত আছে, মুসলেহ্ মওউদ সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণীর প্রেক্ষাপটে মুসলেহ্ মওউদ দিবসের জলসা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ২০ ফেব্রুয়ারি হচ্ছে সেই দিন, যেদিন হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) আল্লাহ্ তা’লার পক্ষ থেকে সংবাদ পেয়ে এক পুত্রের জন্মের ব্যাপারে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে খবর দিয়েছিলেন, যাতে সেই পুত্রের বিভিন্ন গুণাবলীরও উল্লেখ ছিল। ১৮৮৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি এই বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। এ কারণে যেস্থানে সম্ভব ২০ ফেব্রুয়ারি মুসলেহ্ মওউদ দিবস পালন করা হয়, আর যেখানে এই দিনে পালন সম্ভব হয় না সেখানে আগে বা পরে সুবিধাজনক তারিখে তা পালন করা হয়। হুযূর বলেন, মুসলেহ্ মওউদ দিবস পালন মূলত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর এক মহান ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হবার কারণে করা হয়, এটি মির্যা বশিরুদ্দীন মাহমুদ আহমদ (রা.)-এর জন্মের কারণে নয়। হুযূর বলেন, এই ব্যাখ্যা এজন্য দিচ্ছি যে আজকাল কতিপয় যুবক এই প্রশ্ন করে যে মুসলেহ্ মওউদ দিবস যেহেতু আমরা পালন করি, তাহলে অন্য খলীফাদের জন্মদিন কেন পালন করি না? এটা জানা থাকা দরকার যে ২০ ফেব্রুয়ারি তার জন্মদিন নয়, তার জন্ম তো হয়েছিল ১৮৮৯ সালের ১২ জানুয়ারি। এরপর হুযূর মুসলেহ মওউদ-এর ভবিষ্যদ্বাণী প্রসঙ্গে আলোচনা করেন।

প্রথমে হুযূর (আই.) মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর নিজের বর্ণনায় এ সংক্রান্ত ইলহামটি উদ্ধৃত করেন এবং একইসাথে তাঁর (আ.) লেখনী ইত্যাদির আলোকে এই বিষয়টিও তুলে ধরেন যে তিনি (আ.) স্বয়ং মির্যা বশিরুদ্দীন মাহমুদ আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ সানী (রা.)-কেই এই ইলহামের বিকাশস্থল জ্ঞান করতেন, একইসাথে হযরত খলীফাতুল মসীহ্ আউয়াল (রা.)-ও এবং জামাতের আরও কয়েকজন বুযুর্গও তা-ই জ্ঞান করতেন। অনুরূপভাবে ভবিষ্যদ্বাণীতে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যও বর্ণিত হয়েছিল, সেগুলো যেভাবে পূর্ণতা পেয়েছিল এবং আহমদী ও অ-আহমদীরা এ সম্পর্কে তাদের যেসব অভিমত প্রকাশ করেছিল, তার মধ্য থেকেও কতিপয় হুযূর তুলে ধরেন।

হুযূর (আই.) ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৮৮৬-এ প্রকাশিত সেই মহান ভবিষ্যদ্বাণী উদ্ধৃত করেন। মির্যা বশিরুদ্দীন মাহমুদ আহমদ (রা.)-এর মুসলেহ্ মওউদ হবার ব্যাপারে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) হাকীকাতুল ওহী পুস্তকে লিখেন, “এভাবে যখন আমার প্রথম পুত্র মৃত্যুবরণ করল তখন মূর্খ মৌলবীরা ও তাদের বন্ধুরা এবং খৃষ্টান ও হিন্দুরা খুব আনন্দ প্রকাশ করল। তাদেরকে বারংবার বলা হল, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৬-তে এই ভবিষ্যদ্বাণীও করা হয়েছিল যে কতিপয় পুত্র মারাও যাবে, তাই আবশ্যক ছিল যে কোন পুত্র দুগ্ধপোষ্য থাকাকালেই মারা যাবে। তবুও তারা আপত্তি করা থেকে বিরত হল না। তখন খোদা তা’লা আমাকে দ্বিতীয় এক পুত্রের সুসংবাদ দেন। আমার সবুজ ইশতেহারের ৭ম পৃষ্ঠায় সেই দ্বিতীয় পুত্রের জন্মের ব্যাপারে এই সুসংবাদ আছে, ‘দ্বিতীয় বশির দেয়া হবে, যার আরেক নাম হল মাহমুদ….।’ এটি হল সবুজ ইশতেহারের ৭ম পৃষ্ঠার সেই বর্ণনা, যে অনুসারে জানুয়ারি ১৮৮৯-এ পুত্র জন্ম নেয়, যার নাম মাহমুদ রাখা হয় এবং আজ পর্যন্ত আল্লাহ্‌র ফযলে বেঁচে আছে ও তার সতেরতম বছর চলছে।”

হযরত খলীফাতুল মসীহ্ আউয়াল (রা.)-এর মৃত্যুর ছয়মাস পূর্বে কায়দা ইয়াসসারনাল কুরআনের প্রণেতা পীর মঞ্জুর মোহাম্মদ সাহেব তার কাছে নিবেদন করেন, ‘আজ মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর ইশতেহারসমূহ পড়ে আমি বুঝতে পারলাম যে মিঁয়া সাহেবই (অর্থাৎ হযরত মির্যা বশিরুদ্দীন মাহমুদ আহমদ) তাঁর প্রতিশ্রুত পুত্র।’ তখন খলীফা আউয়াল (রা.) বলেন, ‘আমি তো তা আগে থেকেই জানি। কেন তোমরা দেখ না আমি মিঁয়া সাহেবের সাথে কেমন বিশেষ ব্যবহার করি এবং সম্মান করি?’ পীর সাহেব এই ঘটনাটিই লিখে খলীফা আউয়ালকে সত্যায়িত করার জন্য দেন, তিনি (রা.) সত্যায়ন করে স্বাক্ষর ও তারিখ দিয়ে দেন। পরদিন ১১ সেপ্টেম্বর, ১৯১৩ তারিখে যখন পীর সাহেব আবার হুযূর (রা.)-এর সাথে করতে যান, তখন হুযূর (রা.) হঠাৎ নিজে থেকেই বলেন, ‘এ বিষয়টি এখন প্রকাশ করো না, যখন বিরোধিতা হবে তখন প্রকাশ করো।’

১৯৪৪ সনে হযরত খলীফাতুল মসীহ্ সানী (রা.) আল্লাহ্ তা’লার পক্ষ থেকে সংবাদ পেয়ে স্বয়ং মুসলেহ্ মওউদ হবার দাবী করার পর জামাতের অনেক বুযুর্গ আগেই এ বিষয়ে দেখা স্বপ্ন পুনর্ব্যক্ত করে চিঠি লিখেন। এদের মধ্যে একজন ছিলেন সুফী মুতিউর রহমান বাঙ্গালী। তিনি হুযুরের (রা.) দাবীর ২৩-২৪ বছর পূর্বে স্বপ্নে দেখেছিলেন, ঈদের জলসা চলছে আর মসীহ্ মওউদ (আ.) সবুজ রংয়ের চোগা পরে খুব উঁচু স্থান থেকে খুতবা দিচ্ছেন। খুতবা শেষ হলে যখন তিনি হাত মেলানোর জন্য কাছে যান, তখন মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর পরিবর্তে খলীফা সানী (রা.)-কে দেখতে পান। স্বপ্নটি তিনি তার ভাই মৌলভী জিল্লুর রহমান সাহেবকে, যিনি বাংলায় মোবাল্লেগ হিসেবে ছিলেন, তাকে বললে তিনিও এই ব্যাখ্যাই করেন যে এটি আমীরুল মুমিনীনের মুসলেহ্ মওউদ হবার নিদর্শন। হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.)-কে যতদিন পর্যন্ত আল্লাহ্ তা’লা বলেন নি, ততদিন পর্যন্ত তিনি দাবী করেন নি। কিন্তু যখন আল্লাহ্ স্পষ্টভাবে নির্দেশনা দান করেন তখন তিনি ঘোষণা দেন, এবং অত্যন্ত দৃঢ় ভাষায় আল্লাহ্‌র নামে কসম খেয়ে এই ঘোষণা দেন।

মুসলেহ্ মওউদ-এর ভবিষ্যদ্বাণীতে যেসব বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর সংখ্যা ৫২ বা কারও মতে ৫৮, মোটকথা পঞ্চাশের অধিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। মুসলেহ মওউদের মৃত্যুতে দামেস্কের হযরত সৈয়দ আবুল ফারশ আল্‌ হাসনি বর্ণনা করেন যে হুযুরের (রা.) মৃত্যুতে দামেস্কের জামাত বিশেষভাবে দুঃখভারাক্রান্ত, কারণ দামেস্কের জামাত তার (রা.) নিজ হাতে লাগানো গাছ ছিল, যা এখন ফুলে-ফলে সুশোভিত হচ্ছে। আল্লাহ্ তা’লা তার সম্পর্কে সঠিক বলেছিলেন যে ‘জাতিসমূহ তার দ্বারা কল্যাণমণ্ডিত হবে’। আরও অনেক আহমদীর এ বিষয়ে সাক্ষ্য রয়েছে। মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর এই মহান ভবিষ্যদ্বাণীর সাক্ষ্য আল্লাহ্ তা’লা অ-আহমদীদের মাধ্যমেও প্রদান করিয়েছেন। মৌলভী সামিউল্লাহ্ খান ফারুকী, যিনি একজন প্রসিদ্ধ অ-আহমদী আলেম, তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে একবার ‘সত্য প্রকাশ’ শিরোনামে লিখতে গিয়ে মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর এই মুসলেহ্ মওউদ সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণীর অংশবিশেষ উল্লেখ করে লিখেন, “এই ভবিষ্যদ্বাণীটি পড় এবং বারবার পড়, তারপর বল এই ভবিষ্যদ্বাণী কি পূর্ণ হয় নি? যখন এই ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়, তখন বর্তমান খলীফা (অর্থাৎ খলীফা সানী) নিতান্ত শিশু ছিল, আর মির্যা সাহেব তাকে খলীফা বানানোর জন্য কোন ওসীয়্যতও করে যান নি, বরং খেলাফত সাধারণ সদস্যদের সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। তাঁর পর অধিকাংশ লোক হাকিম নূরুদ্দীন সাহেবকে খলীফা মানল, তখন বিরোধীরা সেই ভবিষ্যদ্বাণীর অপূর্ণতা নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করল। কিন্তু হাকিম সাহেবের মৃত্যুর পর মির্যা বশিরুদ্দীন মাহমুদ আহমদ খলীফা হলেন, আর সত্য এই যে তার যুগে আহমদীয়াত যতটা উন্নতি করেছে তা আশ্চর্যজনক। স্বয়ং মির্যা সাহেবের জীবদ্দশায় আহমদীদের সংখ্যা কম ছিল, খলীফা নূরুদ্দীন সাহেবের যুগেও বিশেষ কোন উন্নতি হয় নি। কিন্তু বর্তমান খলীফার (খলীফা সানী) যুগে মির্যায়ী মতবাদ প্রায় পৃথিবীর সব অংশেই পৌঁছে গেছে।…. মোটকথা তাঁর (মির্যা সাহেব) ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে তাঁরই বংশধরদের মাঝ থেকে একজনকে তাঁর জামাতের জন্য দাঁড় করানো হয়েছে এবং তার মাধ্যমে জামাতের আশ্চর্যজনক উন্নতি হয়েছে- এত্থেকে স্পষ্ট সাব্যস্ত হয় যে মির্যা সাহেবের এই ভবিষ্যদ্বাণী হুবহু পূর্ণ হয়েছে”।

খুতবার শেষদিকে হুযূর দোয়া করেন, মুসলেহ মওউদ দিবসের জলসায় এসব বিষয়াদি শুনে একদিকে আমাদের যেমন হযরত মুসলেহ মওউদ (রা.)-এর পদমর্যাদা বৃদ্ধির জন্য দোয়া করা উচিত, সেইসাথে নিজেদের এই হিসাবও নেয়া উচিত যে আহমদীয়াতের মহান বিজয় ও উন্নতির জন্য প্রত্যেকের যাবতীয় চেষ্টা ও শক্তি এই কাজে নিয়োজিত করার সাথে সম্পৃক্ত, যদি আমরা তা করি তবে নিজেদের জীবদ্দশাতেই এই উন্নতির মহান রূপ পূর্বের চেয়ে বর্ধিত রূপে দেখতে পাব- আল্লাহ্ তা’লা আমাদের সেই তৌফিক দান করুন। আমীন।